বাজারভর্তি 'দুই নম্বরি' কসমেটিকসে-বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী চকবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে by শরীফুল আলম সুমন ও তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

রকমারি বিদেশি পণ্যের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কী নেই! পৃথিবীর যত নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনসামগ্রী থরে থরে সাজানো। চেয়ে না পাওয়ার কোনো ব্যাপারই নেই; কিন্তু যেটা পাবেন না সেটা হলো 'আসল' জিনিস। চারপাশে নকল কসমেটিকসের ছড়াছড়ি। এটা হচ্ছে রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার চকবাজারের চিত্র।


এখানকার শতাধিক পাইকারি দোকান থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয় থাইল্যান্ডে তৈরি হেড অ্যান্ড শোল্ডার, যুক্তরাষ্ট্রের প্যানটিন প্রো-ভি শ্যাম্পু ও ডাভ ক্রিম কিংবা ভারতের গার্নিয়ার শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রিম, লিপস্টিক, লোশনের মতো প্রসাধনসামগ্রী। এগুলোর সবই নকল। অথচ তা বোঝারও উপায় নেই। তবে এগুলো যে নকল জিনিস সে কথা দোকানিরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, চকবাজারে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের তৈরি নামকরা প্রসাধনসামগ্রীর নকল আইটেম পাওয়া যায়। চলতি ভাষায় যেগুলোকে বলা হয় 'দুই নম্বরি' জিনিস। বছরজুড়েই এই ব্যবসা চলে। তবে ঈদ উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও তাঁদের মজুদ আর বেচাকেনা বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন দোকান ও সারা দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁরা এসব নকল পণ্য বিক্রি করছেন। ক্রেতারা আসল মনে করে নকল কসমেটিকস কিনে নিয়ে মনের আনন্দে ব্যবহার করছেন। নিয়মিত ব্যবহারের ফলে ত্বকের নানা রকম সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন তাঁরা।
সম্প্রতি তিন দিন ধরে কালের কণ্ঠের নিবিড় অনুসন্ধানে এ ধরনের নকল পণ্য বিক্রির শতাধিক দোকান খুঁজে পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালত এরই মধ্যে চকবাজারে প্রায় ৫৩ ধরনের নকল প্রসাধনীর অস্তিত্ব পেয়েছে। প্রায়ই ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও বন্ধ হচ্ছে না নকল পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ। কারণ হিসেবে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও দায়ী করছেন অনেকে। এ বিষয়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চকবাজারের খান মার্কেটে তিনবার অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ মার্কেটের মালিক সমিতির লোকজন আমাদের কথা দিয়েছেন, তাঁরা এই ব্যবসা থেকে সরে আসবেন। তারপরও নকল প্রসাধনীর ব্যবসা চলছে। আমার মনে হয়, শুধু শাস্তি দিয়ে হবে না, সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে।'
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই মার্কেটের ব্যবসায়ী হাজি মফিজুর রহমান ওরফে ব্যাটারি মফিজ গত তিন যুগের বেশি সময় এই নকল সামগ্রী বিক্রির সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ম্যানেজ করার দায়িত্বও এই ব্যাটারি মফিজের। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব নকল সামগ্রী যেসব দোকানে বেচাকেনা হয়, সেগুলোর কোনোটিরই সাইনবোর্ড নেই। তবে চালান এবং বিক্রি রসিদ আছে সবারই। এ ছাড়াও দেখা গেছে, কোনো দোকানেই মালিক নিজে বসেন না, কর্মচারীরাই সব দেখাশোনা করে। মালিকরা বাইরে থেকে টেলিফোনে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
চকবাজারের অবস্থা এমনই যে, এখানে কে আসল পণ্যের ব্যবসায়ী তা শনাক্ত করা কঠিন। স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও তাঁদের খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো সহযোগিতা মেলেনি। তবে কয়েকজন দোকান মালিক নিজেদের প্রকৃত ব্যবসায়ী দাবি করে বলেন, এই নকল চক্রের কারণে চকবাজারের নাম এখন 'ঠগবাজার' হয়ে গেছে। এদের কারণে তাঁদের সুনামও নষ্ট হচ্ছে। মূলত ব্যবসায়িকভাবে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সম্প্রতি চকবাজারের খান মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে নকল পণ্য। পাইকারি ক্রেতা সেজে কথা হয় মার্কেটের মেসার্স সাব্বির অ্যান্ড সিজান এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী দেলোয়ারের সঙ্গে। তিনি বিভিন্ন নকল প্রসাধনীর দুই ধরনের দাম ক্যাশ মেমোতে লিখে দেন। তাঁদের কাছে প্যান্টিন ও হেড অ্যান্ড শোল্ডার শ্যাম্পুর ৪০০ মিলির বোতল আছে দুই পদের। দুটি পণ্যই নকল। তাঁর মতে, একটি কিছুটা উন্নতমানের বোতলে রাখা। সাধারণটির দাম ৮০ টাকা এবং একটু উন্নতটির দাম ১২০ টাকা। অথচ বাজারে এ দুটি ব্র্যান্ডের একই পরিমাপের আসল পণ্যের দাম ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা। এই দোকানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুসহ আরো অনেক ধরনের নকল প্রসাধনসামগ্রী বিক্রির জন্য সাজানো রয়েছে। সব পণ্যের দামই আসলের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।
একই মার্কেটের আল-আমিন স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিলিভারের এক্স বডি স্প্রে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, অথচ এটির আসল পণ্যের দাম ১৯০ টাকা। এখানে নকল ডুইট, হ্যাভক, ফগসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বডি স্প্রের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। বাজারে আসলগুলোর দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। ৩৮৫ মিলির নকল জিলেট ফোম ৯০ টাকা, আসলটির দাম ৩২০ টাকা। ১০০ গ্রামের নকল পন্ডস ফেসওয়াস ৩৫ টাকা, এর আসলটির দাম ৭০ টাকা। হুবহু একই ধরনের মোড়কে তৈরি করা এসব নকল প্রসাধনী বাইরে থেকে দেখে সাধারণ কোনো ক্রেতার পক্ষে বোঝার উপায় নেই যে এটি নকল হতে পারে। আসল আমদানিকারকের স্টিকারের মতো হুবহু স্টিকারও লাগানো রয়েছে নকল সব পণ্যের প্যাকেটের গায়ে। রয়েছে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ছাপ। তবে আইনগত জটিলতা এড়াতে এসব বিক্রেতা তাঁদের ক্যাশ মেমোতে প্রসাধনীর নামগুলো (মুদ্রিত) সামান্য পরিবর্তন করে লিখে রেখেছেন।
এলাকার কয়েকজন আসল প্রসাধনী বিক্রেতা জানান, চক ও মৌলভীবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, চক মার্কেট, ইয়াকুব মার্কেট, খাতুন মার্কেট, ভাই ভাই মার্কেট, মরিয়ম মার্কেট ও তাজমহল মার্কেটেই সবচেয়ে বেশি নকল পণ্যের দোকান রয়েছে। এসব নকল পণ্য দেশের বিভিন্ন অভিজাত শপিংমলেও বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা জেনেশুনেই বেশি লাভের আশায় এসব পণ্য কিনে বিক্রি করেন। প্রতারিত হন সাধারণ ব্যবহারকারীরা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চকবাজারে খান মার্কেটের দোতলায় ব্যাটারি মফিজের নকল প্রসাধনীর দোকান রয়েছে একাধিক। অনেক অভিযান হলেও সব সময়ই তিনি থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্নভাবে মফিজের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। নকল পণ্যের আরেক পরিচিত ব্যবসায়ী নবী উল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড প্লাস্টিক প্রোডাক্ট, কসমেটিকস কোং-এর মালিক। তিনি নিজস্ব কারখানায় এসব প্রসাধনী তৈরি ও সরবরাহ করেন। ঢাকা জেলা ক্ষুদ্র প্রসাধনী উৎপাদন সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ তাঁর বড় ভাই। গত সোমবার বিকেলে নবী উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'নকল প্রসাধনী ব্যবসার সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি। প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা করছি। এরপরও যদি এসব বিষয়ে আমাকে জড়ানো হয়, তাহলে আমিও আপনাদের দেখে নিব।' নবী উল্লাহ নিজেকে এখন নকলবিরোধী বলে দাবি করলেও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর চকবাজারের খাজেদল সিং লেনের ১৭/এ-১ নম্বর নিজস্ব বাড়ি থেকে কয়েক মাস আগেও প্রায় ১০ কোটি টাকার নকল প্রসাধনী উদ্ধার করে। অভিযোগ রয়েছে, এই অভিযানের জের ধরেই খুন হন নবী উল্লার প্রতিবেশী ব্যবসায়ী হোসেন। পুলিশকে হোসেনই এ নকল প্রসাধনীর তথ্য দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এই ঘটনায় নবী আসামি হলেও পরে চার্জশিট থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়। অনেকেই বলেছেন, পুলিশের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণেই তাঁর নাম চার্জশিটে আসেনি।
জানা যায়, হাজি শেখ শাহীন আহমেদ নামে চকবাজার এলাকায় আরেকজন প্রভাবশালী নকল প্রসাধনী প্রস্তুতকারক আছেন। তাঁর নিজস্ব দোকান না থাকলেও তিনি চকবাজারের বিভিন্ন দোকানে এসব পণ্য সরবরাহ করেন। এসব নকল পণ্যের কারখানা মূলত কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এবং পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, এসব নকল প্রসাধনীর কারখানা ও দোকান থেকে নিয়মিত টাকা ওঠায় চকবাজার থানা পুলিশের সোর্সরা। মক্কা মার্কেট থেকে শহীদ এবং অন্যান্য মার্কেট থেকে নীরব ও তুফান নামে তিন পুলিশ সোর্স টাকা ওঠায় বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়। তবে চকবাজার থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মার্কেট থেকে পুলিশের টাকা ওঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ভেজাল প্রসাধনীর ব্যাপারে তাঁরা সরাসরি কোনো অভিযান পরিচালনা করেন না। অন্য কোনো সংস্থা অভিযানে এলে তাদের সহযোগিতা করেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, চকবাজারে এই ব্যবসা পরিচালনার একটি সিন্ডিকেট আছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন ব্যাটারি মফিজ, নবী ও আসাদ। এ ছাড়াও এই সিন্ডিকেটে মজিদ, ইকবাল, সাজিদ, সাত্তার, মনোয়ার, নাজিম, হাবিব, আতিয়ার হোসেন রেজু নামে আরো কয়েকজন সদস্য আছেন। এদের মূল পেশাই হচ্ছে নকল পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করা। এর মধ্যে সাজিদকে চকবাজার থেকে গত ৩ জুলাই ডিবি পুলিশ নকল শাহাজাদী মেহেদিসহ গ্রেপ্তার করে। সাজিদের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, পুরান ঢাকার বড় কাটরার লতিফ স্টোর, চিশতীয়া মার্কেটে জুয়েল ব্রাদার্স, এস কে ভবনে শেখ ব্রাদার্স, সুলতান প্লাজার আহমেদ স্টোর, মনসুর খাঁ প্লাজার আমিন স্টোর, রাজ্জাক স্টোর, খাজা মার্কেটে সালাউদ্দিন স্টোর, হোসেন স্টোর, মক্কা মার্কেটে রেজু স্টোরে তাঁদের তৈরি নকল প্রসাধনী বিক্রি হয়।
সংশ্লিষ্ট নকল ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু, লোশন, ক্রিম, পাউডার, বডি স্প্রে ব্যবহারের পর ভোক্তারা সাধারণত খালি কৌটা ফেলে দেন বা হকারদের কাছে বিক্রি করেন। নানা হাত ঘুরে এসব কৌটা আবার ভর্তি হয়ে চলে আসে বাজারে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাজারে চলতি ব্র্যান্ডের কৌটাও তৈরি হচ্ছে। রহমতগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে গোপনে এগুলো তৈরি করা হয়।
নকল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অনুসারে বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা করা হয়। এ আইনে লঘুদণ্ড হওয়ায় যেসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে, তারা দণ্ডিত হওয়ার পরও আবার উৎপাদন করছে। অনেকেরই অভিমত, বিএসটিআই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভোক্তা সংরক্ষণ আইনে মামলা না করে ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলা করলে শাস্তির পরিমাণ বাড়ত। এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক এ কে ফজলুল আহাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'খাদ্যের ওপর বেশি জোর দেওয়ায় সম্প্রতি নকল প্রসাধনীর উৎপাদন বেড়ে গেছে। এদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।' ফৌজদারি আইনে মামলা না করে কেন ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করা হয়, সে ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারটি পুরোপুরি নির্ভর করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর।' জানা গেছে, গত বছর চকমোগলটুলীর খান মার্কেটের দোতলায় দীন ইসলামের আল আমিন স্টোর, আরিফুর রহমানের হাবিব ব্রাদার্স, খোরশেদ আলমের আল্লার দান স্টোরে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করা হয়। এরপর কয়েক দিন বন্ধ রেখে আবারও তারা পুরনো ব্যবসা শুরু করে।
ক্ষতি অনেক রকমের

No comments

Powered by Blogger.