চালচিত্র-বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রক্তাক্ত অমর একুশ ও তার অর্জন by শুভ রহমান

সাঙ্গ হয়ে এল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সদ্য অতিক্রান্ত হলো রক্তাক্ত অমর শহীদ দিবস, যা একাধারে ভাষা দিবস হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকে। মনীষী নন্দনতান্ত্রিক দার্শনিক ও সাম্যবাদের পুনরুত্থানের ভবিষ্যদ্বাদী সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের কথা আমরা প্রায় বিস্মৃতই হয়ে গেছি।


এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষের বছর। এ উপলক্ষে সম্প্রতি উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এক সেমিনারের আয়োজন করে। এরপর বর্ষব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হওয়ার কথা। আমাদের বিরল সৌভাগ্য ষাটের দশকে আমরা এই মনীষীর সংস্পর্শে এসেছিলাম 'সংবাদ'-এ কাজ করতে গিয়ে। সে সময় রণেশদা একটা কথা আমাদের বারবারই স্মরণ করিয়ে দিতেন। একুশ শুধু অমর একুশ নয়, রক্তাক্ত অমর একুশ লিখতে হবে। একুশে রাজপথে মাতৃভাষার জন্য ছাত্র-জনতার রক্তদানকে তিনি সর্বোচ্চ মূল্য দিতেন এবং সে রক্তদানের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করে রাখতে বলতেন। রক্তদানের পুণ্যেই একুশ সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে আমাদের কালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ ও তার সফল পরিণতি স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্তদান আমাদের বৃথা যায়নি। শুধু বাঙালি জাতি ও নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠীগুলোর একটি স্বাধীন দেশই নয়, প্রত্যেকের মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার অবলুপ্তির গ্রাস থেকে বিকৃতি ও বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্য থেকে, ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের থাবা থেকে মুক্ত করে স্বাধীন চর্চা ও বিকাশের অকল্পনীয় সুযোগ এনে দিয়েছে। সর্বোপরি আজ এই মহান একুশ একাধারে প্রবাসী বাঙালি, জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকো ও কিছু বিশ্বপ্রেমিক বিদেশি নাগরিক এবং আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করেছে। বিশ্বের কোনো জাতির ভাষার জন্য রক্তদান এত সুবিশাল অর্জনের অধিকারী হতে পারেনি।
আমরা শুধু স্বাধীনভাবে অকুতোভয়ে মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ, ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অবাধ ও বিজ্ঞানসম্মত চর্চা ও বিকাশের অধিকারই অর্জন করিনি, অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো এক মহা আকর্ষণীয় ও অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যও গড়ে তুলতে পারছি। এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা বা চলতি কথায় একুশের বইমেলা বাঙালি জাতি ও এ স্বাধীন ভূখণ্ডের নৃতাত্তি্বক আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর নিজ নিজ মেধা ও মননের, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সুদূরপ্রসারী এবং বিশ্বমানের বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বয়ে এনেছে।
রক্তাক্ত একুশ যেভাবে আমাদের রুদ্ধ প্রাণের অর্গল হাট করে খুলে দিয়েছে, তাতে অনেক সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ভাষা-সংস্কৃতির গোপন শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও কারসাজি সব কিছু শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠে আমরা যে একদিন বিশ্বসাহিত্য সংস্কৃতির সেরা আসন অধিকার করতে সক্ষম হব_এতে আমাদের কোনোই সন্দেহ নেই। আজ এক রবীন্দ্রনাথই বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে বাঙালি ভাষাভাষীর মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছেন, সেদিনও খুব বেশি দূরে নয়, এই ভূখণ্ড থেকেই আরো অজস্র রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও নজরুল, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মেঘনাদ সাহা, অমর্ত্য সেন, জগদীশ বোস, সত্যেন বোস বিশ্বসভায় বাঙালি জাতির গৌরবগাথা-কীর্তিত হওয়ার মতো বিরল সব অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
খেলাধুলার জগতেও আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। আমরা আমাদের রাজধানীতে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-কে ধারণ করছি এবং তার উদ্বোধনে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারীও হয়েছি। একদিন আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল ও অলিম্পিকেও স্থান করে নিতে সক্ষম হব। সেদিনও বেশি দূরে নয়। শুধু এর পূর্বশত, যা একান্তভাবেই সচেতন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অধিকারী ও আপসহীনভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী, জনগণের সেই নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতও থাকতে হবে।
এবারের একুশে অতীতের ভাষা দিবসগুলোর চেয়ে অনেক বেশি উৎস সন্ধানী, ভাষার ও সংস্কৃতির প্রচলন, ব্যবহার, চর্চা, বিকাশ ও সমৃদ্ধি সাধনে অনেক বেশি সচেতন, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নৈরাজ্য মুক্তিপ্রয়াসী এবং সে কারণেই অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিবহ ও ভরসার স্থল। এবারই সচেতনভাবে দেশের সব জনগোষ্ঠীর নিরক্ষরতা দূর করা, হাতেখড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশগড়ার পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষা ও স্বয়ম্ভরতায় স্বাবলম্বী হওয়ার ওপর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবার একুশেই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠনে সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। ২০১১ সালের মধ্যে শতভাগ ভর্তির পরিসংখ্যান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রকল্পের জন্য যে দাতাদের অর্থসহায়তা না করার কারণে এ প্রকল্পের কার্যক্রমও শুরু করা যায়নি। সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং সংকট উত্তরণে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। এগুলো একদিকে যেমন হতাশার কথা, তেমন সে হতাশা ঝেড়ে ফেলার কিছু তাগিদের আভাসও দেয় বৈকি। আমাদের ভুললে চলবে না, বর্তমান ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেই যুগান্তকারী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত ও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, দেশবাসীর ভরসাযোগ্য শিক্ষামন্ত্রী নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এ সরকারের আমলেই শিশুনীতিও প্রণীত ও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিকে কথা দিয়েছেন, কোনো শিশুকেই নিরাশ্রয় হয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্রহারা হয়ে পথে পথে ঘুরতে দেওয়া হবে না। সে প্রতিশ্রুতির বড় রকম বাস্তবায়ন দেশবাসী বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেই দেখার প্রত্যাশা রাখে।
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি একুশ ও ভাষার মাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবেই বাংলা বানান ও উচ্চারণ রীতির বিভ্রাটের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। শুধু দেশ ও মানুষের মুক্তিই যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে নিশ্চিত ও অর্থবহ করে তা নয়, সে জন্য ভাষা-সংস্কৃতির মুক্তিও একান্তভাবেই অপরিহার্য। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী বাংলা বানান ও উচ্চারণ রীতি নিয়ে বিভ্রাট থাকার কথা জানিয়ে বলেছেন, এ বিভ্রাট দূর করতে ভাষাবিদদের সক্রিয় হতে হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত একটি বানান ও উচ্চারণ রীতি তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বস্তুত ভাষা দিবস এবার অতীতের চেয়ে অনেক বেশি অনুসন্ধানী আলোকপাত করেছে ভাষা-সংস্কৃতির বহুবিধ বিষয়ের প্রতিই। প্রসঙ্গত, আমরা একুশের বইমেলায় সৃজনশীল বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশকদের অধিকতর দায়িত্বসচেতন হওয়ার প্রতিও বিনীত আবেদন রাখতে চাই। লেখক, প্রকাশকদের ব্যবসায়ী মনোভাব ও বাণিজ্যমুখিতা বহু ক্ষেত্রেই যথেষ্ট বেদনাদায়ক এবং তা সচেতন পাঠক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হতেও দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয়তা অর্জনের সুবাদে কোনো গণ্যমান্য লেখক এখন অবশেষে একান্তভাবে মুনাফাকেন্দ্রিক হয়ে সম্পূর্ণ 'ট্র্যাশ' বা সস্তা বাজে লেখাও পাঠকদের একরকম গছিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রবণতা ভয়ংকর বিপজ্জনক। দায়িত্বশীল প্রকাশকরা সে জন্য সুষ্ঠু গ্রন্থনীতি প্রণয়নের ওপরও জোর দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক সরকারকে আমরা সেদিকেও জরুরিভিত্তিতে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, অনেক লেখকই মূলত অর্থাগমের আশায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় অধিকতর আগ্রহী হন এবং অনেক প্রকাশকও তাতেই বেশি ইন্ধন জোগান। এ প্রবণতার খারাপ ভালো দুটি দিকই রয়েছে। মুনাফাসর্বস্ব হওয়ার কারণে এ জাতীয় গ্রন্থ সৃষ্টির চেয়ে অনাসৃষ্টি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন দেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিবরণ লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে প্রগাঢ় দেশপ্রেম, যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রখর সৃজনশীলতা এবং ইতিহাস সচেতনতা পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে, আমাদের প্রকাশনী সে তুলনায় একেবারে দৈন্যদশা, অজ্ঞানতা ও অক্ষমতার পরিচায়ক হয়ে থাকছে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি জাতির সার্বিক জীবন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপজীব্য করে কোনো সৃষ্টিশীল গ্রন্থ রচনা করতে হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অজস্র সোভিয়েত উপন্যাস, যেমন শলোকভের ধীরে বহে ডন, পোলিশ লেখক ভান্দা ভাসিলিয়েভস্কায়ার রেইনবো, জার্মান লেখক হাইনৎস লাইপম্যানের 'অগি্নগর্ভ' এরিখ মারিয়া রেমার্কের 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট কিংবা আরো প্রাচীন ইতিহাস যেমন, দাসবিদ্রোহকে উপজীব্য করে লেখা হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস কিংবা উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামকে ভিত্তি করে লেখা মনোজ বসুর ভুলি নাই এ জাতীয় গ্রন্থপাঠ ও তার মর্মবাণী ও রচনাশৈলী অনুধাবন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে লঘু, তুচ্ছ ও সীমিত দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই অতিসরলীকরণেরও কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ব ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করেই এ-জাতীয় সব গ্রন্থ রচিত হওয়া দরকার। ঠিক একইভাবে শিশু-কিশোরদের পাঠোপযোগী লেখালেখির ক্ষেত্রেও নির্ভুল বানান, নিখুঁত ছন্দ, শিক্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর গল্প, উপন্যাস, রূপকথা সৃষ্টির দিকেই সব শ্রম ও মেধা ব্যয় করা উচিত। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল লেখকদের পথপ্রদর্শক হয়ে রয়েছে। আবার প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যেমন দেশীয় আর্থসামাজিক অবস্থা তেমনি বিশ্বপরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে বিশ্লেষণাত্মক ও মেধার দ্যুতির পরিচায়ক গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত। এসব ব্যাপারে লেখক-প্রকাশক সবারই সমান দায়িত্ব। আমাদের গ্রন্থের জন্য প্রটেকশন বা সংরক্ষণ নীতি দাবি করার আগে তার মানোন্নয়নের প্রতিই লেখক, প্রকাশকদের অধিকতর যত্নবান হতে হবে। তা না হলে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের পাঠক ও ক্রেতা কেন বেশি হবে, তার সদুত্তর কোনোকালেই পাওয়া যাবে না।
একুশ মনের রুদ্ধ দুয়ারের অর্গল খুলে দেয় বলেই এত কথা বলা। মোবাইল ফোন কম্পানির বিজ্ঞাপনের মতো অনর্গল কথা বলা নয়, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি, মেধা-মননকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে জাতি হিসেবে আমাদের মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করে দাঁড়াতেই আমরা শুদ্ধ ও হৃদয়গ্রাহী মাতৃভাষায় কথা বলতে, সাহিত্য-সংস্কৃতির ইমারত গড়ে তুলতে, মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রহ হতে চাই।
আমাদের বরাভয় আমাদের নিজস্ব রুচিশীল, দেশ ও মানুষের সার্বিক কল্যাণকামী গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায়।
একটা গল্প আছে এ রকম : হিটলারের সময় নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে জার্মানির ফুটবল খেলা। নেদারল্যান্ডস ইচ্ছে করে হেরে যেতে থাকল এবং জার্মানিকে জিতিয়ে দিল। জার্মানি জিতে না ফিরলে হিটলার তাদের হলোকস্টে চড়াত। আমাদের সে ভয় নেই। আমরা নির্ভয়েই খেলব, সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে, বুক উঁচিয়ে। হারলে হারব, জিতলে জিতব। পরিশেষে জয়ী হবই।
আরেকটা গল্প আজকের, আরব মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা নিয়ে। ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন একবার সেমিনারে বলেছিলেন, একজন আরব শ্রমিক বেতন নিতে গিয়ে ঝট করে দামি সোনার কলমটা বের করে বুড়ো আঙুলের মাথায় কালি লাগিয়ে টিপসই দিয়ে বেতন তুলল। অদৃষ্টের পরিহাস! পেটে বিদ্যার দরকার নেই। তেলের সমৃদ্ধির জোরে আপাত উন্নত দেশে রাজতান্ত্রিক, শেখ, আমির কিংবা একনায়ক শাসিত উচ্ছিষ্টভোগী খেটে খাওয়া মানুষগুলো শিক্ষাবঞ্চিতই থেকে যায়। সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপও থাকে না। নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে তারা থাকে একরকম অজ্ঞই।
ভ্রূক্ষেপ যখন হলো তখন দেখি আরব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইন, লিবিয়া এবং পরিশেষে আলজেরিয়ায়ও বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এত দিন ঘুমাচ্ছিল এরা। এখন গণতন্ত্রের জন্য অকাতরে জীবন দিচ্ছে। গণতন্ত্রই শুধু! আসল ব্যাপারগুলো খুঁটিয়ে জানা যাচ্ছে না। জানা যায়, লিবিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরাও একনায়ক গাদ্দাফির হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে আমাদের সরকার উদ্বিগ্ন। মিসরে তো জাতীয়তাবাদী নাসেরের আমলে একবার রাজতন্ত্রবিরোধী জাগরণ হয়েছিল, হার্টস-এর কিং, ব্রিটিশ কিং আর কিং ফারুক ওই তিন নৃপতি ছাড়া বিশ্বে আর কোনো রাজন্য থাকবে না। এ আত্মম্ভরিতার মৃত্যু ঘটেছিল গণরোষের মুখে ফারুকের বিদায়ে। এরপর সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। আনোয়ার সাদাতের আমলে যত জ্ঞানী-গুণী বিদ্বজ্জন দেশত্যাগ করেন। তাতে মৌলবাদী ইসলামী ব্রাদারহুড প্রাধান্য বিস্তার করে। এরপর এখন ঘটল তিন দশকের একনায়ক হোসনি মুবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান। আলজেরিয়ায় তিন জামিলা, জামিলা বুই রেদ, জামিলা বোপাশা আর জামিলা বুয়েজ্জা_এই তিন বীরাঙ্গনার চরম আত্মত্যাগ আর গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ফরাসি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আট বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েও বেন খেদ্দা, বেন বেল্লা প্রমুখ জাতীয়তাবাদীর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কর্নেল বুতেফ্লিকার দুর্বল সামরিকতন্ত্র কায়েম হয়। ফ্রন্ট সালভেশন ইসলামিক (এফআইএস)-এর নেতৃত্বাধীন মৌলবাদীরা জনগণের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ক্ষমতা দখলে উঠেপড়ে লাগে। মনে হয়, এখনকার বিক্ষোভে তারাই প্রধান ইন্ধনদাতা। তিউনিসিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেন_এসব জায়গায়ও যেমন আছে অবদমিত জনগণের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি আছে সাম্রাজ্যবাদ আর মৌলবাদীদের ইন্ধনও। গোটা আরব মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত গণতন্ত্রমুখী পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। কিন্তু শিক্ষা ও মৌলিক অধিকারবঞ্চিত মানুষ কি সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে! এ প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে গোটা আরব বিশ্বে। 'বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা'_এ প্রশ্ন আজ গোটা আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চকিত।
আমরা সে স্তর পার হয়ে এসেছি। 'ভাষা মতিনে'র ক্ষোভ যতই ঝরে পড়ুক দুই প্রধান বুর্জোয়া দলের বিরুদ্ধে অমর একুশ জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকবচ হয়েই থাকবে।
২২.০২.২০১১

No comments

Powered by Blogger.