কর্নেল মুজিবুল হক-শ্রদ্ধাভরে তোমাকে স্মরি... by ইমামুল হক
ঋজু বৃক্ষের মতো ঊর্ধ্বমুখী অহংকার নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলায় সেদিন (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) তুমি ওদের শান্ত হতে বলেছিলে। চেষ্টা করেছিলে দরবার হলের বাইরে এসে পরিস্থিতি শান্ত করতে। চরম বিপর্যয়েও সেদিন নতজানু হলে না, পর্বতশৃঙ্গের মতো আকাশ স্পর্শ করে জীবন দিলে।
তোমার সাহসিকতা, দূরদর্শিতা ও কর্মদক্ষতা শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যদের নয়, বরং তোমার অনেক পরিচিতজনদের কাছেই ছিল অনুকরণীয় ও অনুসরণযোগ্য। ধৈর্য, আনুগত্য, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের মতো্রমহত্ গুণাবলি ছিল তোমার চরিত্রে।
‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচির মাধ্যমে তোমার সহকর্মীদের নিয়ে সেদিন হাজার হাজার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলে তুমি। তুমি বলতে, ‘যে দেশ ও মানুষকে ভালোবাসবে—শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে, প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে, জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।’ যেকোনো আলোচনায় তুমি দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা করতে।
তুমি তোমার জীবদ্দশায় বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিবারের সবাইকে জীবনের সব সমস্যা থেকে দূরে রাখতে। নিজেই সমস্যার সামনে গিয়ে সবাইকে রাখতে আড়ালে। শুধু পরিবার নয়, একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তোমার সহকর্মী ও বিডিআর জওয়ানদের প্রতিও। ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচি চালাতে গিয়ে আমাদের সঙ্গেও সুবিচার করতে পারোনি। বলেছিলে, মানুষের জন্য কাজ করার শেষ সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে চাও। তোমার মেধা আর মননশক্তি সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলে ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচিতে। বলেছিলে আমাদের, ‘এখন মানুষের সেবা করে নিই। অবসরের পর বেশি সময় দিয়ে পুষিয়ে দেব তোমাদের।’ আমাদের যথেষ্ট সময় দিতে না পারলেও উজাড় করে সময় দিয়েছিলে আম্মাকে। ব্যস্ততার মধ্যেও হাসপাতালে প্রতিদিন শয্যাশায়ী আম্মার পাশে বসে থাকতে তুমি। আর পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সাহস দিতে আমাদের।
আজ তোমার জন্মদিন আর গত বছরের এই দিনই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল তোমার। বলেছিলে, ৩ এপ্রিল ২০০৯-এ বড় এক অনুষ্ঠান হবে, সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবে। সত্যিই এক বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল সেদিন, সবাই ছিল, ছিল সব স্বজন, ছিলে না শুধু তুমি। সেদিন তোমার চেহলামে ছিল তোমার জন্য হাজার মানুষের শুভাশিস, ছিল স্বজনদের প্রার্থনা তোমার আত্মার শান্তির জন্য।
??? সূর্যের মতো অগ্নিগর্ভ হয়ে দিগন্ত বিদীর্ণ করা তোমার সেই ২৪ ফেব্রুয়ারির নান্দনিক প্যারেড আজও আমাদের চোখের সামনে মূর্তিমান।
এটি অভূতপূর্ব যে, আমরা আমাদের জীবদ্দশায় তোমার মতো সাহসী মানুষের আশীর্বাদপুষ্ট হতে পেরেছিলাম। একই সঙ্গে এটাও খুব দুঃখজনক যে, আমরা তোমার এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত তোমার সহকর্মীদের জীবন রক্ষা করতে পারিনি।
বৈশাখের শিলাপাতে আহত শস্যের মতো বিচূর্ণ আজ আমরা সবাই। তোমার স্নেহে লালিত আমরা সবাই আজ দিগ্ভ্রান্ত। কারণ, যাঁকে দেখলে আমরা দিকনির্দেশনা পেতাম, ভয়শূন্য হতাম, সে আজ নেই। তুমি এলে পরিবারে সুবাতাস বইত, তুমি এলে সবার মুখে হাসি ফুটত,্রসবাই সাহসী হয়ে উঠতাম। জানি তুমি আর আসবে না।
এমন বিশাল শূন্যতার ভেতরে থেকেও আমরা সবাই তোমার জীবনাদর্শ থেকে সাহস-শক্তি নিয়ে তোমার ভালোবাসার এই দেশের ভাগ্যহত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। কৃষকের ঘরে শস্যের দানা তুলে দিতে চাই, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই, বধ্যভূমিতে বর্ণাঢ্য অরণ্য সৃষ্টি করতে চাই, দিগ্ভ্রান্ত তারুণ্যকে সোনালি স্বপ্নের কথা বলতে চাই।
তোমার মানবিকতাবোধ, দেশপ্রেম ও মানুষের জন্য তোমার সহমর্মিতা সম্পর্কে না জানলে জীবনের একটি বড় অংশই আমার বোঝা হতো না। তোমাকে দেখেছি পেশাগত শত ব্যস্ততার পরও কীভাবে প্রতিবছর সংগ্রহ করতে সাহায্য, কখনো অর্থ, কখনো কাপড়, কখনো বা হাত সেলাই মেশিন দেশের হতদরিদ্র মানুষের জন্য। তুমি প্রায়ই বলতে, ‘আমাদের সীমিত সামর্থ্য ও সম্পদ যেন ভুল মানুষের কাছে না যায়। আসল হতদরিদ্র মানুষই যেন আমাদের সাহায্য পায়।’
আমরা ইতিমধ্যে তোমাদের সবার অসীম আত্মত্যাগের প্রতি আমাদের হূদয় উৎসারিত বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করেছি। ‘কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট’ গঠন করে তোমার স্বজনেরা সংগঠিত হয়েছে।
তুমি এই প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে বলতে, দেশের জন্য সব সময় সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা করতে। তোমাদের মনে রেখে তোমাদের মতো বীর সেনাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম ও জীবনাদর্শ থেকে যেন এ প্রজন্ম উজ্জীবিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের এই প্রকাশনা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের জীবনাদর্শ থেকে এ প্রজন্ম এবং তরুণ কর্মকর্তারা দেশপ্রেম ও মানবতাবোধের শিক্ষা নেবে। তোমরা আমাদের শিখিয়েছ কি করে দেশকে ভালোবাসতে হয় এবং মানুষের সেবা করতে হয়। তোমাদের তিরোধানের বর্ষপূর্তিতে সেদিনও আমরা একত্র হয়েছিলাম এবং শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আমরা তোমাদের স্মরণ করেছি।
দেশের সর্বস্তরের মানুষ তোমাদের স্মরণ করেছে সেদিন এবং শ্রদ্ধায় নত হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সব গণমাধ্যম তোমাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে। আশা করি ২০১১ সাল থেকে আমরা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিবসটি পালন করতে পারব।
আজ আমরা তোমার কাছে এবং সেদিনের সব শহীদের কাছে এই বারতা পৌঁছে দিতে চাই—‘হে বীর, তোমাদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম, আমরা তোমাদের কখনো ভুলব না।’
তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
লেখক: শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের ভাই।
emam85@hotmail.com
‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচির মাধ্যমে তোমার সহকর্মীদের নিয়ে সেদিন হাজার হাজার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলে তুমি। তুমি বলতে, ‘যে দেশ ও মানুষকে ভালোবাসবে—শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে, প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে, জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।’ যেকোনো আলোচনায় তুমি দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা করতে।
তুমি তোমার জীবদ্দশায় বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিবারের সবাইকে জীবনের সব সমস্যা থেকে দূরে রাখতে। নিজেই সমস্যার সামনে গিয়ে সবাইকে রাখতে আড়ালে। শুধু পরিবার নয়, একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তোমার সহকর্মী ও বিডিআর জওয়ানদের প্রতিও। ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচি চালাতে গিয়ে আমাদের সঙ্গেও সুবিচার করতে পারোনি। বলেছিলে, মানুষের জন্য কাজ করার শেষ সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে চাও। তোমার মেধা আর মননশক্তি সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলে ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচিতে। বলেছিলে আমাদের, ‘এখন মানুষের সেবা করে নিই। অবসরের পর বেশি সময় দিয়ে পুষিয়ে দেব তোমাদের।’ আমাদের যথেষ্ট সময় দিতে না পারলেও উজাড় করে সময় দিয়েছিলে আম্মাকে। ব্যস্ততার মধ্যেও হাসপাতালে প্রতিদিন শয্যাশায়ী আম্মার পাশে বসে থাকতে তুমি। আর পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সাহস দিতে আমাদের।
আজ তোমার জন্মদিন আর গত বছরের এই দিনই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল তোমার। বলেছিলে, ৩ এপ্রিল ২০০৯-এ বড় এক অনুষ্ঠান হবে, সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবে। সত্যিই এক বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল সেদিন, সবাই ছিল, ছিল সব স্বজন, ছিলে না শুধু তুমি। সেদিন তোমার চেহলামে ছিল তোমার জন্য হাজার মানুষের শুভাশিস, ছিল স্বজনদের প্রার্থনা তোমার আত্মার শান্তির জন্য।
??? সূর্যের মতো অগ্নিগর্ভ হয়ে দিগন্ত বিদীর্ণ করা তোমার সেই ২৪ ফেব্রুয়ারির নান্দনিক প্যারেড আজও আমাদের চোখের সামনে মূর্তিমান।
এটি অভূতপূর্ব যে, আমরা আমাদের জীবদ্দশায় তোমার মতো সাহসী মানুষের আশীর্বাদপুষ্ট হতে পেরেছিলাম। একই সঙ্গে এটাও খুব দুঃখজনক যে, আমরা তোমার এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত তোমার সহকর্মীদের জীবন রক্ষা করতে পারিনি।
বৈশাখের শিলাপাতে আহত শস্যের মতো বিচূর্ণ আজ আমরা সবাই। তোমার স্নেহে লালিত আমরা সবাই আজ দিগ্ভ্রান্ত। কারণ, যাঁকে দেখলে আমরা দিকনির্দেশনা পেতাম, ভয়শূন্য হতাম, সে আজ নেই। তুমি এলে পরিবারে সুবাতাস বইত, তুমি এলে সবার মুখে হাসি ফুটত,্রসবাই সাহসী হয়ে উঠতাম। জানি তুমি আর আসবে না।
এমন বিশাল শূন্যতার ভেতরে থেকেও আমরা সবাই তোমার জীবনাদর্শ থেকে সাহস-শক্তি নিয়ে তোমার ভালোবাসার এই দেশের ভাগ্যহত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। কৃষকের ঘরে শস্যের দানা তুলে দিতে চাই, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই, বধ্যভূমিতে বর্ণাঢ্য অরণ্য সৃষ্টি করতে চাই, দিগ্ভ্রান্ত তারুণ্যকে সোনালি স্বপ্নের কথা বলতে চাই।
তোমার মানবিকতাবোধ, দেশপ্রেম ও মানুষের জন্য তোমার সহমর্মিতা সম্পর্কে না জানলে জীবনের একটি বড় অংশই আমার বোঝা হতো না। তোমাকে দেখেছি পেশাগত শত ব্যস্ততার পরও কীভাবে প্রতিবছর সংগ্রহ করতে সাহায্য, কখনো অর্থ, কখনো কাপড়, কখনো বা হাত সেলাই মেশিন দেশের হতদরিদ্র মানুষের জন্য। তুমি প্রায়ই বলতে, ‘আমাদের সীমিত সামর্থ্য ও সম্পদ যেন ভুল মানুষের কাছে না যায়। আসল হতদরিদ্র মানুষই যেন আমাদের সাহায্য পায়।’
আমরা ইতিমধ্যে তোমাদের সবার অসীম আত্মত্যাগের প্রতি আমাদের হূদয় উৎসারিত বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করেছি। ‘কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট’ গঠন করে তোমার স্বজনেরা সংগঠিত হয়েছে।
তুমি এই প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে বলতে, দেশের জন্য সব সময় সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা করতে। তোমাদের মনে রেখে তোমাদের মতো বীর সেনাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম ও জীবনাদর্শ থেকে যেন এ প্রজন্ম উজ্জীবিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের এই প্রকাশনা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের জীবনাদর্শ থেকে এ প্রজন্ম এবং তরুণ কর্মকর্তারা দেশপ্রেম ও মানবতাবোধের শিক্ষা নেবে। তোমরা আমাদের শিখিয়েছ কি করে দেশকে ভালোবাসতে হয় এবং মানুষের সেবা করতে হয়। তোমাদের তিরোধানের বর্ষপূর্তিতে সেদিনও আমরা একত্র হয়েছিলাম এবং শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আমরা তোমাদের স্মরণ করেছি।
দেশের সর্বস্তরের মানুষ তোমাদের স্মরণ করেছে সেদিন এবং শ্রদ্ধায় নত হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সব গণমাধ্যম তোমাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে। আশা করি ২০১১ সাল থেকে আমরা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিবসটি পালন করতে পারব।
আজ আমরা তোমার কাছে এবং সেদিনের সব শহীদের কাছে এই বারতা পৌঁছে দিতে চাই—‘হে বীর, তোমাদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম, আমরা তোমাদের কখনো ভুলব না।’
তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
লেখক: শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের ভাই।
emam85@hotmail.com
No comments