কল্পকথার গল্প-লাভের বেলায় ঘণ্টা by আলী হাবিব

লেজের প্রিভিলেজ কত প্রকার ও কী কী, প্রাণিকুলে লেজধারীদেরই সেটা ভালো জানা আছে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে ছড়া তো আমরা সবাই শুনেছি, 'আয়রে পাখি লেজ ঝোলা'। লেজ না থাকলেও স্বভাবগুণে অনেকের 'ল্যাজ মোটা' হয়। প্রাণিকুলে পশু ও পাখিদের নানা আকারের লেজ দেখতে পাওয়া যায়।


পাখিদের আবার লেজ নিয়ে এক ধরনের গর্ব আছে। দেশের এক কবি তো লেজ নিয়ে একটি শিশুতোষ বইও লিখেছেন, 'লেজ দিয়ে যায় চেনা'। ব্যাপারটা সত্যি। লেজের বাহার সব দেশেরই আছে। কেউ প্রিভিলেজড, কেউ আন্ডারপ্রিভিলেজড। লেজের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় কাতারে। সেখানেও আমাদের অবস্থান একেবারে পেছনের দিকে।
যতই পেছনের দিকে থাকি না কেন, আমাদের প্রত্যাশার কিন্তু শেষ নেই। প্রত্যাশা আছে বলেই আমরা ভরসা করি। আমাদের ভরসা দেওয়া হয়। ভরসা আশ্রয় করে করে আমরা বাঁচি। আশা-ভরসা না থাকলে আমাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যেত। যাদের ভরসা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তারা নিশ্চয় মহান। আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাদের পদস্পর্শে আমরা ধন্য হই। আমাদের প্রত্যাশার পারদ তরতর করে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রাপ্তির দিকটা কি প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে পারে? সে অনেক হিসাবের ব্যাপার। হিসাবটা করার আগে শিবরাম চক্রবর্তীর একটা গল্প বলে নেওয়া যাক। গল্পের নায়ক মুক্তিপদ এক দুরন্ত কিশোর। তাদের পাড়ায় ছিল একটা শিবমন্দির। সেই শিবমন্দিরে ছিল শিব-পার্বতীর জোড়া মূর্তি। নিয়ম করে রোজ পুজো হতো সেখানে। মুক্তিপদর নজরে পড়ল একটা ঘণ্টা। ঘণ্টাটি ঝোলানো ছিল মূর্তির ওপরে। যেকোনো উপায়ে ঘণ্টাটি চাই তার। সে নিশ্চিতভাবেই জানে, চাইলে কেউ তাকে মন্দিরের ঘণ্টাটি দেবে না। ঘণ্টাটি তাকে চুরি করতে হবে। মুক্তিপদ রোজ মন্দিরের সামনে যায়, কিন্তু কোনোভাবেই মন্দিরে ঢুকতে পারে না। একদিন সুযোগ এসে গেল। দুপুরবেলা মন্দির ফাঁকা। মুক্তিপদ মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। চারদিক ভালো করে দেখে মুক্তিপদ ঢুকে গেল মন্দিরে। কিন্তু কোনোভাবেই সে ঘণ্টার নাগাল পায় না। অনেক চেষ্টা করে সে উঠে গেল মূর্তির ওপর। যেই না শিবের মাথায় পা রাখা অমনি শিবের আবির্ভাব। মুক্তিপদ তো জলজ্যান্ত ঠাকুর দেখে ভয়ে জড়োসড়ো। সে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে যাবে, অমনি শিব বললেন, 'বেটা, তোর ভক্তিতে আমি মুগ্ধ। সবাই ফুল দিয়ে আমার পুজো করে, আমার মাথায় পানি ঢালে। তুই নিজেকে আমার ওপর সমর্পণ করেছিস। আমি প্রীত হয়েছি। বল তোর কী চাই?'
শিব ঠাকুরের কথা শুনে মুক্তিপদ ভাবছে, কেমন করে সে বলে তার মনে কী ইচ্ছে ছিল। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। শিব ঠাকুর বললেন, 'একবার বলেই দেখ। তুই যা চাইবি, আমি তোকে তাই দেব। কী চাস তুই? একটা রাজপ্রাসাদ?' মুক্তিপদ বলে, 'রাজপ্রাসাদে আমার যে দরকার নেই ঠাকুর। আমাদের যে বাড়িটা আছে, সেটা বেশ বড়। ওখানে আমরা বেশ আছি। এখন রাজপ্রাসাদে উঠলে গ্রামের সবাই ভাববে এত টাকা কোত্থেকে এলো?'
'তাহলে অনেক সোনা-দানা, টাকা-পয়সা?' জানতে চাইলেন শিব ঠাকুর।
মুক্তিপদ বলে, 'ওসবেও আমার দরকার নেই ঠাকুর। ওসব নিয়ে বাড়িতে গেলে বাবা ভীষণ মারবে। তুমি যে আমাকে ওসব দিয়েছো, সেটা বিশ্বাসই করবে না।'
'তাহলে পার্বতীর মাথায় যে মুকুটটা আছে, ওটা তোকে দেব।'
মুক্তিপদ বলে, 'তারপর বাবা আমাকে ধরে বেদম পেটাক আর কী!' অনেকদিন আগে বাবার পকেট থেকে একটি টাকা সরানোর পর ধরা পড়ে যে চড়টা খেয়েছিল, সেটার কথা আজও মনে আছে তার।
ওদিকে শিব ঠাকুর ভাবছেন, একটি কিশোর ছেলে কী সৎ। ওকে কিছু একটা না দিয়ে তিনি যাবেনই না। মুক্তিপদও মুখ ফুটে কিছু চাইছে না। শিব ঠাকুর এবার বললেন, 'আমার কপালে যে চাঁদটি আছে, ওটা তবে নিয়ে যা তুই।'
মুক্তিপদ বলে, 'ওটা তো অর্ধচন্দ্র। দেবেই যখন অর্ধচন্দ্র দেবে কেন?'
বড় ঝামেলায় পড়ে গেলেন শিব ঠাকুর। ভেবেছিলেন ছেলেটিকে রাজা বানিয়ে দেবেন। অনেক ধনসম্পত্তির মালিক বানিয়ে দেবেন। ছেলেটি কিছুই নিতে চাইছে না। ছেলেটির কোনো লোভ নেই বলেই মনে হলো তাঁর। তিনি বললেন, 'কী চাই তোর ভেবে বল। ভালো করে করে ভেবে নে। কামিনী-কাঞ্চনে লোভ নেই তোর, বুঝতে পারছি। কিছুই যদি মাথায় না আসে তো ভক্তি আর মুক্তি এই দুটো দিয়ে যাই তোকে।'
মুক্তিপদ বলে, 'ও দুটো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আমার নাম মুক্তিপদ, আমার বাবার নাম ভক্তিপদ। আমার মুক্তিও দরকার নেই। ভক্তিও দরকার নেই।'
ওদিকে শিব ঠাকুর তখন মুক্তিপদকে কিছু একটা দেওয়ার জন্য আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি বললেন, 'আমাকে কেউ এভাবে পায় না। তুই পেয়েছিস। তোর ভক্তিতে আমি প্রীত হয়েছি। তোকে কিছু না দিয়ে তো আমি আবার ওই বিগ্রহের মধ্যে ঢুকতে পারছি না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। একটা কিছু চেয়ে নে। লোকজন এসে পড়লে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাাবে। তুইও ধরা পড়ে যাবি। আমিও ধরা পড়ে যাব।'
মুক্তিপদ ভেবে দেখে, তাই তো। অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। এখন সে যদি ঘণ্টাটা নিতে না পারে তাহলে তো বিপদ হয়ে যেতে পারে। লোকজন চলে এলে তো সে চোর সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারে। সাহস করে সে মনের কথাটা বলেই ফেলল। 'দিতেই যখন চাইছ ঠাকুর, তোমার মাথার ওপরের এই ঘণ্টাটা পেড়ে দাও আমাকে। কোনোভাবেই ওটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছি না। জিনিসটা আমার খুব পছন্দের।'
শিব ঠাকুর বললেন, 'মাত্র ওই ঘণ্টা!' তিনি হাত বাড়িয়ে ঘণ্টাটা পেড়ে মুক্তিপদর হাতে দিলেন। মুক্তিপদ ভক্তিভরে প্রণাম করে দৌড়ে মন্দিরের বাইরে চলে এলো। গ্রামের পথে পথে ঘণ্টা বাজিয়ে বেড়াতে লাগল সে।
আমাদের অবস্থা ওই মুক্তিপদর মতোই। আমাদের তো দেবতার অভাব নেই। সেই দেবতারা আমাদের ভক্তি নিতে মাঝেমধ্যে আমাদের দেখা দেন। কখনো আমরা সেই দেবতাদের দরবারে যাই। কখনো দেবতারা আমাদের এখানে পদধূলি দেন। আমাদের ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এই দেবতারা অনেক কিছু দেওয়ার প্রত্যাশা দেন। সেই প্রত্যাশার ঘণ্টা বাজিয়ে আমাদের দিন চলে যায়। প্রত্যাশার পারদ গিয়ে আকাশে ঠেকে। লাভের বেলায়? তবু যে বাজানোর মতো একটা ঘণ্টা আমাদের মাঝেমধ্যে জুটে যায়, সেটাই বা কম কী? হোক না ব্যাপারটা বাজে, তবু তো ঘণ্টা বাজে!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.