সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-হিলারি কী মেসেজ দিয়ে গেলেন by তারেক শামসুর রেহমান
হিলারি ক্লিনটন যে সিভিল সোসাইটির কথা ঢাকায় বলে গেছেন, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যাবে তরুণ সমাজ তথা সিভিল সোসাইটিকে 'প্রমোট' করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়? হিলারি ক্লিনটন চলে গেছেন।
কিন্তু রেখে গেছেন অনেক প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ২৪ ঘণ্টা সফরে তিনি কী মেসেজ দিয়ে গেলেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মধ্যেই। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মন্তব্যের মধ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তারা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফরকে দেখছেন। এ ক্ষেত্রে মওদুদ আহমদের বক্তব্যে এক ধরনের 'আশাবাদ' থাকলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যে হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবে হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টতই একটি মেসেজ দিয়ে গেছেন। এ মেসেজটি যে শুধু সরকারের জন্যই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য। এর একটি নেগেটিভ দিক আছে। আছে পজিটিভ দিকও। এভাবে একজন বিদেশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন, এটি কাম্য নয়। আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কিংবা হরতাল করা ঠিক কি ঠিক নয়, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশের জনগণ। দেশে সংসদ আছে। সেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বও আছে। সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের মতো একটি 'হার্ড পাওয়ার'-এর একজন নেতা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন তা জাতিসংঘের ১(৭) ধারা লঙ্ঘন করার শামিল। এটি একটি নেগেটিভ দিক। তবে পজিটিভ দিক হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে যে 'দিকনির্দেশনা' রয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও দুটি বড় দলের জন্য এটি একটি মেসেজ! এ মেসেজগুলো যদি আমরা অনুসরণ করতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, 'সংলাপ' হলে ক্ষতির চেয়ে লাভের সম্ভাবনাই বেশি। যদিও অতীতে সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জলিল-মান্নান ভঁূইয়া সংলাপ আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নতর। সংলাপ হওয়া উচিত এবং তাতে অন্তত উত্তেজনা আমরা হ্রাস করতে পারব। দ্বিতীয়ত, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা। এটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। অন্য কোনো নামেও এটি হতে পারে। সরকারের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বর্তমান সংবিধান। বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বিএনপিরও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। বিএনপি চাচ্ছে, সরকার সংবিধান সংশোধন করুক। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না করেও সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন 'ফর্মুলা' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এ নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই সংলাপ জরুরি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের 'পদ' বজায় রেখে (যা সংবিধান সম্মত) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সব দলের সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। তৃতীয়ত, হরতাল আহ্বান না করা। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবি-দাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা 'গুম' করল রাষ্ট্র তা জানবে না, তা হতে পারে না। বিএনপি এ ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেনি। এটি দুঃখজনক। এ ইস্যুতে ভবিষ্যতে হরতাল দিয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হনই, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটি বোঝা উচিত কেন বিরোধী দল হরতাল দেয়। সেই 'পরিস্থিতি' যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। চতুর্থত, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তী সময়ে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু 'ভুল সিগন্যাল' পেঁৗছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না হওয়া, বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক বাজারজাতকরণের স্বার্থেই আমিনুলের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। পঞ্চমত, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে 'রাগ দেখানো'র কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিশ্বজুড়েই ড. ইউনূসের অনেক 'বন্ধু' রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার কোনো একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখা গেলে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে। ষষ্ঠত, এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। আমাদের স্বার্থেই দুর্নীতি রোধে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সপ্তমত, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি 'অংশীদারিত্ব সংলাপ'-এর যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কি রক্ষিত হবে? নাকি চুক্তিটি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে_ এ প্রশ্ন অনেকের মনে। হিলারি ক্লিনটন যখন আমাদের তরুণদের স্মরণ করিয়ে দেন চীন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, তখন এই 'অংশীদারিত্ব চুক্তি' নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ চুক্তির ব্যবহার ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অষ্টমত, হিলারি ক্লিনটনের একটি কর্মসূচি ছিল ঢাকায় তরুণদের সঙ্গে। 'তরুণদের সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ রয়েছে'_এটি ছিল হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য। যারা 'আরব বসন্ত' সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন মিসরের তরুণ প্রজন্মকে 'গণতন্ত্রমুখী' করতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। তাদের অনেককে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। দুটি সংস্থার (April 6 Movement I Kafaya Movement) নেতাদের ওয়াশিংটন প্রশিক্ষণ দিয়েছে এসব খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটন যে সিভিল সোসাইটির কথা ঢাকায় বলে গেছেন, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যাবে তরুণ সমাজ তথা সিভিল সোসাইটিকে 'প্রমোট' করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়? হিলারি ক্লিনটন চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অনেক প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ২৪ ঘণ্টা সফরে তিনি কী মেসেজ দিয়ে গেলেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মধ্যেই। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মন্তব্যের মধ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তারা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফরকে দেখছেন। এ ক্ষেত্রে মওদুদ আহমদের বক্তব্যে এক ধরনের 'আশাবাদ' থাকলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যে হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবে হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টতই একটি মেসেজ দিয়ে গেছেন। এ মেসেজটি যে শুধু সরকারের জন্যই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য। এর একটি নেগেটিভ দিক আছে। আছে পজিটিভ দিকও। এভাবে একজন বিদেশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন, এটি কাম্য নয়। আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কিংবা হরতাল করা ঠিক কি ঠিক নয়, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশের জনগণ। দেশে সংসদ আছে। সেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বও আছে। সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের মতো একটি 'হার্ড পাওয়ার'-এর একজন নেতা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন তা জাতিসংঘের ১(৭) ধারা লঙ্ঘন করার শামিল। এটি একটি নেগেটিভ দিক। তবে পজিটিভ দিক হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে যে 'দিকনির্দেশনা' রয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও দুটি বড় দলের জন্য এটি একটি মেসেজ! এ মেসেজগুলো যদি আমরা অনুসরণ করতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, 'সংলাপ' হলে ক্ষতির চেয়ে লাভের সম্ভাবনাই বেশি। যদিও অতীতে সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জলিল-মান্নান ভঁূইয়া সংলাপ আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নতর। সংলাপ হওয়া উচিত এবং তাতে অন্তত উত্তেজনা আমরা হ্রাস করতে পারব। দ্বিতীয়ত, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা। এটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। অন্য কোনো নামেও এটি হতে পারে। সরকারের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বর্তমান সংবিধান। বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বিএনপিরও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। বিএনপি চাচ্ছে, সরকার সংবিধান সংশোধন করুক। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না করেও সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন 'ফর্মুলা' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এ নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই সংলাপ জরুরি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের 'পদ' বজায় রেখে (যা সংবিধান সম্মত) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সব দলের সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। তৃতীয়ত, হরতাল আহ্বান না করা। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবি-দাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা 'গুম' করল রাষ্ট্র তা জানবে না, তা হতে পারে না। বিএনপি এ ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেনি। এটি দুঃখজনক। এ ইস্যুতে ভবিষ্যতে হরতাল দিয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হনই, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটি বোঝা উচিত কেন বিরোধী দল হরতাল দেয়। সেই 'পরিস্থিতি' যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। চতুর্থত, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তী সময়ে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু 'ভুল সিগন্যাল' পেঁৗছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না হওয়া, বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক বাজারজাতকরণের স্বার্থেই আমিনুলের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। পঞ্চমত, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে 'রাগ দেখানো'র কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিশ্বজুড়েই ড. ইউনূসের অনেক 'বন্ধু' রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার কোনো একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখা গেলে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে। ষষ্ঠত, এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। আমাদের স্বার্থেই দুর্নীতি রোধে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সপ্তমত, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি 'অংশীদারিত্ব সংলাপ'-এর যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কি রক্ষিত হবে? নাকি চুক্তিটি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে_ এ প্রশ্ন অনেকের মনে। হিলারি ক্লিনটন যখন আমাদের তরুণদের স্মরণ করিয়ে দেন চীন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, তখন এই 'অংশীদারিত্ব চুক্তি' নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ চুক্তির ব্যবহার ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অষ্টমত, হিলারি ক্লিনটনের একটি কর্মসূচি ছিল ঢাকায় তরুণদের সঙ্গে। 'তরুণদের সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ রয়েছে'_এটি ছিল হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য। যারা 'আরব বসন্ত' সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন মিসরের তরুণ প্রজন্মকে 'গণতন্ত্রমুখী' করতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। তাদের অনেককে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। দুটি সংস্থার (April 6 Movement I Kafaya Movement) নেতাদের ওয়াশিংটন প্রশিক্ষণ দিয়েছে এসব খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটন যে সিভিল সোসাইটির কথা ঢাকায় বলে গেছেন, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যাবে তরুণ সমাজ তথা সিভিল সোসাইটিকে 'প্রমোট' করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়? হিলারি ক্লিনটন চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অনেক প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments