অভিমত ভিন্নমত

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিজলি জেলের কারারক্ষীরা রাজবন্দীদের ওপর বীভৎস আক্রমণ চালায়। ফলে তিনজন রাজবন্দী শহীদ হন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন। ওই ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার একটি বিশাল জনসভায় রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন।


ওই সময় স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখেছিল যে কারারক্ষীদের যেন খ্রিষ্টচিত করুণা দেখানো হয়। পত্রিকাটির অজুহাত ছিল এই যে রাজবন্দীদের ব্যবহারে কারারক্ষীদের ওপরে স্নায়বিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথ স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। স্টেটসম্যান চিঠিটি ছাপায়নি বরং উদ্ধতভাবে তা কবিগুরুর কাছে ফেরত পাঠায়। এই পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি রচনা করেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর কামারের এক ঘা বইটিতে এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে বণনা করেছেন।
ঊনিশ শ একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও কার‌্যাবলি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর অর্জিত তাদের সামাজিত-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা, একধরনের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে জামায়াতের বন্ধুত্ব ও গোটা জাতির প্রতিক্রিয়া আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি প্রশ্ন মনে আসে।
যিশুখ্রিষ্ট ক্ষমার কথা বলেছেন। বুদ্ধ মৈত্রীর কথা শুনিয়েছেন। ইসলাম শান্তির কথা বলে। কিন্তু সবাইকে কি ক্ষমা করা যায়?
হিজলি কারাগারে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে যারা নিরস্ত্র রাজবন্দীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ তাদের ক্ষমা করতে পারেননি।
“ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/দয়াহীন সংসারে।/তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো/অন্তর হতে বিদ্বেষ দ্বেষ নাশো’।/বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির দ্বারে,/আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।”
বলা হয় বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। ব্যাপারটা হয়তো ছিল রাষ্ট্রনীতির কৌশল। অপরাধীদের যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তারা এ ক্ষমতার আওতায় পড়ে না।
যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সেখানে সেই ব্যক্তি নিজের মহত্বের উদারতায় দুর্বল অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু যেখানে অপরাধ করা হয়েছে নিরস্ত্র জনসমষ্টির বিরুদ্ধে এবং যেখানে অপরাধ করেছে রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান একদল মানুষ, সে ক্ষেত্রে ক্ষমা করার অধিকার কারও রয়েছে কি?
স্বজনহারা, ভগ্নহূদয় মানুষগুলোর পক্ষে কি সম্ভব গণহত্যা আর গণধর্ষণে হানাদার বাহিনীর দোসরদের ক্ষমা করা। সুপরিকল্পিতভাবে যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে তাদের কি ক্ষমা করা যায়?
কারারক্ষীদের ক্ষমা করতে ব্যর্থ রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ হূদয়ে ভগবানকেই প্রশ্ন করে বসলেন, তুমি কি ওদের ক্ষমা করতে পেরেছ?
‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ। তুমি কি বেসেছ ভালো?’
একদিন হয়তো বিধাতা ঘাতক-দালালদের বিচার করবেন। কিন্তু তা হবে তাদের মৃত্যুর পরে। কিন্তু তার আগে তাদের জীবদ্দশায় তাদের আস্ফাালন শুনে স্বজনহারা শোকার্ত মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় বৈকি।
দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের বিচার ইতিহাস কীভাবে করে?
হিটলার নরওয়ে দখল করার পরে ভিদকুন কুইসলিং পুতুল সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। নরওয়ে মুক্ত হলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অধিকৃত ফ্রান্সে পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপতি হন হেনরি ফিলিপে পেতা। ফ্রান্স মুক্ত হলে ৮৮ বছর বয়স হওয়ার জন্য তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বেনেডিক্ট আর্নল্ড ব্রিটিশদের পক্ষ নেন। দেশ থেকে পালিয়ে এসে বিলেতে চরম অবহেলার মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিভীষণ ‘ন্যায়ের পক্ষ’ গ্রহণ করে নিজ দেশের বিরোধিতা করেন। ইতিহাস তাঁকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে ।
কিন্তু আমাদের দেশে দেশদ্রোহীদের কী হয়েছে? শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। গোলাম আযম বহাল তবিয়তে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জামায়াতিরা ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হয়েছে।
এসব অবশ্যই আমাদের অগৌরবের বিষয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে লক্ষ মুক্তিসেনার আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের প্রাপ্য গৌরব আমরা ফিরে পেতে পারি।
ওয়াহিদ নবী, লন্ডন।

এত খুন কেন!
পত্রিকার পাতা চোখের সামনে ধরলেই দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ব্যবসায়ী খুন, রাজনৈতিক নেতা খুন, ছিনতাইকারীর হাতে নিরীহ পথচারী খুন, মলম পার্টির কবলে পড়ে সহায়-সম্বল হারানো—এ ধরনের নানা অপরাধের খবর। সবচেয়ে পীড়াদায়ক বিষয় হলো, আমাদের মা-বোনেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বর্বরদের হাতে নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, কিন্তু স্বাধীন দেশে এখনো যারা এসব করেও শাস্তি পাচ্ছে না, তারা কারা? তাহলে কি এদের মধ্যে পাকিস্তানিদের রক্ত রয়ে গেছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদৌ পারবে?
দেশ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরাও যখন সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন, তখন আমাদের সরকারের মন্ত্রী বলছেন, আইনশৃঙ্খলার নাকি উন্নতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র খুন হলে বলা হচ্ছে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এ রকম হতেই পারে। ফলে সন্ত্রাস দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যে সমাজে অপরাধ করে অপরাধীরা শাস্তি পায় না, বরং সরকারের কণ্ঠে শুনতে পায় অপরাধ হচ্ছে না, শান্তিশৃঙ্খলা খুব আছে—সেই সমাজে অপরাধ বেড়ে চলতে বাধ্য।
এভাবে দেশ চালিয়ে সরকার এ দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? আর নিজেই বা কোথায় যেতে চায়? তাঁরা কি ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে তাঁদের দলের কী পরিণতি হতে পারে? নাকি নির্বাচন এখনো অনেক দূরে বলে সরকারের এসব গায়ে লাগছে না?
কিন্তু খারাপ পরিণতি যাতে না হয়, সে জন্য সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া দরকার।
উত্তম এস রোজারিও
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা।

প্রতুল গোস্বামী নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা
‘তবে কি আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন?’ শিরোনামে প্রতুল গোস্বামীর মেয়ে দীপ্তি লাহিড়ীর লেখাটি ২৪ মার্চ প্রথম আলোয় পড়লাম। মার্চ মাসে তাঁর এই স্মৃতিচারণা আমাদের উজ্জীবিত করেছে। শহীদ প্রতুল গোস্বামী সিরাজগঞ্জবাসীর অহংকার। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদরে অবস্থিত গোস্বামী-পরিবারের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ডাকসাঁইটে জমিদার থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন, সমাজসেবা থেকে মুক্তিযুদ্ধ, সর্বত্রই তাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। হয়েছেন শহীদ, এমনকি তাড়াশ থেকে বাস্তুচ্যুত। শহীদ প্রতুল গোস্বামী এ পরিবারেরই এক কৃতী সন্তান, সাধারণ্যে যিনি হীরালাল গোস্বামী ওরফে হীরা গোস্বামী নামে বেশি পরিচিত। শ্রীমতী দীপ্তি লাহিড়ী তাঁর শুদ্ধ নাম ব্যবহার করায় অনেক পাঠকই বিভ্রান্ত হয়েছেন। কেননা সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে তিনি শহীদ হীরালাল গোস্বামী নামেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এ ছাড়া আরও বিভ্রান্ত হয়েছেন তাঁর পিতৃভিটার পরিচিতি নিয়ে। প্রতুল গোস্বামীর জন্ম পাবনার চাটমোহর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামে মাতুলালয়ে হলেও পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জের তাড়াশ জেলা সদরে। এবং আমৃত্যু এখানেই ছিল তাঁর ঘরবসতি।
১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল তাড়াশে অভিযান চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রতুল গোস্বামীর রামদার কোপে নিহত হয় দুজন সেনা, আহত হয় একজন। আর সেনাদের গুলিতে নিহত হন অভয় মাঝি, দিনেশ সিংহ প্রমুখ। স্থানীয় রাজাকাররা প্রতুল গোস্বামীকে ধরে ফেলে। সেই থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। তাঁর ভাই শহীদ অতুল গোস্বামী ওরফে চুনিলাল গোস্বামীকেও রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদে হীরালাল গোস্বামীকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ‘দেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম নেই’ অথবা ‘নাম নেই শহীদদের তালিকায়’ এ কথা সঠিক নয়। তবে এটা ঠিক, তাঁর যথাযোগ্য মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। সে জন্য আমরা লজ্জিত।
বর্তমান সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আমাদের তিনটি প্রস্তাব: শহীদ প্রতুল গোস্বামী ওরফে হীরালাল গোস্বামীর নামে তাড়াশ উপজেলা সদরে একটি রাস্তার নামকরণ এবং শহীদদের তালিকায় অতুল গোস্বামীর নাম তালিকাভুক্ত করা হোক। তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চত্বর অথবা প্রেসক্লাব চত্বরে তাড়াশে মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা এবং সেসব ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক। তাদের
অনেকেই এখনো জীবিত।
সনাতন দাশ
সভাপতি, তাড়াশ প্রেসক্লাব, সিরাজগঞ্জ।

বহিরাগতদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত স্বাধীনভাবে সৃজনশীল চিন্তাচেতনা বিকাশের জায়গা, যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের চর্চা করবে। তারপর সেই জ্ঞান ছড়িয়ে যাবে সমাজে। গড়ে উঠবে জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ। শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করবে। এই হলো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু বহিরাগত শক্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, তখন আর পরিবেশটা স্বাভাবিক থাকে না। এমনটিই দেখতে পেলাম ১৮ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগ নামধারী কিছু বহিরাগত যুবক আহত করল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরকে। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে আহত হলো কয়েকজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের দিকে গুলিও ছুড়েছিল তারা। ভাগ্যক্রমে তা কারও গায়ে লাগেনি। বিস্মিত হলাম যখন দেখলাম যিনি প্রক্টর হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন তাঁরই নিরাপত্তা নেই।
পত্রিকায় খবরটি এসেছে এভাবে, প্রশাসনকে না জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করতে এসেছিল ছাত্রলীগের বহিরাগত একটি গ্রুপ, যাদের বাধা দিতে যান প্রক্টর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। ফলে সংঘর্ষ, অর্ধশত আহত। এ ঘটনার অন্তরালেই লুকিয়ে আছে এক নিগূঢ় সত্য, যা উন্মোচিত হয়নি। আর তা হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং জন্মদিনকে ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য, যাতে ক্যাম্পাসে চলমান সব ঠিকাদারি কাজ থেকে চাঁদা নেওয়া যায়। এ জন্য তারা জন্মদিনে নিয়ে এসেছিল অস্ত্র।
আবার জানতে পারলাম, এই বহিরাগতদের মধ্যেই নাকি দুজন ছিল, যারা নারী দিবসের ঠিক এক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখলাম, সংঘর্ষের সময় বহিরাগতরা সংঘর্ষ ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর আঘাত হানছে বহিরাগত শিবির। চট্টগ্রামেও রয়েছে বহিরাগত শিবিরের আনাগোনা। এই বহিরাগতদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এদের কোনো সঠিক পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে থাকে না। ফলে এরা অপরাধ করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এভাবে জিম্মি হয়ে পড়বে এই অপরাধীদের হাতে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহিরাগতদের প্রবেশ ও বাইরের রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মো. মমতাজ-আল-শিবলী
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
titubau2009@gmail.com

দেশপ্রেম ও নৈতিকতা
শহীদ মিনারে মানুষ লম্বা লাইন দিয়েছে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সবার হাতেই ফুল। এক তরুণ পকেটমারও ফুল হাতে লাইনে দাঁড়িয়েছে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবে বলে। আর সুযোগ পেলে একজনের পকেট কেটে সটকে পড়বে।
যদি এই তরুণকে মূল্যায়ন করতে বলি, তাহলে কী বলবেন আপনারা?
কেউ খুব গালি দেবেন, কেউ বলবেন মেরে ওর হাত-পা ভেঙে দেওয়া দরকার। শহীদদের সম্মান জানাতে এসে ধান্ধা!
আরেক তরুণ সবে পড়ালেখা শেষ করে বেরিয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তান। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন, কাস্টমস, অডিট বা পুলিশে ঢুকবে। জিজ্ঞাসা করলাম, সে শুধুু এই নির্দিষ্ট ক্যাডারগুলোতেই ঢুকতে চায় কেন। সে বলল, টাকা! এই সার্ভিসগুলোতে নাকি প্রচুর টাকা আয়। মূল বেতন নাকি ব্যাংকেই পড়ে থাকবে। ‘উপরি’ আয় দিয়েই গাড়ি-বাড়ি, আরও কত সম্পত্তি হবে।
এই ছেলেটা ভীষণ হিসাবি, বাইরে এক কাপ চা-ও খায় না। তবে এই তরুণটিই একুশে ফেব্রুয়ারির দিন পুরো ৫০ টাকা খরচ করে ফুল কিনেছে ভাষাশহীদদের সম্মান জানানোর জন্য। ৫০ টাকা তার কাছে অনেক টাকা। তবু সে এটা করেছে তার দেশপ্রেম থেকে।
ধরুন বিসিএস দিয়ে সে কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি পেয়েই গেল এবং দেশমাতৃকার পকেট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মেরে সুখে দিন গুজরান করছে এবং প্রতিটি বিশেষ দিবসে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতেও ভুল করছে না। তখনকার তরুণটিকে আপনি প্রথম তরুণ পকেটমারটির মতো গালাগাল করতে পারবেন? আমরা কেউই তা পারব না। কারণ, আমাদের পরিবার-পরিজন বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজনের অনেকে দেশের পকেট মারার সুযোগ পেয়েছে এবং দেদার মেরে যাচ্ছে।
অথচ সত্যের দাবি হলো, দ্বিতীয় তরুণটিকে পকেটমারের চেয়েও বেশি গালাগালি করা বা ঘৃণা করা। কারণ, পকেটমার কাটছে একজনের পকেট আর সে মারবে কোটি কোটি লোকের পকেট। তাকে তো কয়েক কোটি গালি দেওয়া দরকার! কিন্তু আমরা তা করতে পারব না। কারণ, সে মিনারে ফুল দিয়েই তার দেশপ্রেমের বিরল নজির রেখেছে। তাহলে দেশপ্রেমের মূল্য মাত্র ৫০ টাকা! এর পরই শেষ...এরপর আর দেশ বলে কিছু থাকে না...এরপর শুধু পকেট ভরানো। দেশের হোক দশের হোক, পকেট মেরে কোটি কোটি টাকা বানাও!
আশা করি শহীদ মিনারে আমরা শুধুই ফুল নিয়ে যাব না, ভুলগুলোও শুধরে যাব।
সুমন সালেহী, মিরপুর, ঢাকা।

গ্রাহকের ভোগান্তি
অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসা করার দায়ে সরকার ১৭ মার্চ হঠাৎ ঢাকা ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। মাঝখানে এক দিনের জন্য চালু হলেও পরদিন আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবৈধভাবে কোনো ব্যবসাই চালাতে দেওয়া উচিত নয়। তারা কত দিন ধরে এটা করছিল, কী করে করতে পারছিল, সে বিষয়ে আরও আগেই সরকারের নজর দেওয়া উচিত ছিল। কেন তা করা হয়নি, সেটাও এখন একটা তদন্তের বিষয় হতে পারে। শুধু ঢাকা ফোন নয়, এ রকম আরও কয়েকটি ফোন কোম্পানি একই অভিযোগে সম্প্রতি বন্ধ করা হলো একদমই আকস্মিকভাবে। বন্ধ করার আগে কি সরকার একটু বিবেচনা করে দেখল না যে এর অনেক গ্রাহক আছে? কোনো নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ তাদের এই সেবা বন্ধ করে দেওয়া কি ঠিক হলো। তা ছাড়া কোম্পানিগুলোর কোনো অবৈধ কাজের জন্য গ্রাহকেরা তো শাস্তি পেতে পারে না। আমি ঢাকা ফোনের গ্রাহক, শুধু কথা বলা নয়, ইন্টারনেটও ব্যবহার করতাম। হঠাৎ কোম্পানিটি বন্ধ করে দেওয়ায় ভীষণ অসুবিধায় পড়েছি। নিশ্চয়ই অনেক মানুষেরই এই অসুবিধা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না করে তাদের কি জরিমানা করা যেত না? আর বন্ধই যদি করতে হয়, তবে তার আগে কি নোটিশ দেওয়া যেত না?
এই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলছে। কিন্তু এভাবে জনমানুষের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে অসুবিধা সৃষ্টি হলে কি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া যাবে?
যে ব্যবসা অবৈধভাবে করা যায়, তা নিশ্চয়ই বৈধভাবে করার সুযোগ আছে? ঢাকা ফোনসহ যে প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসা করার অভিযোগে বন্ধ করা হয়েছে, তারা যাতে বৈধভাবে তা করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি সেগুলো আবার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।
ফাহিম আহমেদ, ঢাকা কলেজ।

জনপ্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা
জানতে পারলাম, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মেম্বার-চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের জন্য কঠোর আচরণবিধি তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন। আমার মনে হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার/চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য যোগ্যতা নিয়ে একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। প্রশ্নটি হলো, শিক্ষা। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন ২০২১’-এর লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভূমিকা অনেক। সে ক্ষেত্রে এসব প্রার্থীর জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত। প্রায় সময় দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে মেম্বার-চেয়ারম্যানরাই আগে থাকেন। তাঁদের শিক্ষা না থাকলে একজন অশিক্ষিত লোক কীভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/গ্রাম্য মজলিস পরিচালনা করবেন। শুনেছিলাম, মেম্বার পদপ্রার্থীকে এইচএসসি পাস এবং চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে বিএ/স্নাতক বা তার সমতুল্য হতে হবে। আমি নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব, ইউপি নির্বাচনী আচরণবিধির মধ্যে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে। এবং তা যেন স্নাতক পাসের নিচে না হয়। তা ছাড়া বেকার, অসচ্ছল বা অভাবী লোকদের বদলে মোটামুটি সচ্ছল কর্মজীবী শিক্ষিত লোকদের প্রার্থিতায় অগ্রাধিকার থাকলে ভালো হয়। আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মেম্বার-চেয়ারম্যান বেকার, অশিক্ষিত, অভাবী। ফলে তাঁরা মেম্বার-চেয়ারম্যান হওয়াকে নিজের ভাগ্যোন্নয়নের উপায় হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। আগামী ইউপি নির্বাচনে শিক্ষিত, কর্মজীবী মেম্বার-চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে শিক্ষিত, পরিমার্জিত ও একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থা কামনা করছি।
সবুজ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

শিক্ষকের খুনিদের শাস্তি চাই
২২ মার্চের প্রথম আলো হাতে তুলে নিতেই চোখ পড়ল ‘সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক খুন’। লেখাটি পড়ে খুনিদের প্রতি মনে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হলো। পরদিন জানতে পারলাম, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনার প্রতিবাদ করায় বখাটেরা সুপরিকল্পিতভাবে ওই শিক্ষককে খুন করেছে।
তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু স্যারের মেয়েকে বলব, ‘বোন, মাকে কখনো ভুলেও কষ্ট দেবেন না। এটি আপনার কাছে আমার অনুরোধ। আপনি নিজেকে এবং আপনার ভাইটিকে স্যারের নীতিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’
শিক্ষকের এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ও দ্রুত বিচারের দাবি জানাচ্ছি। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো বখাটে এমন অপরাধ করার সাহস না পায়।
প্রীতি রাহা, ময়মনসিংহ।

আইলা-দুর্গতরা অবহেলিত কেন?
ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলে বিপর্যস্ত সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালী জেলার মানুষের দুর্ভোগ এতটুকু কমেনি। হাজার হাজার মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। খাদ্যের অভাব, খাওয়ার পানিও বেশ দুর্লভ। পরনে কাপড় নেই, আয়-রোজগার নেই, অসুখবিসুখে চিকিৎসা নেই। অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের যেন কোনো সীমা নেই।
আইলায় ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে ৫০ লাখ মানুষ। নষ্ট হয়েছে তিন লাখ ২৩ হাজার একর জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭০ শতাংশ চিংড়ির ঘের। আইলার সময় যে লোনা পানি ঢুকেছে, তা আর বেরোয়নি। ফলে ফসলি জমিগুলো আজও চাষের অনুপযোগী। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো এখনো পুরোপুরি মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। গত ১০ মাসে ৬৮৪ কিলোমিটার বাঁধের মাত্র ১০০ কিলোমিটার কোনোমতে মেরামত করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের যে সামান্য অংশ মেরামত করা হয়েছে, সেখানেও চলেছে ঢের অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে জোয়ারের পানিতে ঠুনকো এই বাঁধ ভেঙেচুরে প্রতিদিনই জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত সেই বিপুল জলরাশির মধ্যে খাবি খাচ্ছে লাখ লাখ অসহায় মানুষ।
আইলা-দুর্গত এলাকায় এখন সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হচ্ছে, বিশুদ্ধ পানির অভাব। ১৫ মার্চ প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় প্রকাশিত ‘চাইল কেনার টাকা ভাইঙ্গে পানি কিনতি অচ্ছে’ শীর্ষক খবর থেকে সুপেয় পানির অভাবের বিষয়টি স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়। কিছু পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলেও নিচে রয়ে গেছে লবণের স্তর। ফলে বৃষ্টির পানি পুকুরে জমলেও তা কেউই ব্যবহার করতে পারছে না। দুর্যোগ-পরবর্তী এক বছরের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত না হওয়াটা খুবই দুঃখজনক বিষয়।
চারদিকে লোনা পানি থাকায় বন্দী মানুষ কোথাও বের হতে পারছে না। ফলে দুর্যোগকবলিত মানুষ ভীষণ জীবিকার সংকটে পড়ে গেছে। অন্যদিকে স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া।
বলাই বাহুল্য, আইলা-দুর্গতদের উদ্ধারকল্পে সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা—কারও ভূমিকাই সন্তোষজনক নয়। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, আইলা-দুর্গত এলাকায় সরকারি তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ১১৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা অর্থ সহয়তা দেওয়া হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এ ছাড়া দাতা সংস্থার কাছে যে পরিমাণ অর্থ সহয়তা চাওয়া হয়েছিল, তার সিকি ভাগও পাওয়া যায়নি। সিডরের বেলায় দাতা সংস্থাগুলোর উদারতা আর আইলার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা—স্বাভাবিকভাবেই মনে নানা নানা প্রশ্ন উদ্রেক করে। সেই সঙ্গে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে আইলার চেয়ে সিডরের ব্যাপকতা বেশি থাকা সত্ত্বেও আমরা সফলভাবেই সিডরকে মোকাবিলা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আইলার ক্ষেত্রে সে রকম সফলতা এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। এ ব্যর্থতা কি আইলা দুর্গতদের প্রতি চরম ‘অবহেলা’ নির্দেশ করে না? যা-ই হোক, সামনের বর্ষার আগেই আশ্রয়হীন ক্ষুধার্ত ও বিপন্ন এই দুর্গত মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। নতুবা আবারও ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চল। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগ জোরদার করা জরুরি।
রানা আব্বাস, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লিখুন, পাঠিয়ে দিন
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় প্রকাশিত সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রতিবেদন ইত্যাদি নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া/ভিন্নমত আমাদের লিখে পাঠান। সমসাময়িক অন্যান্য বিষয়েও আপনার অভিমত, চিন্তা, বিশ্লেষণ সর্বোচ্চ ৪০০ শব্দের মধ্যে লিখে
পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়:

অভিমত, সম্পাদকীয় বিভাগ, প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
ই-মেইল: obhimot@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.