শিক্ষাঙ্গন-লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি এবং রাজনীতিবিমুখতা by আবু সাঈদ খান
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আবহ প্রয়োজন। যে পরিবেশে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শানিত হবে। আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলিও অর্জন করবে। কিন্তু সেই সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এক সময়ের ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদের ভিপি-জিএসরা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন, এ প্রসঙ্গে
তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখের উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে কোনো ছাত্র সংসদে নির্বাচন হচ্ছে না
হতাশার মধ্যেও মানুষ আশার আলো দেখে। দেখে পরিবর্তনের স্বপ্ন। আমরা একাত্তর ও একাত্তর-পূর্ব প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। দীর্ঘ সংগ্রাম আর ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ, একাত্তরের চেতনায় সুখী-সমৃদ্ধ_ সবার বাসযোগ্য সাম্যভিত্তিক সমাজ কি তৈরি হয়েছে?
পরিবর্তনের জন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে উদ্যম, ত্যাগ ও পরিশ্রমের মানসিকতা থাকা প্রয়োজন, তা পরিপূর্ণভাবে আছে। আমাদের আছে উর্বর মাটি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্র সীমানা। কিন্তু বর্তমানের যারা কর্ণধার, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণতা, সুবিধাবাদিতা, স্বেচ্ছাচারিতায় লালিত স্বপ্ন কেবলই বিদীর্ণ হচ্ছে। তাই সঙ্গতভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নেতৃত্বের হাতে জাতির স্বপ্ন পূরণ কতটুকু সম্ভব? এ বাস্তবতায় কোনো কোনো মহল থেকে নতুন নেতৃত্বের কথাও বলা হচ্ছে। বর্তমান নেতৃত্ব, নাকি নতুন নেতৃত্ব_ সে বিতর্ক চলতে থাক। আমি অনাগত নেতৃত্বের দিকে চোখ ফেরাতে চাই, যারা এখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
অত্যন্ত মেধাবী, চক্ষুষ্মান এই প্রজন্ম। দুনিয়ার সব তথ্য ওদের মুঠোতলে। বিশ্লেষণের অপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী তারা। আমি ব্যস্ততার মধ্যেও আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সেমিনার, বিতর্ক সভায় যাই, ওদের প্রতিভার আলোকচ্ছটায় চমৎকৃত হই, প্রীত হই। আমরা যারা ষাটের দশকে বেড়ে উঠেছি, ছিলাম ভাবপ্রবণ। বর্তমান প্রজন্ম অনেক বাস্তবমুখী। এ প্রজন্মের ব্যাপারে আশাবাদী মনোভাব অনেকের নাও থাকতে পারে। অনেক বিজ্ঞজনের লেখায়, বক্তৃতায় এ প্রজন্ম নিয়ে অনেক হতাশা ও দুশ্চিন্তার প্রকাশ দেখি। পাঠক বুঝতেই পারছেন, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। তবে এ প্রজন্মের অতিমাত্রায় আত্মমুখিতা ও রাজনৈতিকবিমুখতা আমাকে পীড়িত করে। ওদের কথাবার্তায় রাজনীতির প্রতি অবজ্ঞা ফুটে ওঠে। ফেসবুকের প্রোফাইলে দেখি, আই ডু নট লাইক পলিটিক্স জাতীয় নানা কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতি কি ধূমপান, মাদকের মতো ক্ষতিকর কিছু? আসলে আমাদের সামষ্টিক পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা অপরিহার্য। মানুষ একা চলতে পারে না। যূথবদ্ধতাই মানব সভ্যতার ভিত্তি। অগ্রগতির প্রয়োজনে মানুষকে গড়তে হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র। আর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে মেধাবীরা মুখ ঘুরিয়ে রাখলে সমাজে অমেধাবী ও দুর্জনের দৌরাত্ম্য বাড়বে, রাষ্ট্র হয়ে পড়বে তাদের কাছে জিম্মি। এটি আমাদের সমাজের সাম্প্রতিক চিত্র। এ অবস্থা বদলাতে হলে নতুন প্রজন্মকে আত্মমুখিতা পরিহার করে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে, সংগঠন ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতি পছন্দ করে না বলছে; কিন্তু রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, তা বলা যাবে না। ফেসবুকে যেসব তরুণের প্রোফাইলে রাজনীতির প্রতি অপছন্দের বাণী লেখা আছে, অথচ দেখা যাচ্ছে তারাই আবার নেতা-নেত্রীদের আচরণের সমালোচনা করছে। এর মানে এই যে, বর্তমানের রাজনৈতিক-সংস্কৃৃতিই নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। তাই তাদের রাজনীতিবিমুখতার জন্য দায়ী প্রচলিত রাজনীতি। রাজনীতিতে আদর্শবাদী ধারা থাকলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এভাবে জাতীয় জীবনের হতাশার প্রতিফলন তরুণদের মধ্যে সংক্রমিত হতো না। কোনো বিবেচনায় তরুণ প্রজন্ম যদি রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে তবে আগামী বাংলাদেশের জন্যও তা শুভ ফল বয়ে আনবে না। আমি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শিকেয় তুলে রেখে এখনই রাজনীতিতে ঢুকে পড়তে বলছি না। বরং আজ ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন দুটির ক্যাডাররা রাজনীতির নামে যা করছে তা সমর্থন করি না। ছাত্ররাজনীতিতে বিপথগামিতা অতীতেও ছিল। এনএসএফের পাণ্ডাদের কথা আমরা জানি। তখন প্রধানত ক্যান্টিনে জোর করে খাওয়া, প্রতিপক্ষের সভায় ডিম ছোড়া বা কাউকে চাকু দেখিয়ে হুমকি দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল তাদের তৎপরতা। তারপর স্বাধীন বাংলায় শুরু হলো হল দখল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও দখলদারিত্বের হাত প্রসারিত হচ্ছে। পথভ্রষ্ট ছাত্রনেতাদের (!) দখলবাজি, চাঁদাবাজি, তদবিরবাজি নিত্যদিনের ঘটনা। এর আগে যখন প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ছিল তখন দুই দলে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এখন যুদ্ধ হচ্ছে সরকার সমর্থকদের ভেতরে। যারা সকালে এক সঙ্গে একই নেতার সমাধিতে ফুল দেয়, একই স্লোগানে কণ্ঠ তোলে_ বিকেলে তারাই একে অন্যের জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য অস্ত্রবাজি করে।
অতীতে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল, ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সমর্থক ছিলেন তারা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সবার শিক্ষক ও শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু আজ একশ্রেণীর শিক্ষক এমনভাবে দলাদলিতে মত্ত হয়ে পড়েছেন, সাদা-নীলে বিভক্ত হয়ে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। তারা ভাগ্য বদলের জন্য ক্ষমতাসীনদের কাছে ধরনা দেন। ক্ষমতার অনুগ্রহে বিভিন্ন রকম আসন ও দায়িত্ব লাভ করেন। এসব লেজুড়বৃত্তিপরায়ণ শিক্ষকের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা কী শিখবে? কী করে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটাবে?
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আবহ প্রয়োজন। যে পরিবেশে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শানিত হবে। আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলিও অর্জন করবে। কিন্তু সেই সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এক সময়ের ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদের ভিপি-জিএসরা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন, এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখের উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে কোনো ছাত্র সংসদে নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে কোনো নেতা বেরিয়ে আসছেন না। তাই অবসরপ্রাপ্ত আমলা, রাজনীতিতে আনকোরা ব্যবসায়ীরা কালো টাকার থলে নিয়ে নির্বাচনে নামছেন। এভাবে রাজনীতি হয়ে পড়েছে অরাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের কাছে জিম্মি। শুধু তাই নয়, ছাত্র সংসদগুলোর এ নিষ্ক্রিয়তায় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মন্থর হয়ে পড়েছে। এ শূন্যতায় মাদকাসক্তি বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রবণতা।
সব রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী সবাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মনোভাবও নেতিবাচক। ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও যদি তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হেরে যায়_ এমন মানসিকতা এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরাজয় মেনে নিয়ে সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসতে যেমনি অনীহ, তেমনি তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের পরাজয় দেখতেও নারাজ। এটিকে আমরা কী বলব? এটি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।
আশ্চর্য লাগে যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আমলে, এমনকি জিয়া-এরশাদের আমলেও যদি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির আমলে তা হতে পারল না কেন? বলা হয় যে, এটি ঝুঁকিপূর্ণ। রক্তপাত হতে পারে। সেই আশঙ্কা কি জাতীয় নির্বাচনে নেই? সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও কেন জাতীয় নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সবাই? ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয় ঝুঁকি আছে_ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল, ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেটের নির্বাচনও কি ঝুঁকিপূর্ণ? তবে এসব নির্বাচন বন্ধ করা হচ্ছে কেন, কার স্বার্থে?
দুঃখজনকভাবে সত্য যে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থক দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রলীগের মধ্যে এ বিষয়ে অদ্ভুত ঐক্য রয়েছে। ছাত্র সংসদের নির্বাচনের প্রশ্নে তারা নীরব। কিছু বাম ছাত্র সংগঠন এ ব্যাপারে সোচ্চার হলেও তা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। তবে ছাত্রসমাজ সোচ্চার হলে তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না।
এক সময় ছাত্রসমাজ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানই নয়, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন পথহারা, তখন '৪৮-'৫২-তে ছাত্রসমাজই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘুম ভাঙিয়েছে। '৬৯-এ স্বৈরশাসক আইয়ুবের জগদ্দল ভেঙে আশার আলো জ্বেলেছে। '৭১-এ স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে, ইশতেহার পাঠ করে স্বাধীনতার পথনির্দেশ করেছে। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ছাত্রসমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
সেই ছাত্রসমাজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে না? ছাত্র সংগঠন সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ বলে সাধারণ ছাত্ররা কি অতীতের মতো গর্জে উঠবে না? সচেতন ছাত্রসমাজের উত্থানে-জাগরণেই কেবল শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক আবহ দুই-ই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
হতাশার মধ্যেও মানুষ আশার আলো দেখে। দেখে পরিবর্তনের স্বপ্ন। আমরা একাত্তর ও একাত্তর-পূর্ব প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। দীর্ঘ সংগ্রাম আর ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ, একাত্তরের চেতনায় সুখী-সমৃদ্ধ_ সবার বাসযোগ্য সাম্যভিত্তিক সমাজ কি তৈরি হয়েছে?
পরিবর্তনের জন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে উদ্যম, ত্যাগ ও পরিশ্রমের মানসিকতা থাকা প্রয়োজন, তা পরিপূর্ণভাবে আছে। আমাদের আছে উর্বর মাটি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্র সীমানা। কিন্তু বর্তমানের যারা কর্ণধার, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণতা, সুবিধাবাদিতা, স্বেচ্ছাচারিতায় লালিত স্বপ্ন কেবলই বিদীর্ণ হচ্ছে। তাই সঙ্গতভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নেতৃত্বের হাতে জাতির স্বপ্ন পূরণ কতটুকু সম্ভব? এ বাস্তবতায় কোনো কোনো মহল থেকে নতুন নেতৃত্বের কথাও বলা হচ্ছে। বর্তমান নেতৃত্ব, নাকি নতুন নেতৃত্ব_ সে বিতর্ক চলতে থাক। আমি অনাগত নেতৃত্বের দিকে চোখ ফেরাতে চাই, যারা এখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
অত্যন্ত মেধাবী, চক্ষুষ্মান এই প্রজন্ম। দুনিয়ার সব তথ্য ওদের মুঠোতলে। বিশ্লেষণের অপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী তারা। আমি ব্যস্ততার মধ্যেও আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সেমিনার, বিতর্ক সভায় যাই, ওদের প্রতিভার আলোকচ্ছটায় চমৎকৃত হই, প্রীত হই। আমরা যারা ষাটের দশকে বেড়ে উঠেছি, ছিলাম ভাবপ্রবণ। বর্তমান প্রজন্ম অনেক বাস্তবমুখী। এ প্রজন্মের ব্যাপারে আশাবাদী মনোভাব অনেকের নাও থাকতে পারে। অনেক বিজ্ঞজনের লেখায়, বক্তৃতায় এ প্রজন্ম নিয়ে অনেক হতাশা ও দুশ্চিন্তার প্রকাশ দেখি। পাঠক বুঝতেই পারছেন, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। তবে এ প্রজন্মের অতিমাত্রায় আত্মমুখিতা ও রাজনৈতিকবিমুখতা আমাকে পীড়িত করে। ওদের কথাবার্তায় রাজনীতির প্রতি অবজ্ঞা ফুটে ওঠে। ফেসবুকের প্রোফাইলে দেখি, আই ডু নট লাইক পলিটিক্স জাতীয় নানা কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতি কি ধূমপান, মাদকের মতো ক্ষতিকর কিছু? আসলে আমাদের সামষ্টিক পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা অপরিহার্য। মানুষ একা চলতে পারে না। যূথবদ্ধতাই মানব সভ্যতার ভিত্তি। অগ্রগতির প্রয়োজনে মানুষকে গড়তে হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র। আর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে মেধাবীরা মুখ ঘুরিয়ে রাখলে সমাজে অমেধাবী ও দুর্জনের দৌরাত্ম্য বাড়বে, রাষ্ট্র হয়ে পড়বে তাদের কাছে জিম্মি। এটি আমাদের সমাজের সাম্প্রতিক চিত্র। এ অবস্থা বদলাতে হলে নতুন প্রজন্মকে আত্মমুখিতা পরিহার করে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে, সংগঠন ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতি পছন্দ করে না বলছে; কিন্তু রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, তা বলা যাবে না। ফেসবুকে যেসব তরুণের প্রোফাইলে রাজনীতির প্রতি অপছন্দের বাণী লেখা আছে, অথচ দেখা যাচ্ছে তারাই আবার নেতা-নেত্রীদের আচরণের সমালোচনা করছে। এর মানে এই যে, বর্তমানের রাজনৈতিক-সংস্কৃৃতিই নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। তাই তাদের রাজনীতিবিমুখতার জন্য দায়ী প্রচলিত রাজনীতি। রাজনীতিতে আদর্শবাদী ধারা থাকলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এভাবে জাতীয় জীবনের হতাশার প্রতিফলন তরুণদের মধ্যে সংক্রমিত হতো না। কোনো বিবেচনায় তরুণ প্রজন্ম যদি রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে তবে আগামী বাংলাদেশের জন্যও তা শুভ ফল বয়ে আনবে না। আমি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শিকেয় তুলে রেখে এখনই রাজনীতিতে ঢুকে পড়তে বলছি না। বরং আজ ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন দুটির ক্যাডাররা রাজনীতির নামে যা করছে তা সমর্থন করি না। ছাত্ররাজনীতিতে বিপথগামিতা অতীতেও ছিল। এনএসএফের পাণ্ডাদের কথা আমরা জানি। তখন প্রধানত ক্যান্টিনে জোর করে খাওয়া, প্রতিপক্ষের সভায় ডিম ছোড়া বা কাউকে চাকু দেখিয়ে হুমকি দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল তাদের তৎপরতা। তারপর স্বাধীন বাংলায় শুরু হলো হল দখল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও দখলদারিত্বের হাত প্রসারিত হচ্ছে। পথভ্রষ্ট ছাত্রনেতাদের (!) দখলবাজি, চাঁদাবাজি, তদবিরবাজি নিত্যদিনের ঘটনা। এর আগে যখন প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ছিল তখন দুই দলে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এখন যুদ্ধ হচ্ছে সরকার সমর্থকদের ভেতরে। যারা সকালে এক সঙ্গে একই নেতার সমাধিতে ফুল দেয়, একই স্লোগানে কণ্ঠ তোলে_ বিকেলে তারাই একে অন্যের জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য অস্ত্রবাজি করে।
অতীতে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল, ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সমর্থক ছিলেন তারা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সবার শিক্ষক ও শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু আজ একশ্রেণীর শিক্ষক এমনভাবে দলাদলিতে মত্ত হয়ে পড়েছেন, সাদা-নীলে বিভক্ত হয়ে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। তারা ভাগ্য বদলের জন্য ক্ষমতাসীনদের কাছে ধরনা দেন। ক্ষমতার অনুগ্রহে বিভিন্ন রকম আসন ও দায়িত্ব লাভ করেন। এসব লেজুড়বৃত্তিপরায়ণ শিক্ষকের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা কী শিখবে? কী করে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটাবে?
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আবহ প্রয়োজন। যে পরিবেশে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শানিত হবে। আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলিও অর্জন করবে। কিন্তু সেই সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এক সময়ের ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদের ভিপি-জিএসরা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন, এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখের উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে কোনো ছাত্র সংসদে নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে কোনো নেতা বেরিয়ে আসছেন না। তাই অবসরপ্রাপ্ত আমলা, রাজনীতিতে আনকোরা ব্যবসায়ীরা কালো টাকার থলে নিয়ে নির্বাচনে নামছেন। এভাবে রাজনীতি হয়ে পড়েছে অরাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের কাছে জিম্মি। শুধু তাই নয়, ছাত্র সংসদগুলোর এ নিষ্ক্রিয়তায় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মন্থর হয়ে পড়েছে। এ শূন্যতায় মাদকাসক্তি বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রবণতা।
সব রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী সবাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মনোভাবও নেতিবাচক। ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও যদি তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠন হেরে যায়_ এমন মানসিকতা এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরাজয় মেনে নিয়ে সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসতে যেমনি অনীহ, তেমনি তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের পরাজয় দেখতেও নারাজ। এটিকে আমরা কী বলব? এটি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।
আশ্চর্য লাগে যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আমলে, এমনকি জিয়া-এরশাদের আমলেও যদি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির আমলে তা হতে পারল না কেন? বলা হয় যে, এটি ঝুঁকিপূর্ণ। রক্তপাত হতে পারে। সেই আশঙ্কা কি জাতীয় নির্বাচনে নেই? সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও কেন জাতীয় নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সবাই? ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয় ঝুঁকি আছে_ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল, ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেটের নির্বাচনও কি ঝুঁকিপূর্ণ? তবে এসব নির্বাচন বন্ধ করা হচ্ছে কেন, কার স্বার্থে?
দুঃখজনকভাবে সত্য যে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থক দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রলীগের মধ্যে এ বিষয়ে অদ্ভুত ঐক্য রয়েছে। ছাত্র সংসদের নির্বাচনের প্রশ্নে তারা নীরব। কিছু বাম ছাত্র সংগঠন এ ব্যাপারে সোচ্চার হলেও তা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। তবে ছাত্রসমাজ সোচ্চার হলে তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না।
এক সময় ছাত্রসমাজ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানই নয়, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন পথহারা, তখন '৪৮-'৫২-তে ছাত্রসমাজই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘুম ভাঙিয়েছে। '৬৯-এ স্বৈরশাসক আইয়ুবের জগদ্দল ভেঙে আশার আলো জ্বেলেছে। '৭১-এ স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে, ইশতেহার পাঠ করে স্বাধীনতার পথনির্দেশ করেছে। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ছাত্রসমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
সেই ছাত্রসমাজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে না? ছাত্র সংগঠন সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ বলে সাধারণ ছাত্ররা কি অতীতের মতো গর্জে উঠবে না? সচেতন ছাত্রসমাজের উত্থানে-জাগরণেই কেবল শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক আবহ দুই-ই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments