প্রতিবেশ-সুন্দরবনের মধুর রক্তাক্ত আখ্যান by পাভেল পার্থ
সুন্দরবনের মধু বাংলাদেশের এক অনন্য ভৌগোলিক নির্দেশনা। প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে প্রায় ১৬ হাজার মণ মধু ও মোম আহরিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১২-১৩ কোটি টাকা। দেশ ও দেশের বাইরে সুন্দরবনের মধুর বিপুল চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকলেও এখন পর্যন্ত সুন্দরবনের মধু নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গড়ে ওঠেনি সুন্দরবনের মধু ও মোমের প্রতিবেশবান্ধব ন্যায্য সুরক্ষিত বাজার।
বনজীবী মৌয়ালরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঘ-কুমির-সাপ-কামঠ ও বনদস্যুদের আঘাত সয়ে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ ও সরকারের কোষাগারে বিপুল রাজস্ব জমা করলেও তাঁরা এখনো প্রভাবশালী মহাজন ও ঋণ কারবারিদের কাছে জিম্মি। মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ মৌসুমের আগে মহাজন ও ঋণ কারবারিদের কাছ থেকে সংসারের খরচ, নৌকা বানানো, বন বিভাগের বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) খরচসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির জন্য নানান শর্তে ঋণ নেন। মধু সংগ্রহের পর ভান্ডারসহ আহরিত সব মধু ও মোম তাঁদের তুলে দিতে হয় মহাজনের ঘরে।
১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ১৯৯২ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে দেশের প্রথম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, এখানের গাছপালা থেকে শুরু করে জীবজন্তু কি মৌমাছি বা বনজীবী ও বন বিভাগ—কারও জীবনেরই কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এক প্রশ্নহীন রক্তপ্রবাহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অরক্ষিত দুনিয়ার এই সবচেয়ে বড় জোয়ারভাটার অরণ্য।
সুন্দরবনের একেক ফুলের মধুর রং ও স্বাদ একেক রকম। সুন্দরবনের নানান মধুর ভেতর আগুনে মৌমাছিদের (Apis dorsata) চাকের খলসি ফুলের মধু সেরা। প্রায় ফুল থেকে আহরিত মধু সাদা রঙের। তবে গেওয়ার মধু কিছুটা সোনালি আভার। গরানের লাল রঙের মধুর স্বাদ ঝাঁজালো মিষ্টি। কেওড়ার মধু হালকা টক, গেওয়ার মধু একটু কষা তিতা স্বাদের।
মধু সংগ্রহের মৌসুমে এক একটি মৌয়াল দলের নৌকার জন্য বন বিভাগ একটি বিএলসি পাস দেয়। বনজীবী নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত নিজেদের আহরিত মধু তাঁরা নিজেদের নির্ধারণ করা দামে বিক্রি করতে পারেন না। এ ছাড়া একশ্রেণীর মধু ভেজালকারী চিনি মিশিয়ে সুন্দরবনের মধু নাম দিয়ে মধু বিক্রি করছে। সুন্দরবনের মধুর ওপর ঐতিহাসিকভাবে বনজীবী মৌয়ালদের প্রথাগত অধিকার থাকলেও বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি বোতলজাত করে বনজীবীদের কোনো ধরনের সম্মতি ছাড়াই প্রশ্নহীনভাবে সুন্দরবনের মধু বিক্রি করছে। বনে মধুর চাক খোঁজার সময় বনজীবীদের দৃষ্টি ওপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরা খাদ্যহীন বাঘের হামলার শিকার হন সবচেয়ে বেশি। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মধু সংগ্রহের মৌসুমে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জেই ১১ জন বনজীবী বাঘের হামলায় নিহত হন। তাঁদের ভেতর পাঁচজন বিএলসি পাস নিয়ে মধু আহরণে গিয়েছিলেন। বেসরকারি পর্যায়ে জীবনবিমার একটি ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত ও সুস্পষ্ট নয়।
