ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : 'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না' by সেলিনা হোসেন
চল্লিশের দশকে প্রখ্যাত মনীষী এস ওয়াজেদ আলি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন, এই জাতি একজন মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে। কী গভীর অর্থবহ কথা। আশাটা কি বেশি করা হয়েছিল যে বাঙালি শুধু ভারতবর্ষের নয়, প্রাচ্য ভুখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে?
অর্থচ কী আশ্চর্য, চলি্লশের দশক থেকে ষাটের দশক_মাত্র দুই দশক সময়ের ব্যবধানে এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তাঁর সেই অসাধারণ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, একটি অলৌকিক বাক্য। তিনি তর্জনী তুলে পরিষ্কার বলেছিলেন, 'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না।' বাক্যটি ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন তাহলে বলতেন, 'আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।' তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দসহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ের এ বিশাল দরজা খুলে দিয়েছেন, যে দরজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য।
এই ছোট্ট বাক্যটির সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে এস ওয়াজেদ আলির একটি দীর্ঘ বাক্যের সঙ্গে, যেখানে তিনি বলেছেন, বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে। যিনি তাঁকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন_ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুস্পষ্ট করে তুলবেন। পার্থক্য এই যে তাঁকে দীর্ঘ অর্থবহ বাক্য রচনা করতে হয়নি, তিনি রচনা করেছেন ছোট অথচ তীক্ষ্ন, অপ্রমিত অথচ গভীর অর্থবহ বাক্য। একজন প্রাজ্ঞ সাহিত্যে, আর একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিতে। দুইজনেরই অঙ্গীকার জাতির কাছে, জীবনের কাছে। দুইজনেরই যাত্রা অসীম জীবনের সন্ধানে। কেউ কাউকে দেখেনি অথচ একজন অন্যজনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। দুইজনের অজান্তে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের অলিখিত সত্য। একজন সাহিত্যের ভেতর দিয়ে রাজনীতির কথা বলেছেন, অন্যজন রাজনীতির ভেতর দিয়ে সাহিত্যের কথা বলেছেন। দুটোই জীবন-সম্পৃক্ত, মানুষ-সম্পৃক্ত।
৭ মার্চের ভাষণে সেদিন তিনি সেই বাক্যটির পরে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' লক্ষণীয় বিষয় যে এ বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। এখানেও এস ওয়াজেদ আলির আর একটি বাক্যের সঙ্গে সংযোগসেতু রচিত হয়। যেখানে তিনি বলেছেন, 'এখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে_সত্য, সুন্দর, শুভ জীবন-পথের।' কী আশ্চর্যভাবে তিনি জাতীয় পটভূমি থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছেন_মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রতিটি দেশের জন্য সর্বজনীন সত্য। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না_এর জন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালি জাতিসত্তার ঊধর্ে্ব পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এ বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম। সেদিনের বক্তৃতায় তাঁর উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জনীর সঙ্গে কণ্ঠস্বর যখন একই সমান্তরালে পেঁৗছে যায়, তখনই বাঙালির অভিনব জীবন আস্বাদের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই পাইনি, তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তাঁর রাষ্ট্রভাষাকে বিশ্বের মানুষের কাছে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে আরো এক শরও বেশি পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বললেন, 'পৃথিবীর পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশ স্বাগতম।' ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল জাতিসংঘের ২৯তম নিয়মিত অধিবেশন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এ অধিবেশনের এশিয়ার দেশগুলোর একটির অন্যতম নেতা, যিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বরে বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি। ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার শুরুতে বলেছিলেন, 'বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।' সত্যি তো তাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ৬১ বছর পর আবার বিশ্বের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
চলি্লশের দশকে মনীষী এস ওয়াজেদ আলি তাঁর প্রবন্ধে বাঙালির জন্য একজন মহামানবের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা জানি না এস ওয়াজেদ আলির সে লেখাটি বঙ্গবন্ধু পড়েছিলেন কি না। না পড়ে থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই। বাঙালির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল সীমাহীন, বাঙালিকে কেন্দ্র করে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সমুদ্রসমান ভালোবাসা দিয়ে এ জাতিকে গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেওয়ার স্বপ্নে তৈরি করেছিলেন নিজের সবটুকু। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, একটি ভাষাগত ও জাতিগত রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে তা এ সময়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা-ই।
'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না'_এই পঙ্ক্তিটির চিত্রকল্প কল্পনা করলে কেমন দাঁড়াবে? ধরে নেওয়া যায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটি জনগোষ্ঠী। তার ঘাড়ের ওপর শোষকের পা_ নিংড়ে নিতে চায় তার জীবনের নির্যাস। কিন্তু কত দিন পা দাবিয়ে রাখবে? একে-দুইয়ে মাথা উঠাতে থাকে। সেই পা অস্বীকার করে উঁচু হয়ে উঠতে চায় মাথা।
ঘাড় উঁচু করে তাকাতে শুরু করে আকাশের দিকে। শাসকের দুই পা দুই হাতে ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। ভেবে নেওয়া যায় যে এমন অজস্র উঁচু হয়ে ওঠা মাথার চিত্রকল্প নিয়েই রচিত হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'বল বীর চির উন্নত মম শির'_কী আশ্চর্য মেলবন্ধন! এভাবেই বুঝি কবিতার ভাষার সঙ্গে রাজনীতি এক হয়। মুখোমুখি দাঁড়ায় কবি ও রাজনীতিবিদ। মনে হয় না কি 'আর দাবায়ে রাখতে পারবা না' পঙ্ক্তিটিও একটি কালজয়ী পঙ্ক্তি?
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি সমগ্র জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন_ইতিহাস তাঁরই পক্ষে যিনি সময়ের বিচারে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন। এ সংজ্ঞায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাঁকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন। যিনি কঠোর স্বরে নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সব কালের উপযোগী এবং সব দেশের জন্য প্রযোজ্য একটি অমর পঙ্ক্তি 'আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।'
এই অর্থে তিনি আমাদের জীবনে জাতির জনক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তাঁর সেই অসাধারণ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, একটি অলৌকিক বাক্য। তিনি তর্জনী তুলে পরিষ্কার বলেছিলেন, 'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না।' বাক্যটি ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন তাহলে বলতেন, 'আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।' তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দসহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ের এ বিশাল দরজা খুলে দিয়েছেন, যে দরজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য।
এই ছোট্ট বাক্যটির সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে এস ওয়াজেদ আলির একটি দীর্ঘ বাক্যের সঙ্গে, যেখানে তিনি বলেছেন, বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে। যিনি তাঁকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন_ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুস্পষ্ট করে তুলবেন। পার্থক্য এই যে তাঁকে দীর্ঘ অর্থবহ বাক্য রচনা করতে হয়নি, তিনি রচনা করেছেন ছোট অথচ তীক্ষ্ন, অপ্রমিত অথচ গভীর অর্থবহ বাক্য। একজন প্রাজ্ঞ সাহিত্যে, আর একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিতে। দুইজনেরই অঙ্গীকার জাতির কাছে, জীবনের কাছে। দুইজনেরই যাত্রা অসীম জীবনের সন্ধানে। কেউ কাউকে দেখেনি অথচ একজন অন্যজনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। দুইজনের অজান্তে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের অলিখিত সত্য। একজন সাহিত্যের ভেতর দিয়ে রাজনীতির কথা বলেছেন, অন্যজন রাজনীতির ভেতর দিয়ে সাহিত্যের কথা বলেছেন। দুটোই জীবন-সম্পৃক্ত, মানুষ-সম্পৃক্ত।
৭ মার্চের ভাষণে সেদিন তিনি সেই বাক্যটির পরে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' লক্ষণীয় বিষয় যে এ বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। এখানেও এস ওয়াজেদ আলির আর একটি বাক্যের সঙ্গে সংযোগসেতু রচিত হয়। যেখানে তিনি বলেছেন, 'এখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে_সত্য, সুন্দর, শুভ জীবন-পথের।' কী আশ্চর্যভাবে তিনি জাতীয় পটভূমি থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছেন_মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রতিটি দেশের জন্য সর্বজনীন সত্য। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না_এর জন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালি জাতিসত্তার ঊধর্ে্ব পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এ বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম। সেদিনের বক্তৃতায় তাঁর উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জনীর সঙ্গে কণ্ঠস্বর যখন একই সমান্তরালে পেঁৗছে যায়, তখনই বাঙালির অভিনব জীবন আস্বাদের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই পাইনি, তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তাঁর রাষ্ট্রভাষাকে বিশ্বের মানুষের কাছে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে আরো এক শরও বেশি পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বললেন, 'পৃথিবীর পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশ স্বাগতম।' ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল জাতিসংঘের ২৯তম নিয়মিত অধিবেশন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এ অধিবেশনের এশিয়ার দেশগুলোর একটির অন্যতম নেতা, যিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বরে বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি। ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার শুরুতে বলেছিলেন, 'বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।' সত্যি তো তাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ৬১ বছর পর আবার বিশ্বের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
চলি্লশের দশকে মনীষী এস ওয়াজেদ আলি তাঁর প্রবন্ধে বাঙালির জন্য একজন মহামানবের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা জানি না এস ওয়াজেদ আলির সে লেখাটি বঙ্গবন্ধু পড়েছিলেন কি না। না পড়ে থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই। বাঙালির প্রতি তাঁর আবেগ ছিল সীমাহীন, বাঙালিকে কেন্দ্র করে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং সমুদ্রসমান ভালোবাসা দিয়ে এ জাতিকে গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেওয়ার স্বপ্নে তৈরি করেছিলেন নিজের সবটুকু। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, একটি ভাষাগত ও জাতিগত রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে তা এ সময়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা-ই।
'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না'_এই পঙ্ক্তিটির চিত্রকল্প কল্পনা করলে কেমন দাঁড়াবে? ধরে নেওয়া যায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটি জনগোষ্ঠী। তার ঘাড়ের ওপর শোষকের পা_ নিংড়ে নিতে চায় তার জীবনের নির্যাস। কিন্তু কত দিন পা দাবিয়ে রাখবে? একে-দুইয়ে মাথা উঠাতে থাকে। সেই পা অস্বীকার করে উঁচু হয়ে উঠতে চায় মাথা।
ঘাড় উঁচু করে তাকাতে শুরু করে আকাশের দিকে। শাসকের দুই পা দুই হাতে ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। ভেবে নেওয়া যায় যে এমন অজস্র উঁচু হয়ে ওঠা মাথার চিত্রকল্প নিয়েই রচিত হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'বল বীর চির উন্নত মম শির'_কী আশ্চর্য মেলবন্ধন! এভাবেই বুঝি কবিতার ভাষার সঙ্গে রাজনীতি এক হয়। মুখোমুখি দাঁড়ায় কবি ও রাজনীতিবিদ। মনে হয় না কি 'আর দাবায়ে রাখতে পারবা না' পঙ্ক্তিটিও একটি কালজয়ী পঙ্ক্তি?
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি সমগ্র জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন_ইতিহাস তাঁরই পক্ষে যিনি সময়ের বিচারে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন। এ সংজ্ঞায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাঁকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন। যিনি কঠোর স্বরে নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সব কালের উপযোগী এবং সব দেশের জন্য প্রযোজ্য একটি অমর পঙ্ক্তি 'আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।'
এই অর্থে তিনি আমাদের জীবনে জাতির জনক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments