কেবল গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম- সব ব্যাংকেই এমডি নিয়োগের ক্ষমতা পর্ষদের হাতে by জাহাঙ্গীর শাহ

গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে এক বছর চেষ্টা করেও পছন্দ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করতে পারেনি সরকার। পরিচালনা পর্ষদের আপত্তির মুখে বারবার তা ভেস্তে যায়। এ কারণেই অধ্যাদেশে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন পছন্দের এমডি নিয়োগে কোনো বাধা রইল না।


এভাবেই দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বহুল আলোচিত গ্রামীণ ব্যাংকে চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এমডি নিয়োগের বিরল উদাহরণ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরামর্শে তিনজন নির্বাচিত ব্যক্তির মধ্যে সরকার-মনোনীত চেয়ারম্যান নিজেই এখন এমডি নিয়োগ দেবেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশের ১৪ ধারায় এমন সংশোধনী আনার প্রস্তাব গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সভায় পাস করা হয়েছে। শিগগিরই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা কার্যকর করবেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করা ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নির্ধারিত বয়সের অতিরিক্ত সময় থেকে কী পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন এবং এটা বৈধ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকাকালে ড. ইউনূস ‘ওয়েজ আর্নার’ হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কি না, এনে থাকলে কী পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন, সে বিষয়েও একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দেওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদের এসব সিদ্ধান্তের কারণে দেশে-বিদেশে নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। ড. ইউনূসও প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করে দেবে।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার পর সরকার গত এক বছরে নিজেদের পছন্দমতো এমডি নিয়োগে নানা চেষ্টাচরিত্র করেছে। নিয়মানুযায়ী, এমডি নিয়োগে বাছাই কমিটি পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক পাস করিয়ে নিতে হয়। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সমর্থন করায় তা সম্ভব হয়নি। এমনকি পর্ষদ পুনর্বিন্যাস করেও তা করতে পারেনি সরকার।
বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। দেশে সরকারি মালিকানাধীন আরও কয়েকটি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বেসিক ব্যাংক প্রভৃতি। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংক রয়েছে। এর কোনোটিতেই এমডি নিয়োগের ক্ষমতা চেয়ারম্যানের নেই। সর্বত্র পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমেই এমডি নিয়োগ করা হয়। এইটা আন্তর্জাতিক রীতি। অথচ একমাত্র ব্যতিক্রম এখন গ্রামীণ ব্যাংক।
এই সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান মনে করেন, গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত সভ্যদের মাধ্যমে হওয়া উচিত। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিই গ্রামীণ ব্যাংক চালাবেন। এমডি নিয়োগের ক্ষমতা এই ব্যাংকের মালিকদের। এ ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে হিতে বিপরীত হবে।
গ্রামীন ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, কে বলে গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক? গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক না। এর অধিকাংশ শেয়ারের মালিক গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা। সরকার বললেই তা ‘বিশেষায়িত ব্যাংক’ না। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের কোথায় বলা আছে, এটি বিশেষায়িত ব্যাংক? এই বিষয়ে সরকারের বক্তব্য ‘মিথ্যা’ বলে তিনি মত দেন।
বেতন নেওয়া প্রসঙ্গ: বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বেতনভাতা বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশ প্রসঙ্গে আকবর আলি খান বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে মন্ত্রিপরিষদ সভায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না। কারও বিরুদ্ধে তদন্তের প্রয়োজন হলে তা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেই করা সম্ভব। তিনি মনে করেন, মন্ত্রিপরিষদ সভা থেকে যদি ড. ইউনূসের বিষয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়, তবে নিচের দিকের কর্মকর্তারা মনে করবেন, তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে ড. ইউনূস সুবিচার পাবেন না। আর এই ধরনের তদন্তের মাধ্যমে তাঁর মতো ব্যক্তিদের খাটো করা হয়।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই ধরনের বিষয় নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভায় আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল না।
এক বছরে পছন্দের এমডি নিয়োগে ব্যর্থতা: গত বছরের মে মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব ছাড়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগম। পরে ১৪ আগস্ট তিনি নিয়মিত অবসরে যান। এরপর শুরু হয় সরকারের পছন্দের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগপ্রক্রিয়া। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহজাহানকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি এখনো সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১১ সালের ২৬ জুলাই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় নতুন এমডি নিয়োগের জন্য বোর্ড সদস্যরা বাছাই কমিটির সদস্যদের নাম প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে নাম ছিল: মুহাম্মদ ইউনূস, আকবর আলি খান, বোর্ড চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক, সরকার-মনোনীত সদস্য কামরুল হাসান ও রোজিনা বেগম। পর্ষদের নারী সদস্যদের চাপে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাবে রাখা হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত এই বাছাই কমিটি গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মানেননি।
এরপর গত নভেম্বর মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজের পছন্দ অনুযায়ী একটি বাছাই কমিটি পরিচালনা পর্ষদে পাস করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রস্তাবিত সেই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজের নাম প্রস্তাব করেন। আর কমিটির অপর দুজন হলেন সরকার-মনোনীত বোর্ড প্রতিনিধি ও দুজন ঋণগ্রহীতা বোর্ড সদস্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারে সরকারের মতই যাতে বাছাই কমিটিতে প্রাধান্য পায়, সেই লক্ষ্যে নতুন কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেই কমিটিও পর্ষদে অনুমোদন পায়নি।
চলতি বছরের শুরুতে ঋণগ্রহীতা পর্ষদ সদস্যদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন আনা হয়। নতুন নয়জন ঋণগ্রহীতা পর্ষদ সদস্য নির্বাচিত হন। নতুন পর্ষদও প্রস্তাবিত বাছাই কমিটির অনুমোদন দেয়নি। এর পরই সরকার বৃহস্পতিবার অধ্যাদেশে সংশোধনী আনল।
১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেরই কেবল ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের এখতিয়ার রয়েছে। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচনে পর্ষদকে তিন থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠন করতে হয়। তারপর সেই কমিটির সুপারিশ অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পর্ষদ নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করে, আর সেই চেয়ারম্যান এমডি নিয়োগ করেন—এটা হয় না। শুধু বিশেষায়িত নয়, কোনো ধরনের ব্যাংকেই সেটা হয় না। বোর্ডই এমডি নিয়োগ দেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশের বেলায় এ ধরনের সংশোধন একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এটা মোটেই কাম্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.