ছাত্ররাজনীতি-লেজুড়বৃত্তির এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে by বদিউল আলম মজুমদার

মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী কিছুদিন আগে ছাত্ররাজনীতিকে গলিত শবের সঙ্গে তুলনা করেছেন (প্রথম আলো, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে সফল, সত্ ও করিতকর্মা মন্ত্রী ছাড়াও মতিয়া আপা হলেন অগ্নিকন্যাখ্যাত ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির অন্যতম পুরোধা।


তাই তাঁর মুখ থেকে যখন কোনো কথা বিশেষত ছাত্ররাজনীতি নিয়ে উচ্চারিত হয়, তখন সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমরা আশা করি, সরকার তাঁর কথার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ছাত্ররাজনীতির গলিত শবের সৎকারের উদ্যোগ নেবে।
ছাত্ররাজনীতির গলিত শব থেকে নিঃসরিত পূতিগন্ধ আজ সারা দেশে এক অসহনীয় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বস্তুত চরম পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত ছাত্ররাজনীতি বর্তমানে বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির তো এমন দুরবস্থা অতীতে ছিল না, মতিয়া আপাদের সময়ে তো নয়ই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই, বিশেষত গত দুই দশকের গণতান্ত্রিক শাসনামলে ছাত্ররাজনীতির চরম অবক্ষয় ঘটেছে। এর বিরূপ প্রভাব মূল দলের ওপরও পড়ছে, কারণ ছাত্রসংগঠনের ক্যাডাররা দলে আধিপত্য বিস্তারে নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়েছে অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের অনুকরণে। বিশ্বখ্যাত ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদে (যেমন অক্সফোর্ড ইউনিয়ন) নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছাত্রছাত্রীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে সংসদের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধরনের ‘এক্সট্রা কারিকুলার’ বা পাঠ্যসূচিবহির্ভূত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তারা কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির লেজুড় হিসেবে ব্যবহূত হয় না।
রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে কাজ করেনি বলেই আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অতীতে জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐতিহাসিক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্নভাবে চরম বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত। আরও লিপ্ত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনখারাবির মতো অপরাধী কর্মকাণ্ডে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইডেন ও বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার মারামারির পেছনে রয়েছে ভর্তি ও সিট-বাণিজ্য থেকে অর্জিত টাকার ভাগাভাগি এবং নেতাদের কাছ থেকে ফায়দা আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে জোর করে ব্যবহার নিয়ে কলহ। আমরা যারা এককালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম, তাদের কাছে এ ধরনের পঙ্কিলতা অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় ও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু কেন ছাত্ররাজনীতির এ চরম অবক্ষয়? কীভাবে তা ঘটল? এর জন্য দায়ীই বা কারা?
আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। এমনকি বহুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় না। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে অতীতের ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তে বর্তমানে ‘ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের রাজনীতি’ বিরাজ করছে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গঠিত তাদের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোকে ‘বি-টিম’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আর ছাত্রদের নেতা-নেত্রীরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করছে মিছিল-মিটিংসহ অন্যান্য অনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে। প্রতিদানে তারা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, এমনকি ছিনতাই ও সন্ত্রাসের মতো বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার লক্ষ্যে। তাই অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর নামে বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে অপকর্মের ‘দুষ্টচক্র’ বিরাজ করছে, তাকে কোনোভাবেই ছাত্ররাজনীতি বলা যায় না। বরং তা অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির জন্য চরম কলঙ্ক।
বিরাজমান ছাত্ররাজনীতি যে অতীতের ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এগুলো যে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে পরিচালিত হয় না, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় এগুলোর নেতৃত্বের দিকে তাকালেই। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন মূলত অছাত্ররাই। উদাহরণস্বরূপ, ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতির বয়স ৪৭ বছর, যিনি গত সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি বিবাহিত, এক সন্তানের জনক এবং পেশায় ব্যবসায়ী। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকও বিবাহিত এবং পেশায় ব্যবসায়ী। একইভাবে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৭১ জনের মধ্যে ১০৩ জনই বিবাহিত, ১০২ জনের বয়স পঁয়ত্রিশের ওপরে এবং ১৫০ জনের ছাত্রত্ব নেই, যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অছাত্ররা সংগঠনের সদস্য থাকতে পারে না (প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০)।
প্রথম আলোর উপরিউক্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সংগঠনের গঠনতন্ত্রে ২৯ বছরের বেশি বয়স্কদের নেতৃত্বে থাকার ওপর বিধিনিষেধ থাকলেও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়। এ ছাড়া ৮৭টি জেলা কমিটির মধ্যে ৮২টির নেতৃত্বে রয়েছে অছাত্ররা। উপরন্তু বিবাহিতদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার অযোগ্য হলেও ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটির একটি বিরাট অংশই বিবাহিত। ছাত্রদলের মতো ছাত্রলীগের কমিটিগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বও অছাত্রদের কাঁধে। ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সম্প্রতি ইস্তফা দেয়া সাধারণ সম্পাদক উভয়ই অছাত্র, যদিও গঠনতন্ত্রে অছাত্রদের সংগঠনের সদস্য থাকার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমনকি বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও বর্তমানে অছাত্রদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে অল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং তারা কোনোভাবেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের জোর করে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করানো হয়। ভর্তি ও সিটের বিনিময়ে অনেক নিরীহ ছাত্রছাত্রী এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত হতে বাধ্য হয়। নিরাপত্তার খাতিরেও অনেক ছাত্রছাত্রীকে ছাত্রসংগঠনে নাম লেখাতে হয়।
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবক্ষয়ের জন্য মূলত দায়ী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াপনা। দেউলিয়াপনার কারণেই আমাদের রাজনীতি ক্রমাগতভাবে নিয়মতান্ত্রিকতার ধারা ছেড়ে রাজপথে স্থান নিয়েছে। মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদির মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আর এ কাজে ছাত্রছাত্রীরা মূলত ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। নেতা-নেত্রীদের নিজেদের পুত্র-কন্যাদের পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদেরই এ লাঠিয়ালির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ সেখানে বহুলাংশে অনুপস্থিত। নিয়মিত ক্লাস হয় না, যথাসময়ে পরীক্ষা হয় না, পরীক্ষার ফলও যথারীতি প্রকাশিত হয় না। সেশনজট এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলোর একটি অংশ অপচয় হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভুক্তভোগী ছাত্রছাত্রী ও পরিবারগুলোই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, পুরো জাতির মেধার বিকাশ এবং উৎপাদনশীলতাও ব্যাহত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ছাত্ররাজনীতিই নয়, শিক্ষক-রাজনীতিও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের অবনতির অন্যতম কারণ। অনেক শিক্ষকই, বিশেষত দলবাজির সঙ্গে যুক্ত অনেকে এখন আর নিয়মিত ক্লাস নেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগ হয় না, হয় ভোটার নিয়োগ। এ ছাড়া কোনো শিক্ষক দায়িত্ব পালন না করলে কিংবা গর্হিত কাজে লিপ্ত হলেও দলীয় বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তচিন্তার পাদপীঠ না হয়ে এখন দলীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
বিরাজমান ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের রাজনীতি ইতিমধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি সাধন করেছ। শিক্ষার মানে ধস নামানো এবং সেশনজট সৃষ্টি ছাড়াও এর কারণে অনেক প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে। একটি হিসাবমতে, ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ নীতি-আদর্শবিবর্জিত তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির বলিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগের অন্তঃকলহের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবু বকর, যশোরের রিপন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের নৃশংস হামলায় নিহত ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক এ মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ সংযোজন।
আমাদের আশঙ্কা, সহিংসতা ও মৃত্যুর মিছিলের এখানেই শেষ নয়, এটি এগিয়ে চলবে এবং আরও বিস্তৃত পরিসরে। নেতা-নেত্রীদের ক্ষুদ্র স্বার্থে পরিচালিত ছাত্ররাজনীতি-কেন্দ্রিক সহিংসতার আগুন দাবানলের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, বিশেষত ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত ছাত্রলীগের অন্তঃকলহের মাধ্যমে, যার আলামত ইতিমধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ এ আগুনে, ফায়দা বিতরণের মাধ্যমে, ক্রমাগতভাবে ঘি ঢালা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে ফায়দা পাওয়া কিংবা দলের ছত্রচ্ছায়ায় অনেকটা নিরাপদে ভর্তিবাণিজ্য-সিটবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, দখলদারি ইত্যাদি গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়াই বর্তমানের ছাত্ররাজনীতির মূল আকর্ষণ। এসবের আকর্ষণেই ছাত্র নামধারী অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এখন ছাত্রলীগের দিকে ছুটছে। মাননীয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আশঙ্কা অনুযায়ী, শিবিরের ক্যাডাররা সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগে যোগ দিলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, কারণ ভাত ছিটালে কাক আসবেই ।
কিন্তু নীতি-আদর্শের পরিবর্তে ভাত ছিটিয়ে কাক জড়ো করার পরিণতি অনিবার্যভাবে অশুভ। কারণ ভাত বা বিতরণ করার মতো ফায়দার পরিমাণ সীমাহীন নয়। আর যতক্ষণ ফায়দা পাওয়ার সম্ভাবনা বিরাজ করবে কিংবা অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে পার পেয়ে যাওয়া যাবে, তত দিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের মতো সহযোগী সংগঠনে যোগ দেওয়ার আকর্ষণ অব্যাহত থাকবে। ফলে সীমিত পরিমাণের ফায়দা লাভের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে, যা সহিংসতায় রূপ নিতে বাধ্য। এভাবে সহিংসতার ব্যাপ্তি এবং অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটবে।
এটি আজ সুস্পষ্ট যে বিরাজমান স্বার্থপরতার ছাত্ররাজনীতি জাতি হিসেবে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। এ কারণেই, যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আগের মেয়াদে বিরোধী দলের সম্মতি সাপেক্ষে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এবার তা করার অপূর্ব সুযোগও সৃষ্টি হয়েছিল। সব রাজনৈতিক দলের পরামর্শক্রমে জারি করা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অধ্যাদেশ, ২০০৮-এর বিধান অনুযায়ী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি। নবম জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনেই এ বিধান বলবত্ রেখে অধ্যাদেশটি অনুমোদন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো রাজনৈতিক দলই আইনের এ বিধানটি মানেনি এবং নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করেনি, যদিও কমিশন সমপ্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি লিখেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই প্রথম ছাত্রলীগকে অঙ্গসংগঠনের পরিবর্তে সহযোগী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি অনৈতিক খেলা খেলেছে, যদিও আইন অনুযায়ী অঙ্গ ও সহযোগী উভয় ধরনের সংগঠনই থাকাটা বেআইনি। বিএনপি অবশ্য আনন্দচিত্তেই সর্বক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ জনস্বার্থের বিপক্ষে অনৈতিকতার আবারও বিজয় হলো! শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদেরা সজ্ঞানেই তা করলেন!
পরিশেষে, মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর বিরাজমান ছাত্ররাজনীতিকে গলিত শবের সঙ্গে তুলনায় দেশের অধিকাংশ জনগণ একমত। গলিত শবের কোনো চিকিৎসা হয় না, এর পুনর্জীবনও ঘটানো যায় না। জরুরি ভিত্তিতে এর কবর দিতে হয়। তেমনিভাবে বর্তমানে চরম পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত ছাত্রদের ব্যবহারের রাজনীতির সংস্কারও সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এর লাগাম টেনে ধরে বা অপরাধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত কিছু ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনা। যত দিন ফায়দাবাজির রাজনীতি বজায় থাকবে, রাজনীতিবিদেরা ছাত্রছাত্রীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করবে এবং ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে, অর্থাৎ লেজুড়বৃত্তির ছাত্রসংগঠন বিরাজমান থাকবে, তত দিন ছাত্র সংসদ-কেন্দ্রিক সুস্থ ও স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্ররাজনীতি গড়ে উঠবে না। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরে আসবে না, শিক্ষার মানে উন্নতি ঘটবে না, এমনকি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজও ত্বরান্বিত হবে না। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের ৯০(গ) ধারা প্রয়োগ করে অবিলম্বে বর্তমানের লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য আমরা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ জানাই, যাতে ভবিষ্যতে দেশে সত্যিকারের কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির বিকাশ ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, দণ্ডবিধির ১৫৩(খ) ধারার অধীনেও বিরাজমান ছাত্রদের ব্যবহারের রাজনীতি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’।

No comments

Powered by Blogger.