সমুদ্রসৈকত কত দূর? by মহসীন হাবিব
বেশ কিছুকাল ধরে বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠান ট্যুরিস্ট আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীও ট্যুরিস্টদের বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য একাধিকবার জোর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি ভাষণ দানকালে এই আমন্ত্রণ জানান। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে,
ওয়েবসাইটে এবং ফেইসবুকে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। সবাই উল্লেখ করছেন, আমাদের আছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আপনারা আসুন, ভ্রমণ করুন।
আমন্ত্রণকারীদের ধন্যবাদ। কারণ শুধু দর্জির কাজ করে আর স্বল্প মজুরির অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করে একটি দেশের পক্ষে দরিদ্র অবস্থা থেকে মধ্য আয়ে উন্নীত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। ট্যুরিজম এখন প্রায় প্রতিটি দেশের রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি_এগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বড় বরকত এনে দেওয়ার খাত হলো ট্যুরিজম। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বহু দেশের অন্যতম আয় হলো এই ট্যুরিজম খাত। বাংলাদেশে এগুলো যাঁরা অনুধাবন করছেন, তাঁরা চিৎকার করে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষণীয়, বিশ্বের কোটি কোটি ট্যুরিস্ট যেন কানে তুলা দিয়ে আছেন। কোনোক্রমেই শুনতে চাচ্ছেন না, সত্যিই বাংলাদেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে। এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে কিছু ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে আসবেন, এমন ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু চোখ খুলে তাকালেই দেখা যাবে, স্বল্পসংখ্যক ক্রিকেট দর্শক এসেছেন; কোনো ট্যুরিস্ট আসেননি। নিষ্ঠুর সত্য হলো, ট্যুরিস্ট আকর্ষণের যে সমুদ্রসৈকত, তার বৈশিষ্ট্যগত দিক বিচারে বাংলাদেশে লম্বা একটি সমুদ্রপাড় (কূল) আছে; সমুদ্রসৈকত নেই। একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে, কিন্তু সেখানে পর্যটক আকর্ষণের কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্বে কোটি কোটি ট্যুরিস্ট রয়েছে। এমন ট্যুরিস্টও আছেন, যাঁরা সারা বছর কোনো না কোনো ট্যুরিস্ট স্পটে থাকেন। এক দেশ থেকে চলে যান অন্য দেশে। এক সমুদ্রসৈকত থেকে ছুটতে থাকেন অন্য কোনো ঐতিহাসিক স্থান দর্শনে। তাঁরাও এমনকি বাংলাদেশকে (হয়তো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও) স্পট হিসেবে তালিকায় রাখেন না। কেন রাখেন না, সেই কারণ আমাদের জানা দরকার।
ট্যুরিস্টদের ঐতিহ্যগত কিছু শর্ত আছে। এর প্রথম শর্ত হলো নিরাপত্তা। নিরাপত্তা বলতে আমরা এখন বুঝি মৌলবাদী সংগঠনগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা। সেই প্রশ্ন তো আছেই, তার বাইরেও ট্যুরিস্টদের কাছে একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা বিভিন্ন দেশে পর্যটনে যান, তাঁরা অত্যন্ত সঠিকভাবে খোঁজখবর রাখেন, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই বিচারে কঙ্বাজার 'সমুদ্রসৈকত' অঞ্চল এবং সেখানে যাওয়ার পথ আগেও নিরাপদ ছিল না, এখনো নিরাপদ নয়। আমার এক ইউরোপীয় আত্মীয়া কয়েক বছর আগে কঙ্বাজারে গিয়েছিলেন। তিনি পেশায় স্কুল টিচার। বাংলাদেশের অসহায় স্কুল টিচারের মতো নন; ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে প্রথম শ্রেণীর সম্মানিত পেশার নাগরিক। এসেছিলেন কঙ্বাজার দেখতে নয়, তার পরও আত্মীয়স্বজনের মুখে এত বড় সমুদ্রসৈকতের গল্প শুনে সেখানে গেলেন। শরীর-হাত-পা ঢেকে রেখেই সেখানে সময় উপভোগের চেষ্টা করলেন। স্বাস্থ্য সচেতন এই মানুষটি জগিং করে লোকজনের ভিড় থেকে একটু দূরে যেতেই তিন-চারজন ছিনতাইকারী অকস্মাৎ বেরিয়ে এসে তাঁর গলায় লম্বা ছুরি ধরে মূল্যবান ক্যামেরাটি নিয়ে গেল। এই আকস্মিক ঘটনায় তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সমাজের কোনো লোক এই কাহিনী শুনে বাংলাদেশের সমুদ্র দেখতে আসবে? আমাদের অসংলগ্ন বিষয়গুলো লক্ষণীয়। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিদেশিদের আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, সেই দেশের সৈকত অঞ্চল ছিঁচকে ছিনতাইকারীদের দখলে! মনে হয়, না আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, না আছে পর্যটন করপোরেশনের কোনো দায়িত্ব।
বিশ্বের সব পর্যটকের একটি বৈশিষ্ট্য আছে_বিশেষ করে সমুদ্র সৈকত উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের আনন্দ চান। তাঁরা সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা সি-বিচে রৌদ্রস্নান করেন, সন্ধ্যার পর নানা রকম পার্টি, নানা রকম আয়োজনে চলে যান। এরপর তাঁরা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে যান। সেই ব্যবস্থা এখানে কোথায়? বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতের যে পরিবেশ, তাতে কার সাহস আছে যে সেখানে সমুদ্রে নামার মানানসই পোশাক পড়ে স্নান করতে যাবেন? সরকার যে সমুদ্রসৈকতকে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করতে চায়, পারবে কি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে? যদি তা না পারে, তাহলে আর বিদেশিদের ডাকাডাকি কেন? সমুদ্রসৈকতের সংস্কৃতি কখনো একটি জাতীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে না। তার প্রমাণ ইন্দোনেশিয়ার বালি, ভারতের গোয়া কিংবা মালদ্বীপের কোকোয়া বা নিকা সমুদ্রসৈকত। প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ভারতের গোয়ায় সমুদ্রসৈকতের পৃথক এলাকা ভাগ করে দেওয়া আছে, যেখানে সাধারণত শুধু বিদেশিরাই জলস্নান-রৌদ্রস্নান করে থাকে। তীক্ষ্ন নজরদারি রয়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলার ওপর। গোয়ার অনেক এলাকায় ঢুকলে কেউ ভাবতেই পারবে না, এটা ভারতের কোনো স্থান। এতে কি ভারতের পরিচয় নষ্ট হয়ে গেছে?
সৈকতের চিরচেনা পোশাক হলো বিকিনি, সুইমিং কাস্ট। আমরা এমন সংস্কৃতির মধ্যে আটকে গেছি যে মধ্যপ্রাচ্যের জোব্বা গায়ে দেশগুলোর সৈকতে যে পোশাক পরে লোকে নামছে, সেই পোশাক এখানে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কেন এখানকার সৈকতে মানুষ আসবে?
এবার সুন্দরবনের কথা ধরা যাক। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তবে তা ডাকাত এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর দখলে। বাংলাদেশের মানুষই তো সেখানে যেতে ভয় পায়, বিদেশিরা আসবে কী করে? সুন্দরবনের আশপাশে কোথাও বিদেশিদের থাকার পরিবেশ নেই। বন গবেষণা, প্রাণী গবেষণায় জড়িয়ে আছে পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ। সঠিক পরিবেশের অভাবে তাদের কোনো সুযোগ নেই এখানে এসে দিনের পর দিন থেকে কাজ করার। পর্যটন করপোরেশনের তাহলে প্রচেষ্টা কী, সফলতা কী? দেশের বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী একজন সজ্জন-দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পরিচিত। আমরা কি ভেবে নেব, তিনি কাজ করতে পারছেন না?
এখানেই শেষ নয়। দেশের মানুষের ট্যুরিস্ট গ্রহণ করার একটা মানসিকতা তৈরি থাকতে হয়। পর্যটকরা দেশের মানুষের আচার-আচরণের ঘ্রাণ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে কেমন ধারণা রয়েছে বহির্বিশ্বে? সেই ধারণা কতটা বেঠিক, তা ভেবে দেখার বিষয়। ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে রয়েছে এমন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, যে আয়ারল্যান্ডের কাছে ক্রিকেট ম্যাচে পরাজয়ের চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছু ইংল্যান্ডের সামনে নেই। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বিশ্বকাপ ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় এবং দলীয় কর্মকর্তারা হাসিমুখে অভিনন্দন জানালেন আইরিশদের। কেভিন ও'ব্রায়ানের দুর্দান্ত শতরানকে ইংলিশ দর্শকরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল। আর বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো যোগ্য একটি দলকে পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে এবং লজ্জাজনকভাবে তাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রিস গেইলদের বহনকারী গাড়িতে ছুড়ল ঢিল! লজ্জাজনক সেই খবর প্রচার করতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশখানিকটা সময় বিব্রত বোধ করল। খবরটি বাংলাদেশের আগে প্রথম প্রচার করল সিএনএনের মতো সারা বিশ্ব কভারেজ দেওয়া প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের সম্পর্কে আগ্রহ আশা করা যায়?
এসব অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে। কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব চিত্রে। দরকার অনেক পাঁচতারা হোটেল, দরকার বিদেশিদের জন্য সমুদ্রসৈকতে পৃথক অঞ্চল করে দেওয়া_যেখানে তারা দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ করতে পারবে, যেখানে নাচতে পারবে, গাইতে পারবে এবং সৈকত উপভোগ করতে পারবে। সুন্দরবন এলাকাকে দস্যুমুক্ত করে বিদেশিদের জন্য অবস্থান করার উপযোগী অবকাঠামো তৈরি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা হোক। শুধু এই সহজ তিনটি কাজ করার উদ্যোগ নিলে হলফ করে বলে দেওয়া যায়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য পর্যটন-আয় সম্ভব হবে। কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
আমন্ত্রণকারীদের ধন্যবাদ। কারণ শুধু দর্জির কাজ করে আর স্বল্প মজুরির অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করে একটি দেশের পক্ষে দরিদ্র অবস্থা থেকে মধ্য আয়ে উন্নীত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। ট্যুরিজম এখন প্রায় প্রতিটি দেশের রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি_এগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বড় বরকত এনে দেওয়ার খাত হলো ট্যুরিজম। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বহু দেশের অন্যতম আয় হলো এই ট্যুরিজম খাত। বাংলাদেশে এগুলো যাঁরা অনুধাবন করছেন, তাঁরা চিৎকার করে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষণীয়, বিশ্বের কোটি কোটি ট্যুরিস্ট যেন কানে তুলা দিয়ে আছেন। কোনোক্রমেই শুনতে চাচ্ছেন না, সত্যিই বাংলাদেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে। এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে কিছু ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে আসবেন, এমন ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু চোখ খুলে তাকালেই দেখা যাবে, স্বল্পসংখ্যক ক্রিকেট দর্শক এসেছেন; কোনো ট্যুরিস্ট আসেননি। নিষ্ঠুর সত্য হলো, ট্যুরিস্ট আকর্ষণের যে সমুদ্রসৈকত, তার বৈশিষ্ট্যগত দিক বিচারে বাংলাদেশে লম্বা একটি সমুদ্রপাড় (কূল) আছে; সমুদ্রসৈকত নেই। একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে, কিন্তু সেখানে পর্যটক আকর্ষণের কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্বে কোটি কোটি ট্যুরিস্ট রয়েছে। এমন ট্যুরিস্টও আছেন, যাঁরা সারা বছর কোনো না কোনো ট্যুরিস্ট স্পটে থাকেন। এক দেশ থেকে চলে যান অন্য দেশে। এক সমুদ্রসৈকত থেকে ছুটতে থাকেন অন্য কোনো ঐতিহাসিক স্থান দর্শনে। তাঁরাও এমনকি বাংলাদেশকে (হয়তো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও) স্পট হিসেবে তালিকায় রাখেন না। কেন রাখেন না, সেই কারণ আমাদের জানা দরকার।
ট্যুরিস্টদের ঐতিহ্যগত কিছু শর্ত আছে। এর প্রথম শর্ত হলো নিরাপত্তা। নিরাপত্তা বলতে আমরা এখন বুঝি মৌলবাদী সংগঠনগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা। সেই প্রশ্ন তো আছেই, তার বাইরেও ট্যুরিস্টদের কাছে একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা বিভিন্ন দেশে পর্যটনে যান, তাঁরা অত্যন্ত সঠিকভাবে খোঁজখবর রাখেন, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই বিচারে কঙ্বাজার 'সমুদ্রসৈকত' অঞ্চল এবং সেখানে যাওয়ার পথ আগেও নিরাপদ ছিল না, এখনো নিরাপদ নয়। আমার এক ইউরোপীয় আত্মীয়া কয়েক বছর আগে কঙ্বাজারে গিয়েছিলেন। তিনি পেশায় স্কুল টিচার। বাংলাদেশের অসহায় স্কুল টিচারের মতো নন; ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে প্রথম শ্রেণীর সম্মানিত পেশার নাগরিক। এসেছিলেন কঙ্বাজার দেখতে নয়, তার পরও আত্মীয়স্বজনের মুখে এত বড় সমুদ্রসৈকতের গল্প শুনে সেখানে গেলেন। শরীর-হাত-পা ঢেকে রেখেই সেখানে সময় উপভোগের চেষ্টা করলেন। স্বাস্থ্য সচেতন এই মানুষটি জগিং করে লোকজনের ভিড় থেকে একটু দূরে যেতেই তিন-চারজন ছিনতাইকারী অকস্মাৎ বেরিয়ে এসে তাঁর গলায় লম্বা ছুরি ধরে মূল্যবান ক্যামেরাটি নিয়ে গেল। এই আকস্মিক ঘটনায় তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সমাজের কোনো লোক এই কাহিনী শুনে বাংলাদেশের সমুদ্র দেখতে আসবে? আমাদের অসংলগ্ন বিষয়গুলো লক্ষণীয়। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিদেশিদের আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, সেই দেশের সৈকত অঞ্চল ছিঁচকে ছিনতাইকারীদের দখলে! মনে হয়, না আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, না আছে পর্যটন করপোরেশনের কোনো দায়িত্ব।
বিশ্বের সব পর্যটকের একটি বৈশিষ্ট্য আছে_বিশেষ করে সমুদ্র সৈকত উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের আনন্দ চান। তাঁরা সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা সি-বিচে রৌদ্রস্নান করেন, সন্ধ্যার পর নানা রকম পার্টি, নানা রকম আয়োজনে চলে যান। এরপর তাঁরা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে যান। সেই ব্যবস্থা এখানে কোথায়? বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতের যে পরিবেশ, তাতে কার সাহস আছে যে সেখানে সমুদ্রে নামার মানানসই পোশাক পড়ে স্নান করতে যাবেন? সরকার যে সমুদ্রসৈকতকে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করতে চায়, পারবে কি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে? যদি তা না পারে, তাহলে আর বিদেশিদের ডাকাডাকি কেন? সমুদ্রসৈকতের সংস্কৃতি কখনো একটি জাতীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে না। তার প্রমাণ ইন্দোনেশিয়ার বালি, ভারতের গোয়া কিংবা মালদ্বীপের কোকোয়া বা নিকা সমুদ্রসৈকত। প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ভারতের গোয়ায় সমুদ্রসৈকতের পৃথক এলাকা ভাগ করে দেওয়া আছে, যেখানে সাধারণত শুধু বিদেশিরাই জলস্নান-রৌদ্রস্নান করে থাকে। তীক্ষ্ন নজরদারি রয়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলার ওপর। গোয়ার অনেক এলাকায় ঢুকলে কেউ ভাবতেই পারবে না, এটা ভারতের কোনো স্থান। এতে কি ভারতের পরিচয় নষ্ট হয়ে গেছে?
সৈকতের চিরচেনা পোশাক হলো বিকিনি, সুইমিং কাস্ট। আমরা এমন সংস্কৃতির মধ্যে আটকে গেছি যে মধ্যপ্রাচ্যের জোব্বা গায়ে দেশগুলোর সৈকতে যে পোশাক পরে লোকে নামছে, সেই পোশাক এখানে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কেন এখানকার সৈকতে মানুষ আসবে?
এবার সুন্দরবনের কথা ধরা যাক। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তবে তা ডাকাত এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর দখলে। বাংলাদেশের মানুষই তো সেখানে যেতে ভয় পায়, বিদেশিরা আসবে কী করে? সুন্দরবনের আশপাশে কোথাও বিদেশিদের থাকার পরিবেশ নেই। বন গবেষণা, প্রাণী গবেষণায় জড়িয়ে আছে পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ। সঠিক পরিবেশের অভাবে তাদের কোনো সুযোগ নেই এখানে এসে দিনের পর দিন থেকে কাজ করার। পর্যটন করপোরেশনের তাহলে প্রচেষ্টা কী, সফলতা কী? দেশের বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী একজন সজ্জন-দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পরিচিত। আমরা কি ভেবে নেব, তিনি কাজ করতে পারছেন না?
এখানেই শেষ নয়। দেশের মানুষের ট্যুরিস্ট গ্রহণ করার একটা মানসিকতা তৈরি থাকতে হয়। পর্যটকরা দেশের মানুষের আচার-আচরণের ঘ্রাণ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে কেমন ধারণা রয়েছে বহির্বিশ্বে? সেই ধারণা কতটা বেঠিক, তা ভেবে দেখার বিষয়। ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে রয়েছে এমন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, যে আয়ারল্যান্ডের কাছে ক্রিকেট ম্যাচে পরাজয়ের চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছু ইংল্যান্ডের সামনে নেই। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বিশ্বকাপ ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় এবং দলীয় কর্মকর্তারা হাসিমুখে অভিনন্দন জানালেন আইরিশদের। কেভিন ও'ব্রায়ানের দুর্দান্ত শতরানকে ইংলিশ দর্শকরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল। আর বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো যোগ্য একটি দলকে পরাজয়ের স্বপ্ন দেখে এবং লজ্জাজনকভাবে তাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রিস গেইলদের বহনকারী গাড়িতে ছুড়ল ঢিল! লজ্জাজনক সেই খবর প্রচার করতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশখানিকটা সময় বিব্রত বোধ করল। খবরটি বাংলাদেশের আগে প্রথম প্রচার করল সিএনএনের মতো সারা বিশ্ব কভারেজ দেওয়া প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের সম্পর্কে আগ্রহ আশা করা যায়?
এসব অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে। কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব চিত্রে। দরকার অনেক পাঁচতারা হোটেল, দরকার বিদেশিদের জন্য সমুদ্রসৈকতে পৃথক অঞ্চল করে দেওয়া_যেখানে তারা দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ করতে পারবে, যেখানে নাচতে পারবে, গাইতে পারবে এবং সৈকত উপভোগ করতে পারবে। সুন্দরবন এলাকাকে দস্যুমুক্ত করে বিদেশিদের জন্য অবস্থান করার উপযোগী অবকাঠামো তৈরি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা হোক। শুধু এই সহজ তিনটি কাজ করার উদ্যোগ নিলে হলফ করে বলে দেওয়া যায়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য পর্যটন-আয় সম্ভব হবে। কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments