পানি বণ্টন-তিস্তার ঘাটেই বসে থাকব? by শেখ রোকন
ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে আমাদের অনেক ইস্যু। সব নিয়ে কি আমরা তিস্তার ঘাটে অপার হয়ে বসে থাকব? তিস্তার সাগরমুখী স্রোত হয়তো নেমে আসার জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে; সময় কিন্তু বসে থাকবে না। স্বাধীনতার পর কেবল গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছে।
আর এক নদীর পানি বণ্টনেই যদি ছয় দশক চলে যায়, বাকি ৫২টির সুরাহা হতে কত বছর লাগবে?
কে না জানে যে পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমল মিলিয়ে গত ছয় দশক ধরেই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আমরা তৎপর। কিন্তু লাভের খাতা যে খালিই পড়ে, তার সর্বশেষ নজির আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাম্প্রতিক ভারত সফর। তিনি নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোর সমাধানে গঠিত উচ্চ পর্যায়ে যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন) বৈঠকে যোগ দিতে। একই সঙ্গে তিনি সেদেশের প্রধানমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমের খবর_ টিপাইমুখ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ড. মনমোহন সিং আশ্বস্ত করেছেন যে, ভারত এককভাবে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যা প্রতিবেশী দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বনশালের সঙ্গেও 'আধ ঘণ্টারও বেশি' সময় ধরে আলোচনা করেছেন। মি. বনশাল বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তার দেশ 'অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যে পেঁৗছার' প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইতিবাচক ফলের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী (ডেইলি স্টার, ৯ মে ২০১২)।
এ আর নতুন কী? আশাবাদের কথা তো আমরা গোড়া থেকেই শুনে আসছি। বরং নিরাশার জন্ম দিলেও অন্তত নতুন কিছু ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের একদিন পর, ১০ মে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সংবাদে। উচ্চপদস্থ এক ভারতীয় কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়, বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি খুব সহসাই হচ্ছে না। সদ্য সম্পন্ন দিলি্ল সফরের সময়ই তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী অবশ্য এই খবর নাকচ করে দিয়ে বলেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তিনি এখনও আশাবাদী (ডেইলি স্টার, ১১ মে ২০১২)। পরদিন মিসর সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিবিসি বাংলার কাছে জানান, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাব্য সময় জানাতে না পারলেও তিনি অনিশ্চয়তা নিয়ে বিবিসির আগের রিপোর্টটি উপদেষ্টার মতোই নাকচ করে দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, 'তিস্তার পানি বণ্টন ও স্থল সীমান্ত চুক্তিসহ সব প্রতিশ্রুতিই ভারত রক্ষা করবে।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
আশাবাদ ভালো; কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত হলে আরও ভালো। তিস্তার পানি বণ্টন এবং ছিটমহল বিনিময়ের মতো ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধকে আমরা যতই 'অভ্যন্তরীণ' বলে বৃথা স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করি না কেন, আখেরে লাভ হয় না। বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নতুন কৌশল নির্ধারণ করলে সব দিক থেকে সুবিধা।
বাস্তবতা হচ্ছে_ আমরা পছন্দ করি বা না করি, কেবল কলকাতা নয়; দিলি্লর ক্ষমতার রাজনীতিতেও মিজ ব্যানার্জি এখন ফ্যাক্টর। নড়বড়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে টিকে থাকতে শরিকদের মন জুগিয়ে চলতেই হবে। সংবিধানের দিক থেকে ফেডারেল কাঠামোর ভারত তিস্তার পানি বণ্টনের মতো চুক্তি করতে রাজ্য সরকারের সম্মতি নিতেও বাধ্য। অন্যদিকে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন হটিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতাকে মসনদ পোক্ত করতে হলে সাধারণ ভোটারের সামনে 'রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায়' অনড় ভাবমূর্তি অটুট রাখতে হবে। সেদিক থেকে তিস্তা আকর্ষণীয় ইস্যু, সন্দেহ নেই। তিনি যথারীতি তিস্তার বণ্টনযোগ্য প্রবাহ যাচাই করতে কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। অথচ মে মাসে এসেও রা নেই। উপরন্তু ফারাক্কার ভাঙা কপাট দিয়ে বাংলাদেশে কত বেশি পানি আসছে, সে নিয়ে নয়াদিলি্লর সঙ্গে ইতিমধ্যে এক দফা কাজিয়া করেছেন মমতা। ভোটের রাজনীতির গলি-ঘুপচি যাদের জানা আছে, তাদের মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে তিস্তা ইস্যুটি তিনি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে চান। নির্বাচনী বৈতরণীর ভয় কেন্দ্রীয় সরকারেরও আছে। তারা মমতাকে চটাতে চাইবেন না, বলাই বাহুল্য।
জটিলতা আরও আছে। রাজনীতির বাইরে খোদ তিস্তার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বিশ্বের বিপন্ন আটটি নদী নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। অতি ব্যবহারের কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা ওই নদীগুলোর মধ্যে আমাদের তিস্তাও রয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, 'উন্নয়ন' প্রকল্প প্রভৃতি কারণে তিস্তার উজান অংশে যে দক্ষযজ্ঞ চলছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে তিস্তায়। পানির প্রাকৃতিক জোগান কমে যাচ্ছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। হিমবাহ চক্রে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তাহলে তিস্তার মতো নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, যদি রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক জটিলতা না-ও থাকে, সীমান্তের দুই পাশে দুটি সেচ প্রকল্প থাকায় পাহাড়ি নদীটির পানি বণ্টন সংক্রান্ত জটিলতা অবধারিত। পাহাড়ি নদীর প্রবাহে নাটকীয়তার অন্ত থাকে না। ওই অঞ্চলে কিংবা উজানে বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে এর প্রবাহ। ফলে যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা যায়, তিস্তার পানি বণ্টন দূর অস্ত!
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আশাবাদ সম্বল করে কতদিন কি বসে থাকব? ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে আমাদের অনেক ইস্যু। সব নিয়ে কি আমরা তিস্তার ঘাটে অপার হয়ে বসে থাকব? তিস্তার সাগরমুখী স্রোত হয়তো নেমে আসার জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে; সময় কিন্তু আমাদের জন্য বসে থাকবে না। স্বাধীনতার পর কেবল গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছে। আর এক নদীর পানি বণ্টনেই যদি ছয় দশক চলে যায়, বাকি ৫২টির সুরাহা হতে কত বছর লাগবে? নতুন নতুন ইস্যু আসছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। দেখা যাচ্ছে, গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগে-পরে, আমরা যখন তিস্তা নিয়ে ব্যস্ত ভারত তখন প্রায় চাপা পড়ে যাওয়া টিপাইমুখ প্রকল্পে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলেছে। আবার টিপাইমুখ নিয়ে যখন হৈচৈ, তখন যেন কবর থেকে উঠে এলো আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন, অবিলম্বে সর্বনাশা ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চীন বাঁধ দিয়ে প্রবাহ ঘুরিয়ে ফেলবে শোনা যাচ্ছে।
আশঙ্কা করা অনুচিত নয় যে, অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে সামনের দিনগুলোতে আরও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। বিশাল ভারতের জল ও জ্বালানি ক্ষুধা এড়িয়ে কোনো নদীই তার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। যত দিন যাবে পরিস্থিতি জটিল হবে। এই অবস্থায় এক তিস্তা নিয়ে বসে থাকার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর নেই।
এমনও নয় যে তিস্তা বাংলাদেশের প্রধানতম নদী। পানিপ্রবাহের পরিমাণের কথা যদি বলি, অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল ব্রহ্মপুত্রের। এই নদী দিয়ে সবচেয়ে বেশি পানি আমরা পাই। অথচ এর পানি বণ্টন নিয়েই কোনো কথা নেই। নদীটি এখনও সরাসরি বাঁধ বা ব্যারাজের ফাঁসে আটকা পড়েনি বলে? আমরা কি আরেকটি বাঁধের জন্য অপেক্ষা করব? সুরমা-কুশিয়ারাও তিস্তা থেকে অনেক বড় নদী। কিন্তু আমরা টিপাইমুখ প্রকল্প চালুর আগে দশকের পর দশক এই যৌথ প্রবাহের পানি বণ্টনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থেকেছি। এখনও আমাদের যত উদ্বেগ বাঁধ নিয়ে, পানি বণ্টন নয়। প্রবাহের প্রশ্নে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভোগাই, সিলেট অঞ্চলের মনুও কিন্তু তিস্তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু এই দুই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কথা বলছি না কেন?
ভালো হতো পানি বণ্টনে একটি অভিন্ন ফর্মুলায় পেঁৗছতে পারলে। নদীভেদে খুঁটিনাটি পরে ঠিক করে নেওয়া যেত। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতের সম্মতি জরুরি। তার আগ পর্যন্ত নদীভিত্তিক বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাগড়া দেবেন না বলে আশা করা যায়। অনেক জটিলতার আধার তিস্তাকে আপাতত রেহাই দিয়ে সেই কাজটিই আমরা শুরু করি না কেন?
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি এবং সেটা আদায়ের চেষ্টা থেকে এক চুল সরে আসার কথা বলছি না। কিন্তু ৫২ অভিন্ন নদী পাশ কাটিয়ে এক তিস্তা নিয়ে দশকের পর দশক কাটিয়ে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
কে না জানে যে পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমল মিলিয়ে গত ছয় দশক ধরেই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আমরা তৎপর। কিন্তু লাভের খাতা যে খালিই পড়ে, তার সর্বশেষ নজির আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাম্প্রতিক ভারত সফর। তিনি নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোর সমাধানে গঠিত উচ্চ পর্যায়ে যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন) বৈঠকে যোগ দিতে। একই সঙ্গে তিনি সেদেশের প্রধানমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমের খবর_ টিপাইমুখ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ড. মনমোহন সিং আশ্বস্ত করেছেন যে, ভারত এককভাবে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যা প্রতিবেশী দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বনশালের সঙ্গেও 'আধ ঘণ্টারও বেশি' সময় ধরে আলোচনা করেছেন। মি. বনশাল বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তার দেশ 'অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যে পেঁৗছার' প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইতিবাচক ফলের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী (ডেইলি স্টার, ৯ মে ২০১২)।
এ আর নতুন কী? আশাবাদের কথা তো আমরা গোড়া থেকেই শুনে আসছি। বরং নিরাশার জন্ম দিলেও অন্তত নতুন কিছু ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের একদিন পর, ১০ মে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সংবাদে। উচ্চপদস্থ এক ভারতীয় কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়, বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি খুব সহসাই হচ্ছে না। সদ্য সম্পন্ন দিলি্ল সফরের সময়ই তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী অবশ্য এই খবর নাকচ করে দিয়ে বলেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তিনি এখনও আশাবাদী (ডেইলি স্টার, ১১ মে ২০১২)। পরদিন মিসর সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিবিসি বাংলার কাছে জানান, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাব্য সময় জানাতে না পারলেও তিনি অনিশ্চয়তা নিয়ে বিবিসির আগের রিপোর্টটি উপদেষ্টার মতোই নাকচ করে দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, 'তিস্তার পানি বণ্টন ও স্থল সীমান্ত চুক্তিসহ সব প্রতিশ্রুতিই ভারত রক্ষা করবে।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
আশাবাদ ভালো; কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত হলে আরও ভালো। তিস্তার পানি বণ্টন এবং ছিটমহল বিনিময়ের মতো ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধকে আমরা যতই 'অভ্যন্তরীণ' বলে বৃথা স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করি না কেন, আখেরে লাভ হয় না। বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নতুন কৌশল নির্ধারণ করলে সব দিক থেকে সুবিধা।
বাস্তবতা হচ্ছে_ আমরা পছন্দ করি বা না করি, কেবল কলকাতা নয়; দিলি্লর ক্ষমতার রাজনীতিতেও মিজ ব্যানার্জি এখন ফ্যাক্টর। নড়বড়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে টিকে থাকতে শরিকদের মন জুগিয়ে চলতেই হবে। সংবিধানের দিক থেকে ফেডারেল কাঠামোর ভারত তিস্তার পানি বণ্টনের মতো চুক্তি করতে রাজ্য সরকারের সম্মতি নিতেও বাধ্য। অন্যদিকে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন হটিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতাকে মসনদ পোক্ত করতে হলে সাধারণ ভোটারের সামনে 'রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায়' অনড় ভাবমূর্তি অটুট রাখতে হবে। সেদিক থেকে তিস্তা আকর্ষণীয় ইস্যু, সন্দেহ নেই। তিনি যথারীতি তিস্তার বণ্টনযোগ্য প্রবাহ যাচাই করতে কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। অথচ মে মাসে এসেও রা নেই। উপরন্তু ফারাক্কার ভাঙা কপাট দিয়ে বাংলাদেশে কত বেশি পানি আসছে, সে নিয়ে নয়াদিলি্লর সঙ্গে ইতিমধ্যে এক দফা কাজিয়া করেছেন মমতা। ভোটের রাজনীতির গলি-ঘুপচি যাদের জানা আছে, তাদের মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে তিস্তা ইস্যুটি তিনি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে চান। নির্বাচনী বৈতরণীর ভয় কেন্দ্রীয় সরকারেরও আছে। তারা মমতাকে চটাতে চাইবেন না, বলাই বাহুল্য।
জটিলতা আরও আছে। রাজনীতির বাইরে খোদ তিস্তার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বিশ্বের বিপন্ন আটটি নদী নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। অতি ব্যবহারের কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা ওই নদীগুলোর মধ্যে আমাদের তিস্তাও রয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, 'উন্নয়ন' প্রকল্প প্রভৃতি কারণে তিস্তার উজান অংশে যে দক্ষযজ্ঞ চলছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে তিস্তায়। পানির প্রাকৃতিক জোগান কমে যাচ্ছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। হিমবাহ চক্রে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তাহলে তিস্তার মতো নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, যদি রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক জটিলতা না-ও থাকে, সীমান্তের দুই পাশে দুটি সেচ প্রকল্প থাকায় পাহাড়ি নদীটির পানি বণ্টন সংক্রান্ত জটিলতা অবধারিত। পাহাড়ি নদীর প্রবাহে নাটকীয়তার অন্ত থাকে না। ওই অঞ্চলে কিংবা উজানে বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে এর প্রবাহ। ফলে যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা যায়, তিস্তার পানি বণ্টন দূর অস্ত!
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আশাবাদ সম্বল করে কতদিন কি বসে থাকব? ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে আমাদের অনেক ইস্যু। সব নিয়ে কি আমরা তিস্তার ঘাটে অপার হয়ে বসে থাকব? তিস্তার সাগরমুখী স্রোত হয়তো নেমে আসার জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে; সময় কিন্তু আমাদের জন্য বসে থাকবে না। স্বাধীনতার পর কেবল গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছে। আর এক নদীর পানি বণ্টনেই যদি ছয় দশক চলে যায়, বাকি ৫২টির সুরাহা হতে কত বছর লাগবে? নতুন নতুন ইস্যু আসছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। দেখা যাচ্ছে, গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগে-পরে, আমরা যখন তিস্তা নিয়ে ব্যস্ত ভারত তখন প্রায় চাপা পড়ে যাওয়া টিপাইমুখ প্রকল্পে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলেছে। আবার টিপাইমুখ নিয়ে যখন হৈচৈ, তখন যেন কবর থেকে উঠে এলো আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন, অবিলম্বে সর্বনাশা ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চীন বাঁধ দিয়ে প্রবাহ ঘুরিয়ে ফেলবে শোনা যাচ্ছে।
আশঙ্কা করা অনুচিত নয় যে, অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে সামনের দিনগুলোতে আরও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। বিশাল ভারতের জল ও জ্বালানি ক্ষুধা এড়িয়ে কোনো নদীই তার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। যত দিন যাবে পরিস্থিতি জটিল হবে। এই অবস্থায় এক তিস্তা নিয়ে বসে থাকার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর নেই।
এমনও নয় যে তিস্তা বাংলাদেশের প্রধানতম নদী। পানিপ্রবাহের পরিমাণের কথা যদি বলি, অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল ব্রহ্মপুত্রের। এই নদী দিয়ে সবচেয়ে বেশি পানি আমরা পাই। অথচ এর পানি বণ্টন নিয়েই কোনো কথা নেই। নদীটি এখনও সরাসরি বাঁধ বা ব্যারাজের ফাঁসে আটকা পড়েনি বলে? আমরা কি আরেকটি বাঁধের জন্য অপেক্ষা করব? সুরমা-কুশিয়ারাও তিস্তা থেকে অনেক বড় নদী। কিন্তু আমরা টিপাইমুখ প্রকল্প চালুর আগে দশকের পর দশক এই যৌথ প্রবাহের পানি বণ্টনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থেকেছি। এখনও আমাদের যত উদ্বেগ বাঁধ নিয়ে, পানি বণ্টন নয়। প্রবাহের প্রশ্নে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভোগাই, সিলেট অঞ্চলের মনুও কিন্তু তিস্তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু এই দুই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কথা বলছি না কেন?
ভালো হতো পানি বণ্টনে একটি অভিন্ন ফর্মুলায় পেঁৗছতে পারলে। নদীভেদে খুঁটিনাটি পরে ঠিক করে নেওয়া যেত। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতের সম্মতি জরুরি। তার আগ পর্যন্ত নদীভিত্তিক বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাগড়া দেবেন না বলে আশা করা যায়। অনেক জটিলতার আধার তিস্তাকে আপাতত রেহাই দিয়ে সেই কাজটিই আমরা শুরু করি না কেন?
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি এবং সেটা আদায়ের চেষ্টা থেকে এক চুল সরে আসার কথা বলছি না। কিন্তু ৫২ অভিন্ন নদী পাশ কাটিয়ে এক তিস্তা নিয়ে দশকের পর দশক কাটিয়ে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments