বিচারের বাণী-একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আইনি দর্শন by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রত্যাশিত ঘোষণাটি পাওয়া গেল ৩৮তম স্বাধীনতা দিবসের পূর্ববর্তী দিনটিতে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধগুলো (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৬, ৭ ও ৮ ধারায় দেওয়া যথাক্রমে ক্ষমতাবলে সরকার কর্তৃক ট্রাইব্যুনাল, অভিযোক্তা বা সরকারি আইনজীবী দল ও তদন্ত এজেন্সি গঠিত হয়েছে। আইন তার নিরপেক্ষ নিজস্ব গতিতে চলবে এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত ও পূরণ হবে।
ন্যায়বিচার কত দিন দ্বীপান্তরে? শোনা যাচ্ছিল ক্রন্দন ৩৮ বছর ধরে। আর ক্রন্দন নয়, আশা করা যায় বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদার ফ্যাসিবাদী অশুভ সময়ের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, তার মরণকামড় টের পাওয়া যাচ্ছে নানা কৌশলী ঢঙের অযুক্তি-কুযুক্তিতে। আপাতত সরল অথচ চাতুরী অযুক্তি কিংবা খোঁড়া যুক্তি যেটাকে বলা যায় সেটা হচ্ছে, ১৯৭৩ সালের আইনটি পুরোনো হয়ে গেছে এবং ২০০২ সালের ১ জুলাই প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত’ আইন—রোম আইন নামে পরিচিত—সেটার আদলে ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন করা হোক। এটা খণ্ডনের সাধারণ যুক্তিটি হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব আইনই সংশোধন করার প্রয়োজন হয় না। সব গণতান্ত্রিক দেশেই কালোত্তীর্ণ এমন আইন আছে, যা সে দেশের বিজ্ঞ আইনবিদেরা তাঁদের বুদ্ধি দিয়ে যত্ন করে প্রণয়ন করে গেছেন ও সেটা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের উত্তর-পুরুষেরা মেনে চলছেন বহুকাল ধরে।
তবে সব কটি বিরুদ্ধ যুক্তি বাতিল করার হাতিয়ার যে আইনি দর্শন, আজ তা বলার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। একাত্তরের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ২৬ মার্চের আগমনের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বস্তুত একাত্তরের ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আদেশে প্রচারিত ৩৫টি প্রশাসনিক নির্দেশনামার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। সুতরাং ২৬ মার্চ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যুদ্ধ।
বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধে আক্রান্ত রাষ্ট্র ও পাকিস্তান ছিল বেআইনি দখলদার আগ্রাসী রাষ্ট্র এবং এই যুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনা করা যায়। সে যুদ্ধে জার্মানি ও ইতালি ছিল আক্রমণকারী রাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র ছিল আক্রান্ত রাষ্ট্র। এই যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছিল ‘চার্টার অব নুরেমবার্গ ট্রায়াল’ বা নুরেমবার্গ বিচারের সনদপত্র। ১৯৭৩ সালের আইনটিও ওই চার্টারের অনুসরণে প্রণীত হয়। যেমন—১৯৭৩ সালের আইনটির ৩(২)(খ) ধারার উদ্ধৃতি এই: ‘শান্তিবিরুদ্ধ অপরাধ, যথা— আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ, মতৈক্যসমূহ কিংবা প্রতিশ্রুতিসমূহ ভঙ্গ করিয়া যুদ্ধের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, পদক্ষেপ নেওয়া কিংবা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া।’ এটা নুরেমবার্গ বিচারের সনদপত্রের ৬ ধরার ১ দফার হুবহু একই। এ রকম একাধিক উদাহরণ দেওয়া যায়। উল্লেখ্য, এ আইনটির খসড়া প্রস্তুত হলে সেটা আন্তর্জাতিক দুজন আইনবিশেষজ্ঞ খুঁটিয়ে দেখেন। তাঁদের একজন আয়ান ম্যাকভরমটি, যিনি তত্কালে জেনেভাস্থিত ‘আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ কমিশন’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। অপরজন অধ্যাপক অটো ভন ট্রিফটারার, যিনি নুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক আদালতে একজন প্রসিকিউটর ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আইনটি জুলাই মাসে কার্যকর হয়। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে জেনেভা শহরে জাতিসংঘের ‘মানবাধিকার কমিশন’-এর ২৯তম অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে ঘোষণা দেওয়া হয়: (১) যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যখন যেখানে সংঘটিত হবে, তার তদন্ত করতে হবে এবং সে অপরাধে কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত হলে তাকে গ্রেপ্তার, আটক ও বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যাবে। (২) উপরিউক্ত অপরাধীদের বিচার যে দেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে দেশে সে দেশের বিধানমতো হবে। (৩) উপরিউক্ত নীতিদ্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ব্যক্তি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সুপরিকল্পিত হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মারাত্মক অপরাধ করেছে বলে প্রমাণ আছে, তাদের বিচার করার অধিকার ও কর্তব্য বাংলাদেশের আছে।
উপরোল্লিখিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, কোনো দেশের ফৌজদারি আদালতের সম্পূরক হিসেবে আইনটি কার্যকর হবে, যার সরল অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তখনই কার্যকর করা যাবে, যখন কোনো দেশ তার এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য অপরাধের বিচার করতে সমর্থ কিংবা সম্মত নয়। উগান্ডা, কঙ্গো ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র—এই তিনটি রাষ্ট্র তাদের দেশে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উত্থাপন করেছে এবং সুদান রাষ্ট্রের দারফুর এলাকায় সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য সুদান সম্মত না হওয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উত্থাপিত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনটির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপট এবং ২০০৪ সালের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনটির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপট এক নয়, বরং পুরোপুরি ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো নির্ভেজাল যুদ্ধাপরাধ। এটি সমতুল্য যুদ্ধাপরাধ নয়, যা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচার্য। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধটি সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ চলাকালে। সে কারণে বিচারের কার্যক্রম ও পদ্ধতিও ভিন্ন এবং সেটা আইনি দর্শনে সঠিক ও স্বাভাবিক।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
তবে সব কটি বিরুদ্ধ যুক্তি বাতিল করার হাতিয়ার যে আইনি দর্শন, আজ তা বলার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। একাত্তরের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ২৬ মার্চের আগমনের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বস্তুত একাত্তরের ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আদেশে প্রচারিত ৩৫টি প্রশাসনিক নির্দেশনামার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। সুতরাং ২৬ মার্চ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যুদ্ধ।
বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধে আক্রান্ত রাষ্ট্র ও পাকিস্তান ছিল বেআইনি দখলদার আগ্রাসী রাষ্ট্র এবং এই যুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনা করা যায়। সে যুদ্ধে জার্মানি ও ইতালি ছিল আক্রমণকারী রাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র ছিল আক্রান্ত রাষ্ট্র। এই যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত হয়েছিল ‘চার্টার অব নুরেমবার্গ ট্রায়াল’ বা নুরেমবার্গ বিচারের সনদপত্র। ১৯৭৩ সালের আইনটিও ওই চার্টারের অনুসরণে প্রণীত হয়। যেমন—১৯৭৩ সালের আইনটির ৩(২)(খ) ধারার উদ্ধৃতি এই: ‘শান্তিবিরুদ্ধ অপরাধ, যথা— আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ, মতৈক্যসমূহ কিংবা প্রতিশ্রুতিসমূহ ভঙ্গ করিয়া যুদ্ধের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, পদক্ষেপ নেওয়া কিংবা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া।’ এটা নুরেমবার্গ বিচারের সনদপত্রের ৬ ধরার ১ দফার হুবহু একই। এ রকম একাধিক উদাহরণ দেওয়া যায়। উল্লেখ্য, এ আইনটির খসড়া প্রস্তুত হলে সেটা আন্তর্জাতিক দুজন আইনবিশেষজ্ঞ খুঁটিয়ে দেখেন। তাঁদের একজন আয়ান ম্যাকভরমটি, যিনি তত্কালে জেনেভাস্থিত ‘আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ কমিশন’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। অপরজন অধ্যাপক অটো ভন ট্রিফটারার, যিনি নুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক আদালতে একজন প্রসিকিউটর ছিলেন।
১৯৭৩ সালের আইনটি জুলাই মাসে কার্যকর হয়। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে জেনেভা শহরে জাতিসংঘের ‘মানবাধিকার কমিশন’-এর ২৯তম অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে ঘোষণা দেওয়া হয়: (১) যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যখন যেখানে সংঘটিত হবে, তার তদন্ত করতে হবে এবং সে অপরাধে কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত হলে তাকে গ্রেপ্তার, আটক ও বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যাবে। (২) উপরিউক্ত অপরাধীদের বিচার যে দেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে দেশে সে দেশের বিধানমতো হবে। (৩) উপরিউক্ত নীতিদ্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ব্যক্তি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সুপরিকল্পিত হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মারাত্মক অপরাধ করেছে বলে প্রমাণ আছে, তাদের বিচার করার অধিকার ও কর্তব্য বাংলাদেশের আছে।
উপরোল্লিখিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, কোনো দেশের ফৌজদারি আদালতের সম্পূরক হিসেবে আইনটি কার্যকর হবে, যার সরল অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তখনই কার্যকর করা যাবে, যখন কোনো দেশ তার এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য অপরাধের বিচার করতে সমর্থ কিংবা সম্মত নয়। উগান্ডা, কঙ্গো ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র—এই তিনটি রাষ্ট্র তাদের দেশে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উত্থাপন করেছে এবং সুদান রাষ্ট্রের দারফুর এলাকায় সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য সুদান সম্মত না হওয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উত্থাপিত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনটির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপট এবং ২০০৪ সালের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনটির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপট এক নয়, বরং পুরোপুরি ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো নির্ভেজাল যুদ্ধাপরাধ। এটি সমতুল্য যুদ্ধাপরাধ নয়, যা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচার্য। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধটি সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ চলাকালে। সে কারণে বিচারের কার্যক্রম ও পদ্ধতিও ভিন্ন এবং সেটা আইনি দর্শনে সঠিক ও স্বাভাবিক।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments