মাহে রমজানের ফাজায়েল ও মাসায়েল by মাওলানা এম এ করিম ইবনে মছব্বির
বছর ঘুরে ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে রহমত, মাগফিরাত ও দোজখ থেকে নাজাতের মাস রমজান। যে বরকতময় মাসে প্রিয়নবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল বিশ্বের মানবজাতির একমাত্র পরিচালনার গাইড মহাগ্রন্থ আল-কোরআন।
আরবি সাওম শব্দের বহুবচন হচ্ছে সিয়াম। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো ধরনের পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকা। এ সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, আদম সন্তানের নেক আমলের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহপাক বলেন, 'সিয়াম আমার জন্য এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই। কেননা সিয়াম পালনকারীরা একমাত্র আমারই সন্তুষ্টির উদ্দেশে পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পরিত্যাগ করে থাকে।' কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- হে ইমানদাররা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাক্বওয়া বা সাবধানতা অবলম্বন করতে পার।
কারা রোজা রাখবে : এ মাসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, রোগী, মুসাফির, পাগল, হায়েজ-নেফাসসম্পন্ন মহিলা ও শরয়ী পরিভাষায় অক্ষম ব্যতীত প্রত্যেক নর-নারীর ওপর রোজা পালন করা ফরজ।
রোজার নিয়ত : নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রামদানিল মুবারাকি, ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিনি্ন ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম। অর্থাৎ 'হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল রমজানের রোজা রাখার নিয়ত করছি। যা তোমার পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।
সেহেরি : সেহেরি খাওয়া সুন্নত। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'আমাদের এবং আহলে কিতাবের (ইহুদি-নাসারা) রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো আমরা সেহেরি খাই, তারা খায় না।' তিনি আরো বলেন, 'তোমরা সেহেরি খাও, কারণ এর মধ্যে বরকত নিহিত আছে।'
সেহেরির সময় : হাদিসের আলোকে জানা যায়, সেহেরি খাওয়া রাতের শেষভাগেই উত্তম। হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) হুজুরের জামানার কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমরা মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সেহেরি খেয়েছি। তারপর নামাজে (ফজরের জন্য) দাঁড়িয়েছি। জিজ্ঞাসা করা হলো উভয়ের (সেহেরি ও নামাজের) মধ্যে কতটুকু ব্যবধান ছিল? হজরত জায়েদ (রা.) বললেন, ৫০টি আয়াত তেলাওয়াত করতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু।
ইফতার : সূর্যাস্তের পরপরই ইফতার করা উত্তম। মহানবী (সা.) বলেন, মানুষ তত দিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যত দিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে।
ইফতারের দোয়া : 'আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।' অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি তোমার নামে রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দ্বারাই ইফতার করছি।
ইফতার করানোর ফজিলত : মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় সে ওই রোজাদারের সমান সাওয়াব পায়। অথচ ওই রোজাদারের ভাগ থেকে কিছু মাত্র কম করা হবে না।
তারাবির নামাজ : রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ফরজ এবং এশার নামাজের পর ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
তারাবি নামাজের নিয়ত : নাওয়াইতুআন উসালি্লয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকাতাই সালাতিত তারাবিহ, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তায়ালা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার। প্রতি চার রাকাত পরপর বিশ্রাম নেওয়া মুস্তাহাব। এ সময়ে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়া যায়- সুবহানা জিল মূলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাজিল ইজ্জাতি, ওয়াল আজমাতি ওয়াল হায়বাতি, ওয়াল কুদরাতি, ওয়াল কিবরিয়ায়ি, ওয়াল জাবারুত, সুবহানাজিল মালিকিল হায়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা, সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মলায়িকাতি ওয়ার রূহ।
যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় : রোজা রেখে শরিয়তসম্মত কারণ ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা ও স্ত্রী সম্ভোগ করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। আর এতে কাজা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব। অনিচ্ছাকৃত অজু, গোসলের পানি বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য গলায় চলে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়। এতে শুধু কাজা ওয়াজিব। নাকের ছিদ্রপথে কোনো কিছু পেটে গেলে, দাঁতের মধ্যকার কোনো খাদ্য বুট পরিমাণ পেটে গেলে, মুখভরা বমি মুখের ভেতরে এসে আবার পেটে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। এতে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। নিদ্রা অবস্থায় কেউ কিছু খাইয়ে দিলে, পেটে বা মাথার ক্ষতস্থানে লাগানো ওষুধ পেটে বা মস্তিষ্কে ঢুকলে, কানের মধ্য দিয়ে কোনো কিছু খেলে, ইফতারের সময় হয়েছে মনে করে রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার বা স্ত্রী সম্ভোগ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে এতে রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে বলে মনে করে আবার এ কাজগুলো যদি কেউ করে, তাহলে কাজা ওয়াজিব হবে।
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ : অনর্থক কোনো কিছু চিবানো, শরিয়তসম্মত কারণ (যেমন বদরাগী স্বামী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তরকারিতে লবণ হয়েছে কি না দেখা) ব্যতীত কোনো কিছুর স্বাদ গ্রহণ করা, গরম ও পিপাসা হালকা করার উদ্দেশে ইচ্ছাকৃত বেশি পানি ব্যবহার করা, গীবত, মিথ্যা অশ্লীল কথা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া, টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা মাজন দ্বারা দিনের বেলায় দাঁত পরিষ্কার করা।
রোজার ফিদিয়া : রোজার পরিবর্তে যে সদকা প্রদান করা হয় তাকে ফিদিয়া বলা হয়। বয়োবৃদ্ধ যার রোজা রাখার কোনো শক্তি নেই বা এত দুর্বল হয়ে গেছেন যে তাঁর আর ভালো হওয়ার আশা নেই। এরূপ লোকদের ফিদিয়া আদায় করতে হবে।
ফিদিয়ার পরিমাণ : একটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দুই বেলা পেট ভরে খানা খাওয়াতে হবে। না হয় একটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে সদকায়ে ফিতরা পরিমাণ গম, আটা বা শুকনো আঙুর অর্ধ 'সা' অর্থাৎ (পৌনে ২ সের বা ১ কেজি ৭০৬ গ্রাম) আর খোরমা, যব বা তার সমান আটা এক 'সা' (অর্থাৎ ৩ কেজি ৪১২ গ্রাম) পৌনে দুই সের গম অথবা সমপরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখ্য, ফিদিয়া আদায় করা ওয়াজিব।
লেখক : ইসলামী গবেষক।
কারা রোজা রাখবে : এ মাসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, রোগী, মুসাফির, পাগল, হায়েজ-নেফাসসম্পন্ন মহিলা ও শরয়ী পরিভাষায় অক্ষম ব্যতীত প্রত্যেক নর-নারীর ওপর রোজা পালন করা ফরজ।
রোজার নিয়ত : নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রামদানিল মুবারাকি, ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিনি্ন ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম। অর্থাৎ 'হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল রমজানের রোজা রাখার নিয়ত করছি। যা তোমার পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।
সেহেরি : সেহেরি খাওয়া সুন্নত। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'আমাদের এবং আহলে কিতাবের (ইহুদি-নাসারা) রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো আমরা সেহেরি খাই, তারা খায় না।' তিনি আরো বলেন, 'তোমরা সেহেরি খাও, কারণ এর মধ্যে বরকত নিহিত আছে।'
সেহেরির সময় : হাদিসের আলোকে জানা যায়, সেহেরি খাওয়া রাতের শেষভাগেই উত্তম। হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) হুজুরের জামানার কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমরা মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সেহেরি খেয়েছি। তারপর নামাজে (ফজরের জন্য) দাঁড়িয়েছি। জিজ্ঞাসা করা হলো উভয়ের (সেহেরি ও নামাজের) মধ্যে কতটুকু ব্যবধান ছিল? হজরত জায়েদ (রা.) বললেন, ৫০টি আয়াত তেলাওয়াত করতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু।
ইফতার : সূর্যাস্তের পরপরই ইফতার করা উত্তম। মহানবী (সা.) বলেন, মানুষ তত দিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যত দিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে।
ইফতারের দোয়া : 'আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।' অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি তোমার নামে রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দ্বারাই ইফতার করছি।
ইফতার করানোর ফজিলত : মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় সে ওই রোজাদারের সমান সাওয়াব পায়। অথচ ওই রোজাদারের ভাগ থেকে কিছু মাত্র কম করা হবে না।
তারাবির নামাজ : রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ফরজ এবং এশার নামাজের পর ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
তারাবি নামাজের নিয়ত : নাওয়াইতুআন উসালি্লয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকাতাই সালাতিত তারাবিহ, সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তায়ালা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার। প্রতি চার রাকাত পরপর বিশ্রাম নেওয়া মুস্তাহাব। এ সময়ে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়া যায়- সুবহানা জিল মূলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাজিল ইজ্জাতি, ওয়াল আজমাতি ওয়াল হায়বাতি, ওয়াল কুদরাতি, ওয়াল কিবরিয়ায়ি, ওয়াল জাবারুত, সুবহানাজিল মালিকিল হায়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা, সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মলায়িকাতি ওয়ার রূহ।
যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় : রোজা রেখে শরিয়তসম্মত কারণ ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা ও স্ত্রী সম্ভোগ করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। আর এতে কাজা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব। অনিচ্ছাকৃত অজু, গোসলের পানি বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য গলায় চলে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়। এতে শুধু কাজা ওয়াজিব। নাকের ছিদ্রপথে কোনো কিছু পেটে গেলে, দাঁতের মধ্যকার কোনো খাদ্য বুট পরিমাণ পেটে গেলে, মুখভরা বমি মুখের ভেতরে এসে আবার পেটে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। এতে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে। নিদ্রা অবস্থায় কেউ কিছু খাইয়ে দিলে, পেটে বা মাথার ক্ষতস্থানে লাগানো ওষুধ পেটে বা মস্তিষ্কে ঢুকলে, কানের মধ্য দিয়ে কোনো কিছু খেলে, ইফতারের সময় হয়েছে মনে করে রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার বা স্ত্রী সম্ভোগ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে এতে রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে বলে মনে করে আবার এ কাজগুলো যদি কেউ করে, তাহলে কাজা ওয়াজিব হবে।
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ : অনর্থক কোনো কিছু চিবানো, শরিয়তসম্মত কারণ (যেমন বদরাগী স্বামী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তরকারিতে লবণ হয়েছে কি না দেখা) ব্যতীত কোনো কিছুর স্বাদ গ্রহণ করা, গরম ও পিপাসা হালকা করার উদ্দেশে ইচ্ছাকৃত বেশি পানি ব্যবহার করা, গীবত, মিথ্যা অশ্লীল কথা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া, টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা মাজন দ্বারা দিনের বেলায় দাঁত পরিষ্কার করা।
রোজার ফিদিয়া : রোজার পরিবর্তে যে সদকা প্রদান করা হয় তাকে ফিদিয়া বলা হয়। বয়োবৃদ্ধ যার রোজা রাখার কোনো শক্তি নেই বা এত দুর্বল হয়ে গেছেন যে তাঁর আর ভালো হওয়ার আশা নেই। এরূপ লোকদের ফিদিয়া আদায় করতে হবে।
ফিদিয়ার পরিমাণ : একটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দুই বেলা পেট ভরে খানা খাওয়াতে হবে। না হয় একটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে সদকায়ে ফিতরা পরিমাণ গম, আটা বা শুকনো আঙুর অর্ধ 'সা' অর্থাৎ (পৌনে ২ সের বা ১ কেজি ৭০৬ গ্রাম) আর খোরমা, যব বা তার সমান আটা এক 'সা' (অর্থাৎ ৩ কেজি ৪১২ গ্রাম) পৌনে দুই সের গম অথবা সমপরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখ্য, ফিদিয়া আদায় করা ওয়াজিব।
লেখক : ইসলামী গবেষক।
No comments