এরশাদের ভারত সফর : একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ by কাজী সিরাজ
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অতিসাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা চলছে। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোয় অনেকে ভারতের সমালোচনাও করছেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা পবিত্র ওমরাহ পালনের নামে রাজনৈতিক মিশন নিয়ে 'বারো মাসে প্রায় তেরো বার' সৌদি আরব যান,
একই উদ্দেশ্যে বারবার যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং তদবির করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, নিদেনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হোয়াইট হাউসের বারান্দায় বা এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যাওয়ার চলতি পথে করিডরে 'টুথপেস্ট হাসির' ছবি তুলে নিজেদের ধন্য মনে করেন, তাঁরা চীন যান, রাশিয়া যান; তাতে দোষের কিছু না হলে বাংলাদেশের কোনো নেতানেত্রীর রাজনৈতিক মিশন নিয়ে ভারত সফর দোষের হবে কেন? সেদিক থেকে এরশাদ সাহেবের ভারত সফরে দোষ খোঁজার কোনো কারণ নেই। বিশ্বকে এখন বলা হচ্ছে একটা গ্লোবাল ভিলেজ। পারস্পরিক সমস্যা থাকলেও তা মীমাংসার চেষ্টা না করে নিজের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে থাকলে 'বিশ্বগ্রামের' অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, মুক্তিযুদ্ধকালের প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অন্যতম উন্নয়ন সহযোগীও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যেমন উষ্ণতা থাকার কথা, সম্পর্কটা সব সময় সে পর্যায়ে থাকছে না। এ দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশের মধ্যে (এমনকি অনেক আওয়ামী লীগারের মধ্যেও) নানা কারণে ভারত-ভীতির একটা মনোভাব কাজ করে। এই ভীতি কখনো কখনো বিদ্বেষের স্তরে উন্নীত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিল এবং যাদের বেশ কিছু সেনাসদস্য আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন, সেই বন্ধুরাষ্ট্রকে অনেকে এখন আর তেমন নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভাবেন না। এটা বাংলাদেশ-ভারত কারো জন্য শুভ নয়, সুখকরও নয়। এর পেছনে কারণ যে নেই তা নয়। ভারতকে তাদের ভূখণ্ডগত প্রয়োজনে আমরা বেরুবাড়ি উপহার দিয়েছি সেই কবে বঙ্গবন্ধুর আমলে। কিন্তু আমাদের তিনবিঘা করিডর, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাসহ বিভিন্ন ছিটমহল সমস্যা ঝুলে থাকল কয়েক দশক। দু-একটি ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও এসব বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসা ৪০ বছরেও হলো না। সীমান্তে অনেকটা পাখি শিকার করার মতো বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করা হয় ঠুনকো অজুহাতে; পতাকা বৈঠক হয় উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী পর্যায়ে, বৈঠক হয় রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়েও। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সীমান্তে হত্যা বন্ধে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি-সিদ্ধান্ত কাগজে-ফাইলেই বন্দি থাকে, কার্যকর হয় না। ফারাক্কা, তিস্তাসহ ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিতে বাংলাদেশের প্রাপ্যতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অবহেলিত, বাণিজ্যিক ঘাটতির ফারাক আকাশ-পাতাল। দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ ও তা সম্প্রসারণে এসব বিষয়ের ইতিবাচক ফয়সালা হওয়া দরকার। এসব ফয়সালার জন্যই তো দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার ক্ষেত্র আরো উন্নত করা জরুরি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, সরকারি-বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব পর্যায়ে এমনকি জনগণের পর্যায়েও আসা-যাওয়া, আলাপ-আলোচনা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়ানো উচিত; উচিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের। সেরকম সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া বা অন্য দলের নেতা-নেত্রীরাও ভারত সফরে যেতে পারেন এবং সে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রী ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করতে পারেন। কিন্তু কোনো সফর যদি সমমর্যাদাভিত্তিক না হয়ে প্রভুর দরবারে ভৃত্যের ধরনার মতো হয়, তা গোটা জাতির মাথাটাই লজ্জায়-অপমানে হেঁট করে দেয়। এরশাদের ভারত সফরকালে সে দেশের নেতা ও সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে তার সব কিছু কখনোই জানা যাবে না। দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে এরশাদ সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছেন তা একটা স্বাধীন জাতির আত্মসম্মানে আঘাত হানার মতো। নির্বাচন হবে বাংলাদেশে। এখানে কোন দল কত আসনে নির্বাচন করবে না করবে সে ব্যাপারে অন্য দেশের কোনো দল বা নেতৃত্বের ছাড়পত্রের কী প্রয়োজন? এরশাদ বলেছেন, 'ওনাদের আমি ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজি করাতে পেরেছি।' প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন 'ঘুড়ি'র নাটাই কি তবে ভারতের হাতে? এরশাদ তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে মিন করতে চেয়েছেন, ভারত তাঁকে বাংলাদেশের খলিফাগিরি দিয়ে দিয়েছে- তা বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা বাংলাদেশের কোনো কিছুই তাদের কাছে গোপন নেই। অন্য কোনো দেশের কোনো দল বা নেতানেত্রীকে 'খলিফাগিরি' দিয়ে দেওয়ার মতো কাঁচা রাজনীতি ভারতের ঝানু রাজনীতিকরা করেন বলে মনে হয় না। এরশাদ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার আশায়ই এমন কথা বলেছেন বলে মনে হয়।
পতিত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভারত সফর নিয়ে প্রতিক্রিয়া মিশ্র। এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিব্রত ও বিপদগ্রস্ত না করে মহাজোটে থেকে একযোগে কাজ করার জন্য বোঝানোর উদ্দেশ্যেই তাঁকে ভারতে ডেকে নেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনে প্রধানমন্ত্রীর হাত আছে। উল্লেখ্য, এক বছর ধরে হু. মু. এরশাদ মহাজোট ছেড়ে ৩০০ আসনে একক নির্বাচনের 'হুঙ্কার' দিয়ে আসছেন। তাঁর দলের ভেতর থেকেও এ ব্যাপারে প্রচণ্ড চাপ আছে। এরশাদের দলে এখন এক আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর সাবেক জাসদ ছাত্রলীগের জিয়াউদ্দিন বাবলু ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে শক্ত ওকালতি করার উল্লেখযোগ্য কেউ নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গুম-হত্যা-সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংকটের তীব্রতা, শাসক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দুর্নীতি মহাজোট সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসছে জনগণ। এ অবস্থায় গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে ব্রুট মেজরিটির জোরে সংবিধান পাল্টে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সরকারি বালখিল্য সিদ্ধান্ত। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই ইস্যুতে তারা শিগগিরই আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই ইস্যুতে ১৯৯৪ থেকে '৯৬ দুই বছর তুমুল, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাপা এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর উপদেষ্টারা এটা ভাবতেই পারেন, তাঁদেরও আবার সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থায় যেতে হতে পারে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে এককভাবে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের দশা বড়ই করুণ হবে, সে কথা তাঁদের মিত্ররাও বলছেন। এরশাদকে সঙ্গে রাখা তাই তাঁদের খুবই দরকার। তাই তাঁর এই ভারত সফরকে অনেক কিছু না পাওয়ার 'অভিমানে' ক্ষুব্ধ এরশাদকে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের মাধ্যমে বশে আনার বা বশে রাখার একটা চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
আবার উল্টো ভাবনাও আছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান লীগ সরকার বাতিল করে দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় ধরে রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়েই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশে সংসদ (সরকার) কাজটি করেছে বলে সাধারণ মানুষও মনে করে। সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে অটল থাকলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন করতে হবে। এরশাদ সাহেব হয়তো ভাবছেন, এ অবস্থায় লীগ সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ও অজনপ্রিয় হয়ে পড়ার সুযোগে ৩০০ আসনে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় চলে যাবে। এ কথাটাই তিনি ভারতীয় নেতাদের বুঝিয়ে এসেছেন। ঢাকায় ফিরে এমন কথাই তো বললেন তিনি।
ভারতীয় নেতারা কি এতই কাঁচা যে, এরশাদ যা বললেন তাই তাঁরা বিশ্বাস করবেন? তাঁরা কি জানেন না যে, মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের ভোটসহ এরশাদের জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে পেয়েছে ২৫ আসন? প্রাপ্ত ভোটের হার ৭.৪ শতাংশ। ৮৬.৭ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ৪৮.৪ শতাংশ আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়েছে। বিএনপির বাক্সে পড়েছে ৩২.৫ শতাংশ ভোট। এরশাদের ভোট কিন্তু ক্রমেই কমছে। '৯১ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে তা কমেছে ৪ শতাংশ। কী করে এরশাদ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা বিএনপির বিকল্প হওয়ায় চিন্তা করেন তা উনিই বলতে পারেন। এর পরও ভারত তাঁকে এত গুরুত্ব দিল কেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। শুধু জন্মসূত্রেই নয়, প্রশিক্ষণরত অবস্থায় দীর্ঘদিন ভারতে থাকার কারণে এই সাবেক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে ভারতের কোনো কোনো মহলের মধুর একটা সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক বলেই মনে করে মানুষ। সেই সূত্রে এবং বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাঁর ভারত সফরে যাওয়া অত্যাশ্চর্য কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বাজারে ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, ভারত তাঁকে ছাড়পত্র দিয়েছে- এর কোনো যৌক্তিক কারণ ও ভিত্তি নেই। কথাটা বলে বেড়াচ্ছেন এরশাদ নিজে, নিজের ঢোল নিজে বাজানোর মতো। তবে এটা মনে হচ্ছে, মহাজোটের সঙ্গে এরশাদের মধু চন্দ্রিমার যবনিকাপাত ঘটতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের ভারত সফরে একটা তাৎপর্য অবশ্যই আছে। এত দিন ভারত সফর আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সিপিবির কোনো নেতা বা প্রতিনিধি দল, লীগপন্থী শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা তথা যাঁরা নিজেদের ভারতপন্থী বলতে গর্ববোধ করেন, তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদের ব্যাপারে, অন্যদের মধ্যে ছিল মনোজাগতিক এক অদৃশ্য দেয়াল। সে দেয়ালটা ভেঙে দেওয়া হলো। জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শিগগিরই হয়তো তিনি দিল্লির মেহমান হবেন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ সফর হতে পারে। সেই সফর বিএনপি ভারত সম্পর্ককে অনেক উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারে। বিএনপির মতো একটা মডারেট ডানপন্থী দলের যদি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে এবং চীনের পার্টি কংগ্রেসে যদি বিএনপি প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারে, তাহলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি এমনকি বিজেপির সঙ্গেও সখ্য না হোক, সম্পর্ক হতে অসুবিধা কোথায়? কারো কারো সঙ্গে সখ্যও হতে পারে। সে রকম একটা সম্পর্ক গড়ার পরিস্থিতি এবার হয়তো সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবে যদি তা হয়, তা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনবে। ভেঙে যাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। এ অবস্থায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনদের জন্য তা কাল হবে। এ আন্দাজ লীগ মহলেও আছে। তাই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত চালাবে সরকার পক্ষ। তখনই রাজনীতি হয়ে উঠবে '৯৪-৯৬ এবং ওয়ান ইলেভেনপূর্ব পরিস্থিতির মতো সাংঘর্ষিক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগ কোনো মিত্র খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। তখন সমগ্র উপমহাদেশে আন্তদলীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির চেহারাও হয়তো পাল্টে যাবে। এরশাদের ভারত সফর এর সূচনা মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
kazi.shiraz@yahoo.com
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, মুক্তিযুদ্ধকালের প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অন্যতম উন্নয়ন সহযোগীও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যেমন উষ্ণতা থাকার কথা, সম্পর্কটা সব সময় সে পর্যায়ে থাকছে না। এ দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশের মধ্যে (এমনকি অনেক আওয়ামী লীগারের মধ্যেও) নানা কারণে ভারত-ভীতির একটা মনোভাব কাজ করে। এই ভীতি কখনো কখনো বিদ্বেষের স্তরে উন্নীত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিল এবং যাদের বেশ কিছু সেনাসদস্য আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন, সেই বন্ধুরাষ্ট্রকে অনেকে এখন আর তেমন নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভাবেন না। এটা বাংলাদেশ-ভারত কারো জন্য শুভ নয়, সুখকরও নয়। এর পেছনে কারণ যে নেই তা নয়। ভারতকে তাদের ভূখণ্ডগত প্রয়োজনে আমরা বেরুবাড়ি উপহার দিয়েছি সেই কবে বঙ্গবন্ধুর আমলে। কিন্তু আমাদের তিনবিঘা করিডর, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাসহ বিভিন্ন ছিটমহল সমস্যা ঝুলে থাকল কয়েক দশক। দু-একটি ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও এসব বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসা ৪০ বছরেও হলো না। সীমান্তে অনেকটা পাখি শিকার করার মতো বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করা হয় ঠুনকো অজুহাতে; পতাকা বৈঠক হয় উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী পর্যায়ে, বৈঠক হয় রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়েও। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সীমান্তে হত্যা বন্ধে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি-সিদ্ধান্ত কাগজে-ফাইলেই বন্দি থাকে, কার্যকর হয় না। ফারাক্কা, তিস্তাসহ ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিতে বাংলাদেশের প্রাপ্যতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অবহেলিত, বাণিজ্যিক ঘাটতির ফারাক আকাশ-পাতাল। দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ ও তা সম্প্রসারণে এসব বিষয়ের ইতিবাচক ফয়সালা হওয়া দরকার। এসব ফয়সালার জন্যই তো দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার ক্ষেত্র আরো উন্নত করা জরুরি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, সরকারি-বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব পর্যায়ে এমনকি জনগণের পর্যায়েও আসা-যাওয়া, আলাপ-আলোচনা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়ানো উচিত; উচিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের। সেরকম সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া বা অন্য দলের নেতা-নেত্রীরাও ভারত সফরে যেতে পারেন এবং সে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রী ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করতে পারেন। কিন্তু কোনো সফর যদি সমমর্যাদাভিত্তিক না হয়ে প্রভুর দরবারে ভৃত্যের ধরনার মতো হয়, তা গোটা জাতির মাথাটাই লজ্জায়-অপমানে হেঁট করে দেয়। এরশাদের ভারত সফরকালে সে দেশের নেতা ও সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে তার সব কিছু কখনোই জানা যাবে না। দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে এরশাদ সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছেন তা একটা স্বাধীন জাতির আত্মসম্মানে আঘাত হানার মতো। নির্বাচন হবে বাংলাদেশে। এখানে কোন দল কত আসনে নির্বাচন করবে না করবে সে ব্যাপারে অন্য দেশের কোনো দল বা নেতৃত্বের ছাড়পত্রের কী প্রয়োজন? এরশাদ বলেছেন, 'ওনাদের আমি ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজি করাতে পেরেছি।' প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন 'ঘুড়ি'র নাটাই কি তবে ভারতের হাতে? এরশাদ তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে মিন করতে চেয়েছেন, ভারত তাঁকে বাংলাদেশের খলিফাগিরি দিয়ে দিয়েছে- তা বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা বাংলাদেশের কোনো কিছুই তাদের কাছে গোপন নেই। অন্য কোনো দেশের কোনো দল বা নেতানেত্রীকে 'খলিফাগিরি' দিয়ে দেওয়ার মতো কাঁচা রাজনীতি ভারতের ঝানু রাজনীতিকরা করেন বলে মনে হয় না। এরশাদ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার আশায়ই এমন কথা বলেছেন বলে মনে হয়।
পতিত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভারত সফর নিয়ে প্রতিক্রিয়া মিশ্র। এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিব্রত ও বিপদগ্রস্ত না করে মহাজোটে থেকে একযোগে কাজ করার জন্য বোঝানোর উদ্দেশ্যেই তাঁকে ভারতে ডেকে নেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনে প্রধানমন্ত্রীর হাত আছে। উল্লেখ্য, এক বছর ধরে হু. মু. এরশাদ মহাজোট ছেড়ে ৩০০ আসনে একক নির্বাচনের 'হুঙ্কার' দিয়ে আসছেন। তাঁর দলের ভেতর থেকেও এ ব্যাপারে প্রচণ্ড চাপ আছে। এরশাদের দলে এখন এক আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর সাবেক জাসদ ছাত্রলীগের জিয়াউদ্দিন বাবলু ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে শক্ত ওকালতি করার উল্লেখযোগ্য কেউ নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গুম-হত্যা-সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংকটের তীব্রতা, শাসক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দুর্নীতি মহাজোট সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসছে জনগণ। এ অবস্থায় গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে ব্রুট মেজরিটির জোরে সংবিধান পাল্টে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সরকারি বালখিল্য সিদ্ধান্ত। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই ইস্যুতে তারা শিগগিরই আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই ইস্যুতে ১৯৯৪ থেকে '৯৬ দুই বছর তুমুল, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাপা এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর উপদেষ্টারা এটা ভাবতেই পারেন, তাঁদেরও আবার সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থায় যেতে হতে পারে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে এককভাবে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের দশা বড়ই করুণ হবে, সে কথা তাঁদের মিত্ররাও বলছেন। এরশাদকে সঙ্গে রাখা তাই তাঁদের খুবই দরকার। তাই তাঁর এই ভারত সফরকে অনেক কিছু না পাওয়ার 'অভিমানে' ক্ষুব্ধ এরশাদকে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের মাধ্যমে বশে আনার বা বশে রাখার একটা চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
আবার উল্টো ভাবনাও আছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান লীগ সরকার বাতিল করে দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় ধরে রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়েই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশে সংসদ (সরকার) কাজটি করেছে বলে সাধারণ মানুষও মনে করে। সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে অটল থাকলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন করতে হবে। এরশাদ সাহেব হয়তো ভাবছেন, এ অবস্থায় লীগ সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ও অজনপ্রিয় হয়ে পড়ার সুযোগে ৩০০ আসনে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় চলে যাবে। এ কথাটাই তিনি ভারতীয় নেতাদের বুঝিয়ে এসেছেন। ঢাকায় ফিরে এমন কথাই তো বললেন তিনি।
ভারতীয় নেতারা কি এতই কাঁচা যে, এরশাদ যা বললেন তাই তাঁরা বিশ্বাস করবেন? তাঁরা কি জানেন না যে, মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের ভোটসহ এরশাদের জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে পেয়েছে ২৫ আসন? প্রাপ্ত ভোটের হার ৭.৪ শতাংশ। ৮৬.৭ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ৪৮.৪ শতাংশ আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়েছে। বিএনপির বাক্সে পড়েছে ৩২.৫ শতাংশ ভোট। এরশাদের ভোট কিন্তু ক্রমেই কমছে। '৯১ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে তা কমেছে ৪ শতাংশ। কী করে এরশাদ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা বিএনপির বিকল্প হওয়ায় চিন্তা করেন তা উনিই বলতে পারেন। এর পরও ভারত তাঁকে এত গুরুত্ব দিল কেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। শুধু জন্মসূত্রেই নয়, প্রশিক্ষণরত অবস্থায় দীর্ঘদিন ভারতে থাকার কারণে এই সাবেক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে ভারতের কোনো কোনো মহলের মধুর একটা সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক বলেই মনে করে মানুষ। সেই সূত্রে এবং বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাঁর ভারত সফরে যাওয়া অত্যাশ্চর্য কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বাজারে ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, ভারত তাঁকে ছাড়পত্র দিয়েছে- এর কোনো যৌক্তিক কারণ ও ভিত্তি নেই। কথাটা বলে বেড়াচ্ছেন এরশাদ নিজে, নিজের ঢোল নিজে বাজানোর মতো। তবে এটা মনে হচ্ছে, মহাজোটের সঙ্গে এরশাদের মধু চন্দ্রিমার যবনিকাপাত ঘটতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের ভারত সফরে একটা তাৎপর্য অবশ্যই আছে। এত দিন ভারত সফর আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সিপিবির কোনো নেতা বা প্রতিনিধি দল, লীগপন্থী শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা তথা যাঁরা নিজেদের ভারতপন্থী বলতে গর্ববোধ করেন, তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদের ব্যাপারে, অন্যদের মধ্যে ছিল মনোজাগতিক এক অদৃশ্য দেয়াল। সে দেয়ালটা ভেঙে দেওয়া হলো। জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শিগগিরই হয়তো তিনি দিল্লির মেহমান হবেন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ সফর হতে পারে। সেই সফর বিএনপি ভারত সম্পর্ককে অনেক উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারে। বিএনপির মতো একটা মডারেট ডানপন্থী দলের যদি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে এবং চীনের পার্টি কংগ্রেসে যদি বিএনপি প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারে, তাহলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি এমনকি বিজেপির সঙ্গেও সখ্য না হোক, সম্পর্ক হতে অসুবিধা কোথায়? কারো কারো সঙ্গে সখ্যও হতে পারে। সে রকম একটা সম্পর্ক গড়ার পরিস্থিতি এবার হয়তো সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবে যদি তা হয়, তা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনবে। ভেঙে যাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। এ অবস্থায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনদের জন্য তা কাল হবে। এ আন্দাজ লীগ মহলেও আছে। তাই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত চালাবে সরকার পক্ষ। তখনই রাজনীতি হয়ে উঠবে '৯৪-৯৬ এবং ওয়ান ইলেভেনপূর্ব পরিস্থিতির মতো সাংঘর্ষিক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগ কোনো মিত্র খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। তখন সমগ্র উপমহাদেশে আন্তদলীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির চেহারাও হয়তো পাল্টে যাবে। এরশাদের ভারত সফর এর সূচনা মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
kazi.shiraz@yahoo.com
No comments