গোলাম আযমকে কেউ ক্ষমা করেনি
মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর-উত্তম একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিচার শুরু হয়েছে। গোলাম আযমের বিচার হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। একাত্তরে শহীদ ৩০ লাখ মানুষের পরিবার-পরিজন ও গোটা বাঙালি জাতি এই দাবি জানিয়ে আসছিল।
কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে তাঁদের বিচার হয়নি, তা সবাই জানেন। গত দুই দশকে যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিটি জোরালো হয়। দেরিতে হলেও তাঁর বিচার শুরু হয়েছে। সুতরাং এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমাদের দাবি, অপরাধীদের বিচার হোক।
গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে একাত্তরে ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁর এই অবস্থান ছিল। আমার কথা, পাকিস্তানের পক্ষে থাকাটাই যদি যুক্তি হয়, তাহলে তিনি পাকিস্তানেই থেকে গেলে পারতেন। বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আবার বাংলাদেশে আসা কেন? বাংলাদেশে থাকাই বা কেন? গোলাম আযমের বিচার শুরু হয়েছে। আমি বলব, শুধু গোলাম আযমই নন, তাঁর ওপরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও বিচার হওয়া উচিত। আমরা বেঁচে থাকলে সেই চেষ্টাও করে যাব।
একাত্তরে সরাসরি যাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। শীর্ষ অপরাধীদের বিচার করতে হলে প্রয়োজনে জাতিসংঘেও যদি যেতে হয়, তাহলে যেতে হবে। আজকে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে যাঁরা অভিযোগ উত্থাপন করছেন, তাঁরা একপেশে ও অযৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। তাঁদের বোঝা উচিত, ওই সময় কোন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তাঁরা কি ভুলে গেছেন, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে চার লাখ বাঙালি পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল? দেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলো যুদ্ধের সময়। অন্যদিকে চার লাখ মানুষ আটকা পড়ল পাকিস্তানে। ৩০ লাখের সংখ্যাটা আরো বেড়ে যাক, এটা কি প্রত্যাশিত হতে পারে?
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন হুংকার দিয়েছিলেন, যদি পাকিস্তানিদের ছেড়ে দেওয়া না হয়, তারা তাহলে চার লাখ বাঙালির একজন একজন করে বিচার করবে। তাদের শাস্তি প্রদান করবে। বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন এই চার লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরও কথা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেসব সদস্যকে এমনিতেই ছেড়ে দেননি। পাকিস্তানি বাহিনীর অপরাধী সদস্যদের বিচারের যৌক্তিকতা পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার অঙ্গীকার করেছিল যে এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে পাকিস্তানে। আমরা কী দেখলাম। পাকিস্তান সরকার সেসব যুদ্ধাপরাধীর কোনো বিচার করেনি। সুতরাং তাদের মাফ করে দেওয়া হয়েছে- এমন কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না।
গোলাম আযমসহ যাঁদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্ম সম্পাদনের অভিযোগ আছে, তাঁদের বিচার করতেই হবে। আজকে কেউ কেউ এই বিচারকাজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অপরাধীরা এই রাজনৈতিক ধুয়া তুলে পার পেতে পারেন না। একাত্তরে মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্তদের বিচার হচ্ছে দেশীয় আইনে। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে বিচার হওয়া উচিত বলে যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাঁদের জানা উচিত, আমাদের যে আইন আছে তা আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। এমনকি আমাদের আইনটি বসনিয়া কর্তৃপক্ষ কপি করে নিয়ে তাদের দেশে প্রয়োগ করেছে। তাদের ওখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে তারা। সুতরাং আমাদের আইনটি আন্তর্জাতিকভাবেও গৃহীত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগে এক জায়গায় এই বিচার আন্তর্জাতিক আইনে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণও তো টানা যায়। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে বিচার করা হলো। তাঁকে হত্যা করা হলো। সেই কাজটি কি আন্তর্জাতিক আইনে হয়েছিল? মনে রাখা দরকার, একাত্তরে আমরা ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। গোলাম আযম বলেছেন, তাঁকে নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলে দিই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউকে ক্ষমা করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছেন, ১২ জানুয়ারি আইন হয়েছে। ৭৩টি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের বিচার শুরু হয়েছিল। এই বিচারকাজ চালানোর সময় গোলাম আযম ছিলেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সেখানে থেকে যাওয়ার কথা। পাকিস্তানে থাকা গোলাম আযমের বিচার তখন শুরু হয়নি। সুতরাং তাঁকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, এটা পুরোপুরি মিথ্যা।
গোলাম আযমের বিচারের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। তাঁর অপরাধগুলো বিশ্লেষণ হবে এবং আইন অনুযায়ী তাঁর শাস্তি হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাঁর বিচার হলে দেশের ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ও সাবেক এমপি
অনুলিখন : মোস্তফা হোসেইন
গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে একাত্তরে ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁর এই অবস্থান ছিল। আমার কথা, পাকিস্তানের পক্ষে থাকাটাই যদি যুক্তি হয়, তাহলে তিনি পাকিস্তানেই থেকে গেলে পারতেন। বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আবার বাংলাদেশে আসা কেন? বাংলাদেশে থাকাই বা কেন? গোলাম আযমের বিচার শুরু হয়েছে। আমি বলব, শুধু গোলাম আযমই নন, তাঁর ওপরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও বিচার হওয়া উচিত। আমরা বেঁচে থাকলে সেই চেষ্টাও করে যাব।
একাত্তরে সরাসরি যাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। শীর্ষ অপরাধীদের বিচার করতে হলে প্রয়োজনে জাতিসংঘেও যদি যেতে হয়, তাহলে যেতে হবে। আজকে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে যাঁরা অভিযোগ উত্থাপন করছেন, তাঁরা একপেশে ও অযৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। তাঁদের বোঝা উচিত, ওই সময় কোন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তাঁরা কি ভুলে গেছেন, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে চার লাখ বাঙালি পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল? দেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলো যুদ্ধের সময়। অন্যদিকে চার লাখ মানুষ আটকা পড়ল পাকিস্তানে। ৩০ লাখের সংখ্যাটা আরো বেড়ে যাক, এটা কি প্রত্যাশিত হতে পারে?
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন হুংকার দিয়েছিলেন, যদি পাকিস্তানিদের ছেড়ে দেওয়া না হয়, তারা তাহলে চার লাখ বাঙালির একজন একজন করে বিচার করবে। তাদের শাস্তি প্রদান করবে। বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন এই চার লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরও কথা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেসব সদস্যকে এমনিতেই ছেড়ে দেননি। পাকিস্তানি বাহিনীর অপরাধী সদস্যদের বিচারের যৌক্তিকতা পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার অঙ্গীকার করেছিল যে এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে পাকিস্তানে। আমরা কী দেখলাম। পাকিস্তান সরকার সেসব যুদ্ধাপরাধীর কোনো বিচার করেনি। সুতরাং তাদের মাফ করে দেওয়া হয়েছে- এমন কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না।
গোলাম আযমসহ যাঁদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্ম সম্পাদনের অভিযোগ আছে, তাঁদের বিচার করতেই হবে। আজকে কেউ কেউ এই বিচারকাজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অপরাধীরা এই রাজনৈতিক ধুয়া তুলে পার পেতে পারেন না। একাত্তরে মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্তদের বিচার হচ্ছে দেশীয় আইনে। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে বিচার হওয়া উচিত বলে যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাঁদের জানা উচিত, আমাদের যে আইন আছে তা আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। এমনকি আমাদের আইনটি বসনিয়া কর্তৃপক্ষ কপি করে নিয়ে তাদের দেশে প্রয়োগ করেছে। তাদের ওখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে তারা। সুতরাং আমাদের আইনটি আন্তর্জাতিকভাবেও গৃহীত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগে এক জায়গায় এই বিচার আন্তর্জাতিক আইনে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণও তো টানা যায়। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে বিচার করা হলো। তাঁকে হত্যা করা হলো। সেই কাজটি কি আন্তর্জাতিক আইনে হয়েছিল? মনে রাখা দরকার, একাত্তরে আমরা ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। গোলাম আযম বলেছেন, তাঁকে নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলে দিই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউকে ক্ষমা করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছেন, ১২ জানুয়ারি আইন হয়েছে। ৭৩টি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের বিচার শুরু হয়েছিল। এই বিচারকাজ চালানোর সময় গোলাম আযম ছিলেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সেখানে থেকে যাওয়ার কথা। পাকিস্তানে থাকা গোলাম আযমের বিচার তখন শুরু হয়নি। সুতরাং তাঁকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, এটা পুরোপুরি মিথ্যা।
গোলাম আযমের বিচারের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। তাঁর অপরাধগুলো বিশ্লেষণ হবে এবং আইন অনুযায়ী তাঁর শাস্তি হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাঁর বিচার হলে দেশের ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ও সাবেক এমপি
অনুলিখন : মোস্তফা হোসেইন
No comments