প্রস্তাবিত সাফারি পার্ক-পার্কটি হয়ে উঠুক দেশজ প্রাণীর অভয়াশ্রম by খসরু চৌধুরী

রাজধানী ঢাকা শহরের অদূরে রাথুরায় আরেকটি সাফারি পার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানাই। দুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সাফল্য ও অভিজ্ঞতা পার্ক নির্মাণে সহায়ক হবে বলে আশা রাখছি।


রাথুরা এলাকায় সাফারি পার্ক নির্মাণের জন্য সরকার বন বিভাগের ২১০ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং নির্মাণ ব্যয়ের জন্য ৩২.০৪ কোটি এবং পশুপাখি কেনার জন্য ১.০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সবকিছু সচল থাকলে এ বছর জুলাই মাসে পার্ক নির্মাণ শুরু হবে বলে আশা করা যায়।
ঢাকার কাছাকাছি এ ধরনের একটি পার্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল অনেক কাল ধরেই। আমাদের বনভূমিগুলোকে যে ধরনের মানবসৃষ্ট উৎপাত সহ্য করতে হয়, তাতে বনে গিয়ে কারও পক্ষে দু-একটি প্রাণীর বেশি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। কিন্তু সাফারি পার্কের কৃত্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবজন্তু দেখার সুযোগ মেলে। জীবজন্তুদের জন্য অবশ্য সাফারি পার্কের এলাকা মোটেই সুখের নয়। কারণ, একেকটি প্রাণী বিশেষভাবে গড়ে ওঠে একেক ধরনের বনাঞ্চলে। তাদের খাদ্য, শিকার ও গড়ে ওঠা সেই সব জঙ্গল সমর্থিত। সাফারি পার্কের মধ্যে পরিবেশগত সুবিধা না থাকলেও প্রাণীরা চিড়িয়াখানার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় থাকে। সাফারি পার্কের প্রজনন রেকর্ডও চিড়িখানার চেয়ে ভালো।
দুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কটি ঢাকা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় অনেকেই সেখানে যেতে পারে না। রাথুরায় নতুন পার্ক হলে ঢাকা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে দর্শনার্থীরা সেখানে পৌঁছতে পারবে। এ পার্কটি করার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে দু-একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। এটা নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখবেন।
বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং গ্রামীণ বনভূমি যেভাবে নষ্ট হচ্ছে, তাতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বন্য প্রাণী উদ্বাস্তু হয়ে গ্রামবাসীর হাতে মারা পড়ছে। ফলে খুব দ্রুতই আমাদের দেশি বন্য প্রাণী শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গন্ধগোকুল গোত্র ও বিড়াল গোত্রের প্রাণী মেরে ফেলা হচ্ছে। শিয়ালও বাদ যাচ্ছে না। এ অবস্থায় এসব প্রাণীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পার্কের মাধ্যমে হতে পারে।
সবচেয়ে ভালো হয় বিদেশ থেকে দামি প্রাণী আমদানি করে পার্ক না ভরিয়ে বাংলাদেশে যেসব প্রাণী রয়েছে, ওই সব প্রাণীর আবাসনের ব্যবস্থা পার্কে করলে। বাংলাদেশ এমন একটি আশ্চর্য দেশ, যেটি আকারে ছোট হলেও প্রাণিবৈচিত্র্য অসাধারণ। এই প্রাণীগুলোর বর্ণবৈচিত্র্য আকার-প্রকারও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এ দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাটিতে হাঁটা স্তন্যপায়ী হাতি, সবচেয়ে দীর্ঘ সরীসৃপ গোলবাহার সাপ, দীর্ঘ বিষধর শঙ্খচূড় পাওয়া যায়। আমাদের দেশের সুন্দরবন এখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে ডোরাকাটা বাঘের ঘনবসতির এলাকা। অথচ আমাদের দেশের কোনো চিড়িয়াখানায় বা পার্কে সুন্দরবনের বাঘ নেই। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একমাত্র যে বাঘটি ছিল, সেটি বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে তখনকার বন বিভাগ পচাব্দীগাজীকে দিয়ে সুন্দরবন থেকে বাঘের বাচ্চা ধরে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিলে তিনি সেটি ঢাকা চিড়িয়াখানায় অর্পণ করেন। পরে আনা বাঘগুলো ভারতীয় চিড়িয়াখানায় জন্মানো বাঘ, সুন্দরবনের নয়।
বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন অনেক প্রাণী ভারতে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। সেগুলো পার্কের জন্য আনা যেতে পারে। বারাশিঙা হরিণ, এশীয়, এক শিঙের গন্ডার, বুনো মোষ, গাউর, গুলবাঘ বা চিতাবাঘ, লামচিতা, সোনালি বিড়াল, মার্বেল বিড়াল, রামকুত্তা, শ্লথ ভালুক, হিমালয়ান বাদামি ভালুক, সান ভালুক, ডোরা হায়েনা, বাদামি নেকড়ে, নীলগাই, প্যারাইল্লা বানর—প্রাণীগুলো আশপাশের দেশ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। পাখিদের মধ্যে ময়ূর ও বার্মিজ ময়ূর, হাড়গিলা, কালো গলার স্টর্ক, ডেমোসেল ক্রেন, সারস—ভারত, নেপাল, মিয়ানমার থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। দেশে বর্তমানে থাকা প্রাণী এবং বিলুপ্ত হওয়া প্রাণী একত্র করতে পারলে আমরা একটা অসাধারণ সংগ্রহশালা পাব। স্নেকপার্ক, মেরিন অ্যাম্পোরিয়াম করার জন্য বিদেশি প্রাণী আমদানির দরকার নেই। এ দেশেই এদের পাওয়া যাবে।
প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের (রাথুরা) জন্য জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, পরবর্তীকালে পার্কের সম্প্রসারণের প্রয়োজন হতে পারে। তা ছাড়া এই এলাকার আশপাশের গজারি বন অনেকটাই দখলকারীদের হাতে চলে গেছে। এ ছাড়া পার্কের জমির আওতায় বেসরকারি-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কটেজ নির্মাণ, রেস্তোরাঁ নির্মাণের সুযোগ দিতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ যাতে পার্কের আয় থেকে উপকৃত হতে পারে, তারও ব্যবস্থা রাখতে হবে। এদিকের নদী-খালগুলোর পানি কলকারখানার বর্জ্যে পচে বিষাক্ত হয়ে আছে। পার্কের ভেতর অবশ্যই জলপ্রবাহের নদীর কিছুটা অংশ রাখা দরকার। এ কাজের জন্য পার্কের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত জলের খাত, যাতে বর্জ্য পচা না হয়, এর জন্য পানি ব্যবহারকারী আশপাশের কারখানাগুলোকে নিবৃত্ত করা প্রয়োজন।
আমাদের অনিকেত বন্য প্রাণী, বিলুপ্ত বন্য প্রাণী পার্কের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত হলে উদ্বৃত্ত প্রাণী আমাদের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতে পারবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আনা আফ্রিকার জেব্রা, জিরাফ, সিংহ ও উটপাখি দিয়ে আমাদের সাফারি পার্ক ভরিয়ে লাভ নেই। তার জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা। সাফারি পার্ক হয়ে উঠুক দেশজ প্রাণীর অভয়াশ্রম।
খসরু চৌধুরী: সাংবাদিক, বন বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.