চারদিক-নারী আন্দোলনের চার দশক by ফওজিয়া মোসলেম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক অতিক্রান্ত হবে আগামী বছর। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে একটি বড় পর্ব জুড়ে রয়েছে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থান যেন স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের সূচনা-সংগীত। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তা। সমগ্র বাঙালি জাতি নিজেকে মেলে ধরেছিল।
বাংলার বীর নারীসমাজও ঘরের অর্গল খুলে সমগ্র জাতির আন্দোলনের কাতারে শামিল হয়েছিল নিজ তাগিদে। আমরা যখন ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বানে পল্টনের জনসমুদ্রে উপস্থিত হতাম, তখন দেখতাম আমাদের অজানা-অপরিচিত বহু নারী সেই জনসভায় উপস্থিত। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় সেই জনসভায়। এর মধ্যে একজনের কথা মন্রে হয়, যাঁকে আমরা চিনতাম ‘নলগোলার খালাম্মা’ বলে। মিটিং শেষে ছাত্রনেতাদের আলিঙ্গন না করে তিনি কখনো সভাস্থল ত্যাগ করতেন না। এসব মহিলা ও ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদ।
এই সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠারও আগে এমনকি গণঅভ্যুত্থানেরও আগে বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গ্রেফতার হলেন। সে সময় রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হওয়া একমাত্র নারী তিনি। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিশিষ্ট নারীদের বিবৃতি দেওয়া হলো। এই কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হলো বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের মুক্তির দাবিতে নারীসমাজ বিবৃতি দিল। সমাবেশ করল। এভাবেই বাংলাদেশের নারীসমাজ জাতীয় কর্তব্য পালনে এগিয়ে এল।
এ বিষয়গুলো অবতারণার কারণ হলো, স্বাধীনতার ৩৯ বছরে বাংলাদেশের নারীর জীবনে যে পরিবর্তনের লক্ষণগুলো আমরা দেখি, তার উৎসমুখে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে, এককথায় বলা যেতে পারে, বাংলার মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নারীমুক্তির আন্দোলনও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল শুরু থেকেই। বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের একটা অবয়ব ২০১০-এ এসে হয়তো ফুটে উঠেছে। কিন্তু ১৯৭০-এর আগে নারীর সমস্যা ও অধিকারভিত্তিক কোনো নারী সংগঠন ছিল না। সে সময় নারী সংগঠনের কাজ সূচিশিল্প ও দুস্থদের সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং স্থানীয় পরিধিতেই তা আবর্তিত হতো। তাই ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যখন আত্মপ্রকাশ করল নারীর সমান অধিকারের দাবি নিয়ে, তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল এটি কোনো রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্ম। আজ চার দশকে মহিলা পরিষদ প্রমাণ করেছে, এটি নারীদের জন্য নারী সংগঠন। সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এর যাত্রা শুরু এবং এখনো পর্যন্ত সেই লক্ষ্যই অব্যাহত আছে।
বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে নারীর অধিকার বিষয়ে সমাজ সচেতন হয়েছে। রাষ্ট্রও নারীর অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃতি দিচ্ছে, যদিও এখন পর্যন্ত নারীর সব অধিকার নিশ্চিত করার আইনগত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি সব ক্ষেত্রে। নারী আন্দোলনের ক্রমাগত বিকাশের কারণে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীসমাজকে সংগঠিত করতে গিয়ে দেখা গেল, অধিকারহীনতার কারণে নারী ভয়াবাহ নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৮০-এর দশকে শুরু হলো নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলো, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন নারীর মানবাধিকারের পক্ষ সমর্থন করে না। আবার কিছু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ হয় না। শুরু হলো নারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন তৈরি ও প্রচলিত আইন সংস্কারের জন্য আন্দোলন।
নারীর স্বার্থে আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন সমাজের মানুষের মানসিক গঠনের পরিবর্তন, নীতিনির্ধারণী্র পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ। তাই দাবি উঠল নারীর ক্ষমতায়নের। তবে একথা উল্লেখ্য, নারী আন্দোলনের এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উত্তরণের অর্থ এই নয় যে আগের পর্যায়ের সব কাজের পুরোপুরি সমাধান হয়েছে। নারী নির্যাতনবিরোধী কাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি করতে হবে। কারণ নারী এখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সর্বত্রই। আজ নারীসহ সমাজের সবাই সম্পদ ও সম্পত্তিতে সমানাধিকার ছাড়া নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করে।
সম্প্রতি উদ্যাপিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবার্ষিকী। সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণমাধ্যম নানা আয়োজনে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে। বাংলাদেশেও বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি উদ্যাপিত হলো। নারী আন্দোলনের অগ্রযাত্রার সূচক হিসেবে এটাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বর্তমান সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে নারী আন্দোলন অনেক শক্তি অর্জন করেছে। নারীর অধিকারের বিষয়টি জাতীয় বিবেচ্য ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের হুমকি ও জলবায়ুর বৈরিতা পৃথিবীজুড়ে নারী আন্দোলনের সামনে নতুন সমস্যা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের নারীসামজ অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। নারী তার আপন শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা চিহ্নিত করেছে। এখন দৃঢ় পদক্ষেপে কৌশলী হয়ে সেই পথ ধরে অর্জনকে সংরক্ষণ করতে হবে। মানবাধিকারের লক্ষ্যে সমাজ-মানসকে প্রস্তুত করতে হবে। তাহলে সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
এই সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠারও আগে এমনকি গণঅভ্যুত্থানেরও আগে বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গ্রেফতার হলেন। সে সময় রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হওয়া একমাত্র নারী তিনি। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিশিষ্ট নারীদের বিবৃতি দেওয়া হলো। এই কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হলো বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের মুক্তির দাবিতে নারীসমাজ বিবৃতি দিল। সমাবেশ করল। এভাবেই বাংলাদেশের নারীসমাজ জাতীয় কর্তব্য পালনে এগিয়ে এল।
এ বিষয়গুলো অবতারণার কারণ হলো, স্বাধীনতার ৩৯ বছরে বাংলাদেশের নারীর জীবনে যে পরিবর্তনের লক্ষণগুলো আমরা দেখি, তার উৎসমুখে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে, এককথায় বলা যেতে পারে, বাংলার মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নারীমুক্তির আন্দোলনও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল শুরু থেকেই। বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের একটা অবয়ব ২০১০-এ এসে হয়তো ফুটে উঠেছে। কিন্তু ১৯৭০-এর আগে নারীর সমস্যা ও অধিকারভিত্তিক কোনো নারী সংগঠন ছিল না। সে সময় নারী সংগঠনের কাজ সূচিশিল্প ও দুস্থদের সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং স্থানীয় পরিধিতেই তা আবর্তিত হতো। তাই ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যখন আত্মপ্রকাশ করল নারীর সমান অধিকারের দাবি নিয়ে, তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল এটি কোনো রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্ম। আজ চার দশকে মহিলা পরিষদ প্রমাণ করেছে, এটি নারীদের জন্য নারী সংগঠন। সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এর যাত্রা শুরু এবং এখনো পর্যন্ত সেই লক্ষ্যই অব্যাহত আছে।
বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে নারীর অধিকার বিষয়ে সমাজ সচেতন হয়েছে। রাষ্ট্রও নারীর অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃতি দিচ্ছে, যদিও এখন পর্যন্ত নারীর সব অধিকার নিশ্চিত করার আইনগত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি সব ক্ষেত্রে। নারী আন্দোলনের ক্রমাগত বিকাশের কারণে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীসমাজকে সংগঠিত করতে গিয়ে দেখা গেল, অধিকারহীনতার কারণে নারী ভয়াবাহ নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৮০-এর দশকে শুরু হলো নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলো, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন নারীর মানবাধিকারের পক্ষ সমর্থন করে না। আবার কিছু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ হয় না। শুরু হলো নারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন তৈরি ও প্রচলিত আইন সংস্কারের জন্য আন্দোলন।
নারীর স্বার্থে আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন সমাজের মানুষের মানসিক গঠনের পরিবর্তন, নীতিনির্ধারণী্র পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ। তাই দাবি উঠল নারীর ক্ষমতায়নের। তবে একথা উল্লেখ্য, নারী আন্দোলনের এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উত্তরণের অর্থ এই নয় যে আগের পর্যায়ের সব কাজের পুরোপুরি সমাধান হয়েছে। নারী নির্যাতনবিরোধী কাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি করতে হবে। কারণ নারী এখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সর্বত্রই। আজ নারীসহ সমাজের সবাই সম্পদ ও সম্পত্তিতে সমানাধিকার ছাড়া নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করে।
সম্প্রতি উদ্যাপিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবার্ষিকী। সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণমাধ্যম নানা আয়োজনে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে। বাংলাদেশেও বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি উদ্যাপিত হলো। নারী আন্দোলনের অগ্রযাত্রার সূচক হিসেবে এটাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বর্তমান সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে নারী আন্দোলন অনেক শক্তি অর্জন করেছে। নারীর অধিকারের বিষয়টি জাতীয় বিবেচ্য ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের হুমকি ও জলবায়ুর বৈরিতা পৃথিবীজুড়ে নারী আন্দোলনের সামনে নতুন সমস্যা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের নারীসামজ অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। নারী তার আপন শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা চিহ্নিত করেছে। এখন দৃঢ় পদক্ষেপে কৌশলী হয়ে সেই পথ ধরে অর্জনকে সংরক্ষণ করতে হবে। মানবাধিকারের লক্ষ্যে সমাজ-মানসকে প্রস্তুত করতে হবে। তাহলে সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
No comments