সমাজ-গণতন্ত্রে শিক্ষার ভূমিকা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় by কাজী এএসএম নুরুল হুদা
রাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র দেখা যায়। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের গণতন্ত্র প্রযোজ্য_ তা একটি প্রশ্ন। রাষ্ট্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আকারের কথা বলতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় আকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরোক্ষ গণতন্ত্রই ভালো হবে।
এ ক্ষেত্রে ডাকসুর মতো মৃত প্রতিষ্ঠানগুলো জাগিয়ে তুলতে হবে
সামাজিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো শিক্ষাই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বলা যায়। শিক্ষা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয় বলে রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমনই হোক না কেন, শিক্ষা তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার এই অপরিহার্যতা গণতন্ত্রের বেলায় আরও বেশি করে সত্য।
এ কথা ঠিক যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিমানুষের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এই উন্নয়ন ব্যক্তি সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রকৃত গণতন্ত্র সম্বন্ধে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি করা। আর শিক্ষাই এ ধরনের সচেতন নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। এ কারণেই গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সফল করতে জন ডিউইয়ের মতো শিক্ষা দার্শনিকরা শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই শিক্ষা ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের উন্নতি সাধন করবে এবং প্রচলিত যে কোনো ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা আনবে না। মোদ্দাকথা, ব্যক্তিজীবনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে না দমিয়েই ব্যক্তিমানুষকে একটি গণতন্ত্রমনা সামাজিক জীবে পরিণত করাই হবে এ শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
আবার এটিও মানতে হবে যে, শিক্ষার প্রকৃত আদর্শ বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক ভাবধারার সংযোজন দরকার। শিক্ষা ও গণতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক ক্রিয়ার সম্পর্ক রয়েছে, যার কথা আধুনিক কালের অনেক শিক্ষাবিদই স্বীকার করেন।
শিক্ষায় গণতান্ত্রিক আদর্শ সংযোজনে পাঠ্যক্রমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাঠ্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে শিক্ষার্থী গণতান্ত্রিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। তাই পাঠ্যক্রমে আবশ্যিক বিষয়ের পাশাপাশি এমন একটি অংশ থাকতে হবে, যেখান থেকে ব্যক্তি তার নিজ ক্ষমতা, চাহিদা ও আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করবে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে হবে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাজে তাদের কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের যোগদানের সুযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ছাত্র সংসদের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য এমন আইনকানুন তৈরি করা যেতে পারে। এ আইন প্রণয়নের একটি সুবিধা হলো এই যে, এই আইন পালনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ভাব আনতে হলে শিক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাচীন গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা শুধু শুনত এবং শিক্ষক পাঠদান করতেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মকেন্দ্রিক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে তা হবে সহায়ক। এখানে শিক্ষকের জ্ঞান বিতরণকারী ভূমিকার পরিবর্তন ঘটবে। পরিবর্তিত পদ্ধতিতে তিনি শ্রেণীকক্ষে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবেন। শ্রেণীকক্ষে নির্দেশকের ভূমিকা পালনকারী এই শিক্ষক হবেন গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান। ফলে তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং তাদের পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।
শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি। সে লক্ষ্য থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র চর্চা করার কথা বলা হয়। তবে এই চর্চার হার শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে। কারণ একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মানসিক পরিপকস্ফতা বেশি হওয়ার ফলে গণতন্ত্রের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বেশি। এ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিপকস্ফতা সবচেয়ে বেশি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ই হবে গণতন্ত্রের প্রকৃত অনুশীলনের জায়গা।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শিক্ষার পূর্ববর্তী স্তরগুলোতে গণতন্ত্রের কথা এত জোর দিয়ে বলা হয় না কেন? এর একটি সহজ উত্তর হতে পারে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়-পূর্ববর্তী পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। আমার এই জবাবের প্রত্যুত্তরে অনেকে এই শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় কেন_ এমন পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন। তাদের উদ্দেশে বলা যেতে পারে যে, ব্যতিক্রমী উদাহরণের কথা মনে রেখেও বলছি, এই বয়সীদের মানসিক কাঠামোই এমন যে, তারা অনেক সময়ই ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝে উঠতে পারে না। আর এই অপরিপকস্ফ মানুষই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন তাদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই আমরা এই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংগঠিত বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখি। কিন্তু হরহামেশাই দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিপকস্ফতা নিয়ে সমালোচকদের প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। অবশ্য এ জন্য তাদের কথিত গুটিকয়েক শিক্ষক দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তবে আমার আজকের আলোচনার বিষয় তা নয়।
বেসরকারি ও অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দিলাম। '৭৩-এর অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রের করুণ অবস্থা আমাদের দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রের অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই অনেক বছর ধরে। কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচিত হলেও এর ভোটার তালিকা ছিল পুরনো। তাই এটি কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা হতে পারে না। এ জন্য দায়ী সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ। এই অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গণতন্ত্র চর্চার প্রতি সরকারের সন্দেহমূলক মনোভাব ও আস্থার অভাবকে দেখানো যেতে পারে। কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার গণতন্ত্রের চর্চার হারই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের চেহারা নির্ধারণ করে।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যেই এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র চর্চা করছে বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে ক্লাস বর্জনের ডাক দেয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি সম্পূূর্ণই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এমন ছাত্র, যে তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত নয়, তারও গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে এই ক্লাস বর্জন কর্মসূচি না মানার। এখন এই ছাত্রটি যদি ক্লাস করার জন্য ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে প্রবেশ করতে চায়, তবে ওই শিক্ষার্থীর এর পরের অবস্থা আপনারাই কল্পনা করে নিন। কাজেই বলতে হয় যে, অনেক ছাত্র সংগঠনের মাঝেই গণতন্ত্রের সঠিক চেতনা গড়ে ওঠেনি। আবার অনেক শিক্ষকের ক্লাসের ভেতর ও বাইরের ব্যবহার এবং শিক্ষাদানের ধরন আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বৈরশাসকদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা মোটেও অগণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে অসাংঘর্ষিক নয়।
রাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র দেখা যায়। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের গণতন্ত্র প্রযোজ্য_ তা একটি প্রশ্ন। রাষ্ট্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আকারের কথা বলতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় আকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরোক্ষ গণতন্ত্রই ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে ডাকসুর মতো মৃত প্রতিষ্ঠানগুলো জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু ডাকসুর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাগিয়ে তোলাটাই কি সমাধান? ছাত্রদের হাতে তাদের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার আগে ওই বিশেষ ছাত্রদের মাঝে আদৌ নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়েছে কিনা এবং গণতন্ত্রের সঠিক চেতনা বিরাজ করে কিনা, তা জানা জরুরি। এখানেই শিক্ষকরা তাদের মূল যে ভূমিকা, তা পালন করে ছাত্রদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করতে পারেন। এ জন্য সবার আগে যা দরকার তা হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ জায়গায় সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা রাখতে চায় কিনা। যদি না চায়, তাহলে আমাদের বলতেই হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সরকারের কাম্য নয়। বরং রাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রের মতো শাসনব্যবস্থাই বেশি পছন্দের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে কোনো শাসনব্যবস্থা চালু ও স্থায়ী করতে হলে শিক্ষার ওপর নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক। হিটলার জার্মানিতে নাজি শাসন ব্যবস্থাকে স্থায়ী করতে জনসাধারণের শিক্ষাকেই প্রথমে করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন।
কাজী এএসএম নুরুল হুদা :শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সামাজিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো শিক্ষাই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বলা যায়। শিক্ষা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয় বলে রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমনই হোক না কেন, শিক্ষা তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার এই অপরিহার্যতা গণতন্ত্রের বেলায় আরও বেশি করে সত্য।
এ কথা ঠিক যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিমানুষের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এই উন্নয়ন ব্যক্তি সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রকৃত গণতন্ত্র সম্বন্ধে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি করা। আর শিক্ষাই এ ধরনের সচেতন নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। এ কারণেই গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সফল করতে জন ডিউইয়ের মতো শিক্ষা দার্শনিকরা শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই শিক্ষা ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের উন্নতি সাধন করবে এবং প্রচলিত যে কোনো ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা আনবে না। মোদ্দাকথা, ব্যক্তিজীবনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে না দমিয়েই ব্যক্তিমানুষকে একটি গণতন্ত্রমনা সামাজিক জীবে পরিণত করাই হবে এ শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
আবার এটিও মানতে হবে যে, শিক্ষার প্রকৃত আদর্শ বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক ভাবধারার সংযোজন দরকার। শিক্ষা ও গণতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক ক্রিয়ার সম্পর্ক রয়েছে, যার কথা আধুনিক কালের অনেক শিক্ষাবিদই স্বীকার করেন।
শিক্ষায় গণতান্ত্রিক আদর্শ সংযোজনে পাঠ্যক্রমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাঠ্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে শিক্ষার্থী গণতান্ত্রিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। তাই পাঠ্যক্রমে আবশ্যিক বিষয়ের পাশাপাশি এমন একটি অংশ থাকতে হবে, যেখান থেকে ব্যক্তি তার নিজ ক্ষমতা, চাহিদা ও আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করবে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে হবে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাজে তাদের কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের যোগদানের সুযোগ দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ছাত্র সংসদের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য এমন আইনকানুন তৈরি করা যেতে পারে। এ আইন প্রণয়নের একটি সুবিধা হলো এই যে, এই আইন পালনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ভাব আনতে হলে শিক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাচীন গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা শুধু শুনত এবং শিক্ষক পাঠদান করতেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মকেন্দ্রিক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে তা হবে সহায়ক। এখানে শিক্ষকের জ্ঞান বিতরণকারী ভূমিকার পরিবর্তন ঘটবে। পরিবর্তিত পদ্ধতিতে তিনি শ্রেণীকক্ষে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবেন। শ্রেণীকক্ষে নির্দেশকের ভূমিকা পালনকারী এই শিক্ষক হবেন গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান। ফলে তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং তাদের পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।
শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি। সে লক্ষ্য থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র চর্চা করার কথা বলা হয়। তবে এই চর্চার হার শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে। কারণ একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মানসিক পরিপকস্ফতা বেশি হওয়ার ফলে গণতন্ত্রের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বেশি। এ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিপকস্ফতা সবচেয়ে বেশি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ই হবে গণতন্ত্রের প্রকৃত অনুশীলনের জায়গা।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শিক্ষার পূর্ববর্তী স্তরগুলোতে গণতন্ত্রের কথা এত জোর দিয়ে বলা হয় না কেন? এর একটি সহজ উত্তর হতে পারে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়-পূর্ববর্তী পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। আমার এই জবাবের প্রত্যুত্তরে অনেকে এই শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় কেন_ এমন পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন। তাদের উদ্দেশে বলা যেতে পারে যে, ব্যতিক্রমী উদাহরণের কথা মনে রেখেও বলছি, এই বয়সীদের মানসিক কাঠামোই এমন যে, তারা অনেক সময়ই ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝে উঠতে পারে না। আর এই অপরিপকস্ফ মানুষই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন তাদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই আমরা এই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংগঠিত বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখি। কিন্তু হরহামেশাই দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিপকস্ফতা নিয়ে সমালোচকদের প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। অবশ্য এ জন্য তাদের কথিত গুটিকয়েক শিক্ষক দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তবে আমার আজকের আলোচনার বিষয় তা নয়।
বেসরকারি ও অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দিলাম। '৭৩-এর অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রের করুণ অবস্থা আমাদের দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রের অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই অনেক বছর ধরে। কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচিত হলেও এর ভোটার তালিকা ছিল পুরনো। তাই এটি কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা হতে পারে না। এ জন্য দায়ী সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ। এই অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গণতন্ত্র চর্চার প্রতি সরকারের সন্দেহমূলক মনোভাব ও আস্থার অভাবকে দেখানো যেতে পারে। কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার গণতন্ত্রের চর্চার হারই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের চেহারা নির্ধারণ করে।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যেই এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র চর্চা করছে বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে ক্লাস বর্জনের ডাক দেয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি সম্পূূর্ণই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এমন ছাত্র, যে তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত নয়, তারও গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে এই ক্লাস বর্জন কর্মসূচি না মানার। এখন এই ছাত্রটি যদি ক্লাস করার জন্য ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে প্রবেশ করতে চায়, তবে ওই শিক্ষার্থীর এর পরের অবস্থা আপনারাই কল্পনা করে নিন। কাজেই বলতে হয় যে, অনেক ছাত্র সংগঠনের মাঝেই গণতন্ত্রের সঠিক চেতনা গড়ে ওঠেনি। আবার অনেক শিক্ষকের ক্লাসের ভেতর ও বাইরের ব্যবহার এবং শিক্ষাদানের ধরন আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বৈরশাসকদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা মোটেও অগণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে অসাংঘর্ষিক নয়।
রাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র দেখা যায়। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের গণতন্ত্র প্রযোজ্য_ তা একটি প্রশ্ন। রাষ্ট্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আকারের কথা বলতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় আকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরোক্ষ গণতন্ত্রই ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে ডাকসুর মতো মৃত প্রতিষ্ঠানগুলো জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু ডাকসুর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাগিয়ে তোলাটাই কি সমাধান? ছাত্রদের হাতে তাদের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার আগে ওই বিশেষ ছাত্রদের মাঝে আদৌ নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়েছে কিনা এবং গণতন্ত্রের সঠিক চেতনা বিরাজ করে কিনা, তা জানা জরুরি। এখানেই শিক্ষকরা তাদের মূল যে ভূমিকা, তা পালন করে ছাত্রদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করতে পারেন। এ জন্য সবার আগে যা দরকার তা হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ জায়গায় সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা রাখতে চায় কিনা। যদি না চায়, তাহলে আমাদের বলতেই হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সরকারের কাম্য নয়। বরং রাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রের মতো শাসনব্যবস্থাই বেশি পছন্দের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে কোনো শাসনব্যবস্থা চালু ও স্থায়ী করতে হলে শিক্ষার ওপর নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক। হিটলার জার্মানিতে নাজি শাসন ব্যবস্থাকে স্থায়ী করতে জনসাধারণের শিক্ষাকেই প্রথমে করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন।
কাজী এএসএম নুরুল হুদা :শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments