সংসদ-নারী-পুরুষের সমান প্রতিনিধিত্ব চাই by নাহিদ নলেজ

নারী-পুরুষের সমানসংখ্যক আসনের পাশাপাশি শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক জনসংখ্যার অনুপাতে সংসদ সদস্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ষোলোআনাই ফাঁকি। যে জনগণ বুকের পাটা দেখিয়ে এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছে, সেই জনগণকেই ভূমিকা নিতে হবে, বিড়ালের গাছে ওঠার


গল্প মনে রাখতে হবে, আর জানতে হবে কখন শাসক
শ্রেণী গাছে ওঠে


মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির যে সংবিধান আমরা পাই, তাতে ক্ষুদ্র জাতিগুলোর অধিকার না দেওয়ার পেছনে যে কারণ এবং সংবিধানে প্রগতিশীল যে দিকগুলো ছিল, উভয়েরই উৎস এক, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের জনগণ যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিল, তার ঠেলায় শাসকশ্রেণী প্রগতিশীল দিকগুলো সংবিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে একই কারণে তা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উগ্রতার পালে বাতাস লাগায় ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে অস্বীকারের প্রেরণা পেয়েছিল, আর দ্বিতীয় দিকটিই হচ্ছে শাসকশ্রেণীর প্রকৃত চরিত্র।
সে যা-ই হোক, নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর রাষ্ট্র সম্পর্কে জনগণের আশা তলানিতে এসে ঠেকেছে যেমন, তেমনি নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে আস্থা কমেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালে যে অধিকার স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল, আজ এত দিন পর সেসব অধিকার উপস্থাপন করতেও সবাই দ্বিধাগ্রস্ত, সবকিছু মেনে নেওয়ার এক ধরনের মনোভাব যেন গড়ে উঠেছে। আর এটি যখন নাগরিকদের চেতনায় সৃষ্টি হয়, সর্বনাশের শুরু হয় তখনই।
সংবিধান সম্পর্কে যেভাবে, যে পদ্ধতিতে আলোচনা চলছে, সেই পদ্ধতিই প্রশ্নসাপেক্ষ। তারপর এ রাষ্ট্রের সংবিধান কোন পদ্ধতিতে, কোন কোন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছিল, এ সংবিধানে কেন এত স্ববিরোধিতা, সংশোধনের প্রশ্নে গণরায় নেওয়ার ব্যবস্থা কেন নেই, কেন নেওয়া হচ্ছে না_ এসব নিয়ে কথা তোলা উচিত। কিন্তু এ প্রবন্ধটি শুধু আসনসংখ্যা বৃদ্ধি, শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক নারী-পুরুষের সমানসংখ্যক আসন নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে।
প্রথমত, সংসদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়টি ধরা যাক। গত ৪০ বছরে সাংসদদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যে হারে বেড়েছে, তাতে এই গরিব দেশে হাতি পোষার উপমা জোগাড় করতে হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, এই হাতি সাংসদরা জন্মও নেন হাতি পরিবারেই। তারা না জানেন ক্ষুধার কষ্ট, না জানেন বেকারত্বের জ্বালা। এককথায় যে জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ও আজ অবধি চলছে, তা তারা জানেন না। এককথায় প্রকৃত বাংলাদেশকে এরা জানেন না।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের (প্রতিনিধি সভা) আসনসংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৩৫। গত ১০০ বছরেও একজন প্রতিনিধির সংখ্যাও বাড়ানো হয়নি। সে দেশের সিনেটে আছেন আরও ১০০ জন। যদি জনসংখ্যার অনুপাতে হিসাব করা হয়, তাহলে এ রকম_ তাদের জনসংখ্যা আমাদের দ্বিগুণ। সেই অনুপাতে বাংলাদেশের সাংসদসংখ্যা দাঁড়ায় (৪৩৫+১০০)/২ = ২৬৭.৫।
আর যদি অর্থনীতির অনুপাত ধরা হয়, তাহলে কতজন সাংসদ বাংলাদেশের সংসদের ভাগে পড়ে, সম্মানিত পাঠক, সে হিসাবের ভার আপনার কাছেই রাখলাম।
এবার আসি ভারতের প্রসঙ্গে। যে ভারতের উদাহরণ আমরা কথায় কথায় আনি, সেখানকার জনসংখ্যা ১২১ কোটি। তাদের উভয় সভা মিলে আসনসংখ্যা হয় ৫৫২+২৫০ = ৮০২। তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের সাংসদদের সংখ্যা হয় = ৮০২/৮ = ১০০ (প্রায়)। অন্যদিকে অর্থনীতির অনুপাত কত হয়, তার হিসাবও আপনারাই করুন।
তাতেও যদি সন্তুুষ্ট না হন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংসদগুলোকে জনসংখ্যা ও অর্থনীতি অনুপাতে হিসাবে আনুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন, সাংসদ নামের হাতি আমাদের আরও কতগুলো দরকার।
দ্বিতীয়ত, নারীদের জন্য আগে ১০০টি আসন বৃদ্ধির প্রস্তাব তোলা হয়েছে। ভাবখানা এমন, ৩০০ আসনের মধ্য থেকে তো দেওয়া যাবে না, তাই আসনসংখ্যা বৃদ্ধিই হলো নারী অধিকার রক্ষার দাওয়াই। অর্থনীতির বারোটা বাজলে তাতে কী। গত বিএনপি-জামায়াত আমলে তারা বাড়াতে চেয়েছিল ৪৫টি আর প্রগতিশীল মহাজোট তো তার চেয়ে কমাতে পারে না। অতএব বাড়াও ১০০টি। আর এই পরিমাণে বাড়ালে নারী আসনের সংখ্যা হবে এক-চতুর্থাংশ। এবং ভবিষ্যতে যদি সমান আসনের দাবি ওঠে, তাহলে আরও ২০০টি বাড়িয়ে ৬০০ আসনের সংসদ করা যাবে, আর খরচ? গৌরী সেন জনগণ আছে না? জোট, মহাজোট আর সুশীল সমাজের চালচলন দেখে তা-ই ঠাওরাচ্ছি। হাঁটা দেখে নাকি মানুষ চেনা যায়।
আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের সংবিধানে কত কথাই তো থাকে, কাজীর গরু কেতাবেই থাকুক। সংবিধানে থাকলেই নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিতে হবে? সংবিধানের যে ধারাগুলো কোনো অবস্থাতেই সংখ্যা নির্ধারণ গরিষ্ঠতার জোরে হলেও লঙ্ঘন করা যাবে না। তারই কোনো মা-বাবা নেই। আর নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ। ৩০০ আসনের ১৫০ আসন নারীদের জন্য? কখনোই না। না, না, না, হাজারবার না। এই হলো শাসকশ্রেণীর মনের কথা।
তৃতীয়ত, নারী-পুরুষের সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্বের সংসদ পেলেই কি সত্যিকারের শ্রমজীবী জনগণের প্রতিনিধিদের পেয়ে যাব? অবশ্যই না। জেনারেল এরশাদের ৩০ সেট অলঙ্কারের উপমা এ রাষ্ট্রের সামনে আছে। এই ৩০ সেট অলঙ্কার তো আসমান থেকে পড়েনি।
পুরুষ কর্তৃত্বের সংসদে কি আসন একটি এবং পুরুষ শ্রমিককে দেখতে পাই? তেমনি যে নারী চিলমারীর চরে বাড়িতে বসে চুলো ঠেলেন, সন্তানদের আহার জোগাতে উপোস দেন, যারা বাংলাদেশের সংখ্যাঘরিষ্ঠ অংশ তারা কি লুই আই কানের সুরম্য ভাস্কর্যের ভেতরে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন? 'মাননীয় স্পিকার, আমি আজ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর চরের সেই দুঃখী নারীর কথা বলতে এসেছি।' আমরা জানি পারবেন না। অথচ এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সেই চরের তারামন বিবিকে আমরা পেয়েছি, কাঁকন বিবিসহ অজস্র নারী-পুরুষকে পেয়েছি, তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই জানি সমানসংখ্যক আসন থাকলেও পাব না, আজকের মতোই।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, রুশ দেশের প্রতিক্রিয়াশীল জারের আমলেও দুমাতে কৃষক শ্রমিকের প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন। ইতিহাস পড়ূন, তারা বলছে, রাশিয়ার সব কৃষিজমি রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে। অথচ নিজেদের প্রগতিশীল সংবিধানে সমাজতন্ত্র লিখে রেখেও শ্রমিক-কৃষকের কোনো প্রতিনিধি সংসদে নেই।
তাই নারী-পুরুষের সমানসংখ্যক আসনের পাশাপাশি শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক জনসংখ্যার অনুপাতে সংসদ সদস্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ষোলোআনাই ফাঁকি। যে জনগণ বুকের পাটা দেখিয়ে এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছে, সেই জনগণকেই ভূমিকা নিতে হবে, বিড়ালের গাছে ওঠার গল্প মনে রাখতে হবে, আর জানতে হবে কখন শাসকশ্রেণী গাছে ওঠে।

নাহিদ নলেজ :সাবেক সভাপতি
বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, কাবিক, রংপুর

No comments

Powered by Blogger.