ধর্ষণ প্রতিরোধ ও নির্মূলে করণীয় by মিল্টন বিশ্বাস
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কাজের মেয়ে ধর্ষণের একটি ঘটনা দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। নতুন বৌ টুম্পা (কাল্পনিক নাম) স্বামীগৃহে আসার কিছুদিন পর প্রবাসী শ্রমিক দত্ত মিয়া পুনরায় আবুধাবি চলে যায়। শ্বশুরবাড়ির কাজের মেয়ে বেবির কাছ থেকে সে জানতে পারে, তার স্বামী অনেক দিন ধরে ধর্ষণ করে আসছে তাকে।
কেবল দত্ত মিয়া নয়, তার ছোট ভাই এবং টুম্পার শ্বশুরও একই অপরাধ করে এসেছে। টুম্পা তার খালাকে বিষয়টি জানালে খালা বাবাকে জানায়। বাবা ও খালা মিলে তাকে পরামর্শ দেন_স্বামী আগে এ রকম করেছে এখন তো করছে না, আর বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে এ ধরনের ঘটনা থাকে। এ জন্য মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই। সে আরো জানতে পারে, তাদের এনগেজমেন্টের পরও মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে দত্ত মিয়া। দত্ত মিয়ার ঘটনা আমাদের সমাজে গরিব নারীর অসহায়ত্বের কথা জানান দেয়। দারিদ্র্যের কারণে গৃহকর্মে নিযুক্ত কিশোরী এভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে হরহামেশাই; শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন_মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এভাবে। এর প্রতিকার কী? নারীর অসম্মতিতে যৌন মিলনে বাধ্য করাকে ধর্ষণ বলা হয়। আবার বাঁশখালীর বেবির মতো শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্মতি-অসম্মতি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা স্পষ্টত গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নিকটজনরা ধর্ষণ করছে নারীকে। গৃহকর্তা, তার ছেলে, বয়ফ্রেন্ড, স্বামী এবং আত্মীয় দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে নারী। সংখ্যাগত দিক থেকে সব ধর্ষণের ঘটনার অর্ধেকই ঘরের মধ্যে হয়ে থাকে। ধর্ষণকারীর কোনো বয়স, ধর্ম-বর্ণ, সামাজিক মর্যাদা নেই; সে পথে, গাড়িতে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পার্কে সর্বত্রই ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেবল নারী নয়, পুরুষও পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছে।
ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু অপকথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলে থাকে, রেপ হচ্ছে আবেগজনিত বিকার বা ক্রিয়া। নারীরা গোপনে রেপড হতে চায়। নারী পোশাকে ও আচরণে রেপকে আহ্বান করে। রেপ অন্ধকার ও নির্জন এলাকায় সংঘটিত হয়। ধর্ষণকারী ধর্ষণের জন্য খুঁজে বেড়ায় প্রার্থিতজনকে। কেবল অল্প বয়সী ও রূপসীরা রেপড হয়। প্রকৃতভাবে রেপ আবেগের বিষয় নয়, এটি নারীর প্রতি সহিংস শত্রুতা। বাঞ্ছিত যৌন আচরণ থেকে রেপ আলাদা, কারণ এটি যৌন নিপীড়ন। আগেই বলা হয়েছে, পঞ্চাশ শতাংশ রেপ গৃহে হয়ে থাকে। এ জন্য নির্জন স্থানে ও অন্ধকারে রেপ হয় এটা সত্য নয়। অধিকাংশ রেপ দিনের আলোতে হয়। বেশির ভাগ ধর্ষণকারী ধর্ষিতার পূর্বপরিচিত। অধিকাংশ ধর্ষণকারী সশস্ত্র নয়। এদের অনেকেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপরাধ করে। দেশব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে এক জন ধর্ষিতা বিষয়টি পুলিশে রিপোর্ট করেন। ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি ধর্ষিতার আর্থসামাজিক মর্যাদা, বয়স ও রূপের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে সহায়তা দিতে হবে। তার ভোগান্তিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কালের কণ্ঠে গত ১২ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি অনেকগুলো ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের বস্তিতে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও আছে। দেশের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনার ব্যাপকতা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, গ্রাম এবং নগরের নারী ও শিশুদের সচেতনতার অভাবে ধর্ষণের সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দারিদ্র্য ও বিনোদনের অভাব একে অপরের পিঠে ভর করে ধর্ষণের প্রকোপ বৃদ্ধি করছে। কিছুদিন আগে যৌন হয়রানির ওপর 'কালের কণ্ঠে' বিশিষ্টজনদের মতামত প্রকাশিত হওয়ায় সমাজে এর সদর্থক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এ ধরনের উদ্যোগ সমাজে কম। বেকার সমস্যার সমাধান এবং গৃহে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও অফিসে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা না চালানো ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক ব্যর্থতাও। তরুণ সমাজের যে বিরাট অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আচরণ ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও ধর্ষণকারীকে উৎসাহী করছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ধর্ষিতার ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও অপরাধীকে শাস্তি দিতে না পারার ব্যর্থতা এ ধরনের তৎপরতা বৃদ্ধির আরো একটি কারণ। তবে বাংলাদেশ সরকারের নারী নেতৃত্বের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ধর্ষণকারীর জন্য একটি সতর্কবার্তা। সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি আমাদের সামনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীকে সতর্ক থাকতে হবে। ধর্ষণ প্রতিরোধ এবং নির্মূলে করণীয় সম্পর্কে আমাদের অভিমতগুলো নিম্নরূপ। আপনি যখন ঘরে থাকবেন, তখন বাসার দরজা-জানালা ও লক ভালো করে বন্ধ রাখুন। টেলিফোন বুকে আপনার ছোট একটি নাম ছাড়া ঠিকানা দেবেন না। দরজায় আই-ভিউয়ার লাগান। দরজা খোলার আগে জেনে নেবেন কে আছে দরজার বাইরে। আপনার সন্তান ও বাসার অন্যদের দরজা ও টেলিফোন সম্পর্কে সতর্ক করুন। পরিচয় ছাড়া টেলিফোনে নির্বিঘ্নে প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। গৃহের কাজে আসা প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে কাজে নিযুক্ত করুন। এসব ক্ষেত্রে বাইরের কেউ কাজে এলে বিশ্বস্ত পুরুষ কাউকে রাখুন। ঘরের বাইরে বের হলে আলোকিত ও ভালো রাস্তা ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গীসহ হাঁটতে হবে। জনগণের ভেতর দিয়ে চলাচল করা নিরাপদ। গন্তব্যে পেঁৗছানোর জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। প্রতিবেশীদের চিনে রাখতে হবে। পাশের ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বন-জঙ্গল ও নীরব এলাকা পরিহার করে চলতে হবে। চলাচলে সুবিধা হয় এ রকম পোশাক পরতে হবে। সম্ভব হলে হাতব্যাগ বহন না করাই ভালো। নিজের বোঝা বাড়ে এ রকম জিনিসপত্র না নিয়ে চলা নিরাপদ। কাউকে পরোয়া না করে চারদিকে নজর রেখে চলতে হবে। যদি মনে হয় আপনাকে কেউ অনুসরণ করছে, তাহলে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে নিকটস্থ শপিং অথবা উন্মুক্ত স্থানের হকারদের সামনে চলে যাবেন। নারী হিসেবে আপনি গাড়ি ড্রাইভ করলে গাড়ির চাবি সর্বদা নিজের কাছে রাখুন। গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রেখেই গাড়ি থেকে বের হন। গাড়িতে প্রবেশের সময় এটির পেছনের সিট ও নিচের দিক দেখে নেন। পার্ক করুন আলোকিত ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার পার্কিং স্পটে। পার্কিং এলাকা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। অপরাধীরা গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে।
সামাজিক প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন ও অপরিচিত মানুষের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নতুন কেউ পরিচিত হলে প্রয়োজনে ফোন নম্বর দিতে পারেন, ঠিকানা দেবেন না। নতুন কারো সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গেলে সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন। নিজের গাড়ি থাকলে তা ব্যবহার করুন এবং ক্লাব কিংবা রেস্টুরেন্টে বসুন। হিতাহিত জ্ঞান বজায় রাখার জন্য মদপান পরিহার করুন। নির্জন লিফটে অপরিচিত পুরুষ আপনাকে আক্রমণ করতে পারে_এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন। আত্মরক্ষার বিবিধ বিষয় আছে, তবে সশস্ত্র ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ষার জন্য অন্য পন্থা গ্রহণ করতে হবে। ধর্ষিতা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়ে জখম হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বলতে পারেন, আপনি গর্ভবতী, মাসিক চলছে, সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার হাত থেকে পালানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে পারেন। বমির উপক্রম, টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন জানাতে পারেন। তবে পরিস্থিতি ভেদে এ ধরনের কাজের প্রচেষ্টা কার্যকর নাও হতে পারে, সে ক্ষেত্রে সক্রিয় আত্মরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই নিজের ওপর আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আপনি পারবেন_এ ধরনের মনোবল রাখতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি উপযোগী থাকলেই কেবল আক্রান্তকারীকে প্রতিহত করা সম্ভব। তা না হলে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ শ্রেয়। একটি বাঁশি আপনাকে রক্ষা করতে পারে। তবে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে কিংবা ভীত হলে এটা কাজে নাও লাগতে পারে। তীব্র শব্দযুক্ত অ্যালার্ম বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। সুচালো লাঠি রাখা যেতে পারে। এগুলো এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেন সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়।
শিশুরা অপরিচিতের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। অপরিচিতের দেওয়া কিছু গ্রহণ করবে না। বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন দ্বারা কোনো উপদ্রবের শিকার হলে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহী করতে হবে। শিশুরা স্কুলে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নিরাপদ পথ ব্যবহার করবে। নির্জন এলাকা বর্জন করবে। উঠতি বয়সীরা গৃহকর্মে নিযুক্ত হবে গৃহকর্তা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিয়ে। কাজের মেয়ে-সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানাতে হবে। তবে শিশুদের মা-বাবাও নিজেদের কন্যাশিশুর বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে যেকোনো ঘটনা সামাল দেওয়ার জন্য। দেশে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' আছে। সে আইনের সহায়তা ছাড়াও নারী-শিশুকে সতর্ক থাকার জন্য ওপরের বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হলো। তবে এ কথা সত্য যে পুরুষরা পারে ধর্ষণ বন্ধ করতে। নারীদের বিরুদ্ধে উগ্র ও হিংস্রতামুক্ত সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলতে পারলে যৌন নিপীড়ন বন্ধ হতে পারে। পুরুষত্ব বিষয়ে সচেতন করতে হবে পুরুষকে। তাদের শক্তিকে নারীর বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে লিডারশিপ ট্রেনিং দিয়ে পুরুষের সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
dr.miltonbis@yahoo.com
ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু অপকথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলে থাকে, রেপ হচ্ছে আবেগজনিত বিকার বা ক্রিয়া। নারীরা গোপনে রেপড হতে চায়। নারী পোশাকে ও আচরণে রেপকে আহ্বান করে। রেপ অন্ধকার ও নির্জন এলাকায় সংঘটিত হয়। ধর্ষণকারী ধর্ষণের জন্য খুঁজে বেড়ায় প্রার্থিতজনকে। কেবল অল্প বয়সী ও রূপসীরা রেপড হয়। প্রকৃতভাবে রেপ আবেগের বিষয় নয়, এটি নারীর প্রতি সহিংস শত্রুতা। বাঞ্ছিত যৌন আচরণ থেকে রেপ আলাদা, কারণ এটি যৌন নিপীড়ন। আগেই বলা হয়েছে, পঞ্চাশ শতাংশ রেপ গৃহে হয়ে থাকে। এ জন্য নির্জন স্থানে ও অন্ধকারে রেপ হয় এটা সত্য নয়। অধিকাংশ রেপ দিনের আলোতে হয়। বেশির ভাগ ধর্ষণকারী ধর্ষিতার পূর্বপরিচিত। অধিকাংশ ধর্ষণকারী সশস্ত্র নয়। এদের অনেকেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপরাধ করে। দেশব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে এক জন ধর্ষিতা বিষয়টি পুলিশে রিপোর্ট করেন। ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি ধর্ষিতার আর্থসামাজিক মর্যাদা, বয়স ও রূপের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে সহায়তা দিতে হবে। তার ভোগান্তিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কালের কণ্ঠে গত ১২ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি অনেকগুলো ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের বস্তিতে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও আছে। দেশের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনার ব্যাপকতা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, গ্রাম এবং নগরের নারী ও শিশুদের সচেতনতার অভাবে ধর্ষণের সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দারিদ্র্য ও বিনোদনের অভাব একে অপরের পিঠে ভর করে ধর্ষণের প্রকোপ বৃদ্ধি করছে। কিছুদিন আগে যৌন হয়রানির ওপর 'কালের কণ্ঠে' বিশিষ্টজনদের মতামত প্রকাশিত হওয়ায় সমাজে এর সদর্থক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এ ধরনের উদ্যোগ সমাজে কম। বেকার সমস্যার সমাধান এবং গৃহে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও অফিসে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা না চালানো ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক ব্যর্থতাও। তরুণ সমাজের যে বিরাট অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আচরণ ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও ধর্ষণকারীকে উৎসাহী করছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ধর্ষিতার ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও অপরাধীকে শাস্তি দিতে না পারার ব্যর্থতা এ ধরনের তৎপরতা বৃদ্ধির আরো একটি কারণ। তবে বাংলাদেশ সরকারের নারী নেতৃত্বের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ধর্ষণকারীর জন্য একটি সতর্কবার্তা। সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি আমাদের সামনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীকে সতর্ক থাকতে হবে। ধর্ষণ প্রতিরোধ এবং নির্মূলে করণীয় সম্পর্কে আমাদের অভিমতগুলো নিম্নরূপ। আপনি যখন ঘরে থাকবেন, তখন বাসার দরজা-জানালা ও লক ভালো করে বন্ধ রাখুন। টেলিফোন বুকে আপনার ছোট একটি নাম ছাড়া ঠিকানা দেবেন না। দরজায় আই-ভিউয়ার লাগান। দরজা খোলার আগে জেনে নেবেন কে আছে দরজার বাইরে। আপনার সন্তান ও বাসার অন্যদের দরজা ও টেলিফোন সম্পর্কে সতর্ক করুন। পরিচয় ছাড়া টেলিফোনে নির্বিঘ্নে প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। গৃহের কাজে আসা প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে কাজে নিযুক্ত করুন। এসব ক্ষেত্রে বাইরের কেউ কাজে এলে বিশ্বস্ত পুরুষ কাউকে রাখুন। ঘরের বাইরে বের হলে আলোকিত ও ভালো রাস্তা ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গীসহ হাঁটতে হবে। জনগণের ভেতর দিয়ে চলাচল করা নিরাপদ। গন্তব্যে পেঁৗছানোর জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। প্রতিবেশীদের চিনে রাখতে হবে। পাশের ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বন-জঙ্গল ও নীরব এলাকা পরিহার করে চলতে হবে। চলাচলে সুবিধা হয় এ রকম পোশাক পরতে হবে। সম্ভব হলে হাতব্যাগ বহন না করাই ভালো। নিজের বোঝা বাড়ে এ রকম জিনিসপত্র না নিয়ে চলা নিরাপদ। কাউকে পরোয়া না করে চারদিকে নজর রেখে চলতে হবে। যদি মনে হয় আপনাকে কেউ অনুসরণ করছে, তাহলে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে নিকটস্থ শপিং অথবা উন্মুক্ত স্থানের হকারদের সামনে চলে যাবেন। নারী হিসেবে আপনি গাড়ি ড্রাইভ করলে গাড়ির চাবি সর্বদা নিজের কাছে রাখুন। গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রেখেই গাড়ি থেকে বের হন। গাড়িতে প্রবেশের সময় এটির পেছনের সিট ও নিচের দিক দেখে নেন। পার্ক করুন আলোকিত ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার পার্কিং স্পটে। পার্কিং এলাকা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। অপরাধীরা গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে।
সামাজিক প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন ও অপরিচিত মানুষের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নতুন কেউ পরিচিত হলে প্রয়োজনে ফোন নম্বর দিতে পারেন, ঠিকানা দেবেন না। নতুন কারো সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গেলে সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন। নিজের গাড়ি থাকলে তা ব্যবহার করুন এবং ক্লাব কিংবা রেস্টুরেন্টে বসুন। হিতাহিত জ্ঞান বজায় রাখার জন্য মদপান পরিহার করুন। নির্জন লিফটে অপরিচিত পুরুষ আপনাকে আক্রমণ করতে পারে_এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন। আত্মরক্ষার বিবিধ বিষয় আছে, তবে সশস্ত্র ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ষার জন্য অন্য পন্থা গ্রহণ করতে হবে। ধর্ষিতা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়ে জখম হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বলতে পারেন, আপনি গর্ভবতী, মাসিক চলছে, সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার হাত থেকে পালানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে পারেন। বমির উপক্রম, টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন জানাতে পারেন। তবে পরিস্থিতি ভেদে এ ধরনের কাজের প্রচেষ্টা কার্যকর নাও হতে পারে, সে ক্ষেত্রে সক্রিয় আত্মরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই নিজের ওপর আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আপনি পারবেন_এ ধরনের মনোবল রাখতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি উপযোগী থাকলেই কেবল আক্রান্তকারীকে প্রতিহত করা সম্ভব। তা না হলে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ শ্রেয়। একটি বাঁশি আপনাকে রক্ষা করতে পারে। তবে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে কিংবা ভীত হলে এটা কাজে নাও লাগতে পারে। তীব্র শব্দযুক্ত অ্যালার্ম বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। সুচালো লাঠি রাখা যেতে পারে। এগুলো এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেন সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়।
শিশুরা অপরিচিতের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। অপরিচিতের দেওয়া কিছু গ্রহণ করবে না। বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন দ্বারা কোনো উপদ্রবের শিকার হলে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহী করতে হবে। শিশুরা স্কুলে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নিরাপদ পথ ব্যবহার করবে। নির্জন এলাকা বর্জন করবে। উঠতি বয়সীরা গৃহকর্মে নিযুক্ত হবে গৃহকর্তা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিয়ে। কাজের মেয়ে-সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানাতে হবে। তবে শিশুদের মা-বাবাও নিজেদের কন্যাশিশুর বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে যেকোনো ঘটনা সামাল দেওয়ার জন্য। দেশে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' আছে। সে আইনের সহায়তা ছাড়াও নারী-শিশুকে সতর্ক থাকার জন্য ওপরের বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হলো। তবে এ কথা সত্য যে পুরুষরা পারে ধর্ষণ বন্ধ করতে। নারীদের বিরুদ্ধে উগ্র ও হিংস্রতামুক্ত সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলতে পারলে যৌন নিপীড়ন বন্ধ হতে পারে। পুরুষত্ব বিষয়ে সচেতন করতে হবে পুরুষকে। তাদের শক্তিকে নারীর বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে লিডারশিপ ট্রেনিং দিয়ে পুরুষের সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
dr.miltonbis@yahoo.com
No comments