ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশের পর) তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আসলে কারা সক্রিয় ছিল? খোন্দকার মোস্তাকরা না অন্য কেউ? মোস্তাকদের তো এত শক্তি ছিল না যে তাজউদ্দীন আহম্মদের বিরুদ্ধে সফল হয়। দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল তাজউদ্দীন আহম্মদের।
শোনা যায় মন্ত্রিসভা থেকে বিদায়ের পর বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদ কোন এক সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। তাই দেখা যায় জাসদ সৃষ্টি এবং পরে তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরে শত্রুরা মুজিবের ওপর সরাসরি আক্রমণ চালায় এবং সফল হয়।
রক্ষীবাহিনী প্রসঙ্গে
দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, মোনেম খানের প্রশাসনযন্ত্রকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রশাসন চালাতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ দেশ স্বাধীন হলেও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যান্য সদস্যরা ঢাকায় আসেন ২২ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন ১০ জানুয়ারি। তখন আইনশৃঙ্খলার অবস্থা কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলে শাহাদৎ বরণ করে জাতির জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কিন্তু বিজয় অর্জনের পরে সুসংগঠিত বাহিনী হিসেবে তাদের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। এদের যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা বাদে অধিকাংশ পুলিশ স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে পাক বাহিনীর সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে থানার দায়িত্বেও তারাই ছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে রাজাকার আলবদরদের ফেলে দেয়া অস্ত্র নিয়ে ষোড়শ বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। তবুও একথা অস্বীকার করার জো নেই সে সময় পুলিশ বাহিনী না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যদের হাতে অস্ত্র থাকলেও ১৬ ডিসেম্বরের পর বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক লুটতরাজ হত্যার বিশেষ কোন ঘটনা ঘটেনি। এটা সম্ভব হয়েছিল এজন্য যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম ও সংগ্রামী চেতনা তখনো অটুট ছিল। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীর কাছে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অর্পিত হলেও তা তৎকালীন সময়ের জন্য ছিল একেবারেই অপ্রতুল।
সাবেক ইপিআরের অবস্থাও ছিল একই রকম। সে সময় পরিস্থিতি মোকাবেলার পর্যাপ্ত শক্তি তাদের ছিল না। সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল আরও খারাপ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নগণ্য সংখ্যক সৈনিক নিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর পুনর্গঠন শুরু হয়। পাকিস্তানে আটকেপড়া সৈনিকরা দেশে ফেরেন দুই বছর পরে। তবে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
বঙ্গবন্ধু ১৪ জানুয়ারি ’৭২ তারিখে এক বিবৃতিতে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ করতে নির্দেশ দিলেও (ক) যে সব চোর ডাকাত ২৫ মার্চ এবং তৎপরবর্তীকালে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল, (খ) ষোড়শ বাহিনী এবং (গ) অতি উচ্চাভিলাষী যারা পরবর্তীতে জাসদে যোগ দিয়েছিল তারা অস্ত্রসমর্পণ করেনি। এছাড়া অনেক রাজাকার আলবদর অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বহারা পার্টিতে আত্মগোপন করে। এমনি এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ’৭২ এক ঘোষণায় রক্ষীবাহিনী গঠন করেন। রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির বাস্তব আরও যে কারণ তা হচ্ছে কাদেরীয়া বাহিনীর দু’হাজার সদস্য বিডিআর বাহিনীতে নেয়ার কর্মসূচী শেষ পর্যন্ত ভ-ুল হলে তাদের দিয়ে আলাদা বাহিনী করা হয় বলে তৎকালীন সংশ্লিষ্টরা সাক্ষ্য দেন। রক্ষীবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে এবং কার্যাবলী সম্পর্কে এতদসংক্রান্ত আইনে বলা হয় যে, সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে এই বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলার কাজে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য নিয়োগ করতে পারবে। সরকার আহ্বান করলে এই বাহিনী সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে এবং সরকার নির্দেশিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে (অনুচ্ছেদ-১৮)। সরকার সুনির্দিষ্ট নিয়মে এই বাহিনী পরিচালনার জন্য একজন পরিচালক নিয়োগ করেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। উপ-পরিচালক ছিল সেনাবাহিনীর। রক্ষী বাহিনীর অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকে। রক্ষীবাহিনীকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল তা পুলিশের চাইতে বেশি ছিল না। তারা আসামি ধরে থানায় সোপর্দ করত। মামলা দেয়ার দায়িত্ব ছিল পুলিশেরই। কোন মন্ত্রীর বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করা হয়নি। সে সব কাজ পুলিশেই করত।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কোন রক্ষীবাহিনী ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা থেকে। এর প্রধানত যে সব দায়িত্ব পাল করেছিল তার মধ্যে বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার অবৈধ গুদামজাত কালোবাজারি বন্ধ করা, চোরাচালান রোধ করা এবং সে বিষয়ে তারা সফলতার পরিচয় দিয়েছে। রক্ষীবাহিনীর নাম শুনলে চোরাচালান ও অবৈধ গুদামজাতকারীরা আতঙ্ক বোধ করত। এরা প্রচুর অস্ত্র, চোরাচালান পণ্য উদ্ধার ও আটক করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৩-৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণবাহিনীর সঙ্গে অসংখ্য সংঘর্ষ বাধে। রক্ষীবাহিনী দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগের লোকদেরও রেহাই দেয়নি। তবে সে সময় গুপ্ত হত্যার অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছিল সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে কিন্তু দোষ চাপানো হয়েছে রক্ষীবাহিনীর ওপর। আওয়ামী লীগের ৪ জন গণপরিষদ সদস্য এবং অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মীকে জাসদ গণবাহিনী-সর্বহারা পার্টি হত্যা করেছে।
রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর চাইতে উচ্চতর সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যে অপপ্রচার চালানো হয় তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়, কেননা রক্ষীবাহিনী যেহেতু একটি নতুন বাহিনী, তাদের জন্য নতুন অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক পরিচ্ছদ দিতে হয়েছিল। তার অর্থ এই দাঁড়ায় না যে সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষীবাহিনীর (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে) চাইতে অনেক অনেক বেশি দিয়েছিলেন। সীমিত সম্পদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত সেনানিবাসগুলোকে পুনর্গঠন, নতুন করে নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাদের সুযোগ-সুবিধাও যথারীতি অব্যাহত ছিল। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হোক না কেন ক্ষেত্রবিশেষে ভুল বোঝাবুঝিজনিত কারণে বাড়াবাড়ি হয়েছে হয়ত কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ কোনদিনে আনতে পারেনি এবং বঙ্গবন্ধু পরিবর্তনকালে জিয়াউর রহমান তাদের সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত পদমর্যাদায় আত্তীকরণ অনুষ্ঠানে বলেন যে, রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার হয়েছে তা সত্য নয়। এখন দেখছি তাদের গাড়ি, পোশাক, অস্ত্র সেনাবাহিনীর চেয়ে ভাল ছিল না। বেতনও বেশি ছিল না (চিত্র বাংলা, ২১-২৭ মে, ১৯৯২)। উল্লেখ্য, জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমলেও রক্ষী কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ছিলেন এবং ২০১২ সালেও আছেন।
ভারত প্রসঙ্গ
ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেতন ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সাহায্যের প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলনকালে (’৭১) অন্তত দুবার (৬ ও ১৭ মার্চ) তাজউদ্দীন আহমদকে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকার ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের কাছে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর স্বনামধন্য তোফায়েল আহমদ জনকণ্ঠে (১২/৩/১২) লিখেছেন বঙ্গবন্ধু ১৭/২/৭১ তারিখে শেখ মনি রাজ্জাক-সিরাজুল আলম খান-তোয়ায়েলদের (৪ জন) বলেন কলকাতার চিত্তরঞ্জন সুতারেব ঠিকানা (২১নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা) মুখস্থ কর। ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্ত সুতারকে বঙ্গবন্ধু আগেই ভারতে পাঠিয়ে দেন।” (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
রক্ষীবাহিনী প্রসঙ্গে
দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, মোনেম খানের প্রশাসনযন্ত্রকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রশাসন চালাতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ দেশ স্বাধীন হলেও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যান্য সদস্যরা ঢাকায় আসেন ২২ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন ১০ জানুয়ারি। তখন আইনশৃঙ্খলার অবস্থা কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলে শাহাদৎ বরণ করে জাতির জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কিন্তু বিজয় অর্জনের পরে সুসংগঠিত বাহিনী হিসেবে তাদের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। এদের যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা বাদে অধিকাংশ পুলিশ স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে পাক বাহিনীর সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে থানার দায়িত্বেও তারাই ছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে রাজাকার আলবদরদের ফেলে দেয়া অস্ত্র নিয়ে ষোড়শ বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। তবুও একথা অস্বীকার করার জো নেই সে সময় পুলিশ বাহিনী না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যদের হাতে অস্ত্র থাকলেও ১৬ ডিসেম্বরের পর বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক লুটতরাজ হত্যার বিশেষ কোন ঘটনা ঘটেনি। এটা সম্ভব হয়েছিল এজন্য যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম ও সংগ্রামী চেতনা তখনো অটুট ছিল। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীর কাছে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অর্পিত হলেও তা তৎকালীন সময়ের জন্য ছিল একেবারেই অপ্রতুল।
সাবেক ইপিআরের অবস্থাও ছিল একই রকম। সে সময় পরিস্থিতি মোকাবেলার পর্যাপ্ত শক্তি তাদের ছিল না। সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল আরও খারাপ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নগণ্য সংখ্যক সৈনিক নিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর পুনর্গঠন শুরু হয়। পাকিস্তানে আটকেপড়া সৈনিকরা দেশে ফেরেন দুই বছর পরে। তবে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
বঙ্গবন্ধু ১৪ জানুয়ারি ’৭২ তারিখে এক বিবৃতিতে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ করতে নির্দেশ দিলেও (ক) যে সব চোর ডাকাত ২৫ মার্চ এবং তৎপরবর্তীকালে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল, (খ) ষোড়শ বাহিনী এবং (গ) অতি উচ্চাভিলাষী যারা পরবর্তীতে জাসদে যোগ দিয়েছিল তারা অস্ত্রসমর্পণ করেনি। এছাড়া অনেক রাজাকার আলবদর অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বহারা পার্টিতে আত্মগোপন করে। এমনি এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ’৭২ এক ঘোষণায় রক্ষীবাহিনী গঠন করেন। রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির বাস্তব আরও যে কারণ তা হচ্ছে কাদেরীয়া বাহিনীর দু’হাজার সদস্য বিডিআর বাহিনীতে নেয়ার কর্মসূচী শেষ পর্যন্ত ভ-ুল হলে তাদের দিয়ে আলাদা বাহিনী করা হয় বলে তৎকালীন সংশ্লিষ্টরা সাক্ষ্য দেন। রক্ষীবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে এবং কার্যাবলী সম্পর্কে এতদসংক্রান্ত আইনে বলা হয় যে, সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে এই বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলার কাজে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য নিয়োগ করতে পারবে। সরকার আহ্বান করলে এই বাহিনী সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে এবং সরকার নির্দেশিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে (অনুচ্ছেদ-১৮)। সরকার সুনির্দিষ্ট নিয়মে এই বাহিনী পরিচালনার জন্য একজন পরিচালক নিয়োগ করেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। উপ-পরিচালক ছিল সেনাবাহিনীর। রক্ষী বাহিনীর অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকে। রক্ষীবাহিনীকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল তা পুলিশের চাইতে বেশি ছিল না। তারা আসামি ধরে থানায় সোপর্দ করত। মামলা দেয়ার দায়িত্ব ছিল পুলিশেরই। কোন মন্ত্রীর বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করা হয়নি। সে সব কাজ পুলিশেই করত।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কোন রক্ষীবাহিনী ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা থেকে। এর প্রধানত যে সব দায়িত্ব পাল করেছিল তার মধ্যে বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার অবৈধ গুদামজাত কালোবাজারি বন্ধ করা, চোরাচালান রোধ করা এবং সে বিষয়ে তারা সফলতার পরিচয় দিয়েছে। রক্ষীবাহিনীর নাম শুনলে চোরাচালান ও অবৈধ গুদামজাতকারীরা আতঙ্ক বোধ করত। এরা প্রচুর অস্ত্র, চোরাচালান পণ্য উদ্ধার ও আটক করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৩-৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণবাহিনীর সঙ্গে অসংখ্য সংঘর্ষ বাধে। রক্ষীবাহিনী দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগের লোকদেরও রেহাই দেয়নি। তবে সে সময় গুপ্ত হত্যার অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছিল সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে কিন্তু দোষ চাপানো হয়েছে রক্ষীবাহিনীর ওপর। আওয়ামী লীগের ৪ জন গণপরিষদ সদস্য এবং অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মীকে জাসদ গণবাহিনী-সর্বহারা পার্টি হত্যা করেছে।
রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর চাইতে উচ্চতর সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যে অপপ্রচার চালানো হয় তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়, কেননা রক্ষীবাহিনী যেহেতু একটি নতুন বাহিনী, তাদের জন্য নতুন অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক পরিচ্ছদ দিতে হয়েছিল। তার অর্থ এই দাঁড়ায় না যে সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষীবাহিনীর (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে) চাইতে অনেক অনেক বেশি দিয়েছিলেন। সীমিত সম্পদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত সেনানিবাসগুলোকে পুনর্গঠন, নতুন করে নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাদের সুযোগ-সুবিধাও যথারীতি অব্যাহত ছিল। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হোক না কেন ক্ষেত্রবিশেষে ভুল বোঝাবুঝিজনিত কারণে বাড়াবাড়ি হয়েছে হয়ত কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ কোনদিনে আনতে পারেনি এবং বঙ্গবন্ধু পরিবর্তনকালে জিয়াউর রহমান তাদের সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত পদমর্যাদায় আত্তীকরণ অনুষ্ঠানে বলেন যে, রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার হয়েছে তা সত্য নয়। এখন দেখছি তাদের গাড়ি, পোশাক, অস্ত্র সেনাবাহিনীর চেয়ে ভাল ছিল না। বেতনও বেশি ছিল না (চিত্র বাংলা, ২১-২৭ মে, ১৯৯২)। উল্লেখ্য, জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমলেও রক্ষী কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ছিলেন এবং ২০১২ সালেও আছেন।
ভারত প্রসঙ্গ
ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেতন ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সাহায্যের প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলনকালে (’৭১) অন্তত দুবার (৬ ও ১৭ মার্চ) তাজউদ্দীন আহমদকে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকার ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের কাছে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর স্বনামধন্য তোফায়েল আহমদ জনকণ্ঠে (১২/৩/১২) লিখেছেন বঙ্গবন্ধু ১৭/২/৭১ তারিখে শেখ মনি রাজ্জাক-সিরাজুল আলম খান-তোয়ায়েলদের (৪ জন) বলেন কলকাতার চিত্তরঞ্জন সুতারেব ঠিকানা (২১নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা) মুখস্থ কর। ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্ত সুতারকে বঙ্গবন্ধু আগেই ভারতে পাঠিয়ে দেন।” (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
No comments