বিশেষ সাক্ষাত্কার-সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সমাধান ঢাকায় ছোট কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র by এস এম লুত্ফুলকবীর

অধ্যাপক ড. এস এম লুত্ফুল কবীর বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির পরিচালক। শিক্ষকতার শুরু বুয়েটেই, ১৯৮২ সালে। ১৯৮৯ সালে ডিজিটাল মডেলিং অব লার্জ জেনারেশন বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।


১৯৯৯—২০০৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডেসকোর পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া কাজ করেছেন নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্প, প্রিপেইড মিটার, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, এসএসসি ও এইসএসসি পরীক্ষার ফলের কম্পিউটারাইজেশনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে। ৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও জার্নালে তাঁর রচনা পঠিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
 সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো  বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানের জন্য সরকারের পরিকল্পনা কতখানি বাস্তবসম্মত?
লুত্ফুল কবীর  মূল কারণ কয়েকটি, সেগুলো হলো—ক. উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বিশাল পার্থক্য, খ. সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং গ. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দুর্নীতি।
সরকারের পরিকল্পনার দুটি অংশ রয়েছে—একটি দীর্ঘমেয়াদি, অন্যটি স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং তার বাস্তবায়নকাল চার থেকে পাঁচ বছর ধরা হয়েছে। আর স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলনির্ভর উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে, যা এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য।
প্রথম আলো  বর্তমানের তীব্র সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো কীভাবে দ্রুত বিদ্যুৎ-সমস্যা দূর করতে পারবে?
লুত্ফুল কবীর  আমাদের যেহেতু গ্যাসের সংকট রয়েছে, তাই জ্বালানি হিসেবে ফার্নেস অয়েল বা ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ-যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। তবে এই উৎপাদন যন্ত্রগুলো যেহেতু ছোট আকারের, তাই এর ব্যবহারের দিকটা হতে হবে ভিন্ন। এসবের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ না করে যদি লোড সেন্টারে সরাসরি দেওয়া যায়, তবে কারিগরি দিক থেকে বেশি ফলপ্রসূ হয়। বিশ্বে এই ব্যবস্থাকে বলে ডিস্ট্রিবিউটেড উৎপাদনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সহজে ও স্বল্পতম সময়ে বিদ্যুতের বর্তমান সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে।
প্রথম আলো  এই ডিস্ট্রিবিউটেড বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা কোন এলাকায় বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে বলে আপনি মনে করেন?
লুত্ফুল কবীর  এই ব্যবস্থা ঢাকা শহরের জন্য আগে করা প্রয়োজন। কারণ কেবল ঢাকা শহরেই দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে দেশের বাকি অঞ্চলে লোডশেডিং করতে হয়। ছোট ছোট উৎপাদন যন্ত্রগুলো লোড সেন্টারের কাছে বসানোর ফলে সেই লোড সেন্টারের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হবে এবং সেখানে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল, তা দেশের অন্য জায়গায় দেওয়ার ফলে সেখানেও নিরবচ্ছিন্নতা আসবে। ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থায় একটা বড় দিক হলো, পুরো বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা থেকে একটি জায়গায় বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ টেনে নেওয়ায় ঢাকা শহরসহ অন্যান্য এলাকায় লো-ভোল্টেজের সমস্যা দেখা দেয়। আজ থেকে ১০ বছর আগে থেকেই শুনে আসছি, এ সমস্যার জন্য বহু পাম্প পুড়ে যায়। ডিস্ট্রিবিউটেড উৎপাদন-ব্যবস্থা ঢাকায় স্থাপন করা হলে সেই সমস্যাও দূর হবে বলে আমাদের স্টাডিতে দেখতে পেয়েছি।
প্রথম আলো  ঢাকা শহরে প্রায় এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে, এই চাহিদা কি এই ব্যবস্থায় মেটানো সম্ভব? এবং কাদের মাধ্যমে এগুলো স্থাপন ও পরিচালিত হবে?
লুত্ফুল কবীর  হ্যাঁ, সম্ভব। ঢাকা শহরে ডিপিডিসি ও ডেসকো এ দুটি বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তারা তাদের এলাকায় ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। যেমন, ডেসকো তার এলাকার সমগ্র বিদ্যুৎ মাত্র ছয়টি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। উপকেন্দ্রগুলো হলো কল্যাণপুর, মিরপুর, গুলশান, বসুন্ধরা, উত্তরা ও টঙ্গী। এই উপকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ ৩৩ কেভি লেভেলে জাতীয় গ্রিড থেকে না নিয়ে নতুন বিদ্যুৎ-যন্ত্রগুলো বসিয়ে তা থেকে নেওয়া হবে। উপকেন্দ্রগুলোর চাহিদা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৩০-৮০ মেগাওয়াটের বিভিন্ন আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র বসাতে হবে।
প্রথম আলো  এ প্রসঙ্গে বলা হয়, জমি-সংকটে নিমজ্জিত ঢাকায় এই বিদ্যুৎ-যন্ত্রগুলো বসানোর স্থান পাওয়া যাবে কি?
লুত্ফুল কবীর  উপকেন্দ্রভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলেছি, তার মানে এই নয় যে উপকেন্দ্রের মধ্যেই তা বসাতে হবে। উপকেন্দ্রের কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে ৩৩ কেভি লাইনের মাধ্যমে তা উপকেন্দ্রে সরবরাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে নদীসংলগ্ন এলাকাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। হাসনাবাদ, কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া, মিরপুর ইত্যাদি এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা সম্ভব। সরকার ডিপিডিসি ও ডেসকোকে উৎপাদনের জন্য দায়িত্ব দিতে পারে। তারা নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে টেন্ডার করে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থাপনার কাজ হাতে নিতে পারে।
প্রথম আলো  সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে এর বাস্তবায়নে কত সময়ের প্রয়োজন হবে?
লুত্ফুল কবীর  উল্টো দিক থেকে যদি আসি তাহলে বুঝতে সহজ হবে। আগে ধরি, আগামী গ্রীষ্মের আগেই অর্থাৎ ২০১১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করার জন্য সময় আছে কি না? কার্যাদেশ পাওয়ার পর যন্ত্রগুলো বাইরে থেকে আনা ও স্থাপনের জন্য ছয় মাস সময়ের প্রয়োজন, অর্থাৎ আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কার্যাদেশ দিতে হবে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় তিন মাস লেগে থাকে। তার জন্য জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াল, আগামী দেড় মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত ও আনুষঙ্গিক স্টাডি ও চাহিদা নিরূপণ করে দরপত্র তৈরির প্রয়োজন হবে। দেশের আপত্কালে এই সময়ের মধ্যে এই কাজ করতে না পারার কোনো কারণ দেখি না।
প্রথম আলো  আপনি এ ক্ষেত্রে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ-যন্ত্রের কথা বললেন, কিন্তু গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের কথা কেন ভাবা হচ্ছে না?
লুত্ফুল কবীর  গ্যাসের বর্তমান সংকট থাকার কারণে ফার্নেস অয়েলের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রগুলো যেন গ্যাসেও চালানো যায়, তাই প্রথমেই দ্বৈত জ্বালানিসংবলিত বিদ্যুৎ-যন্ত্র বসাতে হবে। তবে বিদ্যুৎ-যন্ত্রগুলো ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালাতে গেলে বর্তমানের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের জন্য বিদ্যুতের ভিন্ন মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজন হবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাধারণ গ্রাহক যদি শুধু বাতি-পাখার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তবে ২৫০-৩০০ ইউনিটের মধ্যে তাঁর মাসের চাহিদা সীমিত থাকে। ঢাকা বিদ্যুতের মূল্যতালিকায় ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারের জন্য মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যাঁরা এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার করবেন অথবা পণ্য উৎপাদনের কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁদের জন্য অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করার যৌক্তিকতা রয়েছে।
প্রথম আলো  তার মানে গেরস্থালি ব্যবহার আর বিলাসি ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আলাদা মূল্য ধার্য করার প্রস্তাব করছেন?
লুত্ফুল কবীর  এতে কোনো সমস্যা দেখি না। সব জিনিস কি আমরা দেশব্যাপী একই মূল্যে পেয়ে থাকি? এক টুকরো জমির মূল্য ঢাকা শহরে আর বরগুনা শহরে কি এক? প্রায় সব জিনিসই আমরা ঢাকায় অন্যান্য শহর থেকে বেশি দিয়ে কিনে থাকি। আসলে বিষয়টি অন্যভাবে দেখলেই সমস্যা মনে হবে না। ঢাকায় যদি আমরা আয়েশি কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করি, উৎপাদন কারখানাগুলো যদি ঢাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিই, তাহলেই কিন্তু বিদ্যুতের জন্য একজন গ্রাহকের অতিরিক্ত বিল দিতে হবে না। বিদ্যুৎ চাহিদা কমে আসবে। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ওপর চাপও কমে আসবে।
প্রথম আলো  আপনি স্বল্পকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বললেন, দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনের বিষয়ে কীকরতে হবে?
লুত্ফুল কবীর  দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে জ্বালানির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্যাস হচ্ছে আমাদের প্রথম পছন্দ। এর উত্তোলন ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জোর প্রয়াস নিতে হবে। তার জন্য এই খাতটিকে জাতীয় স্বার্থেই দুর্নীতিমুক্ত করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অধীনস্থ করতে হবে। তবে যত দিন গ্যাসের জোগান এখনকার মতো অনিশ্চিত থাকবে, তত দিন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনাও স্থগিত রাখতে হবে। এমতাবস্থায়, পরবর্তী পছন্দের তালিকায় রয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা। আর সরকার সঠিকভাবেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপরই জোর দিয়েছেন। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলেও চাহিদা থেমে থাকবে না। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে জ্বালানি পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হবে। তবে পরমাণু বিদ্যুত প্রকল্পের সম্ভাবনা বেশি হলেও এর তেজষ্ক্রিয়তাজনিত দূষণের দিক নিশ্চিত করে এগতে হবে। এর জন্য প্রথমে বিপুল খরচ হলেও জ্বালানী খরচ কম থাকার জন্য উৎপাদিত বিদ্যুত হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের থেকে সস্তা।
প্রথম আলো  দুর্নীতি বিদ্যুৎ-সংকটকে কীভাবে প্রভাবিত করছে?
লুত্ফুল কবীর  বিদ্যুৎ খাতের যেকোনো কাজই হোক না কেন, তা বিশাল অঙ্কের প্রকল্প হয়ে থাকে। অনেক প্রকল্পেই দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ওপরের মহলের চাপে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। তাতে নিম্নমানের মালামাল/কাজ গ্রহণ করতে হয়েছে। আর যখন বাস্তবায়ন করা হয়েছে তখন সেসব মালামাল/কাজ আশানুরূপ ফল দিতে পারেনি। ফলে বিপর্যয় নেমেছে।
প্রথম আলো  গত দেড় দশকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বিনিয়োগ হয়নি কেন?
লুত্ফুল কবীর  দুঃখজনক হলেও সত্য, গত দেড় দশকে এই খাতে বড় বিনিয়োগ আসেনি। সিস্টেম লস কমানো ও আদায় বাড়ানোর জন্য রি-স্ট্রাকচারিংয়ের নামে বিদ্যুৎ সেক্টরকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়েছে এবং এর জন্য দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দিয়েছে, কিন্তু এই সংস্থাগুলো সরবরাহের মতো বিদ্যুৎ কীভাবে পাবে তার জন্য অর্থ ঋণ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে আমরাও নিজস্ব সম্পদ একত্রিত করে উদ্যোগ হাতে নিইনি। তাই আমাদের বসে না থেকে নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ও দেশি উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করে এ সেক্টরে বিনিয়োগ করতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেকোনো মূল্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
প্রথম আলো  জ্বালানি নিরাপত্তা ও বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য গ্যাস রপ্তানিকে আইন করে নিষিদ্ধ করার একটা দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী।
লুত্ফুল কবীর  রপ্তানি তো করা হয় যখন সম্পদ উদ্বৃত্ত হয়। যেখানে গ্যাসের সংকটের কারণে সার কারখানা বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে রপ্তানির প্রশ্ন ওঠার পেছনে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আছে বলে আমি মনে করি না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক একটি উক্তির কথা স্মরণ করছি। তিনি বলেছেন, জ্বালানি বিষয়ে রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। সিদ্ধান্ত হবে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। আমরা আশা করি, আমাদের সরকারগুলো একই নীতি অনুসরণ করবে।
প্রথম আলো  এই খাতে সংকট জিইয়ে থাকার জন্য সরকারগুলোর নীতি ও দুর্নীতি উভয়কেই কি দায়ী করা যায়?
লুত্ফুল কবীর  সরকারগুলোর প্রকাশিত যেসব নীতি আমাদের সামনে আসে, তা দেখে বলার উপায় নেই যে কোনো সরকারই বিদ্যুৎ সেক্টরকে তাদের প্রধান সেক্টর হিসেবে বিবেচনা করেনি। তবে দুর্নীতি নির্মূল করতে সরকারগুলো প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছে। আবারও বলি, দুর্নীতি নির্মূল করতে না পারলে যত পরিকল্পনাই সরকার করুক না কেন, লাভ হবে না। পরিকল্পনা যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শাস্তি/পুরস্কার নিশ্চিত করাটাই প্রধান কাজ।
প্রথম আলো  সামনে বাজেট আসছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস প্রশ্নে আপনি এই বাজেটে কেমন পরিকল্পনা ও বরাদ্দ আশা করেন?
লুত্ফুল কবীর  আমি স্বল্পমেয়াদি যে ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনার প্রস্তাব করেছি, তার জন্য সরকারের বিনিয়োগ প্রধান না হলেও বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র ও এর জ্বালানি আমদানিতে কর-সুবিধা দিতে হবে। এর ফলে বিদ্যুতের মূল্য কমে আসবে। ঢাকা শহরে বিতরণ ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার জন্য ও লোডভিত্তিক চাহিদা নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর জন্য বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম আলো  বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের ভবিষ্যৎ কী?
লুত্ফুল কবীর  আমাদের দেশে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনা তেমন না থাকলেও সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বেশি মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর প্যানেল মূল্যবান্ধব হবে না। তবে সৌর প্যানেলের দাম কমে আসছে। ভবিষ্যতের জন্য এই উদ্যোগগুলো আমাদের কাজে লাগবে। তবে এ বিষয়ে কোনো বাস্তবসম্মত গবেষণা হচ্ছে না, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
প্রথম আলো  অতীতে দেখা গেছে যে বড় বড় উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে টেন্ডার, রি-টেন্ডার ইত্যাদি জটিলতায় কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখে না। এ বিষয়ে সরকারের কী করণীয়?
লুত্ফুল কবীর  বিদ্যুৎকে যদি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, তবে বিষয়টি সহজে টেন্ডারের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ে আন্তর্জাতিক ক্রয় কমিটির মাধ্যমে সরাসরি কার্যাদেশ দেওয়া। সেই কমিটিতে সরকারি ও বিরোধী দলের বিজ্ঞ প্রতিনিধি থাকবেন। বিদ্যুৎ সেক্টরের বর্তমানে ও অতীতে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। বিদ্যুৎ সেক্টরের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতা সংস্থাগুলো থেকে বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিনিধিরা থাকবেন। সবার মতৈক্যে একটা ক্রয়কে স্বচ্ছ করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এ প্রক্রিয়ায় এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থে এ বিষয়ে সবাই সহযোগিতার হাত না বাড়ালে আমরা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
লুত্ফুল কবীর  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.