রঙ্গব্যঙ্গ-বাজার চড়া মেজাজ কড়া by মোস্তফা কামাল
নিয়ামুল হক সরকারি চাকরি করেন। দ্বিতীয় গ্রেডের চাকরি। ২০ বছর চাকরি করে একটি সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। তাও আবার লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে। ব্যাংক থেকে ঋণ করে ঘুষের টাকা দিয়েছেন। এখন প্রতি মাসে তাঁকে কিস্তি দিতে হয়। তাঁর অফিসে ঘুষের সিস্টেম নেই। তিনি যে সিস্টেমের কারণে সৎ মানুষ, তা নয়।
তাঁর স্কুলশিক্ষক বাবার নির্দেশ, 'আর যা-ই কর বাবা, অসৎ পথের ইনকাম ছেলে-মেয়েদের মুখে দিও না। আমি ঘামঝরা, ব্রেন-বেচা পয়সা দিয়ে তোমাদের মানুষ করেছি। সে কারণেই তুমি একটা ভালো চাকরি পেয়েছ। হোক তা দ্বিতীয় গ্রেডের, সরকারি চাকরি তো!'
বাবার নির্দেশ নিয়ামুল হক অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তাঁর দুই ছেলেসহ চারজনের টানাপড়েনের সংসার। তার পরও তিনি অসৎ পথ ধরেননি। ছেলে দুটিকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তাদের গৃহশিক্ষক দেননি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে নিজেই তাদের পড়ালেখা করান। তাঁর ছেলে দুটিও মাশাআল্লাহ! জোয়ারে গা ভাসায়নি। বাইরের চাকচিক্য তাদের প্রভাবিত করতে পারেনি। কোনো দিন মা-বাবার কাছে কোনো বায়না ধরেনি। মা-বাবা খুশি হয়ে যা দেন, তা-ই তারা হাসিমুখে গ্রহণ করে। নতুন জামাকাপড়, খেলনা কিংবা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকেনি। এ যুগে এমন ছেলেপেলে পাওয়া ভার!
একদিন নিয়ামুল হক বাজারে রওনা হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী হালিমা আক্তার হক সাহেবের হাতে বাজারের ফর্দ তুলে দিয়ে বললেন, 'এই জিনিসগুলো আনতে হবে। না আনলে কিন্তু রান্না হবে না!'
ফর্দটি দেখেই নিয়ামুল হকের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তিনি বিরক্তির সুরেই বললেন, 'এত কিছু কী?'
হালিমা খাতুনও তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'এত কিছু কী মানে? যা দরকার তা-ই আনতে বলেছি।'
নিয়ামুল হক বললেন, 'আচ্ছা কী কী দরকার দেখি।' তারপর ফর্দটি হাতে নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন। এক কেজি গরুর মাংস, এক কেজি রুই মাস, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক হালি ডিম, এক লিটার লিকুইড দুধ, একটি ফার্মের মুরগি, হলুদ, মরিচ ও মসলার প্যাকেট। আর লালশাক, পুঁইশাকসহ কিছু তরকারি।
নিয়ামুল হক ফর্দটি বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে বললেন, 'এত কিছু আনতে কত টাকা লাগবে জান?'
হালিমা খাতুন বললেন, 'কত টাকা?'
নিয়ামুল হক বললেন, 'কমপক্ষে এক হাজার টাকা।'
হালিমা খাতুন তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, তা তো লাগবেই।'
নিয়ামুল হক ভেঙ্চি কেটে বললেন, 'হ্যাঁ তা তো লাগবেই! আমার কাছে কত টাকা আছে তুমি জান না?'
হালিমা খাতুন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'আমি কী করে জানব! আমি কি তোমার মানিব্যাগ হাতাহাতি করি নাকি?'
নিয়ামুল হক পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বললেন, 'এই দেখো, আমার কাছে মাত্র সাড়ে চার শ টাকা আছে। এর মধ্যে আগামী এক সপ্তাহ অফিসে যেতে হবে। এই টাকা দিয়ে বাস ভাড়াই হবে না। বাজার করব কী দিয়ে?'
হালিমা খাতুন বললেন, 'তা আমি কী জানি? বাজার না আনলে চুলাও জ্বলবে না।'
নিয়ামুল হকের মেজাজ চটে গেল। তিনি খেপে গিয়ে বললেন, 'কী বললে? চুলা জ্বলবে না? কেন জ্বলবে না? আর কিছু কি বাসায় নেই? কোনো একটা ব্যবস্থা করো।'
এ সময় নিয়ামুল হকের বড় ছেলে আরিফুল হক বলল, 'একি বাবা! তুমি এমন খেপে যাচ্ছ কেন? শান্তভাবেই তো কথাগুলো বলা যায়। যায় না?'
নিয়ামুল হক গলা চড়া করেই বললেন, 'আরে শান্তভাবে বলব কী করে? তোর মা দেখিস না কিভাবে কথা বলে?'
'বাবা! মা কী করবেন? তাঁর কি কিছু করার আছে? তুমি বাজারে যাও। যা পার কিনে নিয়ে এসো! রাতে খেতে তো হবে!'
নিয়ামুল হক আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বিড় বিড় করে কী যেন বললেন। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে বাজারের দিকে রওনা হলেন। শুরুতেই তিনি গেলেন গরুর মাংসের দোকানে। তিনি অনেক কষ্টে নিজের তিরিক্ষি মেজাজ ঠাণ্ডা করে বললেন, 'এই যে ভাই, মাংসের কেজি কত?'
দোকানদার বলল, '৩০০ টাকা।'
নিয়ামুল হক প্রশ্ন করলেন, 'কেন, ৩০০ কেন?'
দোকানদার বলল, 'কচি গরুর মাংস। খুব ভালো মাংস। দেখেন না! লোকজন হরদম নিতেছে। ঠিক আছে, আপনি চেনাজানা মানুষ! ২৮৫ টাকা কেজি। নিয়ে যান।'
নিয়ামুল হক বললেন, 'আমাকে ২৫০ গ্রাম দাও তো!'
২৫০ গ্রামের কথা শুনে বিস্ময়ে দোকানদারের চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেল। সে বলল, '২৫০ গ্রাম! মাংস বেচব না, যান!'
এ কথা শুনে নিয়ামুল হকের মেজাজ একেবারে তালুতে উঠে গেল। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, 'কী বললি দিবি না! তাহলে বেচতে বসছিস কেন? ১০০ গ্রাম কিনতে চাইলেও দিতে হবে!'
চিৎকার-চেঁচামেচির একপর্যায়ে আশপাশের লোকজনের অনুরোধে দোকানদার নিয়ামুল হককে ২৫০ গ্রাম মাংস দিল। তারপর তিনি গেলেন মাছের বাজারে। রুই মাছ দেখে দোকানদারকে বললেন, 'এই! মাছের কেজি কত?'
দোকানদার বলল, '৩০০ টাকা।'
এবারও নিয়ামুল হকের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তিনি গলা উঁচু করেই বললেন, '৩০০ টাকার নিচে কী মাছ আছে?'
এ সময় আশপাশের লোকজন পরস্পরের সঙ্গে বলাবলি করেন, এই লোকটা যেখানে যায়, শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি করে। জনৈক ভদ্রলোক বলেই বসলেন, 'আপনি তো দেখছি বাজার গরম করে ফেললেন!'
নিয়ামুল হক বললেন, 'তাতে আপনার অসুবিধা কী?'
'অসুবিধা আছে। মেজাজ হলো ছোঁয়াচে রোগ। একজনের গরম দেখলে আরেকজনের গরম হয়। বুঝতে পারছেন!'
নিয়ামুল হক কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দোকানদারের কাছে জানতে চাইলেন, 'এই! বললি না, ৩০০ টাকার নিচে কী মাছ আছে?'
দোকানদার বলল, 'টাটকিনি।'
'আমাকে একটা টাটকিনি দে।'
'কেন, আপনি না রুই মাছ নিতে চাইলেন! এখন বাচ্চা নিবেন কেন?'
'কেন নেব তা তুই বুঝিস না?'
এভাবেই নিয়ামুল হক মেজাজ চড়িয়ে বাজার সারলেন। তাঁর চড়া মেজাজ অন্যদেরও সংক্রমিত করল। ধীরে ধীরে বাজারটাও যেন উনুনের আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
বাবার নির্দেশ নিয়ামুল হক অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তাঁর দুই ছেলেসহ চারজনের টানাপড়েনের সংসার। তার পরও তিনি অসৎ পথ ধরেননি। ছেলে দুটিকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তাদের গৃহশিক্ষক দেননি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে নিজেই তাদের পড়ালেখা করান। তাঁর ছেলে দুটিও মাশাআল্লাহ! জোয়ারে গা ভাসায়নি। বাইরের চাকচিক্য তাদের প্রভাবিত করতে পারেনি। কোনো দিন মা-বাবার কাছে কোনো বায়না ধরেনি। মা-বাবা খুশি হয়ে যা দেন, তা-ই তারা হাসিমুখে গ্রহণ করে। নতুন জামাকাপড়, খেলনা কিংবা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকেনি। এ যুগে এমন ছেলেপেলে পাওয়া ভার!
একদিন নিয়ামুল হক বাজারে রওনা হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী হালিমা আক্তার হক সাহেবের হাতে বাজারের ফর্দ তুলে দিয়ে বললেন, 'এই জিনিসগুলো আনতে হবে। না আনলে কিন্তু রান্না হবে না!'
ফর্দটি দেখেই নিয়ামুল হকের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তিনি বিরক্তির সুরেই বললেন, 'এত কিছু কী?'
হালিমা খাতুনও তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'এত কিছু কী মানে? যা দরকার তা-ই আনতে বলেছি।'
নিয়ামুল হক বললেন, 'আচ্ছা কী কী দরকার দেখি।' তারপর ফর্দটি হাতে নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন। এক কেজি গরুর মাংস, এক কেজি রুই মাস, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক হালি ডিম, এক লিটার লিকুইড দুধ, একটি ফার্মের মুরগি, হলুদ, মরিচ ও মসলার প্যাকেট। আর লালশাক, পুঁইশাকসহ কিছু তরকারি।
নিয়ামুল হক ফর্দটি বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে বললেন, 'এত কিছু আনতে কত টাকা লাগবে জান?'
হালিমা খাতুন বললেন, 'কত টাকা?'
নিয়ামুল হক বললেন, 'কমপক্ষে এক হাজার টাকা।'
হালিমা খাতুন তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, তা তো লাগবেই।'
নিয়ামুল হক ভেঙ্চি কেটে বললেন, 'হ্যাঁ তা তো লাগবেই! আমার কাছে কত টাকা আছে তুমি জান না?'
হালিমা খাতুন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'আমি কী করে জানব! আমি কি তোমার মানিব্যাগ হাতাহাতি করি নাকি?'
নিয়ামুল হক পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বললেন, 'এই দেখো, আমার কাছে মাত্র সাড়ে চার শ টাকা আছে। এর মধ্যে আগামী এক সপ্তাহ অফিসে যেতে হবে। এই টাকা দিয়ে বাস ভাড়াই হবে না। বাজার করব কী দিয়ে?'
হালিমা খাতুন বললেন, 'তা আমি কী জানি? বাজার না আনলে চুলাও জ্বলবে না।'
নিয়ামুল হকের মেজাজ চটে গেল। তিনি খেপে গিয়ে বললেন, 'কী বললে? চুলা জ্বলবে না? কেন জ্বলবে না? আর কিছু কি বাসায় নেই? কোনো একটা ব্যবস্থা করো।'
এ সময় নিয়ামুল হকের বড় ছেলে আরিফুল হক বলল, 'একি বাবা! তুমি এমন খেপে যাচ্ছ কেন? শান্তভাবেই তো কথাগুলো বলা যায়। যায় না?'
নিয়ামুল হক গলা চড়া করেই বললেন, 'আরে শান্তভাবে বলব কী করে? তোর মা দেখিস না কিভাবে কথা বলে?'
'বাবা! মা কী করবেন? তাঁর কি কিছু করার আছে? তুমি বাজারে যাও। যা পার কিনে নিয়ে এসো! রাতে খেতে তো হবে!'
নিয়ামুল হক আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বিড় বিড় করে কী যেন বললেন। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে বাজারের দিকে রওনা হলেন। শুরুতেই তিনি গেলেন গরুর মাংসের দোকানে। তিনি অনেক কষ্টে নিজের তিরিক্ষি মেজাজ ঠাণ্ডা করে বললেন, 'এই যে ভাই, মাংসের কেজি কত?'
দোকানদার বলল, '৩০০ টাকা।'
নিয়ামুল হক প্রশ্ন করলেন, 'কেন, ৩০০ কেন?'
দোকানদার বলল, 'কচি গরুর মাংস। খুব ভালো মাংস। দেখেন না! লোকজন হরদম নিতেছে। ঠিক আছে, আপনি চেনাজানা মানুষ! ২৮৫ টাকা কেজি। নিয়ে যান।'
নিয়ামুল হক বললেন, 'আমাকে ২৫০ গ্রাম দাও তো!'
২৫০ গ্রামের কথা শুনে বিস্ময়ে দোকানদারের চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেল। সে বলল, '২৫০ গ্রাম! মাংস বেচব না, যান!'
এ কথা শুনে নিয়ামুল হকের মেজাজ একেবারে তালুতে উঠে গেল। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, 'কী বললি দিবি না! তাহলে বেচতে বসছিস কেন? ১০০ গ্রাম কিনতে চাইলেও দিতে হবে!'
চিৎকার-চেঁচামেচির একপর্যায়ে আশপাশের লোকজনের অনুরোধে দোকানদার নিয়ামুল হককে ২৫০ গ্রাম মাংস দিল। তারপর তিনি গেলেন মাছের বাজারে। রুই মাছ দেখে দোকানদারকে বললেন, 'এই! মাছের কেজি কত?'
দোকানদার বলল, '৩০০ টাকা।'
এবারও নিয়ামুল হকের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তিনি গলা উঁচু করেই বললেন, '৩০০ টাকার নিচে কী মাছ আছে?'
এ সময় আশপাশের লোকজন পরস্পরের সঙ্গে বলাবলি করেন, এই লোকটা যেখানে যায়, শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি করে। জনৈক ভদ্রলোক বলেই বসলেন, 'আপনি তো দেখছি বাজার গরম করে ফেললেন!'
নিয়ামুল হক বললেন, 'তাতে আপনার অসুবিধা কী?'
'অসুবিধা আছে। মেজাজ হলো ছোঁয়াচে রোগ। একজনের গরম দেখলে আরেকজনের গরম হয়। বুঝতে পারছেন!'
নিয়ামুল হক কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দোকানদারের কাছে জানতে চাইলেন, 'এই! বললি না, ৩০০ টাকার নিচে কী মাছ আছে?'
দোকানদার বলল, 'টাটকিনি।'
'আমাকে একটা টাটকিনি দে।'
'কেন, আপনি না রুই মাছ নিতে চাইলেন! এখন বাচ্চা নিবেন কেন?'
'কেন নেব তা তুই বুঝিস না?'
এভাবেই নিয়ামুল হক মেজাজ চড়িয়ে বাজার সারলেন। তাঁর চড়া মেজাজ অন্যদেরও সংক্রমিত করল। ধীরে ধীরে বাজারটাও যেন উনুনের আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments