বিশ্ব পরিবেশ দিবস-বনাঞ্চল রক্ষায় কর্মোদ্যোগ

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসে প্রকৃতি হতে মানুষের বিচ্ছিন্নতা এতটাই প্রকট যে, মানুষকে এখন প্রকৃতি সন্তান বলতে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত হন। মানুষ যে উন্নয়ন. অগ্রগতি ও শিল্পায়নের নামে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক কর্মকাণ্ডকে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বলেও বিবেচনা করার অবকাশ তৈরি হয়েছে।


বনভূমিকে পরাভূত করে, নদীপ্রবাহকে দমন করে, গাছ কেটে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ছড়িয়ে, ভূমিতে অট্টালিকা নির্মাণ করে, অগণন শহর নির্মাণ করে মানুষ সভ্যতাকে সাজিয়েছে। নিজের জন্য আরামপ্রদ করে আশপাশের জগৎকে বদলে নিয়েছে। কিন্তু এর বদলে এমন এক রুদ্রমূর্তি প্রকৃতির সামনে তাকে আজ দাঁড়াতে হয়েছে যা মানুষের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্রকৃতির ওপর মানবিক কর্মকাণ্ডের নিরন্তর হামলা প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছে, পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলেছে। জলবায়ুর বদল ঘটিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। অনেকে বলছেন, এ হলো প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতি ক্ষতি প্রতিবিধানের জন্য আজ পাল্টা হামলা শুরু করেছে। বিশ্বের দিকে দিকে তাই অকাল বন্যার প্রকোপ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড় বিশ্ববাসীকে পরাস্ত, বিপর্যস্ত করে তুলছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে দেরিতে হলেও মানুষের বোধোদয় ঘটেছে। শুধু স্বার্থপর উন্নয়ন ও শিল্পায়নই লক্ষ্য নয়, প্রকৃতিকে রক্ষা করে, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষকে এ পৃথিবীতে বাস করতে হবে_ এ সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত। তাই দেরিতে হলেও পৃথিবী রক্ষার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ নিয়ে বৃহত্তর বৈশ্বিক উদ্যোগের দেখা আমরা পেয়েছি। প্রকৃতির বিষয়ে সচেতনতার ক্ষেত্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হয়েছে এ দিবস উদযাপন। পৃথিবীব্যাপী জাতিগুলোর নতুন উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে পরিবেশ দিবস শুধু পালনীয় নয়, অবশ্য পালনীয় একটি দিবসে পরিণত হয়েছে। এখন সকলেই মনে করেন, একটি দিন শুধু নয়_ পুরো বছরব্যাপী, প্রতিটি দিন পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য কিছু করতে হবে। আর এজন্য দেশে দেশে সরকার, নাগরিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ আসছে। অনেক হতাশাজনক ঘটনার পরও তাই মানুষ আশাবাদী। একটি উন্নততর বসবাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন তাই এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য 'বনাঞ্চল :আমাদের সেবায় প্রকৃতি'। বন রক্ষার ক্ষেত্রে এ স্লোগান বিশেষ সচেতনতা তৈরি করছে। মানুষের সেবায় বন যে কত বিপুল অবদান রাখে তা আমাদের জানা। কিন্তু লোভী মানুষের নানা পদক্ষেপে আজ বন, বনাঞ্চল, প্রাণীজ ও উদ্ভিজ সম্পদ হুমকির সম্মুখীন। আমাদের দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রক্রিয়া অনেক সচেতন উদ্যোগের পরও চালু রয়েছে। প্রতিদিন আমরা বন হারাচ্ছি। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আমাদের সুন্দরবনসহ বড় বনগুলো রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ আসা উচিত। দুর্নীতি, লোভ, চৌর্যবৃত্তির কারণে যেভাবে সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে তাতে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ ধ্বংস প্রক্রিয়া হয়তো অব্যাহত থাকবে। শুধু সুন্দরবন নয়, দেশের অন্য বনগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কাঠের জন্য বন ধ্বংসের প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাসস্থান, কৃষিজমি, শিল্প স্থাপনের জন্যও বনভূমি ধ্বংসের নানা খবর প্রায়ই আমাদের কানে আসে। কিন্তু প্রকৃতির সুরক্ষা ও সেবা সুনিশ্চিত করতে হলে বন রক্ষা আমাদের বিশেষ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এবারের পরিবেশ দিবস দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় আমাদের অব্যাহত সচেতনতা ও কর্মোদ্যোগকে নতুন মাত্রা দেবে বলে আমরা আশা করি। শুধু বিদ্যমান বনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাই নয়, সেগুলোকে সমৃদ্ধ করে তোলা এবং নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টির উদ্যোগও আসুক। এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হোক।
 

No comments

Powered by Blogger.