পাখির চোখে-বাংলা ভাষার উত্তরাধিকার ও কিছু ভাবনা by জাহানার নওশীন

গত শতাব্দীর বায়ান্ন সালে আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটে গেছে, তারপর আবার আমাদের মাতৃভাষার জন্য প্রতিবাদী কলম ধরে বাদানুবাদ বা প্রতিবাদের যুদ্ধে নামতে হবে তা কি ভাবা যায়? কিন্তু তা ঘটছে। বাঙালি জাতি হিসেবে যেমন তার গৌরবের অনেক কিছু আছে তেমনি তার হটকারিতার আবেগী কর্মকাণ্ডে অনেক প্রাপ্তি ও চূড়ান্ত বোকামিও আছে।


আমরা প্রায়ই যেকোনো একটা বিষয়ের ফ্যাকড়া বের করে তাকে কচলে কচলে সুস্বাদু লেবু তেতো করার মতো শুধু বিস্বাদই করি তা নয়, তাকে নিয়ে বিপজ্জনক কাণ্ডও ঘটিয়ে ফেলি। উদাহরণ দেওয়ার দরকার নেই, উদাহরণ অনেক এবং সবাই তা জানেন। কোনো কোনো বিষয়ে আমরা অনেক বিপত্তি সৃষ্টিও করি, শেষ পর্যন্ত তা জাতীয় পর্যায়ে পেঁৗছে বিপর্যয়ের উত্তাল অবস্থায় সৃষ্টি করে ফেলে। ১৯৫২ সালে যাঁরা মাতৃভাষার জন্য ঢাকার রাস্তা রক্ত-পিচ্ছিল করেছিলেন তারা নেই, কিন্তু যাঁরা তাঁদের পতাকা বহন করেছিলেন, দেশকে একসূত্রে গ্রথিত করে দাবি আদায় করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো জীবিত, তাঁদের বিস্তারিত বর্ণনার অভিঘাত নতুন প্রজন্মকেও সিদ্ধিলাভে অনুপ্রাণিত করেনি কি? তার পরও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে কিছু বুদ্ধিজীবী ও লেখকের বিরুদ্ধে খুব দুঃখজনক এই ঘটনা। কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবী বলতে চাইছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা বাংলাদেশের ভাষা হবে কেন?' পূর্ববঙ্গের ভাষা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে পৃথক করতে হবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষরা যেভাবে বা ভাষায় কথা বলি, আমাদের লিখিত ভাষাও তেমনি হতে হবে। আমরা সাহিত্যচর্চায় এবং সর্বক্ষেত্রে সেই ভাষা ব্যবহার করব বা করতে চাই। সে তো করা হচ্ছেই। আমাদের উপন্যাসে, ছোটগল্পের সংলাপে তো চরিত্রানুযায়ী সম্পূর্ণ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার কথ্য বাংলায়ই ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর আর কী পরিবর্তন হবে, বুঝতে আমাদের অসুবিধা লাগছে। তবে কি বাংলাদেশের কথ্য বাংলা বাংলা ভাষা নয়? আমরা তো মনে করি পূর্ববঙ্গীয় ভাষা সম্পূর্ণত বাংলা ভাষাই শুধু উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের জন্য অন্য রকম শোনায়। শুধু উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে ভাষাকে পৃথক্করণ করা যায়? এটা করা মানে মায়ে-ছেলে বা ভায়ে ভায়ে পৃথগন্ন হওয়ার মতো সর্বনেশে। আমরা সংসার ভাঙার সেই সর্বনেশে পথ অনুসরণ করতে চাইছি? সেটা কি এই জন্য যে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়া_দ্যাখো, আমার দেশের মতো আমার ভাষাও আলাদা? বেশ তো নামেই পৃথক কিন্তু ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আলাদা করতে পারব তো? হাজার হাজার বছর একসঙ্গে থাকার জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে গ্লানিমুক্ত হতে পারব তো? আমাদের বিভিন্ন জেলায় যে ভাষা কথ্য হিসেবে ব্যবহার হয় তা কি বাংলা ভাষা নয়? দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যায় (বলে রাখি; এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি দেওয়া যায়) যেমন চট্টগ্রামের 'বেগ্গুন' বা 'বেগ্গিন' শব্দটি।
এর ব্যুৎপত্তিস্থল অনুশীলন করলেই বেরিয়ে আসবে যে 'বেবাকগুলিন'_সংক্ষেপে বেগ্গিন বা বেগ্গুন শব্দটি। চিরুনিকে বলা হয় উনি_শব্দটি চিরুনির সংক্ষিপ্ত রূপ মাত্র। 'আমরা' শব্দটি হয় গেছে 'আঁ রা'_এই রকম। এই সংক্ষিপ্তকরণ ব্যাপারটিও হয়েছে ভৌগোলিক কারণে। নদী আর সমুদ্রের মোহনা নিয়ে যাদের জীবনযুদ্ধ তাদের সময় কোথায় নদীয়া, শান্তিপুরের বা পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনেক জেলার কথার মতো বিছিয়ে বিছিয়ে উচ্চারণ করে শব্দ বিস্তারের?
বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ কতগুলো আর? আমরা ধার করেছি, না বলে বরং বলি, গ্রহণ করেছি আরবি, ফার্সি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ আর বলাবাহুল্য ইংরেজি থেকে। এসবই আমাদের লব্জে চলে এসেছে সঠিক ভাবটি প্রকাশের জন্য, জোর করে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। আর সংস্কৃত শব্দ থেকে তদ্ভব, তৎসম শব্দরাজিও তাই। এখন তদ্ভব, তৎসম শব্দরাজিই যদি আমাদের পৃথক্করণের কারণ হয় এবং সেসব শব্দরাজি যদি ঝেড়ে ফেলতে হয়, তাহলে 'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়' প্রবাদ বাক্যটি বেশ জুৎসই হয়ে আমাদের ঘরে বসবে। তখন শূন্য ঝুলি সার করে 'ভিক্ষা দাও গো জগৎবাসী' করে বেড়াতে হবে না তো? ভাষা তো তৈরি করা যায় না ইচ্ছেমতো। সে প্রয়োজনে আপনাআপনি হয়ে ওঠে। নদীর স্রোত যেমন পলি রেখে যায় তেমনি শব্দ ও মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহারে ও প্রয়োজনে তলানি গেঁথে যায়। তারপর তা ব্যবহারে ব্যবহারে শক্ত সড়ক তৈরি করে যায়, যার ওপর দিয়ে আমরা বেশ গড়গড়িয়ে হেঁটে, চড়ে বেড়াই আর ভাববিনিময়ে বিনাশ্রমে তা ব্যবহার করে জীবন যাপন করি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে। ভাষাটা যখন এমনি করে হয়ে ওঠার ব্যাপার এখন তাকে নিয়ে কিছু করতে চাইলেই কী করা যাবে? তবে একটা জিনিস বেশ হয়ে উঠতে পারে বটে, যাকে বলে হ-য-ব-র-ল। পুনর্গঠনের আর্কিটেকটরা তখন 'বাঁ'ও পাবেন তো? এমন সর্বনাশা ঐতিহ্য বিনষ্টির অশনি তৈরি করা কি ঠিক হবে?
ভাষার এই ডামাডোল সৃষ্টির প্রসঙ্গে আর একটি ডামাডোলের কথা একটু বলে লেখাটি শেষ করব। আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কিছু ছাত্রছাত্রীর বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধাও অনীহা প্রকাশের কথা একটু বলি। তাদের বাংলা ভাষার প্রতি উন্নাসিকতা কোথায় পেঁৗছেছে, তার আন্দাজ পেয়ে যে কেউ স্তম্ভিত হতে পারেন। ওই সব স্কুলের জনৈক শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছি_ছাত্রছাত্রীরা বলে, বাংলা 'আস্লি' ভাষা ও ভাষা শিখে কী হবে? পৃথিবীর মধ্যে ক'জায়গায় এই ভাষা ব্যবহার হয়? ইংরেজি ভাষা সর্বজনবোধ্য। এ কারণে তারা স্কুলে বা বাইরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে না। অনেক অভিভাবক ও সন্তানের এই বাহাদুরিতে নাকি গর্বিত বোধ করেন। শুনে চমৎকৃত হতে হয়। তবে আশার কথা, তারা ১৬ কোটি, ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কয়জন? তবু এই অশ্রদ্ধা আমাদের কষ্ট দেয়_কেন এমন হবে? কেন আমরা তাদের ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারিনি? দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে পারিনি? সে অপরাধও আমাদেরই।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.