সুন্দরবনের মধুর রয়েছে এক বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার। বন বিভাগ প্রতিবছর মধু মৌসুমে মধু ও মোম আহরণের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিবেশগত সূচকের ভিত্তিতে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় না। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মধুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল চার হাজার মণ এবং মোম এক হাজার মণ। কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মোট দুই হাজার ১৯০ মণ মধু ও ৫৪৭ মণ ২০ কেজি মোম আহরিত হয়। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মোট দুই হাজার ৬৭৫ মণ মধু ও ৬৬৮ মণ ৩০ কেজি মোম আহরিত হয়। কেন রাষ্ট্রের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না বা আদতেই এই লক্ষ্যমাত্রার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি না, তা এখনো পর্যন্ত খতিয়ে দেখা হয়নি। অথচ সুন্দরবনের মধুর দিকে তাকিয়ে আছে মধুবিলাসী এক বিশাল পৃথিবী।
সুন্দরবনের সুবিশাল বনদস্যু দলের চাঁদাবাজি থেকে বাদ যায় না দরিদ্র জেলে থেকে শুরু করে মধু আহরণকারী কেউ। বনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি, সুন্দরবনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনজীবীরা দোবেকীর মুখে একটি নিরাপত্তা টহল ফাঁড়ির দাবি করেছেন, যা ফিরিঙ্গিখাল থেকে কলাগাছিয়ার ভেতর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে বলে স্থানীয় জনগণের ধারণা। পাশাপাশি খাসিটানা খাল থেকে চুনকুড়ি খাল পর্যন্ত এই ২৫ কিলোমিটার এলাকার জন্য খাসিটানা খালের গোড়ায় এবং কাচিকাটা-ফুলখালী খালের মুখ থেকে আঠারবেকীর মুখ পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকার জন্য কাঁচিকাটা-ফুলখালী খালের মুখে আরও দুটি নিরাপত্তা টহল ফাঁড়ির দাবি তুলেছেন বনজীবীরা।
কোনো ধরনের সম্মানজনক বেতন, স্বীকৃতি, ঝুঁকি ও উৎসব ভাতা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই বন বিভাগের স্থানীয় কার্যালয়সমূহ নিজেদের জীবন দিয়ে সুন্দরবনের শিরদাঁড়া সমুন্নত রাখছেন।
মধু থেকে সরকার প্রতিবছর যে পরিমাণে রাজস্ব পায়, তা দিয়েই বনজীবীদের জীবন ও মধুবিমা এবং বন বিভাগের স্থানীয় কার্যালয়ের জন্য মধুভাতা চালু করতে পারে।
সুন্দরবনের মধুর ভবিষ্যৎ এবং বিকাশমানতা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, অরক্ষিত ও রক্তাক্ত। দিন দিন আবহাওয়া ও জলবায়ু পঞ্জিকা বদলে যাচ্ছে, যার প্রভাব সুন্দরবনের ওপরও পড়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রায় গাছগুলোতেই ফুল ফোটার সময়কাল এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশি বৃষ্টির অভাবে খরার কারণে ফুল ও কুঁড়ি ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু বন বিভাগ এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেই ১৮ চৈত্র থেকেই মধু সংগ্রহের পাস-পারমিট দিচ্ছে। সুন্দরবন এলাকায় অবৈধভাবে পাস-পারমিট ছাড়াই ফাল্গুনের শেষ থেকে মধুর চাক কাটা শুরু হয়ে যায়। বিপুল পরিমাণে এ ‘চোরাই মধুর’ কোনো হদিস রাষ্ট্রের কোষাগারে যেমন কোনো চিহ্ন রাখে না পাশাপাশি তা প্রথাগত বনজীবী মৌয়ালদের জীবিকার ওপরও এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলের বনজীবী মৌয়ালদের যৌক্তিক দাবি—চলমান আবহাওয়া ও জলবায়ু পঞ্জিকা অনুযায়ী মধু সংগ্রহের পাস-পারমিট ১৮ চৈত্র থেকে এগিয়ে চৈত্রের প্রথম সপ্তাহের ভেতর করা জরুরি।
সুন্দরবনে ফাল্গুন মাস থেকেই মৌচাষি-মৌ-ব্যবসায়ীরা মৌবাক্স নিয়ে ভিড় জমান। সুন্দরবনের আশপাশে নদী ও খালের কিনারে তাঁরা তাঁদের মৌবাক্সগুলো স্থাপন করেন। মৌবাক্স থেকে মৌমাছি সুন্দরবন থেকে মধু ও ফুলের রস নিয়ে বাক্সে জমা করে এবং এসব মৌ-কারবারিরা এই মধু ‘সুন্দরবনের মধু’ নামেই বিক্রি করেন। এখনো পর্যন্ত বন বিভাগ বা প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি যে এভাবে সুন্দরবনের মধু আহরণ ও বিক্রি করা যাবে কি না। কারণ, সুন্দরবনের মধু যদি ‘সরকার সংরক্ষিত বনের’ সম্পদ হয়, তবে সেই মধু অন্যভাবে সংগ্রহ করা গেলে আর বিএলসি পাস-পারমিটের কি দরকার?
এভাবে কেবল বনজীবী বা সরকার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের জটিল প্রতিবেশ ব্যবস্থাও। কারণ, সুন্দরবনের মৌমাছি এবং বাক্সবদ্ধ মৌমাছি (Apis malifera) দুটি ভিন্ন প্রজাতি। যখন হাজারে হাজারে বাক্সের মৌমাছি সুন্দরবনে প্রবেশ করছে, সেখানে সুন্দরবনের স্থানীয় মৌমাছির জন্য খাদ্যঘাটতি এবং খাদ্যচক্রে বিশৃঙ্খলতা তৈরি হচ্ছে। সরকারকে এক পয়সাও রাজস্ব না দিয়ে এভাবে সরকারি বনভূমির সম্পদ সংগ্রহ করে দেদার বাণিজ্য করার কোনো ধরনের আইনগত অধিকার মৌবাক্স চাষিদের আছে কি না, তা আজকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। সরকারি বনভূমির কতটুকু দূরে ইটভাটা ও করাতকল স্থাপন করতে হবে, এ বিষয়ে আইন থাকলেও সরকারি বনভূমির কতটুকু দূরে এসব বাণিজ্যিক মৌবাক্স স্থাপন করা যাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। কারণ, এতে সুন্দরবনের মধুর ক্রেতারাও ‘সুন্দরবনের মধু’ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
প্রতি মধু মৌসুমে বন বিভাগ সুন্দরবনের বেশ কিছু এলাকাকে মৌমাছি অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। সেখান থেকে মধু সংগ্রহ এবং মৌচাক কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের মৌমাছি অভয়াশ্রম হলো ৫১(এ) ও ৫১(বি) কম্পার্টমেন্ট দোবেকী ও নটাবেকীর সম্পূর্ণ এলাকা। পাশাপাশি দক্ষিণ সুন্দরবন অভয়ারণ্যের ৪৩ ও ৪৪ নম্বর কম্পার্টমেন্ট। কিন্তু মৌবাক্স বসিয়ে এসব অভয়াশ্রমের বাস্তুসংস্থান এবং বৈশিষ্ট্যও নষ্ট করা হচ্ছে। কারণ, এসব অভয়াশ্রম থেকে বনজীবী মৌয়াল নয়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে মধু সংগ্রহ করছেন মধু-কারবারিরা।
আমরা প্রায় সবাই সুন্দরবনের মধুর প্রতি এক বিশেষ ধরনের মনোযোগ ও আকর্ষণ বোধ করি। কিন্তু এই মধুর প্রতিটি দানায় দানায় রক্ত আর লোনা ঘামের আহাজারি। চাকের ভেতর এক কেজি মধু জমাতে মৌমাছিদের চাক থেকে ফুলে যাতায়াত করতে হয় প্রায় দেড় লাখ বার। এক চাক মধু সংগ্রহ করতে অনিবার্যভাবে ঝরে বনজীবীর রক্ত। যে সম্পদ বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিপুল অর্থের রাজস্ব জমা দিচ্ছে, তার প্রতি আমরা এখনো কোনো সুবিচার করিনি, দেখাইনি প্রতিবেশগত ন্যায়পরায়ণতা। আশা করি, সরকার এ বছরের মধু মৌসুমেই সুন্দরবনের মধু বিষয়ে এক সুস্পষ্ট সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা যদি দুনিয়ার বুকে সুন্দরবনকে আরও জোরদার কায়দায় মেলে ধরতে চাই, তবে এই মধু ও মোমের তৈরি নানান লোকজ পণ্যই হতে পারে এর একটি কার্যকরী পথনির্দেশিকা।
বনবিবি, বনজীবী ও বন বিভাগ সবাই মিলেই সুন্দরবনের মধুর ঐতিহাসিক আখ্যানের ন্যায়সংগত বিকাশে সহযোগী হওয়া জরুরি এখন থেকেই।
পাভেল পার্থ: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ১৯৯২ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে দেশের প্রথম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, এখানের গাছপালা থেকে শুরু করে জীবজন্তু কি মৌমাছি বা বনজীবী ও বন বিভাগ—কারও জীবনেরই কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এক প্রশ্নহীন রক্তপ্রবাহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অরক্ষিত দুনিয়ার এই সবচেয়ে বড় জোয়ারভাটার অরণ্য।
সুন্দরবনের একেক ফুলের মধুর রং ও স্বাদ একেক রকম। সুন্দরবনের নানান মধুর ভেতর আগুনে মৌমাছিদের (Apis dorsata) চাকের খলসি ফুলের মধু সেরা। প্রায় ফুল থেকে আহরিত মধু সাদা রঙের। তবে গেওয়ার মধু কিছুটা সোনালি আভার। গরানের লাল রঙের মধুর স্বাদ ঝাঁজালো মিষ্টি। কেওড়ার মধু হালকা টক, গেওয়ার মধু একটু কষা তিতা স্বাদের।
মধু সংগ্রহের মৌসুমে এক একটি মৌয়াল দলের নৌকার জন্য বন বিভাগ একটি বিএলসি পাস দেয়। বনজীবী নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত নিজেদের আহরিত মধু তাঁরা নিজেদের নির্ধারণ করা দামে বিক্রি করতে পারেন না। এ ছাড়া একশ্রেণীর মধু ভেজালকারী চিনি মিশিয়ে সুন্দরবনের মধু নাম দিয়ে মধু বিক্রি করছে। সুন্দরবনের মধুর ওপর ঐতিহাসিকভাবে বনজীবী মৌয়ালদের প্রথাগত অধিকার থাকলেও বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি বোতলজাত করে বনজীবীদের কোনো ধরনের সম্মতি ছাড়াই প্রশ্নহীনভাবে সুন্দরবনের মধু বিক্রি করছে। বনে মধুর চাক খোঁজার সময় বনজীবীদের দৃষ্টি ওপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরা খাদ্যহীন বাঘের হামলার শিকার হন সবচেয়ে বেশি। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মধু সংগ্রহের মৌসুমে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জেই ১১ জন বনজীবী বাঘের হামলায় নিহত হন। তাঁদের ভেতর পাঁচজন বিএলসি পাস নিয়ে মধু আহরণে গিয়েছিলেন। বেসরকারি পর্যায়ে জীবনবিমার একটি ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত ও সুস্পষ্ট নয়।
সুন্দরবনের মধুর রয়েছে এক বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার। বন বিভাগ প্রতিবছর মধু মৌসুমে মধু ও মোম আহরণের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিবেশগত সূচকের ভিত্তিতে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় না। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মধুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল চার হাজার মণ এবং মোম এক হাজার মণ। কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মোট দুই হাজার ১৯০ মণ মধু ও ৫৪৭ মণ ২০ কেজি মোম আহরিত হয়। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মোট দুই হাজার ৬৭৫ মণ মধু ও ৬৬৮ মণ ৩০ কেজি মোম আহরিত হয়। কেন রাষ্ট্রের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না বা আদতেই এই লক্ষ্যমাত্রার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি না, তা এখনো পর্যন্ত খতিয়ে দেখা হয়নি। অথচ সুন্দরবনের মধুর দিকে তাকিয়ে আছে মধুবিলাসী এক বিশাল পৃথিবী।
সুন্দরবনের সুবিশাল বনদস্যু দলের চাঁদাবাজি থেকে বাদ যায় না দরিদ্র জেলে থেকে শুরু করে মধু আহরণকারী কেউ। বনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি, সুন্দরবনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনজীবীরা দোবেকীর মুখে একটি নিরাপত্তা টহল ফাঁড়ির দাবি করেছেন, যা ফিরিঙ্গিখাল থেকে কলাগাছিয়ার ভেতর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে বলে স্থানীয় জনগণের ধারণা। পাশাপাশি খাসিটানা খাল থেকে চুনকুড়ি খাল পর্যন্ত এই ২৫ কিলোমিটার এলাকার জন্য খাসিটানা খালের গোড়ায় এবং কাচিকাটা-ফুলখালী খালের মুখ থেকে আঠারবেকীর মুখ পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকার জন্য কাঁচিকাটা-ফুলখালী খালের মুখে আরও দুটি নিরাপত্তা টহল ফাঁড়ির দাবি তুলেছেন বনজীবীরা।
কোনো ধরনের সম্মানজনক বেতন, স্বীকৃতি, ঝুঁকি ও উৎসব ভাতা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই বন বিভাগের স্থানীয় কার্যালয়সমূহ নিজেদের জীবন দিয়ে সুন্দরবনের শিরদাঁড়া সমুন্নত রাখছেন।
মধু থেকে সরকার প্রতিবছর যে পরিমাণে রাজস্ব পায়, তা দিয়েই বনজীবীদের জীবন ও মধুবিমা এবং বন বিভাগের স্থানীয় কার্যালয়ের জন্য মধুভাতা চালু করতে পারে।
সুন্দরবনের মধুর ভবিষ্যৎ এবং বিকাশমানতা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, অরক্ষিত ও রক্তাক্ত। দিন দিন আবহাওয়া ও জলবায়ু পঞ্জিকা বদলে যাচ্ছে, যার প্রভাব সুন্দরবনের ওপরও পড়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রায় গাছগুলোতেই ফুল ফোটার সময়কাল এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশি বৃষ্টির অভাবে খরার কারণে ফুল ও কুঁড়ি ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু বন বিভাগ এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেই ১৮ চৈত্র থেকেই মধু সংগ্রহের পাস-পারমিট দিচ্ছে। সুন্দরবন এলাকায় অবৈধভাবে পাস-পারমিট ছাড়াই ফাল্গুনের শেষ থেকে মধুর চাক কাটা শুরু হয়ে যায়। বিপুল পরিমাণে এ ‘চোরাই মধুর’ কোনো হদিস রাষ্ট্রের কোষাগারে যেমন কোনো চিহ্ন রাখে না পাশাপাশি তা প্রথাগত বনজীবী মৌয়ালদের জীবিকার ওপরও এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলের বনজীবী মৌয়ালদের যৌক্তিক দাবি—চলমান আবহাওয়া ও জলবায়ু পঞ্জিকা অনুযায়ী মধু সংগ্রহের পাস-পারমিট ১৮ চৈত্র থেকে এগিয়ে চৈত্রের প্রথম সপ্তাহের ভেতর করা জরুরি।
সুন্দরবনে ফাল্গুন মাস থেকেই মৌচাষি-মৌ-ব্যবসায়ীরা মৌবাক্স নিয়ে ভিড় জমান। সুন্দরবনের আশপাশে নদী ও খালের কিনারে তাঁরা তাঁদের মৌবাক্সগুলো স্থাপন করেন। মৌবাক্স থেকে মৌমাছি সুন্দরবন থেকে মধু ও ফুলের রস নিয়ে বাক্সে জমা করে এবং এসব মৌ-কারবারিরা এই মধু ‘সুন্দরবনের মধু’ নামেই বিক্রি করেন। এখনো পর্যন্ত বন বিভাগ বা প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি যে এভাবে সুন্দরবনের মধু আহরণ ও বিক্রি করা যাবে কি না। কারণ, সুন্দরবনের মধু যদি ‘সরকার সংরক্ষিত বনের’ সম্পদ হয়, তবে সেই মধু অন্যভাবে সংগ্রহ করা গেলে আর বিএলসি পাস-পারমিটের কি দরকার?
এভাবে কেবল বনজীবী বা সরকার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের জটিল প্রতিবেশ ব্যবস্থাও। কারণ, সুন্দরবনের মৌমাছি এবং বাক্সবদ্ধ মৌমাছি (Apis malifera) দুটি ভিন্ন প্রজাতি। যখন হাজারে হাজারে বাক্সের মৌমাছি সুন্দরবনে প্রবেশ করছে, সেখানে সুন্দরবনের স্থানীয় মৌমাছির জন্য খাদ্যঘাটতি এবং খাদ্যচক্রে বিশৃঙ্খলতা তৈরি হচ্ছে। সরকারকে এক পয়সাও রাজস্ব না দিয়ে এভাবে সরকারি বনভূমির সম্পদ সংগ্রহ করে দেদার বাণিজ্য করার কোনো ধরনের আইনগত অধিকার মৌবাক্স চাষিদের আছে কি না, তা আজকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। সরকারি বনভূমির কতটুকু দূরে ইটভাটা ও করাতকল স্থাপন করতে হবে, এ বিষয়ে আইন থাকলেও সরকারি বনভূমির কতটুকু দূরে এসব বাণিজ্যিক মৌবাক্স স্থাপন করা যাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। কারণ, এতে সুন্দরবনের মধুর ক্রেতারাও ‘সুন্দরবনের মধু’ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
প্রতি মধু মৌসুমে বন বিভাগ সুন্দরবনের বেশ কিছু এলাকাকে মৌমাছি অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। সেখান থেকে মধু সংগ্রহ এবং মৌচাক কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের মৌমাছি অভয়াশ্রম হলো ৫১(এ) ও ৫১(বি) কম্পার্টমেন্ট দোবেকী ও নটাবেকীর সম্পূর্ণ এলাকা। পাশাপাশি দক্ষিণ সুন্দরবন অভয়ারণ্যের ৪৩ ও ৪৪ নম্বর কম্পার্টমেন্ট। কিন্তু মৌবাক্স বসিয়ে এসব অভয়াশ্রমের বাস্তুসংস্থান এবং বৈশিষ্ট্যও নষ্ট করা হচ্ছে। কারণ, এসব অভয়াশ্রম থেকে বনজীবী মৌয়াল নয়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে মধু সংগ্রহ করছেন মধু-কারবারিরা।
আমরা প্রায় সবাই সুন্দরবনের মধুর প্রতি এক বিশেষ ধরনের মনোযোগ ও আকর্ষণ বোধ করি। কিন্তু এই মধুর প্রতিটি দানায় দানায় রক্ত আর লোনা ঘামের আহাজারি। চাকের ভেতর এক কেজি মধু জমাতে মৌমাছিদের চাক থেকে ফুলে যাতায়াত করতে হয় প্রায় দেড় লাখ বার। এক চাক মধু সংগ্রহ করতে অনিবার্যভাবে ঝরে বনজীবীর রক্ত। যে সম্পদ বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিপুল অর্থের রাজস্ব জমা দিচ্ছে, তার প্রতি আমরা এখনো কোনো সুবিচার করিনি, দেখাইনি প্রতিবেশগত ন্যায়পরায়ণতা। আশা করি, সরকার এ বছরের মধু মৌসুমেই সুন্দরবনের মধু বিষয়ে এক সুস্পষ্ট সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা যদি দুনিয়ার বুকে সুন্দরবনকে আরও জোরদার কায়দায় মেলে ধরতে চাই, তবে এই মধু ও মোমের তৈরি নানান লোকজ পণ্যই হতে পারে এর একটি কার্যকরী পথনির্দেশিকা।
বনবিবি, বনজীবী ও বন বিভাগ সবাই মিলেই সুন্দরবনের মধুর ঐতিহাসিক আখ্যানের ন্যায়সংগত বিকাশে সহযোগী হওয়া জরুরি এখন থেকেই।
পাভেল পার্থ: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
No comments