যুক্তি তর্ক গল্প-আপসকামী ভীতু সমাজ অপরাধীর অভয়ারণ্য by আবুল মোমেন
পত্রপত্রিকায় গত কিছু দিনে কিশোর-তরুণদের ভয়ংকর অপরাধের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে বিচলিত না করে পারে না। এগুলো অপরাধ, সন্দেহ নেই। অন্য অনেক দেশেও জুভেনাইল অপরাধের মাত্রা বেড়েছে, তা আমরা জানি।
তার পরও এসব অপরাধের প্রতিকারের দায়িত্ব কেবল পুলিশ ও আদালতের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। তাহলে সমাজের দায় গ্রহণ ও দায় স্বীকারের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়। অন্য কথায়, এটি একটি দায়িত্বহীন সমাজে পরিণত হয়।
এটা ঠিক, আধুনিক নাগরিক-জীবনে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়; পরিবারে-পরিবারে, প্রতিবেশী-প্রতিবেশীতে তো সম্পর্ক গড়েই ওঠে না, এমনকি পরিবারের ভেতরেও বন্ধন মজবুত থাকছে না। তাতে জীবনের আবেগপ্রবণতার বয়সে কিশোর-তরুণেরা যথার্থ অভিভাবকত্ব ও পরিণত সঙ্গ তথা গাইডেন্স থেকে বঞ্চিত হয়। আবেগের তাড়নায় তারা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সম্পর্কে জড়ায়, আবার তুচ্ছ কারণে অভিমান কিংবা অহংকারের বশে ভয়ংকর কোনো ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়। পরিবার পরিণতির দায় বোঝে না, কেবল অক্ষম বেদনায় কাতর হয়। আর সমাজ পরিণতির নিষ্ঠুরতায় বিচলিত হলেও দায় নেয় না, স্বীকার করে না। আমাদের সমাজের রসাতলে যাওয়ার এ-ও একটি কারণ।
কেবল দায়িত্বশীল সমাজই সবার স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ দিতে পারে। যে সমাজ পুলিশ ও আদালতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যেখানে সামাজিক প্রথা-নিয়ম ও সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে কেবল আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হয়, যে সমাজে অভিভাবক-শিক্ষক-মুরব্বিদের অকেজো করে পুলিশ ও উকিলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে—সেটি সুস্থ সমাজ নয়। এ সমাজে যথার্থ অভিভাবক নেই, শিক্ষকেরা যথার্থ ভূমিকায় নেই। কিশোর ও তরুণদের অপরাধের বিচার করার আগে, অথবা অন্তত সেই সঙ্গে সমাজ কেন এবং কীভাবে অভিভাবকহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়ল, তার বিচার জরুরি। কেন শিক্ষকেরা অকেজো হয়ে পড়লেন, সে বিচারে বসা দরকার।
বাংলাদেশে কয়েকটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বর্তমান সংকটের স্বরূপ বুঝতে সেই জানা ঘটনাগুলো যে আশ্চর্যজনক, তা একবার বোঝার চেষ্টা করা দরকার।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা (তথা রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি) তৈরি হচ্ছে, যাদের কোনো সম্পর্ক নেই জনতার সঙ্গে। এরা শুধু সংখ্যায় বাড়ছে না, এদেরই হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে রাজনীতি এভাবে জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর তার লেজ ধরে ক্ষমতা কতিপয়ের মধ্যে আবর্তিত, কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। নিজস্ব যোগ্য ফ্যাকাল্টি এবং গবেষণা কার্যক্রমের সুযোগবিহীন উচ্চমূল্যের কোচিং সেন্টারকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একদল মূলত দলীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত, আর অন্য দল একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-এনজিওতে ভাড়া খাটছে। প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় অকেজো হয়ে পড়ছে, আর নকল বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফা লুটছে। স্কুলকে অকেজো করে রেখে শিক্ষকেরা কোচিং ব্যবসায় মেতেছেন, যেমন করে চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালকে অকেজো করে ক্লিনিকের ব্যবসা ফেঁদেছেন। খেলা-অন্ত মানুষ স্টেডিয়াম ছেড়ে পালিয়েছে, কারণ ক্ষমতা-অন্ধ মানুষ সেগুলোর দখল নিচ্ছে। জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবের ব্যক্তিরা শান্তির ধর্ম ইসলামের সেবা করার দায়িত্ব নিচ্ছে। এভাবে প্রতিটি খাতে ও ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়-অকার্যকরতার চিত্র তুলে ধরা যাবে।
আমি আগেও বারবার লিখেছি, কেবল সরকার পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না, যদি না আমরা সমাজ পরিবর্তনের কাজে হাত দিই।
ওইখানে আমাদের মস্ত দুর্বলতা আছে। সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদ থেকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব চিন্তাকে আপন চিন্তাজগতে ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য সমাজের ভেতর থেকে সংস্কারের আন্দোলন হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন ঘটনা ঘটেনি। ফলে দৃশ্যত মানুষের ব্যস্ততা ও গতি বিস্তর বাড়লেও সমাজমানস হয়ে পড়েছে তামাদি, স্থবির। এ সমাজকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় ‘অচলায়তন’।
একটা দৃষ্টান্ত দিই। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষার আধুনিকায়ন, বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব বাড়ানো, ধর্মশিক্ষাকে শাস্ত্র মুখস্থ করার কূপমণ্ডুকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত করে নীতি-মূল্যবোধসহ জানা-বোঝার দিকে আনা, সাধারণভাবে চিন্তার মুক্ত পরিবেশে নিরীক্ষাপ্রবণ মানসকে (critical faculty) উদ্বুদ্ধ করে সুস্থ বাতাবরণ সৃষ্টি দরকার ছিল। কিন্তু এখানে পরিবর্তনের যেকোনো প্রয়াস ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বানচাল করে দিতে তৎপর হয়, আর আমাদের ক্ষমতা-কাঙাল (ধর্মান্ধের জোটক শব্দ হিসেবে বলা যায় ক্ষমতান্ধ) রাজনীতি আপসের পথ ধরে অচলায়তনে শরিক হয়।
এখনো সমাজ ও সমাজমানসে জ্ঞানবিমুখ ধর্মান্ধদের রাজত্ব বহাল রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, জঙ্গি থেকে সহিষ্ণু নানা মাত্রার ধর্মান্ধদের সক্রিয়তা অনেক বেড়েছে, তাদের বক্তব্য ও আচরণে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য বেড়েছে।
এ ক্ষেত্রেও দুটি উদাহরণ দেব। বাংলার চিরকালের যে সহিষ্ণু উদার মানবতাবাদী বাউল-ধারা চলমান রয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রায় সব মাত্রার ধর্মান্ধরা একাট্টা এবং সমভাবে মারমুখী। দ্বিতীয়ত, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি, যা অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষ, তার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যুক্তির ধার ধারে না, অন্ধবিশ্বাসে ভর করেই তেড়িয়া রূপ ধরে।
এভাবে একটা সমাজমানস যদি অন্ধ, অচল ও অবক্ষয়-কবলিত হয়ে পড়ে, তাহলে শুধু সরকার বদল করে তার পরিবর্তন নিশ্চিত করা যাবে না। বরং এভাবে চলতে থাকার ফলে মৌলিক জায়গাগুলোতেও এই অন্ধত্ব, অচলতা, অবক্ষয়ের সংক্রমণ হচ্ছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হবে, আমাদের ঈমান ও দেশপ্রেমেও কি একই সংকট দেখছি না আমরা? মিথ্যেবাদী, ফেরেববাজ ‘মুসলমানে’ দেশ ভরে যায়নি? দেশপ্রেম কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত হয়নি?
হায়, যেকোনো সমাজের জন্য অন্ধত্ব, অচলতা, অবক্ষয় কেবল ব্যাধি নয়; অভিশাপ। আমরা অভিশপ্ত জাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছি। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে।
অভিশপ্ত সমাজে সুশাসন অসম্ভব, বরং অনাচারের মহামারির প্রাদুর্ভাব হবে। কিশোর-তরুণদের যেসব বিকার আমরা দেখছি, যার ভয়ংকর পরিণতি বিবেকবানদের শিহরিত করছে, তা আমরা ঠেকাতে বা কমাতে পারব না। বরং আমরা আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব পুলিশ ও উকিলের ওপর, প্রশাসন ও আদালতের ওপর। কিন্তু তাতে অপরাধ কমবে না, অপরাধী ধরা না পড়ার জন্য নানা কৌশল নেবে, যাতে নিষ্ঠুরতার ভয়ংকরতাই শুধু বাড়বে। আইন আরও কড়া হবে, পুলিশ আরও নিষ্ঠুর হবে, সম্ভবত দুর্নীতিও বাড়বে। এভাবে একটি অবক্ষয়-কবলিত সমাজ ক্রমে একটি অপরাধী সমাজে পরিণত হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভয়ংকর অপরাধী হয়ে ওঠে, আর বাকি ভীতসন্ত্রস্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অপরাধের সঙ্গে আপস করেই আত্মরক্ষা করতে চায়। এভাবে সমাজ দুঃসাহসী অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। তাতে জীবনধারণ সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে খাটো হতে হয়। আর এভাবে খাটো হতে হতে মনুষ্যত্বের চরম সংকট দেখা দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এক হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি-দার্শনিক লিখেছিলেন, কীভাবে পরিস্থিতি/বাস্তবতা মানবের বামনায়ন ঘটায় (তাঁর ভাষায় dwarfing of man)।
আমাদের সমাজসংস্কারে মন দিতেই হবে। সমাজমানস থেকে তামাদি ভাবনা-বিশ্বাসের জঞ্জাল তাড়াতে হবে। ধর্মের ভেক্ ধরে অনেক অন্ধবিশ্বাস, অচল ধারণা সমাজমানসকে আঁকড়ে ধরেছে, অবশ করে রেখেছে। বস্তুত সমাজমানসের গভীরতম স্থানটি ধর্ম বিশ্বাসের। সেখানে আলো ফেলতে হবে, সচলতা আনতে হবে, গ্রহণ-বর্জনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে কাজ করতে দিতে হবে। ইসলামকে, হিন্দুধর্মকে, বৌদ্ধধর্মকে জেনে-বুঝেই এ কাজ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে জানতে হবে এ দেশের শাশ্বত সংস্কৃতির মূল ধারাগুলো, বাঙালির মানসসাধনার ঐতিহ্যকে। পরিচিত হতে হবে পশ্চিমা জ্ঞানের সঙ্গে। মনন-সাধনের মাধ্যমে বাঙালির মানসকে আলোকিত, সচল, যুক্তিশীল, বিবেকবান করে তুলতে হবে। সমাজে বরাবরই ছোট-বড় সমাজসংস্কারক আসতে থাকেন। সৃজনশীল চিন্তাবিদের জন্ম হয় স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু অন্ধ, স্থবির, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ তাদের আঁতুড়েই মারতে চায়, আর কেউ তা সত্ত্বেও টিকে গেলে তাদের মারার জন্য পিছু নেয়।
সমাজবদলের কাজে প্রথম দুটি কদম দিতে হবে সংসার ও শিক্ষালয়ে। কী সে কাজ?
আমাদের দেশে সংসারে পিতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করি। সাধারণত এ জন্য পিতা প্রধানত ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করেন অথবা পিতা-মাতা মিলে সন্তানকে লোভ দেখিয়ে (ঘুষ দিয়ে) বশে রাখতে চান। না, এই সনাতন ধারাটি বদলাতে হবে। শিশুর সঙ্গী হতে শিখতে হবে, বাবা-মাকে পারস্পরিক সমঝোতা, আস্থা ও বন্ধুতা-শ্রদ্ধার মাধ্যমে সংসারে সুস্থ শিশুবান্ধব মানবিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আজকাল বাবারা সন্তানদের খুবই কম সময় দিচ্ছেন। সঙ্গ দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকছে। এদিকে মা প্রায়ই কেবল পিতার অধঃস্তন নন, অসম্মানজনকভাবে অধীনতায় থেকে সন্তানের সঙ্গে ও সংসারে স্বাধীন সম্মানজনক ভূমিকা নিতে পারেন না। সংসারে তেমন বন্ধন তৈরি করতে হয়, যা স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে না, বরং প্রত্যেক সদস্যের বিকাশে সহায়তা দেয় (রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—অসংখ্য বন্ধনের মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ)।
আর স্কুলকে সচল করতে হবে। শিক্ষককে স্বাধীনতা দিতে হবে এবং শিক্ষাকে স্কুলে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষাসংস্কারের যে কর্মসূচি সরকার নিয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে না এসে এর পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সমাজে কাজ করে যেতে হবে। এ কাজ যতটা না সরকার করবে বা রাজনৈতিক দল করবে, তার চেয়ে বেশি করবে শিক্ষক, অভিভাবকসহ সামাজিক শক্তিগুলো। বরং সরকারের কর্তৃত্ব সর্বত্র প্রয়োগ না করে মূল লক্ষ্যের অনুকূল সহযোগী উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দিলেই ভালো হবে। সমাজমানসে সাধারণভাবে সন্তানের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে অন্ধতা-অচলতার যেসব সনাতন বাধা রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের জোয়ারে ভেসে যাবে। জোয়ার কিন্তু সরকার নয়, সমাজ সৃষ্টি করবে, সরকার হবে সহায়ক শক্তি। স্কুলে শিক্ষা সগৌরবে ফিরিয়ে আনার জন্য নোটবইয়ের মতোই কোচিং সেন্টারও বন্ধ করতে হবে।
আর শিক্ষা তো জীবনের জন্য, জীবনচর্চারই অংশ হিসেবে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউবা প্রশাসক হবে, কেউ ডাক্তার-কবি, কেউ ইঞ্জিনিয়ার-গায়ক, কেউবা প্রশাসক-ঔপন্যাসিক ইত্যাদি ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু স্কুলশিক্ষার বাতাবরণ হতে হবে মুক্ত, জীবনের সব রসদ ছাত্রের ভান্ডারে জমা হতে হবে। তার জন্য শিক্ষাকে দিতে হবে জীবনসংস্কৃতির সঞ্জীবনী। রসকষহীন পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যানির্ভর পড়ার চাপ ছেলে শিশুটিকে কৈশোর ও তারুণ্যের জৈবিক তাড়নার অসহায় শিকারে পরিণত করছে। তার জয়ী হওয়ার, অন্যের ওপর টেক্কা দেওয়ার, পৌরুষের বাহাদুরি প্রদর্শনের, বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ পাওয়ার স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে সে কীভাবে হজম করবে, মেলাবে? সেই রসদগুলো তো তাকে দিতে হবে, তার জন্য বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তো দিতে হবে।
এসব যোগ্যতা-দক্ষতা এবং এসব রসদ ও পুষ্টি তো শৈশবে সংসার ও স্কুল থেকেই ছেলেমেয়েদের অর্জন করতে হবে। সে বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
এটা ঠিক, আধুনিক নাগরিক-জীবনে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়; পরিবারে-পরিবারে, প্রতিবেশী-প্রতিবেশীতে তো সম্পর্ক গড়েই ওঠে না, এমনকি পরিবারের ভেতরেও বন্ধন মজবুত থাকছে না। তাতে জীবনের আবেগপ্রবণতার বয়সে কিশোর-তরুণেরা যথার্থ অভিভাবকত্ব ও পরিণত সঙ্গ তথা গাইডেন্স থেকে বঞ্চিত হয়। আবেগের তাড়নায় তারা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সম্পর্কে জড়ায়, আবার তুচ্ছ কারণে অভিমান কিংবা অহংকারের বশে ভয়ংকর কোনো ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়। পরিবার পরিণতির দায় বোঝে না, কেবল অক্ষম বেদনায় কাতর হয়। আর সমাজ পরিণতির নিষ্ঠুরতায় বিচলিত হলেও দায় নেয় না, স্বীকার করে না। আমাদের সমাজের রসাতলে যাওয়ার এ-ও একটি কারণ।
কেবল দায়িত্বশীল সমাজই সবার স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ দিতে পারে। যে সমাজ পুলিশ ও আদালতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যেখানে সামাজিক প্রথা-নিয়ম ও সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে কেবল আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হয়, যে সমাজে অভিভাবক-শিক্ষক-মুরব্বিদের অকেজো করে পুলিশ ও উকিলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে—সেটি সুস্থ সমাজ নয়। এ সমাজে যথার্থ অভিভাবক নেই, শিক্ষকেরা যথার্থ ভূমিকায় নেই। কিশোর ও তরুণদের অপরাধের বিচার করার আগে, অথবা অন্তত সেই সঙ্গে সমাজ কেন এবং কীভাবে অভিভাবকহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়ল, তার বিচার জরুরি। কেন শিক্ষকেরা অকেজো হয়ে পড়লেন, সে বিচারে বসা দরকার।
বাংলাদেশে কয়েকটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বর্তমান সংকটের স্বরূপ বুঝতে সেই জানা ঘটনাগুলো যে আশ্চর্যজনক, তা একবার বোঝার চেষ্টা করা দরকার।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা (তথা রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি) তৈরি হচ্ছে, যাদের কোনো সম্পর্ক নেই জনতার সঙ্গে। এরা শুধু সংখ্যায় বাড়ছে না, এদেরই হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে রাজনীতি এভাবে জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর তার লেজ ধরে ক্ষমতা কতিপয়ের মধ্যে আবর্তিত, কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। নিজস্ব যোগ্য ফ্যাকাল্টি এবং গবেষণা কার্যক্রমের সুযোগবিহীন উচ্চমূল্যের কোচিং সেন্টারকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একদল মূলত দলীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত, আর অন্য দল একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-এনজিওতে ভাড়া খাটছে। প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় অকেজো হয়ে পড়ছে, আর নকল বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফা লুটছে। স্কুলকে অকেজো করে রেখে শিক্ষকেরা কোচিং ব্যবসায় মেতেছেন, যেমন করে চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালকে অকেজো করে ক্লিনিকের ব্যবসা ফেঁদেছেন। খেলা-অন্ত মানুষ স্টেডিয়াম ছেড়ে পালিয়েছে, কারণ ক্ষমতা-অন্ধ মানুষ সেগুলোর দখল নিচ্ছে। জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবের ব্যক্তিরা শান্তির ধর্ম ইসলামের সেবা করার দায়িত্ব নিচ্ছে। এভাবে প্রতিটি খাতে ও ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়-অকার্যকরতার চিত্র তুলে ধরা যাবে।
আমি আগেও বারবার লিখেছি, কেবল সরকার পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না, যদি না আমরা সমাজ পরিবর্তনের কাজে হাত দিই।
ওইখানে আমাদের মস্ত দুর্বলতা আছে। সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদ থেকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব চিন্তাকে আপন চিন্তাজগতে ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য সমাজের ভেতর থেকে সংস্কারের আন্দোলন হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন ঘটনা ঘটেনি। ফলে দৃশ্যত মানুষের ব্যস্ততা ও গতি বিস্তর বাড়লেও সমাজমানস হয়ে পড়েছে তামাদি, স্থবির। এ সমাজকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় ‘অচলায়তন’।
একটা দৃষ্টান্ত দিই। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষার আধুনিকায়ন, বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব বাড়ানো, ধর্মশিক্ষাকে শাস্ত্র মুখস্থ করার কূপমণ্ডুকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত করে নীতি-মূল্যবোধসহ জানা-বোঝার দিকে আনা, সাধারণভাবে চিন্তার মুক্ত পরিবেশে নিরীক্ষাপ্রবণ মানসকে (critical faculty) উদ্বুদ্ধ করে সুস্থ বাতাবরণ সৃষ্টি দরকার ছিল। কিন্তু এখানে পরিবর্তনের যেকোনো প্রয়াস ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বানচাল করে দিতে তৎপর হয়, আর আমাদের ক্ষমতা-কাঙাল (ধর্মান্ধের জোটক শব্দ হিসেবে বলা যায় ক্ষমতান্ধ) রাজনীতি আপসের পথ ধরে অচলায়তনে শরিক হয়।
এখনো সমাজ ও সমাজমানসে জ্ঞানবিমুখ ধর্মান্ধদের রাজত্ব বহাল রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, জঙ্গি থেকে সহিষ্ণু নানা মাত্রার ধর্মান্ধদের সক্রিয়তা অনেক বেড়েছে, তাদের বক্তব্য ও আচরণে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য বেড়েছে।
এ ক্ষেত্রেও দুটি উদাহরণ দেব। বাংলার চিরকালের যে সহিষ্ণু উদার মানবতাবাদী বাউল-ধারা চলমান রয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রায় সব মাত্রার ধর্মান্ধরা একাট্টা এবং সমভাবে মারমুখী। দ্বিতীয়ত, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি, যা অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষ, তার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যুক্তির ধার ধারে না, অন্ধবিশ্বাসে ভর করেই তেড়িয়া রূপ ধরে।
এভাবে একটা সমাজমানস যদি অন্ধ, অচল ও অবক্ষয়-কবলিত হয়ে পড়ে, তাহলে শুধু সরকার বদল করে তার পরিবর্তন নিশ্চিত করা যাবে না। বরং এভাবে চলতে থাকার ফলে মৌলিক জায়গাগুলোতেও এই অন্ধত্ব, অচলতা, অবক্ষয়ের সংক্রমণ হচ্ছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হবে, আমাদের ঈমান ও দেশপ্রেমেও কি একই সংকট দেখছি না আমরা? মিথ্যেবাদী, ফেরেববাজ ‘মুসলমানে’ দেশ ভরে যায়নি? দেশপ্রেম কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত হয়নি?
হায়, যেকোনো সমাজের জন্য অন্ধত্ব, অচলতা, অবক্ষয় কেবল ব্যাধি নয়; অভিশাপ। আমরা অভিশপ্ত জাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছি। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে।
অভিশপ্ত সমাজে সুশাসন অসম্ভব, বরং অনাচারের মহামারির প্রাদুর্ভাব হবে। কিশোর-তরুণদের যেসব বিকার আমরা দেখছি, যার ভয়ংকর পরিণতি বিবেকবানদের শিহরিত করছে, তা আমরা ঠেকাতে বা কমাতে পারব না। বরং আমরা আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব পুলিশ ও উকিলের ওপর, প্রশাসন ও আদালতের ওপর। কিন্তু তাতে অপরাধ কমবে না, অপরাধী ধরা না পড়ার জন্য নানা কৌশল নেবে, যাতে নিষ্ঠুরতার ভয়ংকরতাই শুধু বাড়বে। আইন আরও কড়া হবে, পুলিশ আরও নিষ্ঠুর হবে, সম্ভবত দুর্নীতিও বাড়বে। এভাবে একটি অবক্ষয়-কবলিত সমাজ ক্রমে একটি অপরাধী সমাজে পরিণত হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভয়ংকর অপরাধী হয়ে ওঠে, আর বাকি ভীতসন্ত্রস্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অপরাধের সঙ্গে আপস করেই আত্মরক্ষা করতে চায়। এভাবে সমাজ দুঃসাহসী অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। তাতে জীবনধারণ সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে খাটো হতে হয়। আর এভাবে খাটো হতে হতে মনুষ্যত্বের চরম সংকট দেখা দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এক হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি-দার্শনিক লিখেছিলেন, কীভাবে পরিস্থিতি/বাস্তবতা মানবের বামনায়ন ঘটায় (তাঁর ভাষায় dwarfing of man)।
আমাদের সমাজসংস্কারে মন দিতেই হবে। সমাজমানস থেকে তামাদি ভাবনা-বিশ্বাসের জঞ্জাল তাড়াতে হবে। ধর্মের ভেক্ ধরে অনেক অন্ধবিশ্বাস, অচল ধারণা সমাজমানসকে আঁকড়ে ধরেছে, অবশ করে রেখেছে। বস্তুত সমাজমানসের গভীরতম স্থানটি ধর্ম বিশ্বাসের। সেখানে আলো ফেলতে হবে, সচলতা আনতে হবে, গ্রহণ-বর্জনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে কাজ করতে দিতে হবে। ইসলামকে, হিন্দুধর্মকে, বৌদ্ধধর্মকে জেনে-বুঝেই এ কাজ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে জানতে হবে এ দেশের শাশ্বত সংস্কৃতির মূল ধারাগুলো, বাঙালির মানসসাধনার ঐতিহ্যকে। পরিচিত হতে হবে পশ্চিমা জ্ঞানের সঙ্গে। মনন-সাধনের মাধ্যমে বাঙালির মানসকে আলোকিত, সচল, যুক্তিশীল, বিবেকবান করে তুলতে হবে। সমাজে বরাবরই ছোট-বড় সমাজসংস্কারক আসতে থাকেন। সৃজনশীল চিন্তাবিদের জন্ম হয় স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু অন্ধ, স্থবির, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ তাদের আঁতুড়েই মারতে চায়, আর কেউ তা সত্ত্বেও টিকে গেলে তাদের মারার জন্য পিছু নেয়।
সমাজবদলের কাজে প্রথম দুটি কদম দিতে হবে সংসার ও শিক্ষালয়ে। কী সে কাজ?
আমাদের দেশে সংসারে পিতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করি। সাধারণত এ জন্য পিতা প্রধানত ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করেন অথবা পিতা-মাতা মিলে সন্তানকে লোভ দেখিয়ে (ঘুষ দিয়ে) বশে রাখতে চান। না, এই সনাতন ধারাটি বদলাতে হবে। শিশুর সঙ্গী হতে শিখতে হবে, বাবা-মাকে পারস্পরিক সমঝোতা, আস্থা ও বন্ধুতা-শ্রদ্ধার মাধ্যমে সংসারে সুস্থ শিশুবান্ধব মানবিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আজকাল বাবারা সন্তানদের খুবই কম সময় দিচ্ছেন। সঙ্গ দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকছে। এদিকে মা প্রায়ই কেবল পিতার অধঃস্তন নন, অসম্মানজনকভাবে অধীনতায় থেকে সন্তানের সঙ্গে ও সংসারে স্বাধীন সম্মানজনক ভূমিকা নিতে পারেন না। সংসারে তেমন বন্ধন তৈরি করতে হয়, যা স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে না, বরং প্রত্যেক সদস্যের বিকাশে সহায়তা দেয় (রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—অসংখ্য বন্ধনের মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ)।
আর স্কুলকে সচল করতে হবে। শিক্ষককে স্বাধীনতা দিতে হবে এবং শিক্ষাকে স্কুলে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষাসংস্কারের যে কর্মসূচি সরকার নিয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে না এসে এর পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সমাজে কাজ করে যেতে হবে। এ কাজ যতটা না সরকার করবে বা রাজনৈতিক দল করবে, তার চেয়ে বেশি করবে শিক্ষক, অভিভাবকসহ সামাজিক শক্তিগুলো। বরং সরকারের কর্তৃত্ব সর্বত্র প্রয়োগ না করে মূল লক্ষ্যের অনুকূল সহযোগী উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দিলেই ভালো হবে। সমাজমানসে সাধারণভাবে সন্তানের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে অন্ধতা-অচলতার যেসব সনাতন বাধা রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের জোয়ারে ভেসে যাবে। জোয়ার কিন্তু সরকার নয়, সমাজ সৃষ্টি করবে, সরকার হবে সহায়ক শক্তি। স্কুলে শিক্ষা সগৌরবে ফিরিয়ে আনার জন্য নোটবইয়ের মতোই কোচিং সেন্টারও বন্ধ করতে হবে।
আর শিক্ষা তো জীবনের জন্য, জীবনচর্চারই অংশ হিসেবে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউবা প্রশাসক হবে, কেউ ডাক্তার-কবি, কেউ ইঞ্জিনিয়ার-গায়ক, কেউবা প্রশাসক-ঔপন্যাসিক ইত্যাদি ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু স্কুলশিক্ষার বাতাবরণ হতে হবে মুক্ত, জীবনের সব রসদ ছাত্রের ভান্ডারে জমা হতে হবে। তার জন্য শিক্ষাকে দিতে হবে জীবনসংস্কৃতির সঞ্জীবনী। রসকষহীন পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যানির্ভর পড়ার চাপ ছেলে শিশুটিকে কৈশোর ও তারুণ্যের জৈবিক তাড়নার অসহায় শিকারে পরিণত করছে। তার জয়ী হওয়ার, অন্যের ওপর টেক্কা দেওয়ার, পৌরুষের বাহাদুরি প্রদর্শনের, বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ পাওয়ার স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে সে কীভাবে হজম করবে, মেলাবে? সেই রসদগুলো তো তাকে দিতে হবে, তার জন্য বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তো দিতে হবে।
এসব যোগ্যতা-দক্ষতা এবং এসব রসদ ও পুষ্টি তো শৈশবে সংসার ও স্কুল থেকেই ছেলেমেয়েদের অর্জন করতে হবে। সে বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments