বাসে বাড়তি ভাড়া আদায়-আজ থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট by পার্থ সারথি দাস

পূর্বাশা পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কিনতে এসেছিলেন সুহেল রানা। ঈদ সামনে রেখে ঢাকা থেকে আগামী ১৪ আগস্ট চুয়াডাঙ্গা যাবেন তিনি। কিন্তু টিকিটের জন্য টাকা দিতে গিয়েই তাঁকে জড়াতে হলো তর্কে। তর্কের সূত্র ধরে জানা গেল, একই পথে কয়েক দিন আগেও ভাড়া নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৩০০ টাকা।


এখন তাঁকে দিতে বলা হচ্ছে ৪০০ টাকা। তর্ক করে কোনো লাভ অবশ্য হলো না সুহেলের। ৪০০ টাকা দিয়েই নিতে হলো আগাম টিকিট। কারণ না নিলে এটিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে গেলে কাউন্টারে কাউন্টারে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। দেশের তিন শতাধিক রুটে যাত্রীপ্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভূমিকা নীরব দর্শকের।
যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, সরকার অনুমোদন না দিলেও ঈদ সামনে রেখে পরিবহন মালিকদের চাপেই শুরু হয়েছে এই ভাড়া-সন্ত্রাস। ঈদ সামনে রেখে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পক্ষে মালিক ও তাঁদের প্রতিনিধিরা যুক্তি দেখান, ফিরতি ট্রিপে খালি গাড়ি নিয়ে রাজধানীতে ফিরতে হবে।
গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনালে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসাধারণ সম্পাদক এরশাদউল্লাহ ও কোষাধ্যক্ষ কামরুল হোসেন স্বাক্ষরিত ভাড়ার এই তালিকা টাঙানো হয়েছে গত ১ আগস্ট। এই তালিকার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান আসন কমিয়ে আরামদায়ক ভ্রমণের ব্যবস্থা করলে আনুপাতিক হারে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বিআরটিএর অনুমোদন থাকে। তবে যাত্রীরা বলেছেন, ঈদের সময় আসন কমানোর তো প্রশ্নই ওঠে না, উল্টো বাড়তি আসন বসানো হয়।
জানা গেছে, এ ধরনের তালিকার বৈধতার জন্য বিআরটিএর অনুমোদন লাগে। কিন্তু কাউন্টারে কাউন্টারে টাঙানো ওই তালিকার জন্য বিআরটিএর অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তালিকা টাঙানোর ক্ষেত্রে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সিল ও স্বাক্ষর লাগে। ওই তালিকার কোনো বৈধতা নেই। তবে আমি দেখেছি, অনেক সময় যাত্রী সংকটের কারণে এখানকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে থাকেন। কিন্তু ঈদে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেলে ভাড়া আগের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়।'
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা গতকাল গাবতলীর বিভিন্ন কাউন্টারে জড়িয়ে পড়েন তর্কে। হানিফ পরিবহনের একটি কাউন্টারের সামনে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে অগ্রিম টিকিট কিনতে আসা সাইদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা থেকে আগে বাস ভাড়া ছিল ৩৬০ টাকা। এখন সেই ভাড়া ঈদ সামনে রেখে হয়েছে ৪১০ টাকা। কেন ভাড়া বাড়ল জানতে চাইলে ওই কাউন্টারের মাস্টার জাকির মলি্লক কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের মৌসুমে রাস্তায় যানজট থাকে। ঢাকা থেকে যেতেই কয়েক ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। আবার ফিরতে হয় খালি গাড়ি নিয়ে। এ কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই নতুন হারের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে ৩ আগস্ট থেকে। ১৪, ১৫ ও ১৬ আগস্টের টিকিট বেশি বিক্রি হচ্ছে। এযাবৎ ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছে।
'এই ক্ষতি পোষানোর খেসারত' কেন যাত্রীদের ওপর পড়বে জানতে চাইলে ঈগল পরিবহনের মালিক অশোক রঞ্জন কাপুড়িয়া বলেন, 'ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে তো আমি জানি না। কাগজপত্র দেখে বলতে পারব ভাড়া বেড়েছে কি না।' প্রতিবেদকের পাল্টা প্রশ্ন- আপনি তো বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, তাহলে বিষয়টি কেন জানবেন না? জবাবে তিনি বলেন, 'আমি আপনাকে পরে জানাব।'
গতকাল দারুস সালাম রোডে সাকুরা পরিবহনের কাউন্টারে গেলে জানা যায়, সেখানে ঈদের ১৪, ১৫ ও ১৬ আগস্টের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা মো. মামুন বলেন, ঈদের কারণে একটু বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সেখানে মাদারীপুর যাওয়ার জন্য অগ্রিম টিকিট কিনতে আসা ইকবাল পারভেজ বলেন, ভাড়া বাড়িয়ে নতুন ভাড়া করা হয়েছে ৪৭৭ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৪৮০ টাকা। এ ব্যাপারে মো. মামুন বলেন, ভাংতি টাকার অভাবে ভাড়ার বাইরে এই অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মৌসুমে হোটেল ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়। আমাদের দেশে ঈদ মৌসুমে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীমুখী বাসের ট্রিপে যাত্রী পাওয়া যায় না। যানজটের কারণে এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-খুলনাসহ বিভিন্ন রুটে দ্বিগুণ বা এরও বেশি সময় লাগছে। আমরা পরিবহন মালিকরা এ কারণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছি। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য ঈদ মৌসুমে ভাড়ার তালিকা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাব। আগামী ৯ আগস্ট আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিষয়টি তুলব। ঢাকা শহরে যানজটের কারণে বাস কম্পানি কমছে। ঢাকার বাইরেও এই অবস্থা হলে পরিবহন ব্যবসার কী হবে? এ বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমি নিজেও চাই না যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হোক।'
১৪ আগস্টের টিকিটের চাপ : ১৫ আগস্ট বুধবার জাতীয় শোক দিবস। পরদিন ১৬ আগস্ট পবিত্র শবেকদর। দুই দিনই সরকারি ছুটি। এরপর শুক্র-শনি (১৭ ও ১৮ আগস্ট) সাপ্তাহিক ছুটি। ১৯ থেকে ২১ আগস্ট ঈদের ছুটি। এভাবে টানা সাত দিন বন্ধ। ঈদের পর ২২ ও ২৩ আগস্ট দুই দিন অফিস খোলা। এই দুই দিন ঐচ্ছিক ছুটি মিললে টানা ১১ দিন ছুটি কাটানো যাবে। ফলে সরকারি চাকরিজীবীরা ১৪ আগস্ট রাতের টিকিট পেতে মরিয়া। কিন্তু গতকাল গাবতলী ও সায়েদাবাদে ১৪ আগস্টের টিকিট অনেকেই পাননি।
আজ শুরু ট্রেনের অগ্রিম : আজ ৫ আগস্ট রবিবার থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে। কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার কমলাপুর ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ৫ থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আন্তনগর ট্রেনের বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট বিক্রি করা হবে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৪ আগস্ট যাত্রার টিকিট ৫ আগস্ট, ১৫ আগস্ট যাত্রার টিকিট ৬ আগস্ট, ১৬ আগস্ট যাত্রার টিকিট ৭ আগস্ট, ১৭ আগস্ট যাত্রার টিকিট ৮ আগস্ট এবং ১৮ আগস্ট যাত্রার টিকিট ৯ আগস্ট বিক্রি করা হবে। এই সময়ে বিক্রীত অগ্রিম টিকিট ফেরত নেওয়া হবে না। এ সময় অগ্রিম টিকিটের পাশাপাশি চলতি টিকিট বিক্রিরও ব্যবস্থা থাকবে। একজন সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারবেন।

চট্টগ্রামে যাত্রীর ১১ তথ্য
আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে যাত্রীর ১১ তথ্য জমা নিয়ে ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি আজ থেকে শুরু হচ্ছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে সকাল ৯টায় ১৪ আগস্টে যাত্রার টিকিট বিক্রির মাধ্যমে চালু হচ্ছে এই কার্যক্রম। তবে গতকাল ৭ থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির দিন থাকায় এদিনও কাউন্টারের সামনে ছিল লম্বা লাইন। সকাল ১১টার দিকে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক যাত্রীকে ১১ তথ্যের যাত্রী বিবরণী ফরম পূরণ করে জমা দিতে হচ্ছে। ১৩ তারিখের সুবর্ণা ট্রেনের টিকিট কাটতে আসা নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যাত্রী বিবরণী ফরম পূরণ করে কাউন্টারে জমা দিলেই টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। যাত্রীদের জন্য তা একটু কষ্টকর হলেও এতে টিকিট কালোবাজারি কিছুটা কমে আসতে পারে।'
যাত্রী বিবরণী ফরমে টিকিট ক্রেতার নাম, ভ্রমণকারীর নাম, বর্তমান ঠিকানা, ভ্রমণের তারিখ, টিকিটের শ্রেণী, টিকিট সংখ্যা, ভ্রমণকারীর মোবাইল ফোন নম্বরসহ ১১ ধরনের তথ্য রয়েছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার এ এম সামসুল ইসলাম বলেন, 'কাউন্টার থেকে কেনা টিকিট দিয়ে নির্ধারিত ব্যক্তি ভ্রমণ করছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে টিকিট কালোবাজারি অনেকাংশে কমে আসবে।'
যাঁরা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনবেন, তাঁরা কম্পিউটারের প্রিন্ট আউট ২ নম্বর কাউন্টারে জমা দিয়ে প্রকৃত টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন বলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়।
দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে বিশেষ সার্ভিস
আমাদের বরিশাল অফিস জানায়, বরিশাল-ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হচ্ছে। গতকাল ঢাকায় লঞ্চ মালিক সমিতির এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, ১৪ আগস্ট থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত ঢাকার সদরঘাট থেকে নিয়মিত চারটি লঞ্চের সঙ্গে বিশেষ চারটিসহ মোট আটটি লঞ্চ বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। তবে যাত্রীর চাপ বেশি হলে লঞ্চের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। এ জন্য অন্তত দুই থেকে তিনটি লঞ্চ পন্টুনে প্রস্তুত রাখা হবে।
সাইদুর রহমান বলেন, একই নিয়মে ঈদের পরবর্তী সাত দিন বরিশাল আধুনিক নৌ বন্দর থেকে লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস অব্যাহত থাকবে। যাত্রীদের অগ্রিম টিকিট দেওয়া শুরু হবে ৮ অথবা ৯ আগস্ট। বিশেষ সার্ভিস চলাকালে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হবে না। বরিশাল-ঢাকা নৌপথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ভিআইপি কেবিন পাঁচ হাজার, ডাবল কেবিন এক হাজার ৯৬০, সিঙ্গেল কেবিন ৯৫০ এবং ডেক যাত্রীভাড়া ২৪০ টাকাই থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.