বহে কাল নিরবধি-বগুড়ার কফিল ভাই ও একজন জেনারেল শওকত by এম আবদুল হাফিজ
কেউ যদি আমাকে আমার প্রিয় স্থান সম্বন্ধে প্রশ্ন করে, আমার দ্বিধাহীন উত্তর হবে, বগুড়া- আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত ছিমছাম ছোট্ট শহর। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ম্যাট্রিক পাস করার সেই প্রিয় শহরটিকে ছেড়ে আমি কিনা গেলাম রংপুরের কারমাইকেল কলেজে পড়তে।
কারমাইকেল কলেজের স্থাপত্য ও বিশালত্ব আমাকে আকর্ষণ করলেও বগুড়াকেই আমার অনেক দিক দিয়ে অনেক বেশি অগ্রসর মনে হতে লাগল। বগুড়ার সাতমাথায় তখন একটি পত্রিকার দোকান ছিল : নিউজ অ্যান্ড ভিউজ, যেখানে টাইম, নিউজউইকসহ কলকাতা থেকে আগত চতুষ্কোণ, পরিচয় বা নতুন সাহিত্যের মতো বিখ্যাত পত্রপত্রিকা পাওয়া যেত। মাত্র কয়েক বছর আগের দেশ বিভাগ কলকাতার সঙ্গে সংযোগকে তখনো শিথিল করতে পারেনি, ভিসাপ্রথা প্রবর্তিত হলেও উৎসব-পার্বণে কলকাতায় যাতায়াত তখনো আগের মতোই। কলকাতা থেকে প্রতি ভোরে তখনো স্টেটসম্যান আসে এবং হকাররা তা পুরনো গ্রাহকদের বিলি করে বেড়ায়। বগুড়াসহ গোটা উত্তরবঙ্গই তখনো যাতায়াতের অসুবিধার জন্য ঢাকামুখী হতে পারেনি।
এক বছরের মধ্যেই রংপুর থেকে সেই বগুড়ায় ফিরে এলাম। বইয়ের পোকা আমি সেখানকার শতবর্ষী গ্রন্থাগার রাজ্যের বই পড়ি। সে আমার এক বিরল আনন্দ। তবে যে আযিযুল কলেজে পড়ি তার সত্যিই কোনো জৌলুস ছিল না। এখন অন্যত্র তার নতুন ভবন হলেও তখনো তা ফুলবাড়ীর সুবিল খালের পাড়ে কয়েকটি টিনশেডে অবস্থিত ছিল। হলে হবে কী, সেই কলেজের পৌরহিত্যে তখন ড. শহীদুল্লাহ বা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো জ্ঞান জগতের দিকপালরা। বগুড়ার জেলা প্রশাসক তখন মুজতবা আলীরই সহোদর। আরো কিছুদিন পর বগুড়ার জেলা প্রশাসক ছিলেন কবি সানাউল হক, যিনি স্বাধীনতার পর সম্ভবত ব্রাসেলসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
আমার এই স্মৃতিচারণার নিবন্ধের মূল চরিত্রে আমি এখনো পৌঁছাইনি। হেঁটে কলেজে যেতাম, ফিরতামও পদব্রজে। মাঝেমধ্যে জিরোতাম কোনো পরিচিত অফিসে বা দোকানে। এমনই একটি স্থান ছিল শহরের পার্ক রোডে কফিল ভাইয়ের কাফেলা স্টুডিও- যেখানে আমিসহ অনেকেই আসত মূলত আড্ডা দিতে বা সংবাদপত্র পড়তে। একজন সুদর্শন কফিল ভাই ডার্করুমে নিবিষ্ট মনে তাঁর কাজ করে যেতেন, আর আমরা আড্ডা দিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যেতাম। চলমান জীবনের একেকটি পর্যায় রেলের প্ল্যাটফর্মের মতো। কারমাইকেল কলেজ, বগুড়া আযিযুল হক কলেজ, কাফেলা স্টুডিও বা এমনিতরো অনেক প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পটভূমি থেকে আগত আমরা অনেকে একত্রই শুধু নয়, ঘনিষ্ঠও হয়েছি, তারপর একসময় যে যার গন্তব্যে বা ঠিকানায় চলে গিয়েছে।
কফিল ভাই সুদর্শন ছিলেন। চেহারাই যদি একমাত্র মাপকাঠি হতো তিনি সহজেই রুপালি পর্দার অভিনেতা হতে পারতেন। দিলীপ কুমারসদৃশ কফিল ভাই অভিনেতা না হয়ে চলচ্চিত্রের কুশলী হতে চেয়েছিলেন। আলোকচিত্র শিল্পেও সে সময় এ দেশে তাঁর সমকক্ষ অল্পই ছিল। শেষ যখন আমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ তিনি জার্মানিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি ষাটের দশকের কোনো এক সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে এলে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। বললেন, তিনি জার্মানিতে সিনেমাটোগ্রাফিতে পড়াশোনা করবেন।
জীবনে অভাবনীয় অনেক কিছুই অনেক সময়ে ঘটে। বিগত আশির দশকে এসে আমি দেশের সরকারি আনুকূল্যে পরিচালিত নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে প্রেরিত হলাম। কার্যকারণে অনেক দেশসহ প্রায়ই ব্রিটেনে যাই। সেখানকার লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অথবা আইআইএসএসই হলো এমন গবেষণার চূড়ান্ত প্রবক্তা। তাই প্রায়ই লন্ডনে গেলে আমাদের দূতাবাসে প্রতিরক্ষা শাখা বা পরিচিত কোনো কূটনীতিকের অফিসে ঢুঁ দিই। সেখানে টেলিফোনে কথা বলি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনী থেকে নিযুক্ত পরিচিত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। এরই ধারায় একবার বনে (তখনো রাজধানী বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়নি) সেখানকার রাষ্ট্রদূত মীর শওকতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। পরে তিনি লন্ডনেও হাইকমিশনার হয়েছিলেন।
মীর শওকত আমার সিনিয়র। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসি ১৯৭০ সালের স্টাফ কোর্সে কোয়েটায়। তিনি বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন। বীর-উত্তম ডেকোরেশনে বিভূষিত স্বল্পসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধার অন্যতম ছিলেন তিনি। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ মীর শওকত পাকিস্তানের স্টাফ কলেজে বাঙালি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারদের তিনি নিজে হাতে তৈরি করা অনেক পদের সমাহারে একটি ভোজ দিয়েছিলেন। টেলিফোনেই তিনি আমাকে বন হয়ে দেশে ফেরার কথা বললেন। টিকিট পরিবর্তনের ঝামেলার ওজর ওঠাতেই তিনি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি লন্ডনস্থ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকে টেলিফোনেই যেন কী কী নির্দেশনা দিলেন।
সামরিক বাহিনীতে সিনিয়রদের ইচ্ছা মানে আদেশ। তাই মনে মনে তথাস্ত বলে পরদিন ঢাকার পরিবর্তে বনের পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে উড়াল দিলাম। মীর শওকত বলেছিলেন, তাঁর সেকেন্ড সেক্রেটারি দূতাবাসের গাড়িতে করে আমাকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বনে নিয়ে যাবে। বনে কোনো এয়ারপোর্ট নেই বলে এই ব্যবস্থা। বিশাল ব্যস্ত ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টের একজিটের মুখেই দেখা হলো সেকেন্ড সেক্রেটারি পাবনার ভদ্রলোক যাঁর নাম এত দিনে ভুলে গেছি।
সেই ভদ্রলোকই আমাকে প্রথম জানালেন যে কাফেলা স্টুডিওর কফিল ভাই নাকি আমার বনে যাওয়ার কথা জানার পর থেকেই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষায় আছেন। শুধু তা-ই নয়, পরদিন আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটে লাঞ্চ খাওয়ার জন্য অগ্রিম দাওয়াতও দিয়ে রেখেছেন। কফিল ভাই সম্ভবত দূতাবাসের এই কর্মকর্তার মাধ্যমেই জেনেছেন যে আমি লাঞ্চ পর্যন্ত বনে থাকব না। আবার জীবনটাকে রেলের একটি প্ল্যাটফর্মের অধিক মনে হলো না, যেখানে দৈবক্রমে কিছুক্ষণের জন্য সাক্ষাৎ হলে পরে যে যার গন্তব্যে যায়।
মীর শওকত একজন দক্ষ বংশীবাদক। আমি পৌঁছার পরই তিনি আমাকে রাইনের উপকূল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তায় তাঁর লিমুজিনে করে লং ড্রাইভে নিয়ে গেলেন। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো। রাইনের কিনারে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তিন তারকার এই জেনারেল তাঁর বাঁশিতে তাল তুললেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। তাঁর বাসভবনে ফিরে দেখলাম তাঁর কাজের লোক আগুন তাপানোর জন্য চুল্লি তৈরি করেছে, যদিও শরৎকালীন সামান্য শীতে তার প্রয়োজন ছিল না।
অতঃপর গভীর রাত পর্যন্ত অনেক শিশির ভেজা গল্প। মীর শওকত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন দেশের কথা, যা সব প্রবাসীই করে গভীর আগ্রহে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে শওকত খাবার গরম করলেন। মিসেস শওকত সে সময় ঢাকায়। শুধু এক ছেলে মার্শাল তাঁর সঙ্গে বিশাল বাসভবনে থেকে পিতাকে সঙ্গ দেয়। এরই মধ্যে মাঝেমধ্যেই বিরক্তিকরভাবে টেলিফোন বেজে উঠছিল। বুঝলাম যে ওটা কফিল ভাইয়েরই কাণ্ড। শওকতও তাই বললেন, গতকাল থেকেই তোমার একটা লোক বারবার তোমাকে চেয়ে টেলিফোন করছে।
কফিল ভাই কী যে খুশি যখন পরদিন তাঁর দুই কামরার ফ্ল্যাটে গেলাম। এরই মধ্যে কফিল ভাই আবার বিয়েও করেছেন। বগুড়ায় থাকতে তাঁর কোনো ঘর-সংসারের কথা শুনিনি। জার্মানিতে তাঁর নাকি যক্ষ্মা হওয়ায় ব্ল্যাক ফরেস্ট সেনিটরিয়ামে ছিলেন বহুদিন। শেষমেশ টুকিটাকি কাজ করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কালাতিপাত করছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, বিদেশ প্রত্যাগত এক লোক যিনি মোহাম্মদপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন, প্রাতর্ভ্রমণ করতে গিয়ে এক দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হন। অনেক পরে জানা গিয়েছিল যে ওই নিহত লোকটি আমাদের কফিল ভাই, যাঁর জন্য সাতকুলে সম্ভবত এক ফোঁটা অশ্রুপাতেরও কেউ ছিল না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
এক বছরের মধ্যেই রংপুর থেকে সেই বগুড়ায় ফিরে এলাম। বইয়ের পোকা আমি সেখানকার শতবর্ষী গ্রন্থাগার রাজ্যের বই পড়ি। সে আমার এক বিরল আনন্দ। তবে যে আযিযুল কলেজে পড়ি তার সত্যিই কোনো জৌলুস ছিল না। এখন অন্যত্র তার নতুন ভবন হলেও তখনো তা ফুলবাড়ীর সুবিল খালের পাড়ে কয়েকটি টিনশেডে অবস্থিত ছিল। হলে হবে কী, সেই কলেজের পৌরহিত্যে তখন ড. শহীদুল্লাহ বা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো জ্ঞান জগতের দিকপালরা। বগুড়ার জেলা প্রশাসক তখন মুজতবা আলীরই সহোদর। আরো কিছুদিন পর বগুড়ার জেলা প্রশাসক ছিলেন কবি সানাউল হক, যিনি স্বাধীনতার পর সম্ভবত ব্রাসেলসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
আমার এই স্মৃতিচারণার নিবন্ধের মূল চরিত্রে আমি এখনো পৌঁছাইনি। হেঁটে কলেজে যেতাম, ফিরতামও পদব্রজে। মাঝেমধ্যে জিরোতাম কোনো পরিচিত অফিসে বা দোকানে। এমনই একটি স্থান ছিল শহরের পার্ক রোডে কফিল ভাইয়ের কাফেলা স্টুডিও- যেখানে আমিসহ অনেকেই আসত মূলত আড্ডা দিতে বা সংবাদপত্র পড়তে। একজন সুদর্শন কফিল ভাই ডার্করুমে নিবিষ্ট মনে তাঁর কাজ করে যেতেন, আর আমরা আড্ডা দিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যেতাম। চলমান জীবনের একেকটি পর্যায় রেলের প্ল্যাটফর্মের মতো। কারমাইকেল কলেজ, বগুড়া আযিযুল হক কলেজ, কাফেলা স্টুডিও বা এমনিতরো অনেক প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পটভূমি থেকে আগত আমরা অনেকে একত্রই শুধু নয়, ঘনিষ্ঠও হয়েছি, তারপর একসময় যে যার গন্তব্যে বা ঠিকানায় চলে গিয়েছে।
কফিল ভাই সুদর্শন ছিলেন। চেহারাই যদি একমাত্র মাপকাঠি হতো তিনি সহজেই রুপালি পর্দার অভিনেতা হতে পারতেন। দিলীপ কুমারসদৃশ কফিল ভাই অভিনেতা না হয়ে চলচ্চিত্রের কুশলী হতে চেয়েছিলেন। আলোকচিত্র শিল্পেও সে সময় এ দেশে তাঁর সমকক্ষ অল্পই ছিল। শেষ যখন আমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ তিনি জার্মানিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি ষাটের দশকের কোনো এক সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে এলে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। বললেন, তিনি জার্মানিতে সিনেমাটোগ্রাফিতে পড়াশোনা করবেন।
জীবনে অভাবনীয় অনেক কিছুই অনেক সময়ে ঘটে। বিগত আশির দশকে এসে আমি দেশের সরকারি আনুকূল্যে পরিচালিত নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে প্রেরিত হলাম। কার্যকারণে অনেক দেশসহ প্রায়ই ব্রিটেনে যাই। সেখানকার লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অথবা আইআইএসএসই হলো এমন গবেষণার চূড়ান্ত প্রবক্তা। তাই প্রায়ই লন্ডনে গেলে আমাদের দূতাবাসে প্রতিরক্ষা শাখা বা পরিচিত কোনো কূটনীতিকের অফিসে ঢুঁ দিই। সেখানে টেলিফোনে কথা বলি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনী থেকে নিযুক্ত পরিচিত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। এরই ধারায় একবার বনে (তখনো রাজধানী বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়নি) সেখানকার রাষ্ট্রদূত মীর শওকতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। পরে তিনি লন্ডনেও হাইকমিশনার হয়েছিলেন।
মীর শওকত আমার সিনিয়র। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসি ১৯৭০ সালের স্টাফ কোর্সে কোয়েটায়। তিনি বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন। বীর-উত্তম ডেকোরেশনে বিভূষিত স্বল্পসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধার অন্যতম ছিলেন তিনি। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ মীর শওকত পাকিস্তানের স্টাফ কলেজে বাঙালি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারদের তিনি নিজে হাতে তৈরি করা অনেক পদের সমাহারে একটি ভোজ দিয়েছিলেন। টেলিফোনেই তিনি আমাকে বন হয়ে দেশে ফেরার কথা বললেন। টিকিট পরিবর্তনের ঝামেলার ওজর ওঠাতেই তিনি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি লন্ডনস্থ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকে টেলিফোনেই যেন কী কী নির্দেশনা দিলেন।
সামরিক বাহিনীতে সিনিয়রদের ইচ্ছা মানে আদেশ। তাই মনে মনে তথাস্ত বলে পরদিন ঢাকার পরিবর্তে বনের পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে উড়াল দিলাম। মীর শওকত বলেছিলেন, তাঁর সেকেন্ড সেক্রেটারি দূতাবাসের গাড়িতে করে আমাকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বনে নিয়ে যাবে। বনে কোনো এয়ারপোর্ট নেই বলে এই ব্যবস্থা। বিশাল ব্যস্ত ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টের একজিটের মুখেই দেখা হলো সেকেন্ড সেক্রেটারি পাবনার ভদ্রলোক যাঁর নাম এত দিনে ভুলে গেছি।
সেই ভদ্রলোকই আমাকে প্রথম জানালেন যে কাফেলা স্টুডিওর কফিল ভাই নাকি আমার বনে যাওয়ার কথা জানার পর থেকেই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষায় আছেন। শুধু তা-ই নয়, পরদিন আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটে লাঞ্চ খাওয়ার জন্য অগ্রিম দাওয়াতও দিয়ে রেখেছেন। কফিল ভাই সম্ভবত দূতাবাসের এই কর্মকর্তার মাধ্যমেই জেনেছেন যে আমি লাঞ্চ পর্যন্ত বনে থাকব না। আবার জীবনটাকে রেলের একটি প্ল্যাটফর্মের অধিক মনে হলো না, যেখানে দৈবক্রমে কিছুক্ষণের জন্য সাক্ষাৎ হলে পরে যে যার গন্তব্যে যায়।
মীর শওকত একজন দক্ষ বংশীবাদক। আমি পৌঁছার পরই তিনি আমাকে রাইনের উপকূল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তায় তাঁর লিমুজিনে করে লং ড্রাইভে নিয়ে গেলেন। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো। রাইনের কিনারে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তিন তারকার এই জেনারেল তাঁর বাঁশিতে তাল তুললেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। তাঁর বাসভবনে ফিরে দেখলাম তাঁর কাজের লোক আগুন তাপানোর জন্য চুল্লি তৈরি করেছে, যদিও শরৎকালীন সামান্য শীতে তার প্রয়োজন ছিল না।
অতঃপর গভীর রাত পর্যন্ত অনেক শিশির ভেজা গল্প। মীর শওকত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন দেশের কথা, যা সব প্রবাসীই করে গভীর আগ্রহে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে শওকত খাবার গরম করলেন। মিসেস শওকত সে সময় ঢাকায়। শুধু এক ছেলে মার্শাল তাঁর সঙ্গে বিশাল বাসভবনে থেকে পিতাকে সঙ্গ দেয়। এরই মধ্যে মাঝেমধ্যেই বিরক্তিকরভাবে টেলিফোন বেজে উঠছিল। বুঝলাম যে ওটা কফিল ভাইয়েরই কাণ্ড। শওকতও তাই বললেন, গতকাল থেকেই তোমার একটা লোক বারবার তোমাকে চেয়ে টেলিফোন করছে।
কফিল ভাই কী যে খুশি যখন পরদিন তাঁর দুই কামরার ফ্ল্যাটে গেলাম। এরই মধ্যে কফিল ভাই আবার বিয়েও করেছেন। বগুড়ায় থাকতে তাঁর কোনো ঘর-সংসারের কথা শুনিনি। জার্মানিতে তাঁর নাকি যক্ষ্মা হওয়ায় ব্ল্যাক ফরেস্ট সেনিটরিয়ামে ছিলেন বহুদিন। শেষমেশ টুকিটাকি কাজ করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কালাতিপাত করছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, বিদেশ প্রত্যাগত এক লোক যিনি মোহাম্মদপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন, প্রাতর্ভ্রমণ করতে গিয়ে এক দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হন। অনেক পরে জানা গিয়েছিল যে ওই নিহত লোকটি আমাদের কফিল ভাই, যাঁর জন্য সাতকুলে সম্ভবত এক ফোঁটা অশ্রুপাতেরও কেউ ছিল না।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments