ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা-দ্য গ্রেট ব্যাংক রবারি!

ষাটের দশকের শেষ দিকে হলিউডের সাড়া জাগানো একটি চলচ্চিত্রের নাম ছিল দ্য গ্রেট ব্যাংক রবারি। একটি ব্যাংকে তিনটি পৃথক দলের ডাকাতির পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল এ কমেডি চলচ্চিত্র। ফিল্মি ডাকাতরা সফল হয়নি। তবে এক দশক আগে ভারতের জাতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের এক অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদনের শিরোনাম


দিয়েছিল হলিউডের ওই চলচ্চিত্রের অনুকরণে 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ব্যাংক রবারি', যাতে বলা হয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নামধারী একদল লোক ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের নামে অন্তত ১ লাখ ১০ হাজার কোটি রুপি কার্যত লুট করে নিয়েছে। শক্তিধর ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সরকারের দুর্বলতাকে প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারিকেও কি দ্য গ্রেট ব্যাংক রবারি, বাংলাদেশ নামে আখ্যায়িত করা চলে না? এ কেলেঙ্কারির মূলে দেশের প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংক, যার ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব এতই ব্যাপক যে, কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ জানালে অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের বিশিষ্টজনরা অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে সঠিক মনে করেননি। তাদের বিবেচনায় এ ধরনের বক্তব্য হলমার্কের মতো যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ নিয়ম লঙ্ঘন করে হাতিয়ে নিয়েছে বা নিতে চাইছে তাদেরই উৎসাহিত করবে। এ অভিমতের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ কম। হলমার্ক-কেলেঙ্কারি আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পদ্ধতিকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে কিছু সংস্কার ও অটোমেশন চালুর প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছিল যে, নিয়মবহির্ভূত ঋণদানের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসার তথ্য প্রদান থেকেও এর সমর্থন মিলছিল। কিন্তু হলমার্কের ঘটনা মুদ্রার অপর পিঠ উন্মোচন করে দিল, যা শুধু ব্যাংকিং খাতের জন্য নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই উদ্বেগের। এ ঘটনা থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সরকার, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি এবং 'যুবক-ডেসটিনির বিপর্যয়ের' ঘটনা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এ কথা বলা হচ্ছে যে, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সরকারের অকারণ হস্তক্ষেপ যেমন কাম্য নয়, তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ গঠনও অগ্রহণযোগ্য। একইভাবে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নামধারী কিছু লোকের ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূত সুবিধা গ্রহণের প্রবণতাও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এ অরাজক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। এজন্য প্রথম কাজ হবে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যোগ্য ও অভিজ্ঞদের নিয়ে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পরিচালনা পর্ষদের খবরদারি বন্ধ করা চাই। সরকারি ও বেসরকারি যে কোনো ধরনের ব্যাংকের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে সরকার কিংবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেউই ব্যাংকের মালিক নয়, ব্যাংকের তহবিল গঠিত হয় ছোট-বড় অগণিত আমানতকারীর অর্থে এবং এর সুরক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরও একটি দায়িত্ব হলমার্ক-কেলেঙ্কারি কীভাবে ঘটতে পারল তা অনুসন্ধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন, যারা এর সূত্র ধরে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক সংস্কারের সুপারিশও তুলে ধরবেন।
 

No comments

Powered by Blogger.