চারদিক-কেমন আছেন দেবদুলাল by অমর সাহা
না এখন তিনি ভালো নেই। একাত্তরের সেই কণ্ঠও যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হয়। অস্পষ্ট উচ্চারণ। জড়িয়ে যায়। তবু আকারে-ইঙ্গিতে চেষ্টা করেন কিছু বলতে। কিছু বোঝাতে। তিনি হলেন সেই একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন উত্তাল দিনগুলোর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাদাতা কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেদিন কে চিনতেন না এই দেবদুলালকে? হয়তো দেখেননি অনেকে, কিন্তু কণ্ঠ ছিল পরিচিত। গোটা বাংলাদেশেই তিনি কোটি মানুষের কাছে পরিচিতি ছিলেন একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে। পরিচিত ছিল আবালবৃদ্ধ জনতার কাছে তাঁর মধুর কণ্ঠ।
আজ সেই কণ্ঠসৈনিক জীবনসায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স ৭৫ পার করেছেন। এখন শুয়ে আছেন কলকাতার সাদার্ন এভিনিউয়ের নিজ বাসভবনের একটি ছোট্ট খাটে।
দিনটা ছিল রোববার। বিকেল পাঁচটা। আমি ও আমাদের চিত্রগ্রাহক ভাস্কর মুখোপাধ্যায় গেলাম তাঁর বাসভবনে। চতুর্থ তলায় থাকেন তিনি। কলবেলের আওয়াজে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে দেবারতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন দেবদুলালের কাছে। তিনি শুয়ে আছেন। পরনে চেক লুঙ্গি আর সবুজ জামা। বললাম, ঢাকার কাগজের লোক আমরা। শুনেই উঠে বসতে চাইলেন। মেয়ে দেবারতী সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শুইয়ে দিলেন। দেবারতী বললেন, ‘বাবা দুরারোগ্য পিএসপি বা প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি রোগে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন তেমন একটা কথা বলতে পারেন না। তবে সব বোঝেন। একটু হাঁটাচলা করতে পারেন। খেতেও পারেন সামান্য। দেবারতী আরও বললেন, ‘২০০৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর বাবা একটু বেশি ভেঙে পড়েছেন। এখন আমরা দেখভাল করছি বাবার। চিকিৎসা করছেন ডা. দেবব্রত দে ও ডা. সঞ্জীব কাসেরা।’ দেবারতী বললেন, ‘আমরা দুই ভাইবোন। দাদা দেবরাজ কলকাতা ২৪ ঘণ্টা সংবাদ চ্যানেলে কর্মরত। আর আমি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি।’
‘মনে পড়ে একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা?’ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন দেবদুলাল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব মনে আছে। ভুলব কেমন করে। বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় স্বদেশ! তাকে কি ভোলা যায়?’
১৯৬৩ সাল থেকে আকাশবাণী রেডিও কেন্দ্রে চাকরি করেছেন দেবদুলাল। আর সেখান থেকেই অবসর নিয়েছেন ১৯৯৪ সালে।
দেবদুলাল বললেন, তাঁর পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা। বললেন, ‘সেদিন আমি প্রাণভরে আমার যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমন ঘটনা তো সবার ভাগ্যে ঘটে না! আমি তো সেই ঘটনার ভাগ্যবান ব্যক্তি। পেয়েছি কোটি বাঙালির ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আমি মরতে চাই।’
দেবদুলাল বললেন, ‘আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসত আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা।’
বললেন, ‘মুত্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়ব বাংলাদেশের খবর।’ বললেন, ‘এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে!’
‘একাত্তর কেন, সেই ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও পড়েছি বাংলাদেশের খবর। তখন কে জানত, এই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালিদের রাষ্ট্র! পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য তৈরি হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি।’ বললেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্য বোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা বলতে গিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশে। ওই সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম আমরা। উঠেছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। আমি তখন বেতার সাংবাদিক হিসেবে প্রথম পা রাখি ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, কোথায় আমাদের সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়? আমি তখন উঠে এগিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল আকাশবাণী আর বিবিসি রেডিও। এই আকাশবাণীতেই সংবাদ, সংবাদ-সমীক্ষা ও সংবাদ-পরিক্রমা পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদ-সমীক্ষা আর পরিক্রমা লিখতেন প্রণবেশ সেন। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সংবাদ-পরিক্রমা প্রযোজনা করতেন উপেন তরফদার। তখন পাকিস্তান সরকার আকাশবাণীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ গোপনে, এমনকি জঙ্গলে গিয়েও শুনেছেন আকাশবাণী বা বিবিসির খবর। আর আকাশবাণীর সেই খবর হূদয় দিয়ে পড়েছেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী।
আজ সেই কণ্ঠসৈনিক জীবনসায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স ৭৫ পার করেছেন। এখন শুয়ে আছেন কলকাতার সাদার্ন এভিনিউয়ের নিজ বাসভবনের একটি ছোট্ট খাটে।
দিনটা ছিল রোববার। বিকেল পাঁচটা। আমি ও আমাদের চিত্রগ্রাহক ভাস্কর মুখোপাধ্যায় গেলাম তাঁর বাসভবনে। চতুর্থ তলায় থাকেন তিনি। কলবেলের আওয়াজে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে দেবারতী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন দেবদুলালের কাছে। তিনি শুয়ে আছেন। পরনে চেক লুঙ্গি আর সবুজ জামা। বললাম, ঢাকার কাগজের লোক আমরা। শুনেই উঠে বসতে চাইলেন। মেয়ে দেবারতী সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শুইয়ে দিলেন। দেবারতী বললেন, ‘বাবা দুরারোগ্য পিএসপি বা প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি রোগে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন তেমন একটা কথা বলতে পারেন না। তবে সব বোঝেন। একটু হাঁটাচলা করতে পারেন। খেতেও পারেন সামান্য। দেবারতী আরও বললেন, ‘২০০৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর বাবা একটু বেশি ভেঙে পড়েছেন। এখন আমরা দেখভাল করছি বাবার। চিকিৎসা করছেন ডা. দেবব্রত দে ও ডা. সঞ্জীব কাসেরা।’ দেবারতী বললেন, ‘আমরা দুই ভাইবোন। দাদা দেবরাজ কলকাতা ২৪ ঘণ্টা সংবাদ চ্যানেলে কর্মরত। আর আমি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি।’
‘মনে পড়ে একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা?’ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন দেবদুলাল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব মনে আছে। ভুলব কেমন করে। বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় স্বদেশ! তাকে কি ভোলা যায়?’
১৯৬৩ সাল থেকে আকাশবাণী রেডিও কেন্দ্রে চাকরি করেছেন দেবদুলাল। আর সেখান থেকেই অবসর নিয়েছেন ১৯৯৪ সালে।
দেবদুলাল বললেন, তাঁর পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা। বললেন, ‘সেদিন আমি প্রাণভরে আমার যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমন ঘটনা তো সবার ভাগ্যে ঘটে না! আমি তো সেই ঘটনার ভাগ্যবান ব্যক্তি। পেয়েছি কোটি বাঙালির ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আমি মরতে চাই।’
দেবদুলাল বললেন, ‘আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসত আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা।’
বললেন, ‘মুত্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়ব বাংলাদেশের খবর।’ বললেন, ‘এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে!’
‘একাত্তর কেন, সেই ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও পড়েছি বাংলাদেশের খবর। তখন কে জানত, এই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালিদের রাষ্ট্র! পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য তৈরি হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি।’ বললেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্য বোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা বলতে গিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশে। ওই সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম আমরা। উঠেছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। আমি তখন বেতার সাংবাদিক হিসেবে প্রথম পা রাখি ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, কোথায় আমাদের সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়? আমি তখন উঠে এগিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল আকাশবাণী আর বিবিসি রেডিও। এই আকাশবাণীতেই সংবাদ, সংবাদ-সমীক্ষা ও সংবাদ-পরিক্রমা পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদ-সমীক্ষা আর পরিক্রমা লিখতেন প্রণবেশ সেন। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সংবাদ-পরিক্রমা প্রযোজনা করতেন উপেন তরফদার। তখন পাকিস্তান সরকার আকাশবাণীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ গোপনে, এমনকি জঙ্গলে গিয়েও শুনেছেন আকাশবাণী বা বিবিসির খবর। আর আকাশবাণীর সেই খবর হূদয় দিয়ে পড়েছেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী।
No comments