সমকালীন প্রসঙ্গ-সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র-বাণিজ্য ও বিশ্বের জনগণের দারিদ্র্য by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে যে পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি হয় তার একটা বিশাল অংশ চুরি, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে নানা শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ লুটপাট করে। দ্বিতীয়ত, সামরিক খাতে যে বিশাল ব্যয় হয় সেটাও চুরি-দুর্নীতির মতোই। দেশের জনগণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের ভূমিকা একই প্রকার।
এ দুই যদি না থাকত তাহলে বাংলাদেশ গত ৪০ বছরে দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে যেত। কিন্তু দেশীয় শোষক, শাসকশ্রেণী ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরবি্ব ও মালিক সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ লুটপাটের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ধন-সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বর্তমান নীতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে অনেক কথাবার্তা ও লেখালেখি সত্ত্বেও এর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক, এমনকি এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সম্পর্কে প্রায় কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনাই দেখা যায় না। এদিকটি হলো, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধ উত্তেজনা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার ওতপ্রোত সম্পর্ক। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাও কখনও কখনও এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিজেদের প্রয়োজনে, যখন তাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়। এ রকম পরিস্থিতিতেই এখন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের খোরাসান প্রদেশে ১৩ মে তারিখে এক জনসভায় বলেন, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ উত্তেজনা সৃষ্টি করে ছোট দেশগুলোকে দিয়ে শত শত কোটি টাকার অস্ত্র বেচাকেনা করছে। কোনো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, এর মধ্যে একটি দেশ ৬০ বিলিয়ন অর্থাৎ ছয় হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে কিনছে। আহমাদিনেজাদ কোনো নাম উল্লেখ না করলেও এই দেশটি হলো সৌদি আরব। এই ৬০ বিলিয়নের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে তারা কিনছে ঋ-১৫ যুদ্ধবিমান! এ সংক্রান্ত রিপোর্ট আগেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
সৌদি আরব ইতিমধ্যেই শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক খাতে। এর ওপর তারা এখন আবার ৬০ বিলিয়ন ডলারের নতুন অস্ত্র কিনছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন যে সৌদি আরবের নেই, এটা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত সকলেরই জানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই গোলাম রাষ্ট্রটি এত বিরাট আকারে সে দেশ থেকে এই পরিমাণ অস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে এ কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সমর্থন ছাড়া সৌদি রাজপরিবার কর্তৃক ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। কাজেই মার্কিন যক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে তাদের তেলসম্পদ লুট করার পর সেই বাবদ তারা যে অর্থ পাচ্ছে সেটা আবার তারা লুট করছে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এটা যে শুধু সৌদি আরবের ক্ষেত্রেই হচ্ছে তাই নয়। ১৯৭৯ সালের আগে ইরানের শাহের শাসনকালে ইরানেও ঠিক এটাই হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তেল লুট করার পর ইরানের হাতে যে ডলার আসত সেটা আবার তারা লুট করত তাদের কাছে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে। সে সময় ইরান ছিল সৌদি আরবের থেকে অনেক বড় আকারে অস্ত্রসজ্জিত।
পুঁজিবাদের অস্তিত্ব ও বিকাশের সঙ্গে অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার ওতপ্রোত সম্পর্ক বিষয়ে অনেক তাত্তি্বক বিশ্লেষণ আছে। এগুলোর বিশদ উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার সম্পর্ক বোঝার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সামরিক ও বেসামরিক উৎপাদনের তুলনাই এ ক্ষেত্রে চোখ খুলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। বার্ট্রান্ড রাসেল তার জীবদ্দশার শেষ দিকে মার্কিন অর্থনীতির ওপর তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, তখন সেই দেশটির অর্থনীতির ৬০% ছিল সামরিক খাতে। এ বিষয়ে বিখ্যাত মার্কসবাদী তাত্তি্বক রোজা লুক্সেমবুর্গ এবং লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রায়ন আছে। বার্ট্রান্ড রাসেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৬০%-এর সামরিকীকরণের কথা বলেছিলেন ষাটের দশকে। এখন এই অনুপাত আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াল স্ট্রিটের অর্থ সংস্থাগুলো (ঋরহধহপরধষ ড়ৎমধহরুধঃরড়হং) যত রকম ভেলকিবাজিই দেখাক, অস্ত্র উৎপাদন ও বাণিজ্যের ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় সার্বভৌম বলা চলে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, মার্কিন অর্থনীতির সংকট বিষয়ে আলোচনায় এদিকটির উল্লেখ অতি সামান্য, গুরুত্বের তুলনায় নগণ্যই বলা চলে।
সাধারণত লোকের ধারণা যে, বিশ্বের পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, এই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর ওপর ওতপ্রোতভাবে নির্ভরশীল। এই দেশগুলোকে নানাভাবে শোষণ ও প্রতারিত করেই সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভুত্ব বজায় রাখে। তাদের এক ধরনের ফাঁদে ফেলে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের অস্ত্রের ব্যবসা জমজমাট রাখে। এই ফাঁদের মধ্যে সব থেকে ফলপ্রসূ হলো, প্রত্যেক অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের পরিবর্তে শত্রুতার সম্পর্ক এবং উত্তেজনার পরিস্থিতি বজায় রাখা। এর জন্য সব রকম নোংরা কূটনৈতিক কৌশল ব্যবহার করা। এই শত্রুতার কারণে এই দেশগুলো নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত করতে চায়, নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় এবং এ জন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় ও আমদানি করে। সাম্রাজ্যবাদের এই অস্ত্র বাণিজ্যের জন্য আজ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে যে পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে ও হচ্ছে সেটা যদি মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় হতো, তাহলে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই এখন স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে এই অস্ত্র-বাণিজ্যের কারণেই বিশ্বের জনগণের বিশাল অংশ আজ ক্ষুধায় অস্থির, দারিদ্র্যের চরম অবস্থা তাদের। জীবন তাদের নরকবাসের মতো।
বাংলাদেশও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এই দেশে এখন সামরিক খাতে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সেটা বাজেট ও মোট উৎপাদনের কত অংশ, এটা এক গোপন ব্যাপার। কিন্তু এই ব্যয় যে বিশাল এবং আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজনীয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এ কারণে যে, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের সঙ্গে তার কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। এমন কোনো শত্রুতার সম্পর্ক নেই যাতে বাংলাদেশের এই সমরসজ্জার কোনো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নতুন নতুন সশস্ত্র সংগঠন ও সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামরিক খাতে ব্যয়ও বৃদ্ধি হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, এই অস্ত্র-বাণিজ্যের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চাল তো আছেই, তার সঙ্গে আছে দেশের জনগণের ওপর দমন-পীড়নের প্রয়োজন। এই প্রয়োজন কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা সরকারের দমন-পীড়নের ব্যাপকতা থেকে বোঝা যায়। সর্বোপরি বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত আছে দুর্নীতি। সামরিক সরঞ্জাম কেনার সঙ্গে আজ কীভাবে সরকারি মহলের শীর্ষতম থেকে সামরিক-বেসামরিক আমলারা কতখানি ও কতভাবে জড়িত তার কোনো হিসাব বের করা মুশকিল, প্রায় অসম্ভব।
এখানে বলা দরকার যে, সামরিক খাতে দুর্নীতিই সব থেকে নিরাপদ। কারণ, এ খাতে যে কেনাকাটা হয়, যে ব্যয় হয় তার সবকিছুুই গোপনীয়তা রক্ষা করেই হয়। জনগণের, এমনকি সরকারের অনেক উচ্চ পর্যায়ের লোকদের অনেকেও তা জানেন না, জানার উপায় থাকে না।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি হয় তার একটা বিশাল অংশ চুরি, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে নানা শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ লুটপাট করে। দ্বিতীয়ত, সামরিক খাতে যে বিশাল ব্যয় হয় সেটাও চুরি-দুর্নীতির মতোই। দেশের জনগণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের ভূমিকা একই প্রকার। এ দুই যদি না থাকত তাহলে বাংলাদেশ গত ৪০ বছরে দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে যেত। কিন্তু দেশীয় শোষক, শাসকশ্রেণী ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরবি্ব ও মালিক সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ লুটপাটের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ধন-সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বর্তমান নীতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। এর জন্য শাসনব্যবস্থা আমূলভাবে পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।
১৪.৫.২০১২
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে অনেক কথাবার্তা ও লেখালেখি সত্ত্বেও এর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক, এমনকি এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সম্পর্কে প্রায় কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনাই দেখা যায় না। এদিকটি হলো, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধ উত্তেজনা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার ওতপ্রোত সম্পর্ক। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাও কখনও কখনও এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিজেদের প্রয়োজনে, যখন তাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়। এ রকম পরিস্থিতিতেই এখন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের খোরাসান প্রদেশে ১৩ মে তারিখে এক জনসভায় বলেন, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ উত্তেজনা সৃষ্টি করে ছোট দেশগুলোকে দিয়ে শত শত কোটি টাকার অস্ত্র বেচাকেনা করছে। কোনো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, এর মধ্যে একটি দেশ ৬০ বিলিয়ন অর্থাৎ ছয় হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে কিনছে। আহমাদিনেজাদ কোনো নাম উল্লেখ না করলেও এই দেশটি হলো সৌদি আরব। এই ৬০ বিলিয়নের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে তারা কিনছে ঋ-১৫ যুদ্ধবিমান! এ সংক্রান্ত রিপোর্ট আগেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
সৌদি আরব ইতিমধ্যেই শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক খাতে। এর ওপর তারা এখন আবার ৬০ বিলিয়ন ডলারের নতুন অস্ত্র কিনছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন যে সৌদি আরবের নেই, এটা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত সকলেরই জানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই গোলাম রাষ্ট্রটি এত বিরাট আকারে সে দেশ থেকে এই পরিমাণ অস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে এ কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সমর্থন ছাড়া সৌদি রাজপরিবার কর্তৃক ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। কাজেই মার্কিন যক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে তাদের তেলসম্পদ লুট করার পর সেই বাবদ তারা যে অর্থ পাচ্ছে সেটা আবার তারা লুট করছে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এটা যে শুধু সৌদি আরবের ক্ষেত্রেই হচ্ছে তাই নয়। ১৯৭৯ সালের আগে ইরানের শাহের শাসনকালে ইরানেও ঠিক এটাই হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তেল লুট করার পর ইরানের হাতে যে ডলার আসত সেটা আবার তারা লুট করত তাদের কাছে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে। সে সময় ইরান ছিল সৌদি আরবের থেকে অনেক বড় আকারে অস্ত্রসজ্জিত।
পুঁজিবাদের অস্তিত্ব ও বিকাশের সঙ্গে অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার ওতপ্রোত সম্পর্ক বিষয়ে অনেক তাত্তি্বক বিশ্লেষণ আছে। এগুলোর বিশদ উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার সম্পর্ক বোঝার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সামরিক ও বেসামরিক উৎপাদনের তুলনাই এ ক্ষেত্রে চোখ খুলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। বার্ট্রান্ড রাসেল তার জীবদ্দশার শেষ দিকে মার্কিন অর্থনীতির ওপর তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, তখন সেই দেশটির অর্থনীতির ৬০% ছিল সামরিক খাতে। এ বিষয়ে বিখ্যাত মার্কসবাদী তাত্তি্বক রোজা লুক্সেমবুর্গ এবং লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রায়ন আছে। বার্ট্রান্ড রাসেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৬০%-এর সামরিকীকরণের কথা বলেছিলেন ষাটের দশকে। এখন এই অনুপাত আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াল স্ট্রিটের অর্থ সংস্থাগুলো (ঋরহধহপরধষ ড়ৎমধহরুধঃরড়হং) যত রকম ভেলকিবাজিই দেখাক, অস্ত্র উৎপাদন ও বাণিজ্যের ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় সার্বভৌম বলা চলে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, মার্কিন অর্থনীতির সংকট বিষয়ে আলোচনায় এদিকটির উল্লেখ অতি সামান্য, গুরুত্বের তুলনায় নগণ্যই বলা চলে।
সাধারণত লোকের ধারণা যে, বিশ্বের পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, এই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর ওপর ওতপ্রোতভাবে নির্ভরশীল। এই দেশগুলোকে নানাভাবে শোষণ ও প্রতারিত করেই সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভুত্ব বজায় রাখে। তাদের এক ধরনের ফাঁদে ফেলে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের অস্ত্রের ব্যবসা জমজমাট রাখে। এই ফাঁদের মধ্যে সব থেকে ফলপ্রসূ হলো, প্রত্যেক অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের পরিবর্তে শত্রুতার সম্পর্ক এবং উত্তেজনার পরিস্থিতি বজায় রাখা। এর জন্য সব রকম নোংরা কূটনৈতিক কৌশল ব্যবহার করা। এই শত্রুতার কারণে এই দেশগুলো নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত করতে চায়, নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় এবং এ জন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় ও আমদানি করে। সাম্রাজ্যবাদের এই অস্ত্র বাণিজ্যের জন্য আজ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে যে পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে ও হচ্ছে সেটা যদি মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় হতো, তাহলে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই এখন স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে এই অস্ত্র-বাণিজ্যের কারণেই বিশ্বের জনগণের বিশাল অংশ আজ ক্ষুধায় অস্থির, দারিদ্র্যের চরম অবস্থা তাদের। জীবন তাদের নরকবাসের মতো।
বাংলাদেশও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এই দেশে এখন সামরিক খাতে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সেটা বাজেট ও মোট উৎপাদনের কত অংশ, এটা এক গোপন ব্যাপার। কিন্তু এই ব্যয় যে বিশাল এবং আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজনীয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এ কারণে যে, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের সঙ্গে তার কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। এমন কোনো শত্রুতার সম্পর্ক নেই যাতে বাংলাদেশের এই সমরসজ্জার কোনো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নতুন নতুন সশস্ত্র সংগঠন ও সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামরিক খাতে ব্যয়ও বৃদ্ধি হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, এই অস্ত্র-বাণিজ্যের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চাল তো আছেই, তার সঙ্গে আছে দেশের জনগণের ওপর দমন-পীড়নের প্রয়োজন। এই প্রয়োজন কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা সরকারের দমন-পীড়নের ব্যাপকতা থেকে বোঝা যায়। সর্বোপরি বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত আছে দুর্নীতি। সামরিক সরঞ্জাম কেনার সঙ্গে আজ কীভাবে সরকারি মহলের শীর্ষতম থেকে সামরিক-বেসামরিক আমলারা কতখানি ও কতভাবে জড়িত তার কোনো হিসাব বের করা মুশকিল, প্রায় অসম্ভব।
এখানে বলা দরকার যে, সামরিক খাতে দুর্নীতিই সব থেকে নিরাপদ। কারণ, এ খাতে যে কেনাকাটা হয়, যে ব্যয় হয় তার সবকিছুুই গোপনীয়তা রক্ষা করেই হয়। জনগণের, এমনকি সরকারের অনেক উচ্চ পর্যায়ের লোকদের অনেকেও তা জানেন না, জানার উপায় থাকে না।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি হয় তার একটা বিশাল অংশ চুরি, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে নানা শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ লুটপাট করে। দ্বিতীয়ত, সামরিক খাতে যে বিশাল ব্যয় হয় সেটাও চুরি-দুর্নীতির মতোই। দেশের জনগণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের ভূমিকা একই প্রকার। এ দুই যদি না থাকত তাহলে বাংলাদেশ গত ৪০ বছরে দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে যেত। কিন্তু দেশীয় শোষক, শাসকশ্রেণী ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরবি্ব ও মালিক সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ লুটপাটের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ধন-সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বর্তমান নীতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। এর জন্য শাসনব্যবস্থা আমূলভাবে পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।
১৪.৫.২০১২
No comments