বিশ্ব পরিবেশ দিবস-বাজেটে সবুজ ভাবনা by মাহবুবা নাসরীন
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি পরিবেশবান্ধব না হয় তবে তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া অবশ্যই সুখকর নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে উন্নত বা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের মডেলের অন্ধ অনুকরণ যে সুফল বয়ে আনতে পারে না তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি। প্রযুক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাবে না।
এ দেশের অর্থনৈতিক নীতি বা বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিবেশকে সামনে রেখে দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচি স্পষ্ট করা
বাংলাদেশে ২০১১ সালের বৃক্ষরোপণ অভিযানের মূল প্রতিপাদ্য 'দেশের বায়ু দেশের মাটি, গাছ লাগিয়ে করব খাঁটি'। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে 'বনভূমি : প্রকৃতি তোমার সেবায়'। প্রকৃতি সৃষ্টির সেবায় সততই অবারিত রেখেছে তার দ্বার। যদি বংলাদেশের কথাই ধরি তবে বলা যায়, এই ভূখণ্ডটি যে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল, এর মূল ভূমিকায় ছিল বনভূমি বা বন; এখনও যার ছিটেফোঁটা নিদর্শন রয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে। ২০০৪ সালে প্রলয়ঙ্করী সুনামির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সুন্দরবনের অবদানের কথা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এর বাইরেও বন ছিল এ দেশের নাজকু ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকার অন্যতম কৌশল। বনের গাছ, মানুষ আর অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন। অতীতের স্বরে কথা বলছি এ জন্য যে, নজিরবিহীন বন বিনাশ, বিদেশি প্রজাতি দিয়ে কৃত্রিম বনায়ন, বনকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি_ এসব নানা কারণে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। বৃক্ষরোপণ অভিযান, পরিবেশবাদী ও দুর্যোগ নিরসনের সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে তবুও বাংলাদেশের কিছুটা সবুজ অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আমরা মানবসমাজ নিয়ে যতটা আলোচনা করি, 'প্রাকৃতিক সমাজ' নিয়ে ততটা করি না। এখনও যেন বিশ্বাস করি, মানুষের জন্যই প্রকৃতি। মানুষ আর অন্যান্য প্রজাতির মিলিত উপস্থিতিই যে প্রতিবেশ ও পরিবেশের উপজীব্য তা আমরা ভুলে যাই।
বনশূন্যতার বিরূপ প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমাজবৈজ্ঞানিক আদিকল্পগুলো ধ্রুপদী চিন্তাবিদদের ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে বনশূন্যতার ক্ষতিকর দিকটি চিন্তা করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি যে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে বনের স্বাভাবিক প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে, বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে চিরতরে। এতে করে যে জীববৈচিত্র্য হারিয়েছে তার মূল্য দেওয়া একটি স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। দেশের সব অঞ্চলের বনশূন্যতার পরিবেশগত মূল্যও এক নয়। যেমন_ উঁচু অববাহিকা অঞ্চলে বনশূন্যতা হলে ভূমিধস হয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়ায়। আর বাংলাদেশের কৃষিজীবী, মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনভূমি ধ্বংসের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিরূপ প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বনকে ঘিরে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন, তাদের যে লোকায়ত জ্ঞান_ বনশূন্যতার কারণে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনশূন্যতা গ্রামীণ নারীকে বাধ্য করে দূরদূরান্ত থেকে শুকনো ডাল-পাতা, ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে অথবা জ্বালানি, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংকটে ভুগতে।
বর্তমানে যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সারাবিশ্ব সোচ্চার, এর মূলে যে কোনো কারণের চেয়ে বনশূন্যতার অবদান অনেক বেশি। কারণ বনই হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক।
পৃথিবীর শতকরা ৫৫ ভাগ জৈব কার্বন জমা থাকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে। বন ধ্বংসের ফলে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
বলা হয়ে থাক যে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয় তার চেয়ে বেশি হয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন ধ্বংস থেকে। এ দুই উৎস থেকে কী পরিমাণ কাবর্ন নির্গত হয় এর তুলনামূলক গবেষণা অপ্রতুল বা নেই বললেই চলে।
এ মাসেই আসছে বাংলাদেশের বাজেট, যেখানে পরিবেশবিষয়ক আলোচনা ঠাঁই পাবে বলে আশা করা যায়। তবে তা টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠি অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হবে কি-না সে বিষয়টি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, যেসব দেশে উন্নয়ন পরিমাপ করার জন্য সবচেয়ে বড় সূচক হচ্ছে জিএনপি, সেখানে পরিবেশের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হলেও তা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কারণ জিএনপিতে সব ধরনের উৎপাদন কাজকে একইভাবে দেখা হয়। জিএনপি সম্পদের ব্যবহারের তথ্য দেয় কিন্তু সেই সম্পদ নবায়ন, নাকি অনবায়নযোগ্য তা দেখে না। যেমন উদ্ভিদ বা খনিজসম্পদকে একই মাপকাঠিতে দেখে। পরিবেশদূষণকে শোধন করার জন্য যে ব্যয়ভার সেটাও পরিমাপ করছে। বন নিধন করে গড়ে উঠছে যে শিল্পটি, বাজেটে তাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ টেকসই ও অটেকসই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোকে একইভাবে পরিমাপ করে বাজেট প্রণীত হলে তা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
বাজেট প্রণয়নের সময় মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষার হার, গড় আয়ু, উৎপাদনের গড় সূচকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি ভৌগোলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে যে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবধান রয়েছে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি এখনও পর্যন্ত কৃষি, যা বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশগত অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের দ্বারা। বাজেটে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, তা না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত পার্থক্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
পরিবেশের আলোচনায় ক্ষুদ্র একটি কোষ থেকে সমগ্র বিশ্বই অন্তর্ভুক্ত। সমাজের উৎপাদন ও ভোগ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে যোগাযোগ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা ১০.১০ ভাগ বা তারও কম বনভূমি রয়েছে। তাই এই অবশিষ্ট বনাঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় অঞ্চলভিত্তিক ও জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হলে বাজেটে এর সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ যতই আড়ম্বরপূর্ণভাবে করা হোক, এ কথা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, বৃক্ষরোপণ বা সামাজিক বনায়ন কখনোই প্রাকৃতিক বনের সমকক্ষ হতে পারে না। তাই বনশূন্যতা রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি পরিবেশবান্ধব না হয় তবে তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া অবশ্যই সুখকর নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে উন্নত বা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের মডেলের অন্ধ অনুকরণ যে সুফল বয়ে আনতে পারে না তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি। প্রযুক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাবে না। এ দেশের অর্থনৈতিক নীতি বা বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিবেশকে সামনে রেখে দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচি স্পষ্ট করা। পরিবেশকে উন্নয়নের ইস্যু থেকে পৃথক করে দেখার প্রবণতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাজেট কার্যকর ফল আনবে না। সম্পদ যেভাবে ক্ষমতা কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাতে করে সম্পদে সব প্রজাতির অধিকার নিশ্চিত করা, উৎপাদন ও ভোগের বিষয়গুলোর মধ্যকার অসামঞ্জস্য দূর করার পরিকল্পনা বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে। তবেই তা হবে সবুজ, প্রাকৃতিক ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির বাজেট।
মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সমন্বয়ক, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mahbubamirza@gmail.com
বাংলাদেশে ২০১১ সালের বৃক্ষরোপণ অভিযানের মূল প্রতিপাদ্য 'দেশের বায়ু দেশের মাটি, গাছ লাগিয়ে করব খাঁটি'। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে 'বনভূমি : প্রকৃতি তোমার সেবায়'। প্রকৃতি সৃষ্টির সেবায় সততই অবারিত রেখেছে তার দ্বার। যদি বংলাদেশের কথাই ধরি তবে বলা যায়, এই ভূখণ্ডটি যে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল, এর মূল ভূমিকায় ছিল বনভূমি বা বন; এখনও যার ছিটেফোঁটা নিদর্শন রয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে। ২০০৪ সালে প্রলয়ঙ্করী সুনামির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সুন্দরবনের অবদানের কথা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এর বাইরেও বন ছিল এ দেশের নাজকু ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকার অন্যতম কৌশল। বনের গাছ, মানুষ আর অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন। অতীতের স্বরে কথা বলছি এ জন্য যে, নজিরবিহীন বন বিনাশ, বিদেশি প্রজাতি দিয়ে কৃত্রিম বনায়ন, বনকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি_ এসব নানা কারণে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। বৃক্ষরোপণ অভিযান, পরিবেশবাদী ও দুর্যোগ নিরসনের সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে তবুও বাংলাদেশের কিছুটা সবুজ অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আমরা মানবসমাজ নিয়ে যতটা আলোচনা করি, 'প্রাকৃতিক সমাজ' নিয়ে ততটা করি না। এখনও যেন বিশ্বাস করি, মানুষের জন্যই প্রকৃতি। মানুষ আর অন্যান্য প্রজাতির মিলিত উপস্থিতিই যে প্রতিবেশ ও পরিবেশের উপজীব্য তা আমরা ভুলে যাই।
বনশূন্যতার বিরূপ প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমাজবৈজ্ঞানিক আদিকল্পগুলো ধ্রুপদী চিন্তাবিদদের ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়েছে বনশূন্যতার ক্ষতিকর দিকটি চিন্তা করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি যে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে বনের স্বাভাবিক প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে, বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে চিরতরে। এতে করে যে জীববৈচিত্র্য হারিয়েছে তার মূল্য দেওয়া একটি স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। দেশের সব অঞ্চলের বনশূন্যতার পরিবেশগত মূল্যও এক নয়। যেমন_ উঁচু অববাহিকা অঞ্চলে বনশূন্যতা হলে ভূমিধস হয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়ায়। আর বাংলাদেশের কৃষিজীবী, মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনভূমি ধ্বংসের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিরূপ প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বনকে ঘিরে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন, তাদের যে লোকায়ত জ্ঞান_ বনশূন্যতার কারণে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনশূন্যতা গ্রামীণ নারীকে বাধ্য করে দূরদূরান্ত থেকে শুকনো ডাল-পাতা, ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে অথবা জ্বালানি, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংকটে ভুগতে।
বর্তমানে যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সারাবিশ্ব সোচ্চার, এর মূলে যে কোনো কারণের চেয়ে বনশূন্যতার অবদান অনেক বেশি। কারণ বনই হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক।
পৃথিবীর শতকরা ৫৫ ভাগ জৈব কার্বন জমা থাকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে। বন ধ্বংসের ফলে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
বলা হয়ে থাক যে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয় তার চেয়ে বেশি হয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন ধ্বংস থেকে। এ দুই উৎস থেকে কী পরিমাণ কাবর্ন নির্গত হয় এর তুলনামূলক গবেষণা অপ্রতুল বা নেই বললেই চলে।
এ মাসেই আসছে বাংলাদেশের বাজেট, যেখানে পরিবেশবিষয়ক আলোচনা ঠাঁই পাবে বলে আশা করা যায়। তবে তা টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠি অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হবে কি-না সে বিষয়টি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, যেসব দেশে উন্নয়ন পরিমাপ করার জন্য সবচেয়ে বড় সূচক হচ্ছে জিএনপি, সেখানে পরিবেশের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হলেও তা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কারণ জিএনপিতে সব ধরনের উৎপাদন কাজকে একইভাবে দেখা হয়। জিএনপি সম্পদের ব্যবহারের তথ্য দেয় কিন্তু সেই সম্পদ নবায়ন, নাকি অনবায়নযোগ্য তা দেখে না। যেমন উদ্ভিদ বা খনিজসম্পদকে একই মাপকাঠিতে দেখে। পরিবেশদূষণকে শোধন করার জন্য যে ব্যয়ভার সেটাও পরিমাপ করছে। বন নিধন করে গড়ে উঠছে যে শিল্পটি, বাজেটে তাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ টেকসই ও অটেকসই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোকে একইভাবে পরিমাপ করে বাজেট প্রণীত হলে তা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
বাজেট প্রণয়নের সময় মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষার হার, গড় আয়ু, উৎপাদনের গড় সূচকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি ভৌগোলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে যে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবধান রয়েছে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি এখনও পর্যন্ত কৃষি, যা বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশগত অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের দ্বারা। বাজেটে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, তা না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশগত পার্থক্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
পরিবেশের আলোচনায় ক্ষুদ্র একটি কোষ থেকে সমগ্র বিশ্বই অন্তর্ভুক্ত। সমাজের উৎপাদন ও ভোগ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে যোগাযোগ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা ১০.১০ ভাগ বা তারও কম বনভূমি রয়েছে। তাই এই অবশিষ্ট বনাঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় অঞ্চলভিত্তিক ও জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হলে বাজেটে এর সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ যতই আড়ম্বরপূর্ণভাবে করা হোক, এ কথা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, বৃক্ষরোপণ বা সামাজিক বনায়ন কখনোই প্রাকৃতিক বনের সমকক্ষ হতে পারে না। তাই বনশূন্যতা রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি পরিবেশবান্ধব না হয় তবে তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া অবশ্যই সুখকর নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে উন্নত বা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের মডেলের অন্ধ অনুকরণ যে সুফল বয়ে আনতে পারে না তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি। প্রযুক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাবে না। এ দেশের অর্থনৈতিক নীতি বা বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিবেশকে সামনে রেখে দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচি স্পষ্ট করা। পরিবেশকে উন্নয়নের ইস্যু থেকে পৃথক করে দেখার প্রবণতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাজেট কার্যকর ফল আনবে না। সম্পদ যেভাবে ক্ষমতা কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাতে করে সম্পদে সব প্রজাতির অধিকার নিশ্চিত করা, উৎপাদন ও ভোগের বিষয়গুলোর মধ্যকার অসামঞ্জস্য দূর করার পরিকল্পনা বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে। তবেই তা হবে সবুজ, প্রাকৃতিক ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির বাজেট।
মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সমন্বয়ক, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mahbubamirza@gmail.com
No comments