ঢাকা সিটি করপোরেশন-কর্মকর্তাদের গাড়িবিলাস by অরূপ দত্ত
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ তিন-চারটি পর্যন্ত দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন। দাপ্তরিক কাজ ছাড়াও ব্যক্তিগত এমনকি পারিবারিক কাজেও এসব গাড়ি ও জ্বালানির ব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিসিসির দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিসিসি (ঢাকা সিটি করপোরেশন) দক্ষিণে রয়েছে ৩১২টি গাড়ি আর উত্তরে ১৬৫টি। গাড়ি ব্যবহারে প্রতি মাসে দুটি করপোরেশনে ন্যূনতম ১৫ হাজার লিটার তেল খরচ করা হচ্ছে বলে পরিবহন শাখা থেকে জানা যায়। যোগ্য না হলেও অনেকে গাড়ি ব্যবহার করছেন, আবার প্রাধিকারযোগ্য অনেক কর্মকর্তা গাড়ি পাচ্ছেন না। যেসব গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নিশান পেট্রোল, নিশান এক্সট্রাইল, মিৎসুবিসি পাজেরো, টয়োটা প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার, কিয়ার স্পটেজ ছাড়াও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি গাড়ি।
ডিসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এই বৈষম্যের বিষয় দূর করার কথা ডিসিসির শীর্ষ দুই ব্যক্তি প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই যেহেতু নির্ধারিত সংখ্যার বাইরে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তাই বৈষম্যের সমাধানও হচ্ছে না। গাড়ি ব্যবহারে এমন অনিয়ম সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করছে। দুদকের উপপরিচালক হারুন আর রশিদ প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ডিসিসির অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি গাড়িবিষয়ক দুর্নীতির কাগজপত্র পর্যালোচনার কাজ চলছে।
দক্ষিণে ১২টি সেবা প্রদানকারী বিভাগের প্রধানই প্রেষণে আসা। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন একটি করে গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ১২ জনই গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাঁদের তিনজনকে দেওয়া হয়েছে একাধিক গাড়ি।
কে কয়টি গাড়ি ব্যবহার করছেন: আইন অনুযায়ী, ডিসিসির কোনো কর্মকর্তাই একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান-উল-ইসলামের নামে পরিবহন শাখার হিসাব খাতায় দুটি গাড়ি ব্যবহারের উল্লেখ আছে। পরিবহন শাখার সূত্র ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ডিসিসি থেকে চারটি গাড়ি নিয়ে পরে একটি তাঁর স্টাফ অফিসারকে দিয়েছেন। তালিকাভুক্ত দুটি গাড়ির মধ্যে একটি পাজেরো স্পোর্ট (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৪-১৮১৬) এবং অপরটি টয়োটা কার (১২-০৩৯৬)। পাজেরো জিপটি দপ্তরে এবং টয়োটা কার বাসায় ব্যবহার করা হয়।
পরিবহন শাখা ছাড়াও ডিসিসির দায়িত্বশীল সূত্রমতে, সম্প্রতি সাদা রঙের নতুন একটি গাড়ি নেওয়া হয়েছে, যার নম্বর এখনো হয়নি। গাড়িটি বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার আজিমপুরের বাসায় দেখা গেছে। গ্যারেজ নম্বর হচ্ছে ঢাকা ম ১৪৮। পরিবহন শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করেন, সাদা রঙের নতুন গাড়িটি ডিসিসির ‘ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের। এটি প্রকল্পের পরিদর্শনকাজে ব্যবহারের জন্য। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসারের গাড়ি পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাঁকে একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো খ ১১-৪৬১১) দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ওই গাড়িটি নগর ভবনের পরিবহন পুলে দেখা যায় এবং কর্তব্যরত প্রহরী স্বীকার করেন, এটি এখন স্টাফ অফিসারের। তবে গাড়িটির সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘মেয়রের গাড়ি রাখার স্থান।’
পরিবহন শাখার তালিকায় দুটি গাড়ি ব্যবহারের উল্লেখ থাকলেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি গাড়িই ব্যবহার করছেন। তাহলে দুটি গাড়ি ব্যবহারের যে তালিকা করা হয়েছে তার জন্য তিনি আপত্তি জানাচ্ছেন না কেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, ওরা কী করছে।’ তাঁর বাসায় নতুন নম্বরবিহীন সাদা গাড়িটি রয়েছে এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদক সেটি দেখেছেন বলা হলে তিনি ডিসিসির একজন প্রকৌশলীর নাম উল্লেখ করে বলেন, ওই গাড়িটির সন্ধান সেই কর্মকর্তা দিয়েছেন কি না। বাড়তি গাড়ি ব্যবহারের বিষয় অস্বীকার করলেও ডিসিসির গাড়ি ব্যবহারে অনিয়ম নিয়ে দুদকের তদন্ত করার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
ডিসিসি দক্ষিণের সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বর্তমান প্রশাসক জিল্লার রহমান একটি কমিয়ে এনেছেন। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন সেই নিশান জিপটি (১১-৬১৬৮) তিনি ব্যবহার করছেন। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে গাড়িটি প্রশাসক ভবনের ফটকের সামনে দেখা যায়। এর বাইরে প্রশাসক একটি টয়োটা কারও (১২-০১৯৭) ব্যবহার করছেন বলে পরিবহন শাখার হিসাব খাতা থেকে জানা যায়।
একই কর্মকর্তা একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন, আবার প্রাধিকারযোগ্য অনেকেই গাড়ি পাচ্ছেন না কেন, জানতে চাইলে প্রশাসক বলেন, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। প্রশাসক হিসেবে এটা দেখা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি পরিবহর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইবেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কেস প্রকল্পের পরিচালক মো. শেহাবউল্লাহ ব্যবহার করছেন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব নিশান এক্সট্রাইল গাড়ি (১১-৫৪২৭)। এ ছাড়া প্রকল্পের দুটি মাইক্রোবাস ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে তিনি তা অস্বীকার করেন। এমনকি কেস প্রকল্পের গাড়ি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসার গ্যারেজে থাকার বিষয়টির প্রমাণ প্রথম আলো পেয়েছে বলার পরও তিনি তা স্বীকার করেননি। কেস প্রকল্পে কয়টি গাড়ি রয়েছে, তার খবরও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলতে রাজি হননি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেকর্ড দেখে বলতে হবে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার আবু নাসের ভূঁইয়া ব্যবহার করছেন একটি পাজেরো জিপ (১১-৪৬১১)। নিয়ম অনুযায়ী তিনি গাড়ি পান না। প্রশাসকের ব্যক্তিগত সচিব সার্বক্ষণিক গাড়ি পেতে পারেন না। কিন্তু বর্তমান তাঁর ব্যক্তিগত সচিব আমিনুর রহমান চৌধুরী ব্যবহার করছেন টয়োটা কার (১৫-৮৩১৪)। দক্ষিণের সাবেক সচিব মো. শামসুজ্জামানও ব্যবহার করতেন দুটি গাড়ি। সম্প্রতি তাঁকে বদলি করার পর নতুন সচিব এসেছেন মাহবুব হোসেন। তিনি আপাতত একটি গাড়ি (১৪-১৮২৮) ব্যবহার করছেন। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান কয়েক দিন আগেও দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এর একটি নিশান জিপ (১১-৫৪৩৮)। অপরটি পিকআপ ভ্যান (১৪-১৪৪৯)। কয়েক দিন আগে এটি ডিসিসি উত্তরে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নগর ভবনের পরিবহন পুলে একটি গাড়ি দেখা যায়, যার নম্বর ১৪-১৪২০। এই গাড়িটি কে ব্যবহার করেন, জানতে চাইলে কর্তব্যরত প্রহরী জবাব দিতে অপারগতা জানান। পরে পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব এই গাড়িটি ব্যবহার করেন। কিন্তু পরিবহন পুলের তালিকায় এটি নেই।
দক্ষিণের পরিবহন বিভাগের ব্যবস্থাপক খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পরিবহন পুলের বাইরে প্রকল্পের গাড়ি কেউ কেউ ব্যবহার করতে পারেন। তবে তা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। প্রশাসকের জন্য দৈনিক ২৫ লিটার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য ২০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকে। অন্যদের জন্য কাজের ওপর ভিত্তি করে তেল দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
ডিসিসি উত্তর: এখানে গাড়ির ব্যবহার তুলনামূলক কম। তবে প্রশাসক শাজাহান আলী মোল্লা ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। পরিবহন শাখার হিসাবে দুটির উল্লেখ আছে। এর মধ্যে একটি সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বাসায় যে পাজেরো গাড়িটি (১১-৫৫৬০) ব্যবহূত হতো এবং অপরটিও পাজেরো জিপ (১৩-৬০৩৩)। উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম এখন পর্যন্ত একটি গাড়ি (১৩-৬০৩২) ব্যবহার করছেন। উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার মো. মুরাদকে পিকআপ (১৪-১৪৪৯) দেওয়া হয়েছে। তাঁরও গাড়ি পাওয়ার কথা নয়।
উত্তরের পরিবহর ব্যবস্থাপক আবদুল বাসেত জানান, গাড়ি পাওয়ার যোগ্য হলেও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী, পরিচালকসহ ১৩ জন গাড়ি পাননি। ছয়জন কর্মকর্তা অ্যাম্বুলেন্সে যাতায়াত করেন। তবে করপোরেশনে ব্যবহারের জন্য আরও গাড়ির রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিধি অনুযায়ী কেউই একটির বেশি গাড়ি পান না: সরকারি বিধি এবং ডিসিসির ১৯৯০ সালের জনবল কাঠামো অনুযাযী কোনো কর্মকর্তাই একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। প্রশাসকের ব্যক্তিগত সচিব, স্টাফ অফিসার গাড়ি পাওয়ার যোগ্য নন। অথচ তাঁরাও দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি যাঁদের জন্য কেনা হয়েছে তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন না, ব্যবহার করেন প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। সরকারি কাজে গাড়ি ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ব্যবহার করা হয়। গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি, চালকের বেতন-ভাতাদি বাবদ পরিশোধিত অর্থ অপচয় হচ্ছে কি না, এসব নিয়ে ডিসিসি তদন্তও করছে না।
ডিসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এই বৈষম্যের বিষয় দূর করার কথা ডিসিসির শীর্ষ দুই ব্যক্তি প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই যেহেতু নির্ধারিত সংখ্যার বাইরে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তাই বৈষম্যের সমাধানও হচ্ছে না। গাড়ি ব্যবহারে এমন অনিয়ম সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করছে। দুদকের উপপরিচালক হারুন আর রশিদ প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ডিসিসির অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি গাড়িবিষয়ক দুর্নীতির কাগজপত্র পর্যালোচনার কাজ চলছে।
দক্ষিণে ১২টি সেবা প্রদানকারী বিভাগের প্রধানই প্রেষণে আসা। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন একটি করে গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ১২ জনই গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাঁদের তিনজনকে দেওয়া হয়েছে একাধিক গাড়ি।
কে কয়টি গাড়ি ব্যবহার করছেন: আইন অনুযায়ী, ডিসিসির কোনো কর্মকর্তাই একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান-উল-ইসলামের নামে পরিবহন শাখার হিসাব খাতায় দুটি গাড়ি ব্যবহারের উল্লেখ আছে। পরিবহন শাখার সূত্র ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ডিসিসি থেকে চারটি গাড়ি নিয়ে পরে একটি তাঁর স্টাফ অফিসারকে দিয়েছেন। তালিকাভুক্ত দুটি গাড়ির মধ্যে একটি পাজেরো স্পোর্ট (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৪-১৮১৬) এবং অপরটি টয়োটা কার (১২-০৩৯৬)। পাজেরো জিপটি দপ্তরে এবং টয়োটা কার বাসায় ব্যবহার করা হয়।
পরিবহন শাখা ছাড়াও ডিসিসির দায়িত্বশীল সূত্রমতে, সম্প্রতি সাদা রঙের নতুন একটি গাড়ি নেওয়া হয়েছে, যার নম্বর এখনো হয়নি। গাড়িটি বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার আজিমপুরের বাসায় দেখা গেছে। গ্যারেজ নম্বর হচ্ছে ঢাকা ম ১৪৮। পরিবহন শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করেন, সাদা রঙের নতুন গাড়িটি ডিসিসির ‘ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের। এটি প্রকল্পের পরিদর্শনকাজে ব্যবহারের জন্য। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসারের গাড়ি পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাঁকে একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো খ ১১-৪৬১১) দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ওই গাড়িটি নগর ভবনের পরিবহন পুলে দেখা যায় এবং কর্তব্যরত প্রহরী স্বীকার করেন, এটি এখন স্টাফ অফিসারের। তবে গাড়িটির সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘মেয়রের গাড়ি রাখার স্থান।’
পরিবহন শাখার তালিকায় দুটি গাড়ি ব্যবহারের উল্লেখ থাকলেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি গাড়িই ব্যবহার করছেন। তাহলে দুটি গাড়ি ব্যবহারের যে তালিকা করা হয়েছে তার জন্য তিনি আপত্তি জানাচ্ছেন না কেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, ওরা কী করছে।’ তাঁর বাসায় নতুন নম্বরবিহীন সাদা গাড়িটি রয়েছে এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদক সেটি দেখেছেন বলা হলে তিনি ডিসিসির একজন প্রকৌশলীর নাম উল্লেখ করে বলেন, ওই গাড়িটির সন্ধান সেই কর্মকর্তা দিয়েছেন কি না। বাড়তি গাড়ি ব্যবহারের বিষয় অস্বীকার করলেও ডিসিসির গাড়ি ব্যবহারে অনিয়ম নিয়ে দুদকের তদন্ত করার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
ডিসিসি দক্ষিণের সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বর্তমান প্রশাসক জিল্লার রহমান একটি কমিয়ে এনেছেন। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন সেই নিশান জিপটি (১১-৬১৬৮) তিনি ব্যবহার করছেন। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে গাড়িটি প্রশাসক ভবনের ফটকের সামনে দেখা যায়। এর বাইরে প্রশাসক একটি টয়োটা কারও (১২-০১৯৭) ব্যবহার করছেন বলে পরিবহন শাখার হিসাব খাতা থেকে জানা যায়।
একই কর্মকর্তা একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন, আবার প্রাধিকারযোগ্য অনেকেই গাড়ি পাচ্ছেন না কেন, জানতে চাইলে প্রশাসক বলেন, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। প্রশাসক হিসেবে এটা দেখা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি পরিবহর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইবেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কেস প্রকল্পের পরিচালক মো. শেহাবউল্লাহ ব্যবহার করছেন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব নিশান এক্সট্রাইল গাড়ি (১১-৫৪২৭)। এ ছাড়া প্রকল্পের দুটি মাইক্রোবাস ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে তিনি তা অস্বীকার করেন। এমনকি কেস প্রকল্পের গাড়ি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসার গ্যারেজে থাকার বিষয়টির প্রমাণ প্রথম আলো পেয়েছে বলার পরও তিনি তা স্বীকার করেননি। কেস প্রকল্পে কয়টি গাড়ি রয়েছে, তার খবরও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলতে রাজি হননি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেকর্ড দেখে বলতে হবে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার আবু নাসের ভূঁইয়া ব্যবহার করছেন একটি পাজেরো জিপ (১১-৪৬১১)। নিয়ম অনুযায়ী তিনি গাড়ি পান না। প্রশাসকের ব্যক্তিগত সচিব সার্বক্ষণিক গাড়ি পেতে পারেন না। কিন্তু বর্তমান তাঁর ব্যক্তিগত সচিব আমিনুর রহমান চৌধুরী ব্যবহার করছেন টয়োটা কার (১৫-৮৩১৪)। দক্ষিণের সাবেক সচিব মো. শামসুজ্জামানও ব্যবহার করতেন দুটি গাড়ি। সম্প্রতি তাঁকে বদলি করার পর নতুন সচিব এসেছেন মাহবুব হোসেন। তিনি আপাতত একটি গাড়ি (১৪-১৮২৮) ব্যবহার করছেন। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান কয়েক দিন আগেও দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এর একটি নিশান জিপ (১১-৫৪৩৮)। অপরটি পিকআপ ভ্যান (১৪-১৪৪৯)। কয়েক দিন আগে এটি ডিসিসি উত্তরে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নগর ভবনের পরিবহন পুলে একটি গাড়ি দেখা যায়, যার নম্বর ১৪-১৪২০। এই গাড়িটি কে ব্যবহার করেন, জানতে চাইলে কর্তব্যরত প্রহরী জবাব দিতে অপারগতা জানান। পরে পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব এই গাড়িটি ব্যবহার করেন। কিন্তু পরিবহন পুলের তালিকায় এটি নেই।
দক্ষিণের পরিবহন বিভাগের ব্যবস্থাপক খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পরিবহন পুলের বাইরে প্রকল্পের গাড়ি কেউ কেউ ব্যবহার করতে পারেন। তবে তা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। প্রশাসকের জন্য দৈনিক ২৫ লিটার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য ২০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকে। অন্যদের জন্য কাজের ওপর ভিত্তি করে তেল দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
ডিসিসি উত্তর: এখানে গাড়ির ব্যবহার তুলনামূলক কম। তবে প্রশাসক শাজাহান আলী মোল্লা ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। পরিবহন শাখার হিসাবে দুটির উল্লেখ আছে। এর মধ্যে একটি সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বাসায় যে পাজেরো গাড়িটি (১১-৫৫৬০) ব্যবহূত হতো এবং অপরটিও পাজেরো জিপ (১৩-৬০৩৩)। উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম এখন পর্যন্ত একটি গাড়ি (১৩-৬০৩২) ব্যবহার করছেন। উত্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার মো. মুরাদকে পিকআপ (১৪-১৪৪৯) দেওয়া হয়েছে। তাঁরও গাড়ি পাওয়ার কথা নয়।
উত্তরের পরিবহর ব্যবস্থাপক আবদুল বাসেত জানান, গাড়ি পাওয়ার যোগ্য হলেও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী, পরিচালকসহ ১৩ জন গাড়ি পাননি। ছয়জন কর্মকর্তা অ্যাম্বুলেন্সে যাতায়াত করেন। তবে করপোরেশনে ব্যবহারের জন্য আরও গাড়ির রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিধি অনুযায়ী কেউই একটির বেশি গাড়ি পান না: সরকারি বিধি এবং ডিসিসির ১৯৯০ সালের জনবল কাঠামো অনুযাযী কোনো কর্মকর্তাই একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। প্রশাসকের ব্যক্তিগত সচিব, স্টাফ অফিসার গাড়ি পাওয়ার যোগ্য নন। অথচ তাঁরাও দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি যাঁদের জন্য কেনা হয়েছে তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন না, ব্যবহার করেন প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। সরকারি কাজে গাড়ি ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ব্যবহার করা হয়। গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি, চালকের বেতন-ভাতাদি বাবদ পরিশোধিত অর্থ অপচয় হচ্ছে কি না, এসব নিয়ে ডিসিসি তদন্তও করছে না।
No comments