একজন কর্নেল শাফায়াত জামিল by নাজমুল আহসান শেখ
সকাল আনুমানিক ৬টা ৩০ মিনিট, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল; অন্য দিনের মতোই স্কুলে (ইউ ল্যাব) যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। আজ বঙ্গবন্ধুর ঢাকা ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনের সময় আমাদের স্কুলও কয়েক মিনিটের জন্য পরিদর্শনের কথা (রাসেলের বাবা হিসেবে)।
বাসায় অন্যদিনের মতোই রেডিও চলছিল। সকাল ৭টার বাংলা খবর শোনা আব্বার অনেক দিনের পুরনো অভ্যাস।
হঠাৎ রেডিওতে শুনলাম মেজর ডালিমের সেই কুখ্যাত ঘোষণা। মেজর ডালিমের সেই প্রথম ঘোষণায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা বলা হয়নি, শুধু সরকার উৎখাতের কথা বলা হয়েছিল। যদিও লে. কর্নেল এম. এ হামিদ তার বইয়ে এবং আরও কিছু লেখক, লিখেছেন মেজর ডালিমের হত্যার ঘোষণার কথা! আমার মতে এই সব ভুল তথ্যের কারণ, তারা কেউই নিজের কানে মেজর ডালিমের সেই কুখ্যাত ঘোষণা শোনেননি। সকাল ৭টার বাংলা খবরেই প্রথম আমরা শুনতে পেলাম ‘রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিহত হয়েছেন’। আমাদের বাসা (৩৩৯ এলিফ্যান্ট রোড) থেকে কয়েক বাসা দূরে (৩৩৬ এলিফ্যান্ট রোড) ছিল কর্নেল তাহেরের বাসা। কর্নেল তাহেরের বাসার সামনে দেখলাম অনেক লোকের আনাগোনা!
’৭৫-এর পরবর্তী কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রসঙ্গে কিছু প্রকাশ করা তো দূরে থাক, আলোচনা করাও অনেকটা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৮ সালে আমার হাতে আসে ১৫ আগস্টের ওপর প্রকাশিত প্রথম বই, ‘মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’, যা তখন আমাদের দেশে নিষিদ্ধ ছিল। এই বইটি ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বেশ কিছু তথ্য ছিল। এর পর পরই ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আরও একটি বই ‘বিক্রমাদিত্যের ডায়েরি’Ñ যা আমার মতে স্রেফ কল্পনাপ্রসূত একটি রচনা। তারপর আশির দশকে প্রকাশিত হয় বিদেশীদের লেখা ‘বাংলাদেশ, আ লিগেসি অব ব্লাড’ আর ‘আনফিনিসড রেভল্যুশন’-এর মতো অনেক তথ্যসমৃদ্ধ বই, যা পরবর্তীকালে রেফারেন্স হিসেবে অনেক লেখকই ব্যবহার করেছেন।
নব্বই দশকে প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্টে ঢাকা সেনানিবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত অনেক সেনা অফিসার রচিত তথ্যনির্ভর বিভিন্ন বই। এই বইগুলোতে ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলÑ
১। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক: মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী,
২। বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১: ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন,
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল,
৪। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. কর্নেল এম. এ হামিদ।
এই চারটি বইয়ের লেখকই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। আর একটা কারণ হচ্ছেÑ এই চারজন অফিসারের কেউই এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। তাই তাদের ভাষ্য মোটামুটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে শুধু কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত।
এই ব্যতিক্রমের মধ্যে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, লে. কর্নেল এম. এ হামিদ তার বইয়ে তদানীন্তন ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে নিরবছিন্নভাবে বিষোদগারের চেষ্টা করেছেন। বিশেষত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর পরই (সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা) খুনীদের বিরুদ্ধে কেন প্রতিরোধ তৈরি করা গেল না, সেই প্রসঙ্গে। আমার মনে হয় ইতিহাসের স্বার্থে এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
লে. কর্নেল এম. এ হামিদ অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন এবং তার এই চেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দু’টি। এক, কর্নেল শাফায়াত জামিল এই হত্যাকা-ের সময় রহস্যজনকভাবে (!) নিষ্ক্রিয় ছিলেন; দুই, ১৫ আগস্ট সকালে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কারণ তিনি আপোসকামী ছিলেন!!
সত্যের সন্ধানে : এই প্রশ্নগুলো আমার মতো অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তাই ১৫ আগস্ট সকালে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে জড়িত সব তথ্য নিয়ে আমি আমার গবেষণা শুরু করি। লে. কর্নেল এম. এ হামিদের বক্তব্যের সমর্থনে কোন বক্তব্যই আমি অন্য কারও ভাষ্যে খুঁজে পাইনি। বরং তৎকালীন ব্রিগেড মেজর, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্যে এবং পরবর্তীতে কর্নেল শাফায়াত জামিলের কার্যকলাপেই আমরা দেখতে পাই তাঁর সত্যিকারের অবস্থান।
তাই লে. কর্নেল এম. এ হামিদের বক্তব্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং তার সততা নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়। আমি আমার পরিচিত সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে ও অতীতে কর্মরত অনেক সিনিয়র অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ১৫ আগস্ট সকাল ৬টার সময় (আনুমানিক) ঘটনা জানার পর শাফায়াত জামিলের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল কি না?
সবারই অভিন্ন মতামত ছিল, যে কোন ইউনিটকে শান্ত অবস্থা থেকে যুদ্ধাবস্থায় প্রস্তুত করতে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন; এবং একই সঙ্গে সেই সকালে কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি ট্যাঙ্ক ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল। যার ফলে সেই সকালে প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় কর্নেল শাফায়াত জামিল আর পাননি। রহস্যজনকভাবে নিষ্ক্রিয়তা নয়, সঙ্গতকারণেই তার একার পক্ষে সেই দিন সকালে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পাশাপাশি, সেই সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ছিলেন বিভ্রান্ত এবং হতবুদ্ধি; তদানীন্তন আর্মি ডেপুটি চীফ জিয়ার অবস্থান ছিল, ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি!’ একই সঙ্গে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে কয়েকজন বাদে প্রায় সকলেই এই অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন। সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে কে শত্রু, কে মিত্র তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। ধীর-স্থির ও সবচেয়ে কুশলী বলে সমধিক পরিচিত সিজিএস, খালেদ মোশাররফের ভাষায়ও সেই দিনের পরিস্থিতি ছিল ‘সম্পূর্ণ ঘোলাটে’।
পরবর্তীতে ঘটনা প্রবাহে খালেদ মোশাররফের ধারণাই যে সঠিক, তা প্রমাণিত হয়েছিল; খালেদ-শাফায়েতের নিজস্ব ইউনিট বলে পরিচিত ৪ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক ছিলেন প্রকৃতপক্ষে জিয়ার প্রতি অনুগত। ৭ নবেম্বরের পর কর্নেল আমিনুল হক পদোন্নতি পেয়ে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাই সেই মুহূর্তে ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের একার পক্ষে, শুধু দুটি ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট নিয়ে, এয়ার সাপোর্ট ছাড়া, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারির মুখোমুখিই হওয়াটা হতো চরম বোকামি ও আত্মহত্যারই শামিল।
জেনারেল সফিউল্লাহ এবং জেনারেল জিয়ার কোর্স মেইট, লে. কর্নেল এম. এ হামিদের এই রাগ বা বিদ্বেষ শুধু কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়, তার সমসাময়িক সবার প্রতি রয়েছে তার এই রাগ বা বিদ্বেষ। ১৯৭৫ সালের পর যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসারের চরম অভাব; কর্মরত সবাই কয়েক বছরের মধ্যে মেজর থেকে মেজর জেনারেলে উন্নীত হচ্ছিলেন, তখনও সেনাপ্রধান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু (হামিদ সাহেবের ভাষায়, তুই তুই সম্পর্ক) হামিদ সাহেব, লে. কর্নেলের উপরে উঠতে পারেননি! পেশাগত ব্যর্থতার কারণেই কি সবার প্রতি তার এই বিদ্বেষ (এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিয়াউর রহমানসহ)? তার উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।
কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম সম্পর্কে অন্যদের বক্তব্য : ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের তৎকালীন মেজর পদবির স্টাফ অফিসার (পরে ব্রিগেডিয়ার) সাখাওয়াত হোসেনের ভাষায়, ‘১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে প্রথম থেকেই শাফায়াত জামিল মেনে নিতে পারেননি। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি হিসেবেই শাফায়াত জামিল তা প্রমাণ করে দেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কমান্ডারের কোন দিকনির্দেশনা না থাকাতে তার চুপ করে হজম করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় ছিল না। ১৫ আগস্টের ডালিমের রেডিও ঘোষণার পর কুমিল্লায় ৪৪ ব্রিগেড অধীনস্থ ১ম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অনেক সৈনিক ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়েÑযা পরে শাফায়াত জামিলের হস্তক্ষেপে থামানো হয়।’
১৭ আগস্ট আর্মি হেডকোয়ার্টারে রশীদ আর ফারুক সব সিনিয়র অফিসারকে ব্রিফিং শুরু করলে শাফায়াত জামিলের দৃঢ়তার জন্য ওই ব্রিফিং সেশন শেষ করতে পারেননি। অক্টোবরের মাঝামাঝি শাফায়াত জামিল নিশ্চিত হলেন যে, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘চেন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না বা আরও সময় নিতে চান। ‘অক্টোবরের শেষের দিকে নিশ্চিত হলাম যে, শাফায়াত জামিল প্রয়োজন বোধে খালেদ মোশাররফকে নিয়েই কিছু একটা করতে যাচ্ছেন। তার লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।’
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের (’৭৫-এ স্টাফ অফিসার, ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড) বর্ণনা অনুযায়ী, ‘তাকে (কর্নেল শাফায়াত জামিল) আমি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও নীতিবান ব্যক্তি হিসেবে আজ ও শ্রদ্ধা করি। তার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। তবে মাঝেমধ্যে তাকে বেশ আবেগপ্রবণ মনে হতো।’
ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের অবস্থান সম্পর্কে সাখাওয়াত হোসেনের এই বক্তব্য যে নিরপেক্ষ ও নির্ভুল ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, খুনী ফারুক, রশীদ, ডালিম গং এ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিটি সাক্ষাতকার বা বক্তব্যে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে অন্ধ মুজিবভক্ত, একরোখা, আনকম্প্রোমাইজিং বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১৫ আগস্টে যখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয় তখন খুনী ফারুক, রশীদ, ডালিম গংয়ের পক্ষে শাফায়াত জামিলকে অন্ধ মুজিবভক্ত, একরোখা বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক।
মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীর বিক্রমের মতে, ‘ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল সরাসরি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে প্রশ্ন করলেন, তিনি সেনাবাহিনী কমান্ড করছেন, নাকি ছয় মেজর বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনী কমান্ড করছেন? কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোর থেকেই হত্যাসহ সেনা আইন ভঙ্গের অপরাধে ছয় মেজরকে অভিযুক্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
ইতিহাস ও তৎকালীন পরিস্থিতি এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কে অজ্ঞ, কিছু অন্ধ-আওয়ামী লীগ সমর্থক তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যে, ‘১৫ আগস্ট সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ‘এ্যাকশন’-এ যেতে বলেছিলেন, কিন্তু কর্নেল শাফায়াত জামিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বা তার আদেশ কার্যকর করেননি!’
এই বক্তব্য যে সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং জেনারেল সফিউল্লাহর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টা, তা জেনারেল সফিউল্লাহর সেই দিনের পরবর্তী কার্যকলাপই প্রমাণ করে। সেই সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ভীতু ও কাপুরুষের মতো মেজর ডালিমের কাছে সেনাসদরে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ আত্মসমর্পণ করেই থেমে থাকেননি; ডালিমের সঙ্গে রেডিও অফিসে গিয়ে, রেডিওর ভাষণে খুনী মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। এই সব অন্ধ সমর্থকের জানা উচিত যে, ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নবেম্বর পর্যন্ত দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের একজন নেতা, সমর্থক বা কর্মীও এই হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন প্রতিরোধ বা প্রতিবাদও করেননি!
মোদ্দাকথা, ১৫ আগস্ট সকালে সামরিক গোয়েন্দাদের (যার মূল দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারগণ) ব্যর্থতার (!) পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র অফিসারদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের পক্ষ থেকে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম কখনই এই অন্যায় মেনে নেননি, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে ৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই খুনী মোশতাক ও তার সহযোগীদের অপসারণ করা হয় ক্ষমতা ও বঙ্গভবন থেকে এবং ১৫ আগস্টের খুনীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলেন এই কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম।
৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে খুনী মোশতাক ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষমতায় থাকার সাধ ধূলিসাত হয়ে যায়।
১৫ আগস্টে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে কর্মরত ক্যাপ্টেন নজরুল, বীর প্রতীক (পরে কর্নেল নজরুল অবসরপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে সংসদ সদস্য)-এর মতে, কর্নেল শাফায়াত জামিল চাইলে ৩ নবেম্বরই ক্ষমতা দখল করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সংবিধান পুনর্প্রতিষ্ঠা করতেই আগ্রহী ছিলেন।
অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম, টেলিফোনে মুক্তিযোদ্ধা, ‘রেবেল’ কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমের সাক্ষাতকার নেব। অনেক চেষ্টা করেও (আর্মির বন্ধুরা আমার অনুরোধে রাওয়া ক্লাব পর্যন্ত গিয়েছিল তার ফোন নম্বর জোগাড় করতে) তার ফোন নম্বর যখন সংগ্রহ করতে পারলাম না, তখন ঠিক করেছিলাম, এবার ঢাকায় গেলে, যেভাবেই হোক, তার সঙ্গে দেখা করব। জিজ্ঞাসা করব, কেন ’৭৫-এর ৩ নবেম্বর আপনারা মোশতাক গংকে হত্যা করলেন না ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। কিন্তু বিধিবাম, নির্লোভ ও প্রচারবিমুখ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সকলের অলক্ষ্যেই তার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।
পাদটীকা : বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রাবস্থায় ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক এবং ফজলুল হক হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সেই সংসদে ভিপি ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও জিএস ছিলেন মওদুদ আহমদ! তাই বোধ হয় ১৫ আগস্ট সকালে খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঘোলাটে, কে শত্রু কে মিত্র বলা মুশকিল!’
তথ্যসূত্র :
১। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক:মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী
২। বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১: ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর : কর্নেল শাফায়াত জামিল
৪। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. কর্নেল এম. এ হামিদ
৫। বাংলাদেশ : আ লিগেসি অব ব্লাড: এন্থনি ম্যাসকারেনহাস
৬। বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন: লরেন্স লিফসুল্যজ
৭। বঙ্গবন্ধু হত্যা : ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
লেখক : সিডনি প্রবাসী
victory1971@gmail.com
হঠাৎ রেডিওতে শুনলাম মেজর ডালিমের সেই কুখ্যাত ঘোষণা। মেজর ডালিমের সেই প্রথম ঘোষণায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা বলা হয়নি, শুধু সরকার উৎখাতের কথা বলা হয়েছিল। যদিও লে. কর্নেল এম. এ হামিদ তার বইয়ে এবং আরও কিছু লেখক, লিখেছেন মেজর ডালিমের হত্যার ঘোষণার কথা! আমার মতে এই সব ভুল তথ্যের কারণ, তারা কেউই নিজের কানে মেজর ডালিমের সেই কুখ্যাত ঘোষণা শোনেননি। সকাল ৭টার বাংলা খবরেই প্রথম আমরা শুনতে পেলাম ‘রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিহত হয়েছেন’। আমাদের বাসা (৩৩৯ এলিফ্যান্ট রোড) থেকে কয়েক বাসা দূরে (৩৩৬ এলিফ্যান্ট রোড) ছিল কর্নেল তাহেরের বাসা। কর্নেল তাহেরের বাসার সামনে দেখলাম অনেক লোকের আনাগোনা!
’৭৫-এর পরবর্তী কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রসঙ্গে কিছু প্রকাশ করা তো দূরে থাক, আলোচনা করাও অনেকটা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৮ সালে আমার হাতে আসে ১৫ আগস্টের ওপর প্রকাশিত প্রথম বই, ‘মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’, যা তখন আমাদের দেশে নিষিদ্ধ ছিল। এই বইটি ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বেশ কিছু তথ্য ছিল। এর পর পরই ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আরও একটি বই ‘বিক্রমাদিত্যের ডায়েরি’Ñ যা আমার মতে স্রেফ কল্পনাপ্রসূত একটি রচনা। তারপর আশির দশকে প্রকাশিত হয় বিদেশীদের লেখা ‘বাংলাদেশ, আ লিগেসি অব ব্লাড’ আর ‘আনফিনিসড রেভল্যুশন’-এর মতো অনেক তথ্যসমৃদ্ধ বই, যা পরবর্তীকালে রেফারেন্স হিসেবে অনেক লেখকই ব্যবহার করেছেন।
নব্বই দশকে প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্টে ঢাকা সেনানিবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত অনেক সেনা অফিসার রচিত তথ্যনির্ভর বিভিন্ন বই। এই বইগুলোতে ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলÑ
১। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক: মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী,
২। বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১: ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন,
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল,
৪। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. কর্নেল এম. এ হামিদ।
এই চারটি বইয়ের লেখকই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। আর একটা কারণ হচ্ছেÑ এই চারজন অফিসারের কেউই এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। তাই তাদের ভাষ্য মোটামুটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে শুধু কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত।
এই ব্যতিক্রমের মধ্যে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, লে. কর্নেল এম. এ হামিদ তার বইয়ে তদানীন্তন ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে নিরবছিন্নভাবে বিষোদগারের চেষ্টা করেছেন। বিশেষত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর পরই (সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা) খুনীদের বিরুদ্ধে কেন প্রতিরোধ তৈরি করা গেল না, সেই প্রসঙ্গে। আমার মনে হয় ইতিহাসের স্বার্থে এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
লে. কর্নেল এম. এ হামিদ অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন এবং তার এই চেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দু’টি। এক, কর্নেল শাফায়াত জামিল এই হত্যাকা-ের সময় রহস্যজনকভাবে (!) নিষ্ক্রিয় ছিলেন; দুই, ১৫ আগস্ট সকালে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কারণ তিনি আপোসকামী ছিলেন!!
সত্যের সন্ধানে : এই প্রশ্নগুলো আমার মতো অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তাই ১৫ আগস্ট সকালে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে জড়িত সব তথ্য নিয়ে আমি আমার গবেষণা শুরু করি। লে. কর্নেল এম. এ হামিদের বক্তব্যের সমর্থনে কোন বক্তব্যই আমি অন্য কারও ভাষ্যে খুঁজে পাইনি। বরং তৎকালীন ব্রিগেড মেজর, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্যে এবং পরবর্তীতে কর্নেল শাফায়াত জামিলের কার্যকলাপেই আমরা দেখতে পাই তাঁর সত্যিকারের অবস্থান।
তাই লে. কর্নেল এম. এ হামিদের বক্তব্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং তার সততা নিয়ে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়। আমি আমার পরিচিত সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে ও অতীতে কর্মরত অনেক সিনিয়র অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ১৫ আগস্ট সকাল ৬টার সময় (আনুমানিক) ঘটনা জানার পর শাফায়াত জামিলের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল কি না?
সবারই অভিন্ন মতামত ছিল, যে কোন ইউনিটকে শান্ত অবস্থা থেকে যুদ্ধাবস্থায় প্রস্তুত করতে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন; এবং একই সঙ্গে সেই সকালে কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি ট্যাঙ্ক ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল। যার ফলে সেই সকালে প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় কর্নেল শাফায়াত জামিল আর পাননি। রহস্যজনকভাবে নিষ্ক্রিয়তা নয়, সঙ্গতকারণেই তার একার পক্ষে সেই দিন সকালে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পাশাপাশি, সেই সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ছিলেন বিভ্রান্ত এবং হতবুদ্ধি; তদানীন্তন আর্মি ডেপুটি চীফ জিয়ার অবস্থান ছিল, ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি!’ একই সঙ্গে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে কয়েকজন বাদে প্রায় সকলেই এই অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন। সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে কে শত্রু, কে মিত্র তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। ধীর-স্থির ও সবচেয়ে কুশলী বলে সমধিক পরিচিত সিজিএস, খালেদ মোশাররফের ভাষায়ও সেই দিনের পরিস্থিতি ছিল ‘সম্পূর্ণ ঘোলাটে’।
পরবর্তীতে ঘটনা প্রবাহে খালেদ মোশাররফের ধারণাই যে সঠিক, তা প্রমাণিত হয়েছিল; খালেদ-শাফায়েতের নিজস্ব ইউনিট বলে পরিচিত ৪ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক ছিলেন প্রকৃতপক্ষে জিয়ার প্রতি অনুগত। ৭ নবেম্বরের পর কর্নেল আমিনুল হক পদোন্নতি পেয়ে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাই সেই মুহূর্তে ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের একার পক্ষে, শুধু দুটি ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট নিয়ে, এয়ার সাপোর্ট ছাড়া, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারির মুখোমুখিই হওয়াটা হতো চরম বোকামি ও আত্মহত্যারই শামিল।
জেনারেল সফিউল্লাহ এবং জেনারেল জিয়ার কোর্স মেইট, লে. কর্নেল এম. এ হামিদের এই রাগ বা বিদ্বেষ শুধু কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়, তার সমসাময়িক সবার প্রতি রয়েছে তার এই রাগ বা বিদ্বেষ। ১৯৭৫ সালের পর যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসারের চরম অভাব; কর্মরত সবাই কয়েক বছরের মধ্যে মেজর থেকে মেজর জেনারেলে উন্নীত হচ্ছিলেন, তখনও সেনাপ্রধান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু (হামিদ সাহেবের ভাষায়, তুই তুই সম্পর্ক) হামিদ সাহেব, লে. কর্নেলের উপরে উঠতে পারেননি! পেশাগত ব্যর্থতার কারণেই কি সবার প্রতি তার এই বিদ্বেষ (এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিয়াউর রহমানসহ)? তার উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।
কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম সম্পর্কে অন্যদের বক্তব্য : ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের তৎকালীন মেজর পদবির স্টাফ অফিসার (পরে ব্রিগেডিয়ার) সাখাওয়াত হোসেনের ভাষায়, ‘১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে প্রথম থেকেই শাফায়াত জামিল মেনে নিতে পারেননি। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি হিসেবেই শাফায়াত জামিল তা প্রমাণ করে দেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কমান্ডারের কোন দিকনির্দেশনা না থাকাতে তার চুপ করে হজম করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় ছিল না। ১৫ আগস্টের ডালিমের রেডিও ঘোষণার পর কুমিল্লায় ৪৪ ব্রিগেড অধীনস্থ ১ম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অনেক সৈনিক ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়েÑযা পরে শাফায়াত জামিলের হস্তক্ষেপে থামানো হয়।’
১৭ আগস্ট আর্মি হেডকোয়ার্টারে রশীদ আর ফারুক সব সিনিয়র অফিসারকে ব্রিফিং শুরু করলে শাফায়াত জামিলের দৃঢ়তার জন্য ওই ব্রিফিং সেশন শেষ করতে পারেননি। অক্টোবরের মাঝামাঝি শাফায়াত জামিল নিশ্চিত হলেন যে, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘চেন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না বা আরও সময় নিতে চান। ‘অক্টোবরের শেষের দিকে নিশ্চিত হলাম যে, শাফায়াত জামিল প্রয়োজন বোধে খালেদ মোশাররফকে নিয়েই কিছু একটা করতে যাচ্ছেন। তার লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।’
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের (’৭৫-এ স্টাফ অফিসার, ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড) বর্ণনা অনুযায়ী, ‘তাকে (কর্নেল শাফায়াত জামিল) আমি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও নীতিবান ব্যক্তি হিসেবে আজ ও শ্রদ্ধা করি। তার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। তবে মাঝেমধ্যে তাকে বেশ আবেগপ্রবণ মনে হতো।’
ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের অবস্থান সম্পর্কে সাখাওয়াত হোসেনের এই বক্তব্য যে নিরপেক্ষ ও নির্ভুল ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, খুনী ফারুক, রশীদ, ডালিম গং এ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিটি সাক্ষাতকার বা বক্তব্যে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে অন্ধ মুজিবভক্ত, একরোখা, আনকম্প্রোমাইজিং বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১৫ আগস্টে যখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয় তখন খুনী ফারুক, রশীদ, ডালিম গংয়ের পক্ষে শাফায়াত জামিলকে অন্ধ মুজিবভক্ত, একরোখা বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক।
মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীর বিক্রমের মতে, ‘ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল সরাসরি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে প্রশ্ন করলেন, তিনি সেনাবাহিনী কমান্ড করছেন, নাকি ছয় মেজর বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনী কমান্ড করছেন? কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোর থেকেই হত্যাসহ সেনা আইন ভঙ্গের অপরাধে ছয় মেজরকে অভিযুক্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
ইতিহাস ও তৎকালীন পরিস্থিতি এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কে অজ্ঞ, কিছু অন্ধ-আওয়ামী লীগ সমর্থক তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যে, ‘১৫ আগস্ট সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ‘এ্যাকশন’-এ যেতে বলেছিলেন, কিন্তু কর্নেল শাফায়াত জামিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বা তার আদেশ কার্যকর করেননি!’
এই বক্তব্য যে সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং জেনারেল সফিউল্লাহর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টা, তা জেনারেল সফিউল্লাহর সেই দিনের পরবর্তী কার্যকলাপই প্রমাণ করে। সেই সকালে তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ ভীতু ও কাপুরুষের মতো মেজর ডালিমের কাছে সেনাসদরে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তদানীন্তন আর্মি চীফ জেনারেল সফিউল্লাহ আত্মসমর্পণ করেই থেমে থাকেননি; ডালিমের সঙ্গে রেডিও অফিসে গিয়ে, রেডিওর ভাষণে খুনী মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। এই সব অন্ধ সমর্থকের জানা উচিত যে, ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নবেম্বর পর্যন্ত দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের একজন নেতা, সমর্থক বা কর্মীও এই হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন প্রতিরোধ বা প্রতিবাদও করেননি!
মোদ্দাকথা, ১৫ আগস্ট সকালে সামরিক গোয়েন্দাদের (যার মূল দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারগণ) ব্যর্থতার (!) পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র অফিসারদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের পক্ষ থেকে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম কখনই এই অন্যায় মেনে নেননি, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে ৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই খুনী মোশতাক ও তার সহযোগীদের অপসারণ করা হয় ক্ষমতা ও বঙ্গভবন থেকে এবং ১৫ আগস্টের খুনীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলেন এই কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম।
৩ নবেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে খুনী মোশতাক ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষমতায় থাকার সাধ ধূলিসাত হয়ে যায়।
১৫ আগস্টে ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে কর্মরত ক্যাপ্টেন নজরুল, বীর প্রতীক (পরে কর্নেল নজরুল অবসরপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে সংসদ সদস্য)-এর মতে, কর্নেল শাফায়াত জামিল চাইলে ৩ নবেম্বরই ক্ষমতা দখল করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সংবিধান পুনর্প্রতিষ্ঠা করতেই আগ্রহী ছিলেন।
অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম, টেলিফোনে মুক্তিযোদ্ধা, ‘রেবেল’ কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমের সাক্ষাতকার নেব। অনেক চেষ্টা করেও (আর্মির বন্ধুরা আমার অনুরোধে রাওয়া ক্লাব পর্যন্ত গিয়েছিল তার ফোন নম্বর জোগাড় করতে) তার ফোন নম্বর যখন সংগ্রহ করতে পারলাম না, তখন ঠিক করেছিলাম, এবার ঢাকায় গেলে, যেভাবেই হোক, তার সঙ্গে দেখা করব। জিজ্ঞাসা করব, কেন ’৭৫-এর ৩ নবেম্বর আপনারা মোশতাক গংকে হত্যা করলেন না ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। কিন্তু বিধিবাম, নির্লোভ ও প্রচারবিমুখ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সকলের অলক্ষ্যেই তার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।
পাদটীকা : বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রাবস্থায় ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক এবং ফজলুল হক হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সেই সংসদে ভিপি ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও জিএস ছিলেন মওদুদ আহমদ! তাই বোধ হয় ১৫ আগস্ট সকালে খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঘোলাটে, কে শত্রু কে মিত্র বলা মুশকিল!’
তথ্যসূত্র :
১। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক:মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী
২। বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১: ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর : কর্নেল শাফায়াত জামিল
৪। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. কর্নেল এম. এ হামিদ
৫। বাংলাদেশ : আ লিগেসি অব ব্লাড: এন্থনি ম্যাসকারেনহাস
৬। বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন: লরেন্স লিফসুল্যজ
৭। বঙ্গবন্ধু হত্যা : ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
লেখক : সিডনি প্রবাসী
victory1971@gmail.com
No comments