ডা. নিতাই হত্যাকাণ্ড-আদালতে জবানবন্দি দিল দুই আসামি-গাড়িচালকসহ আরো ছয়জন গ্রেপ্তার

রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে দুই আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। গতকাল রবিবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দেয় মাসুম ওরফে মিন্টু ওরফে সুমন ও ফয়সল।


হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান তাঁর খাসকামরায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া দুই আসামির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। এরপর তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালকসহ আরো ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গতকাল রবিবার র‌্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাদের হাজির করা হয়। র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা ডা. নিতাইয়ের বাসায় ডাকাতিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
ডা. নিতাই হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি ও র‌্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারকৃতরা হলো ডা. নিতাইয়ের ব্যক্তিগত গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ (২৭), রিলায়েন্স মেডিক্যাল অ্যান্ড সার্ভিসেস-এর ম্যানেজার সাইফুর রহমান (৩৬), দুই কম্পাউন্ডার তারিকুল ইসলাম (২৪), বকুল মিয়া (২৬), রফিকুল ইসলাম (২৪) ও সাঈদ (৩০)। তাদের রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও টঙ্গি থেকে গত দুই দিনে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে ডিবি ডা. নিতাইয়ের মূল ঘাতক মাসুম ওরফে মিন্টু (৩০), ফয়সল (৩২), পেদা মাসুদ (২৮), সাইদুল (৩৮) ও পিচ্চি কালামকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে। মিন্টুকে সাত দিন ও অন্য চারজনকে চার দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি।
জবানবন্দি : মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতাউর রহমান দুই আসামি মিন্টু ও ফয়সলকে আদালতে হাজির করে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন।
গত ২৬ আগস্ট ফয়সল, পেদা মাসুদ, সাইদুল ও পিচ্চি কালামকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলে ওই দিনই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন হাকিম।
গত শনিবার রিমান্ড শেষে মিন্টু ও ফয়সলসহ চারজনকে আদালতে হাজির করে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন একই হাকিম।
অন্যদিকে বাকিদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন আদালত। আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার এক দিন পর ফয়সল ও মিন্টু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
আরো গ্রেপ্তার : গতকাল রবিবার গ্রেপ্তারকৃতদের সাংবাদিকের সামনে হাজির করে র‌্যাব বলেছে, গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিকিৎসক নিতাইয়ের চেম্বারের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) সাইফুরের নাম বলে। তবে সাইফুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, ডা. নিতাইয়ের ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের আগে অরুণ পেশাদার ছিনতাইকারী ছিল। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার আভিযোগে এর আগে সে পাঁচবার গ্রেপ্তার হয়। রিলায়েন্স মেডিক্যাল সার্ভিসেসের ম্যানেজার সাইফুর রহমান ১০ মাস আগে অরুণকে ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পেতে সহায়তা করে। অরুণ ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর (নিতাইয়ের) টাকা-পয়সাসহ পারিবারিক ও রাজনৈতিক সব বিষয়ে ধারণা নিতে থাকে। এ কাজে অরুণ ম্যানেজার সাইদুর ও কম্পাউন্ডার তারিককে কাজে লাগায়। কামরুল যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডাকাতির পরিকল্পনা করে, তাদের সঙ্গে কারাগারেই তার পরিচয় হয় এবং তারাও হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। গ্রেপ্তারকৃত সাইফুর, গাড়িচালক কামরুল ও রিলায়েন্স মেডিকেল অ্যান্ড সার্ভিসেসের কম্পাউন্ডার তারিকুল ইসলাম ঘটনার কিছুদিন আগে ডা. নিতাইয়ের বাসায় মালামাল চুরি করে ভাগাভাগির পরিকল্পনা করে। পরে কামরুল অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায় দুই মাস আগে একবার চুরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। চিকিৎসক নিতাই রিলায়েন্স মেডিক্যাল অ্যান্ড সার্ভিসেসে বসতেন, তাঁর ব্যবস্থাপক সাইফুর।
গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেকের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে জানিয়ে সোহায়েল বলেন, এই মামলা ছাড়াও তাঁরা অন্য কোনো ঘটনার সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখবেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির বাড়ির মতো ডা. নিতাইয়ের বাড়িতেও জানালার গ্রিল কাটা ছিল।
র‌্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, 'এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই বলছে, ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় খুন করা হয় চিকিৎসক নিতাইকে। হত্যাকাণ্ডের আগে পরিকল্পনাকারীরা দুজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন- এমন প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। চিকিৎসক নিতাই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরো কারা ছিল, এটি পরিকল্পিত খুন কি না, তদন্তে তাও জানার চেষ্টা করা হবে।' চিকিৎসক নিতাইয়ের পরিবার দাবি করে আসছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের নিয়োগের যোগসূত্র থাকতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে অরুণ সাংবাদিকদের জানায়, আনুমানিক দুই মাস আগে ম্যানেজার সাইদুর ও কম্পাউন্ডার তারিককে নিয়ে ডা. নিতাইয়ের বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনা করে সে। একপর্যায়ে তারা ওই বাসায় পেশাদার খুনি ও ডাকাত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে থাকে। এরপর মহাখালীর সাত তলা বস্তির অপরাধীচক্রের সাত সদস্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। পরে চিকিৎসক নিতাইয়ের বাসায় ২০ লাখ টাকা নগদ ও ১০৮ ভরি স্বর্ণালংকার আছে জানিয়ে লুট করায় সাইফুর। হত্যাকাণ্ডের পর ৫০০ টাকা দিয়ে সাইফুর তাকে ঢাকার বাইরে চলে যেতে বলে বলেও দাবি করে সে।
এর আগে ডা. নিতাইয়ের মূল ঘাতক মিন্টু জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে জানায়, কামরুলের তথ্য অনুযায়ী তারা ডা. নিতাইয়ের বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনা করে। এরপর ডাকাতি করতে বাসায় ঢুকে বাধা পেয়ে সে ডা. নিতাইকে ছুরি মারে।
র‌্যাব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম ও মোল্যা নজরুল ইসলাম ছাড়াও উপস্থিত ছিল ডা. নারায়ণের স্ত্রী ডা. লাকি দত্তসহ পরিবারের সদস্যরা।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট ভোরে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আবাসিক ভবনে খুন হন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পর্ষদের সদস্য ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই। তাঁর খুন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে চিকিৎসকরা দুই দিন কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।

No comments

Powered by Blogger.