চলচ্চিত্র-বাজেট-ভাবনায় চলচ্চিত্র যেন বাদ না যায় by মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

আমাদের সিনেমা একটা পুনরুজ্জীবনের ধারায় আছে। গত কয়েক বছরে নতুন ঢংয়ের বেশ কিছু ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। ভেনিস, টরন্টো, পুসান, রটারডাম, আবুধাবির মতো বড় উৎসবগুলোতে আমাদের ছবি যাওয়া-আসা করছে। সামনে নতুন নির্মাতাদের বানানো আরও বেশ কিছু নতুন ছবি আসছে।


আমার নতুন ছবি টেলিভিশন-এর (ছবির এই নামটা মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত থাকবে না) কাজ শেষ পর্যায়ে। রেদওয়ান রনির চোরাবালি, অনিমেষ আইচের না-মানুষ, ইফতেখার আহমেদ ফাহমির টু বি কনটিনিউড, সরদার সানিয়াত হোসেনের অল্প-স্বল্প-প্রেমের গল্প, মুস্তফা কামাল রাজের ছায়াছবি—এ রকম নতুন অনেক ছবি পাইপলাইনে আছে। আবু শাহেদ ইমনের এশিয়ান সিনেমা ফান্ড জয়ী একজন ভালো পুলিশের গল্প এবং ইশতিয়াক জিকোর সাউথইস্ট লাভসও এই মিছিলে আছে। গিয়াসউদ্দিন সেলিম ও গোলাম রাব্বানী বিপ্লবও তাঁদের নতুন ছবি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বলে জানি। যত দূর জানি, এই ছবিগুলোর গল্প বা নির্মাণভঙ্গিও একেকটা একেক রকমের। এগুলোর মধ্যে ব্যবসাসফল হওয়ার লক্ষণসমৃদ্ধ অনেক ছবি আছে। কিছু ছবি একই সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও ভালো করবে বলে বিশ্বাস করি। আরও অসংখ্য তরুণ নতুন গল্প নতুন চিন্তা নিয়ে ‘আসি আসি’ করছেন।
এসব ভালোর লক্ষণকে যদি সরকারের তরফ থেকে কিছু নীতি সিদ্ধান্ত দিয়ে সমর্থন দেওয়া না হয়, তাহলে যে উৎসাহ নিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেটা মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। আমাদের দেশে এর আগে কখনোই এত বিপুলসংখ্যক তরুণের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়নি, যাঁদের চোখটা তৈরি হয়েছে বিশ্ব-চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিকতম হালচাল দেখে দেখে, যাঁরা মাধ্যমের সহজলভ্যতার সৌজন্যে নানা ঢংয়ের নানা ভাবের দৃশ্য ধারণ করে করে হাতটা পাকিয়েছেন। তাঁদের ঠিকঠাক সহায়তা দিতে পারলেই তবে আমরা বাংলাদেশের সিনেমার এমন একটা ধারা তৈরি করতে পারব, যেটা বিশ্ব-চলচ্চিত্রের দরবারে গ্রাহ্য করার মতো একটা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। কী সহায়তা দিতে হবে তাঁদের? টাকা-পয়সা? না। দরকার কিছু নীতির। যে নীতির মূল ভঙ্গিতে থাকবে দুটি প্রশ্ন—তাঁরা যে ছবি বানাবেন, সেটা কোথায় দেখাবেন? এবং কীভাবে দেখাবেন? দুটি প্রশ্নই সম্পর্কযুক্ত। ছবি কোথায় দেখাবেন? সিনেমা হলে। সিঙ্গেল স্ক্রিনে, নাকি মাল্টিপ্লেক্সে? কীভাবে দেখাবেন? প্রচলিত ৩৫ মি.মি. প্রজেকশন-ব্যবস্থায়, নাকি ডিজিটাল প্রজেকশন-ব্যবস্থায়? এর সহজ উত্তর, মাল্টিস্ক্রিন থিয়েটার আর ডিজিটাল প্রজেকশন-ব্যবস্থা।
মাল্টিস্ক্রিন থিয়েটার বা যেটাকে আমরা মাল্টিপ্লেক্স বলে জানি, সেটার সুবিধা হচ্ছে, এখানে কয়েকটা হল একসঙ্গে থাকায় কয়েক রকমের ছবি চালানো যায়। আবার ছবি হিট হলে একসঙ্গে সব হলে একই ছবি চালানো যায়। এগুলোর ব্যবস্থাপনা, সাজসজ্জা, নিকটবর্তী ক্যাফে—মিলিয়ে এটা শহরগুলোতে একটা মিলনকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সাধারণভাবে মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে উন্নত প্রজেকশনে ছবি দেখা যায়। সারা পৃথিবীই মাল্টিপ্লেক্সের দিকে ঝুঁকেছে বহু আগেই। পাশের দেশ ভারতও মাল্টিপ্লেক্সের দিকে ঝুঁকেছে বহু আগেই; বলা যায়, সেখানে এখন এর জোয়ার চলছে। এমনকি আমাদের দেশেও এত ‘নাই নাই’য়ের মধ্যেও স্টার সিনেপ্লেক্স ভালো ব্যবসা করছে বলেই জানি। এবং ব্যবসাসফল ছবিগুলোর বেশির ভাগই বাংলাদেশের ছবি। আমি অনেকের কথা জানি, যারা বহু দিন অপেক্ষা করে হলেও ঢাকার অপর প্রান্ত থেকে এসে সিনেপ্লেক্সেই ছবিটা দেখতে চায়। সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার মাহবুব রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেনেছি, সরকারের নীতি-সমর্থন পেলে এক বছরের মধ্যে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর এবং পুরান ঢাকার কোথাও ডিজিটাল প্রজেকশন-ব্যবস্থাসহ তিনটি মাল্টিপ্লেক্স করতে আগ্রহী তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের নীতি-সহায়তা আশা করেন উদ্যোক্তারা? ভারতের ফর্মুলা অনুযায়ী এগোলে সরকার এ রকম একটা নীতি করতে পারে যে ঢাকা এবং জেলা শহরগুলোতে যাঁরা ডিজিটাল প্রজেকশনসহ মাল্টিপ্লেক্স করবেন, তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য কর-অবকাশ পাবেন। দ্বিতীয় পদ্ধতি হতে পারে, ঢাকাসহ যেসব স্থানে সরকারের বা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিত্যক্ত বা অব্যবহূত জমি রয়েছে—এ রকম কিছু জমি ডিজিটাল প্রজেকশনসমৃদ্ধ মাল্টিপ্লেক্সে করার জন্য সহজ শর্তে লিজ দেওয়া। অন্তত ঢাকায় তিনটি ও বড় পাঁচটি শহরে পাঁচটি মাল্টিপ্লেক্স তৈরি করতে আগ্রহী উদ্যোক্তার অভাব হবে বলে মনে হয় না। কেবল স্টার সিনেপ্লেক্স নয়, আরও অনেক উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা এ রকম একটা নীতি পেলে দ্রুতই কাজে নামবেন। আর এ রকম আট-দশটা সফল মাল্টিপ্লেক্স দাঁড়িয়ে গেলে অন্যরাও ধীরে ধীরে তাঁদের হলে ডিজিটাল প্রজেকশনের ব্যবস্থা করবেন। হলের পরিবেশ উন্নত করবেন। মাল্টিস্ক্রিনে রূপান্তরিত করবেন। এ ছাড়া কোনো হলের মালিক যদি সিঙ্গেল স্ক্রিন হলকে ডিজিটাল প্রজেকশন-ব্যবস্থায় রূপান্তর করে তবে সেই হলকে কর-অবকাশ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
তবে এ ধরনের নীতি গ্রহণের পাশাপাশি সরকারকে কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দিতে হবে। হলের নকশা কেমন হতে হবে, সাজসজ্জা কেমন হবে, চেয়ার কেমন হবে, লবিতে বসার জায়গা কেমন থাকবে, আসন অনুপাতে টয়লেটের সংখ্যা কেমন হবে, হলের বাইরে আড্ডা দেওয়ার ক্যাফেটা কেমন হবে, প্রজেকশন কেমন হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য বিষয় তদারকির জন্য পরিদর্শক দল কী রকম অভিযান চালাবে—যাবতীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। স্রেফ নীতিমালাটা ঠিক করে দিন মাননীয় অর্থ এবং তথ্যমন্ত্রী। বাকি কাজটা করে দেবেন তরুণ ও প্রবীণ উদ্যোক্তারা।
এবার আসি ডিজিটাল প্রজেকশন প্রসঙ্গে। আমরা সবাই জানি ডিজিটাল প্রজেকশনে ছবি ঝকঝকা দেখা যায়। ছবির প্রিন্ট খরচ কমে আসে। ৪০টি সিনেমা হলের জন্য ৪০টি প্রিন্ট করতে হলে খরচ হবে ৪০ লাখ টাকা। ছবি বানাতে দেড় কোটি টাকা খরচ হলে ৪০টি হলের জন্য ৪০টি প্রিন্ট করতে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা। ডিজিটাল প্রজেকশন সিস্টেমে এই প্রিন্ট খরচটার কোনো দরকার নেই। নামমাত্র মূল্যে ডিজিটাল মাস্টারিং করে তারপর স্রেফ কপি পাঠিয়ে দিন যত ইচ্ছা তত হলে। যত মাস ইচ্ছা চালান, প্রিন্টে দাগ পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের সিনেমা হল ইতিমধ্যে ডিজিটাল প্রজেকশনে রূপান্তরিত হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মাঝে ৩৫ মি.মি. প্রজেকশন পুরোপুরি উঠে যাবে—এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমাদের দেশেও চারদিকে রব উঠেছে—ডিজিটাল প্রজেকশন চাই। কিন্তু ডিজিটাল প্রজেকশনের জন্য যে ছবি উৎপাদনের পদ্ধতিতে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়, সেটা কি আমরা নিয়েছি?
সহজ করে বলি, গ্রামোফোন দিয়ে যেমন সিডি চালানো যাবে না, তেমনি সিডি প্লেয়ারেও রেকর্ড বাজবে না। একইভাবে ৩৫ মি.মি. প্রজেকশন মেশিনে ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ বা ডিসিপি চালানো যাবে না বা ডিজিটাল প্রজেকশন-ব্যবস্থায় ৩৫ মি.মি. প্রিন্ট চালানো যাবে না। ডিজিটাল প্রজেকশন সিস্টেমে ছবি চালাতে গেলে ছবিটাকে ডিজিটাল মাস্টারিং করতে হবে। আপনি ৩৫ মি.মি. বা ডিজিটাল যে ফরম্যাটেই ছবি শুটিং করেন না কেন, ছবি সম্পাদনা শেষে পুরো ছবিকে ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ বা ডিসিপিতে রূপান্তর করতে হবে। আর এই রূপান্তর বা ডিজিটাল মাস্টারিংয়ের কয়েক রকমের যন্ত্র আছে। আমরা শুনছি, এফডিসির জন্য ৫৮ কোটি বা কম-বেশি কিছু টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সেটা দিয়ে কয়েকটি ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা কেনার কথা শোনা যাচ্ছে। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করতে চাই, আমরা যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ভবিষ্যতের বিষয়টি বিবেচনায় নিই, তবে ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা বা আরও যেসব বিষয়ে খরচের কথা বলা হচ্ছে, সেসব খাতে খরচ কমিয়ে ডিজিটাল মাস্টারিংয়ের প্রয়োজনীয় যন্ত্র, টেলিসিনে মেশিন এবং ডিআই স্যুট কেনার উদ্যোগ নেওয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। যেনতেন একটা ক্রয়তালিকা তৈরি করে বরাদ্দের টাকা শ্রাদ্ধ করার সংস্কৃতি থেকে আমাদের সরকারগুলো বের হয়ে আসবে—আমাদের ‘নবীন এবং কাঁচা’ প্রজন্মের এই-ই আশা। পৃথিবী দৌড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ইতিমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি। আমাদের প্রয়াত সাথি তারেক মাসুদ বেশ কিছু প্রস্তাব তৈরি করে সরকারের নানা পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন বলে শুনেছি। কিছুদিন আগে ক্যাথরিন মাসুদেরও একটা লেখা পড়েছি এই বিষয়ে। আমরা আশা করি, সরকার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। প্রশ্ন হলো, এই ভাবনার গতিটা একটু বাড়িয়ে এই বাজেটেই তার কিছু ছাপ রাখা যায়?
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: চলচ্চিত্রনির্মাতা।

No comments

Powered by Blogger.