চারদিক-বই প্রকাশের আগেই নন্দিত লেখক by তপন বাগচী

বই প্রকাশের আগেই লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়া খুব কঠিন। জীবদ্দশায় একটি বইয়ের জনক না হয়েও কেউ কেউ সমাজে লেখক হিসেবে নন্দিত হতে পারেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ক্ষেত্রেই এমন সৌভাগ্য জুটেছে। মৃত্যুর পরপরই পাঠকের মন থেকে হারিয়ে যাওয়া লেখকের সংখ্যাও কম নয়।


কিন্তু মোতাহের হেসেন চৌধুরী মৃত্যুর ৫৫ বছর পরও পাঠকের কাছে দেদীপ্যমান। বিশেষ করে তাঁর সংস্কৃতি-কথা (১৯৫৮), সভ্যতা (১৯৬২) ও সুখ (১৯৬৫) বই তিনটির জন্য তিনি লেখক হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় আসীন। লেখা বাহুল্য যে তিনটি বই-ই প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর।
কুমিল্লার ‘দারোগাবাড়ি’তে তাঁর জন্ম ১৯০৩ সালের ১ এপ্রিল। এটি তাঁর নানার বাড়ি। তাঁর পৈতৃক বাস কুমিল্লার কাঞ্চনপুর। ১৯২৯ সালে বিএ পাস করে তিনি কুমিল্লা শহরের ইউসুফ হাইস্কুলে শিক্ষকতার ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। এরপর তিনি স্কুলে চাকরিতে ফিরে না গিয়ে ঠিকাদারি করে জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করেন। অল্পদিনেই তাঁর এই পরিকল্পনা বদলে যায়। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগপত্র পান। কিন্তু পারিবারিক কারণে চট্টগ্রাম ছাড়া তাঁর পক্ষে তখন সম্ভব হয়নি। দুর্ভাগ্য এই যে তিনি সারা জীবনই প্রভাষক পদে চাকরি করে গেছেন। জাতির হূদয়ের উন্নতি ঘটাতে পারলেও তাঁর পদের উন্নতি হয়নি। ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
কুমিল্লায় থাকতেই তিনি গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্রীড়াসংগঠক হিসেবেও তাঁর অবদান ছিল। কুমিল্লা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি দীর্ঘদিন সভাপতি ছিলেন। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকেই তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। একসময় যুক্ত হয়ে পড়েন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ সঙ্গে। এই সূত্রে ঘনিষ্ঠ হন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল ও মাহবুব-উল আলমের সঙ্গে।
সংস্কৃতি-কথা মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মৌলিক চিন্তার বই। সভ্যতা ও সুখ বইদুটি রচিত হয়েছে ক্লাইভ বেল-এর সিভিলাইজেশন ও বার্ট্র্যান্ড রাসেলের কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস বই অবলম্বনে। সংস্কৃতি-কথায় তিনি বলেছেন, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম’। এ রকম প্রবাদপ্রতিম উক্তি করেছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। তাঁর সম্পর্কে আবুল ফজল বলেছিলেন, ‘হূদয়ের ঔদার্যে, চরিত্র মাধুর্যে ও বন্ধুবাৎসল্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। জীবন-বোধ ও রুচিজ্ঞানের এক অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর জীবন। রসগ্রহণে ও মূল্যবিচারে তাঁর দক্ষতা ও নৈপুণ্য দেখেছি অসাধারণ। অসাধারণ জীবনবোধ ও মার্জিত রুচি তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় সহজেই লক্ষ্যগোচর।... মননসাহিত্য বলতে যা বোঝায়, একমাত্র মোতাহের হোসেনই আমাদের মধ্যে তার চর্চা করতেন।’
খুব বেশি না লিখেই যে বিখ্যাত হওয়া যায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরীই তার প্রমাণ বহন করছেন। তাঁর সম্পর্কে মনীষী কাজী আবদুল ওদুদের মূল্যায়ন, ‘... পরিমাণে অল্প হলেও তাঁর রচনা যে বিশিষ্ট হয়েছে এতেই তাঁর সাহিত্য-সাধনা সার্থক হয়েছে। সাধারণত সব দেশেরই প্রচলিত সাহিত্যে শিথিল চিন্তা, ভাববিলাসিতা, এসবের স্থান অনেকখানি। কিন্তু সত্যকার সাহিত্য এসব থেকে ভিন্ন ধরনের বস্তু, কেননা অকৃত্রিম দুঃখ-বেদনা ও আনন্দ-বোধ থেকেই তার উদ্ভব, ভাববিলাসিতা থেকে নয়। মোতাহের হোসেনের রচনা সত্যকার সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে।’
তিনি বিখ্যাত হয়েছেন, চিন্তার গভীরতার কারণে। সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধে তিনি চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কিংবা সংস্কৃতি সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন, তা একেবারেই মৌলিক। ব্যর্থতা জিন্দাবাদ নামের এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘যে সমাজে যত ব্যর্থলোকের বাস সে সমাজ তত ধনী। কেননা ব্যর্থতার কথাটাই সাধনার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ব্যর্থলোকের সংখ্যা কম বলেই তো বাংলার মুসলমানসমাজ ব্যর্থ হল, বেশী বলে নয়।’ প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে এমন নতুন করে বলতে পারতেন তিনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভা সম্পর্কে তিনি অন্য রকম কথা বলেছেন— ‘নজরুল ইসলাম বুদ্ধির চর্চা কম করেছিলেন বলে তাঁর রচনায় শিল্পগত ত্রুটি সুস্পষ্ট। ... প্রত্যেক শিল্পীকে ছাঁটাই-বাছাই করতে হয়; নজরুল ইসলামের রচনায় ছাঁটাই-বাছাই কম। বুদ্ধিকে তিনি দস্তুরমতো ভয় করতেন।’ আবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, মহাপুরুষ, অর্থাৎ সত্য ও প্রেমপরায়ণ পুরুষ।’
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হিসেবে মর্যাদা পেতে পারে ‘লাইব্রেরি’, ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্যবিলাস’, ‘নজরুল ইসলাম ও রিনেসাঁস’, ‘নবযুগ’, ‘মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার’, ‘স্বাধীনতা জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা’ প্রভৃতি। তাঁর সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধগ্রন্থ সম্পর্কে মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায়ের মূল্যায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘তিনি যে কীর্তি রেখে গেছেন তা কেবল পূর্ববঙ্গে নয়, বাংলাসাহিত্যে অতুলনীয়। ... মোতাহের হোসেন চৌধুরী এই একখানি বই লিখে অমর হয়ে গেলেন। প্রগতিশীল চিন্তা ও সরস কথ্যভাষার জন্যে প্রত্যেকটি প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য।’ অন্নদাশঙ্করের এই মন্তব্য উদ্ধার করে মোতাহের হোসেনকে স্মরণ করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। তাঁর মূল্যায়ন, ‘ধর্মের সৌন্দর্য ও সত্যের নির্যাসকে ততটুকুই তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছেন, যতটুকু করলে মনুষ্যত্বের অবমাননা হয় না—মানুষের স্বাধীন সত্তার বিকাশ ব্যাহত হয় না—সংস্কৃতিবান হওয়ার পথ রুদ্ধ হয় না। বলা চলে, এখানেই মোতাহের হোসেন চৌধুরীর স্বাতন্ত্র্য।’ এ রকম স্বতন্ত্র মনীষীতুল্য লেখকের জীবন ও কর্ম নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। আনিসুজ্জামান লিখেছেন তাঁর জীবনী। এ ছাড়া হাবিব রহমান ও তিতাশ চৌধুরী গ্রন্থ রচনা করেছেন। একটি গ্রন্থও এক শ পৃষ্ঠার বেশি নয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর রচনাবলি সংকলন করেছেন, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম সংকলন করেছেন একটি সংবর্ধনাগ্রন্থ। কিন্তু সংখ্যায় কম লিখলেও মোতাহের হোসেন ছৌধুরীর লেখায় যে গভীরতা রয়েছে, তাতে তাঁকে নিয়ে আরও গবেষণা হতে পারে। তাঁর বইগুলোও সহজলভ্য করে তোলা দরকার। এতে করে এই বাঙালি দার্শনিকের লেখার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পাঠকেরা পরিচিত হতে পারবে। ১০৮তম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

No comments

Powered by Blogger.