নির্বাচনের ভয়ে চার উপাচার্য by মোশতাক আহমেদ ও আহমেদ জায়িফ

ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর—দেশের পুরোনো ও শীর্ষস্থানীয় এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের কেউই নির্বাচন দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন না শিক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয় করছেন চারজন উপাচার্য। তাঁরা আইনের মারপ্যাঁচে তিন বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত উপাচার্যদের মতোই দায়িত্ব পালন করছেন।


১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের জন্য নির্বাচিত উপাচার্য থাকার কথা।
অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি সিনেট মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। তবে ১১(২) ধারায় বলা আছে, অস্থায়ী শূন্যতার (অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে) জন্য জরুরি প্রয়োজনে আচার্য অস্থায়ীভাবে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে পদটি স্থায়ী করবে।
‘যত দ্রুত সম্ভব’ বলা হলেও কত দ্রুত নির্বাচন করতে হবে, তা অধ্যাদেশে উল্লেখ না থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছেন অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা। বর্তমান সরকারের মেয়াদে এ নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা আর নেই বলেও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করছেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। উপাচার্যরাও নির্বাচিত নন, তাঁরা বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থক। গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত শীর্ষস্থানীয় এই চারটি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কার্যত সরকার-মনোনীত উপাচার্যদের দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব এবং উপাচার্যদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত শিক্ষক, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সিনেট থাকার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি তিনটিতে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত শিক্ষক ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিও নেই। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র প্রতিনিধি নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকের বেশি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় না। আর জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরেই দায়িত্ব পালন করছেন সরকার-মনোনীত অনির্বাচিত উপাচার্যরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচন নিয়মিত হয়ে এলেও বর্তমান অস্থায়ী উপাচার্য তিন বছরেও নির্বাচন দেননি।
উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না—জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দায়িত্ব স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের। এ বিষয়ে তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত রোববার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
উপাচার্য নির্বাচনের লক্ষণ নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে: উপাচার্য নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট সদস্য ও শিক্ষকেরা।
২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছর তাঁর উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হয় সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন। এরপর তিন বছর পার হলেও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট সিনেট সদস্য ১০৪ জন। উপাচার্য নির্বাচনে তাঁরাই ভোট দেন। ২০০৯ সালের ২৮ মে অনুষ্ঠিত হয় সিনেটের ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন। ৯ জুন অনুষ্ঠিত হয় ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন। এখন ৮৪ জন সদস্য নিয়ে কার্যকর আছে সিনেট। আগামী ২৭ জুন শিক্ষক প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। শিক্ষকেরা বলছেন, তার আগে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন না দেওয়া হলে এই সরকারের মেয়াদে আর তা সম্ভব হবে না।
উপাচার্য নির্বাচনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও সহ-উপাচার্য হারুন-অর-রশিদের অনুসারী শিক্ষকেরা বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। হাইকোর্টে গত রোববার রিট আবেদন করেছেন একজন আইনজীবী। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এ জন্য রুল জারি করেছেন আদালত।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা থেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সূত্রমতে, এরপর উপাচার্য ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি তাঁকে অবহিত করেন। তার পর থেকে এটি ধামাচাপা পড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। আচার্য তাঁকে যে ধারা অনুযায়ী নিয়োগ দিয়েছেন, তা এ অধ্যাদেশেরই অংশ। তিনি দাবি করেন, নির্বাচিত উপাচার্য না হলেও তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচিত উপাচার্যদের চেয়ে ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপাচার্য নির্বাচন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনির্বাচিত অবস্থায় উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা সম্পূর্ণ অনৈতিক। যে বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের চর্চা নষ্ট করা সবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বলেন, বর্তমান উপাচার্যকে যে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেখানে স্পষ্টভাবে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগে সম্পূর্ণ সাময়িকভাবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপের মুখে উপাচার্য: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ সিনেট নির্বাচন হয় ১৯৯৮ সালে। তখন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম সাইদুর রহমান খান উপাচার্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরাই উপাচার্য নির্বাচন চান। দলীয় বিরোধের কারণে উপাচার্য চাপের মুখে পড়েছেন। এ মুহূর্তে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়া হলে সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরাই তাঁর বিপক্ষে অবস্থান করবেন—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকসমাজের আহ্বায়ক এম শাহ নওয়াজ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী অবশ্যই নির্বাচন হওয়া উচিত। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে উপাচার্যদের বৈঠকের পর আমরা আশা করছি, শিগগিরই এ নির্বাচন দেওয়া হবে।’
উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান বলেন, সিনেটের বিভিন্ন পদে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতা অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের করণীয় কিছু নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়া উচিত।
চট্টগ্রামে অনির্বাচিতদের দুই দশক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্য নেই দুই দশকের বেশি সময় ধরে। মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সিনেটই চলছে অনির্বাচিতদের নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ২৫ জন এবং শিক্ষক প্রতিনিধি ৩৩ জনের মেয়াদ শেষ হয়েছে দীর্ঘদিন আগে। নিয়মবহির্ভূতভাবেই তাঁরা সিনেট অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন।
সিনেটের মাধ্যমে সর্বশেষ উপাচার্য নির্বাচন হয় ১৯৮৮ সালে। তখন উপাচার্য নির্বাচিত হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। এরপর আর উপাচার্য নির্বাচন হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে মোট সাত ধরনের ৮৩টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে সিনেটে বর্তমানে সদস্য আছেন ৭১ জন।
সর্বশেষ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন হয় ১৯৮৬ সালে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রতিনিধিদের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর দুবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর হয়নি। ২০০১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৪ সালে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ২২ বছর ধরে উপাচার্য নির্বাচন না হওয়া অনৈতিক এবং আইনবহির্ভূত। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে এটা হচ্ছে না বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে উপাচার্য মো. আনোয়ারুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, সিনেটের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে মামলা। যতবারই নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, ততবারই রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিদের কেউ না কেউ মামলা করেন।
জাহাঙ্গীরনগরে উপাচার্যের গদি নড়বড়ে: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় না। তিন বছর আগে নিয়োগ পাওয়া বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে ছাত্র-শিক্ষকেরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে তিন বছরের জন্য নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও শিক্ষক প্রতিনিধিরা এক যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ সদস্যদের দিয়েই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিনেট অধিবেশন।
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। এর আগে সিনেটের মাধ্যমে সর্বশেষ নির্বাচিত উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন না দিয়ে উল্টো বিভিন্ন অনিয়ম করে বর্তমান উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, উপাচার্য একটি সম্মানজনক পদ, নির্বাচিত হয়ে আসা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।
এ বিষয়ে শরীফ এনামুল কবির সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিগগিরই এ বিষয়ে আপনারা জানতে পারবেন।’

No comments

Powered by Blogger.