সহজিয়া কড়চা-অতিথি নারায়ণদের কথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো কোনো উপলক্ষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং তা বিশেষভাবে বিচার্য। সব উপলক্ষ নয়। কোনো দেশে বিদেশি অতিথি সফর করলেই তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি অতিথিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও সফরটি গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। সব কুটুম্ব বড় কুটুম্ব নয়। এই উপমহাদেশে অতিথিকে বলা হয় নারায়ণ।
কিন্তু সব অতিথি নারায়ণ নন—কোনো কোনো অতিথি নির্ভেজাল নারায়ণ। নারায়ণ সন্তুষ্ট থাকলে তাঁর বদৌলতে ভাগ্য খুলে যাবে। নারায়ণ নাখোশ হলে কপাল পোড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা।
ঘটনাক্রমে তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এক হপ্তার মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের আগমনের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই মিডিয়া বলতে থাকে তাঁদের সফল এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেমন আজকাল ১৫ দিন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন: অনাগত হরতালে ‘নাশকতা হবে’, ‘দূর থেকে মিছিলে গুলি হবে’, তেমনি মিডিয়ার মানুষ অতিথি আগমনের আগেই রায় দিয়ে দেন: এ সফর ‘সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য।’
শুধু সাংবাদিকদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই রিপোর্ট করেন। পেশাদার কূটনীতিক, প্রবীণ আমলা এবং টিভি চ্যানেলে প্রাত্যহিক জ্ঞানদানকারীদের মতামত ও বিশ্লেষণের মূল্য খুব বেশি। কিন্তু সাধারণ লোকজন যত নাদানই হোক, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকুক—যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের একটা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আছে। তাদের সেই মূল্যায়নের মূল্য স্বনামধন্য কলাম লেখকদের সারগর্ভ বিশ্লেষণের চেয়ে কম নয়।
তিন অতিথি কাছাকাছি সময়ে বা প্রায় একসঙ্গে এসেছেন—সেটাকেও বলা হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। আসলে তাঁদের একই হপ্তায় আসাটা পরিকল্পিত নয়—কাকতালীয়। যেকোনো কারণেই হোক একসঙ্গে ঘটে গেছে। এমন নয় যে বেগম ক্লিনটন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইসাব, চলেন আমরা এক লগে বাংলাদেশে যাই।’
জাপানি নেতা এসেছেন, তাঁরা আমাদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ প্রভৃতি বানানোর জন্য টাকা ধারকর্জ দেন। শুনেছেন সেই টাকা এধার-ওধার হয়। তাঁদের ট্যাক্সের কষ্টের টাকা। তা যে কাজের জন্য দেন, তা না করে ভাগাভাগি হলে তাঁদের কষ্ট হয়। সেই কথাটা বলতে তিনি এসেছিলেন: ও সব চলবে না। বকাঝকা খাওয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সাফল্য কম নয়!
কূটনৈতিক সাফল্য যেটুকু দেখানোর তা আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূত টোকিওতে দেখিয়ে এসেছেন। তাঁর সাফল্যের কথা জাপানি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তাদের চেয়ে ঢের বেশি জানেন সে দেশের এক বা একাধিক নারী। কী সুন্দর দেশ। কী অপরূপ চেরি ফুল। ওই অপরূপ পরিবেশে হাতের নাগালে যে যুবতীকে পাওয়া যায় তার গায়ে হাত দেওয়ার সাধ কার না হয়? ওই যে কবি বলেছেন: ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো।
লম্পট প্রকৃতির দুলাভাই নির্জন পুকুরের পাড়ে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে শালীকে হাতটা ধরে বলতে পারে, ‘তোমার বুবুর চেয়ে তুমি সুন্দর। কাছে আসো।’ ডাগর শ্যালিকা তার বাবার কাছে নালিশ নাও করতে পারে চক্ষুলজ্জায়। শুধু বোনকে সাবধান করে দেবে, ‘বুবু, তোমার জামাই কেমন জানি। চোখে চোখে রাখবা।’ কিন্তু বিদেশি যুবতীকে কোনো কূটনীতিক অশোভন প্রস্তাব দিলে তিনি নীরবে হজম করবেন না। এসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষ দেখতে চায়, দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যে দেশে খুনখারাবি, অপহরণের শাস্তি হয় না, সেখানে অর্থ আত্মসাৎ বা লুচ্চামি তো নস্যি। রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষ না, কিন্তু তারও একটি নৈতিক মান থাকতে হয়। জোট সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল জঙ্গি মৌলবাদের কারণে। এখন ভাবমূর্তি চূর্ণ হচ্ছে দুর্নীতি ও লাম্পট্যের ঘটনায়। কাঠমান্ডু থেকে টোকিও পর্যন্ত বাংলাদেশের বদনাম। টোকিওতে অনেক দিন থেকে কোনো রাষ্ট্রদূত নেই।
টোকিওর মেহমান যাওয়ার বেলায় যা বলে গেছেন, তাতে দেশের মানুষ মনে করে তাঁর না আসাই ভালো ছিল। কর্তাদের দুর্নীতির খাসলত না বদলালে তাঁরা কোনো অনুদান ও ঋণ দেবেন না। বলেছেন আগে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফয়সালা না হলে তাঁরা পদ্মা সেতুতে একটি পয়সাও দেবেন না।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বর্ষের দুই দেশের যৌথ অনুষ্ঠানমালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানিত অতিথি হয়ে। তাঁর আসার দিনক্ষণ ১৫১ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা ঠিক করে দেন, শুধু কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করেছেন আমাদের পররাষ্ট্র ও ভারতের বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তিনি যে উপলক্ষেই আসুন না কেন, তাকে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারেও কাজে লাগিয়েছেন। তিনি উপলক্ষকে কাজে লাগাবেন তাঁর দেশের স্বার্থে। বাংলাদেশের নেতারা যদি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারতেন, সেটাই হতো তাঁদের ‘কূটনৈতিক সাফল্য’।
পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলোর ভাষায়, প্রণব মুখার্জি ‘শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অন্তরঙ্গ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক যদি দুই দেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তা হলে তার মূল্য খুব বেশি। যদি বন্ধুত্বটা শুধু পারিবারিক ও ব্যক্তিপর্যায়েই গভীর থাকে, তাহলে তাতে দেশের মানুষের কিছু আসে-যায় না।
প্রণববাবু প্রাজ্ঞ মানুষ। রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানি অনেক দিন থেকে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞ। তিনি রাজনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমান দক্ষ। তাঁর খালি গায়ে মন্দিরে বসে চণ্ডীপাঠের দৃশ্য আমি মিডিয়ায় দেখেছি। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি গান্ধীজির অসহযোগের সময় থেকে কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। তাঁর পুত্রও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এসেছেন।
প্রণব মুখার্জি শুরুতে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। বহু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতের মতো একটি বৃহৎ উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তিনি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি একজন লেখকও। কংগ্রেস দলের বহু ইতিহাস আমার ঘরে রয়েছে, কিন্তু যখনই অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ইতিহাসের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় আমি তাঁর সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস দেখে থাকি। ভারতীয় অর্থনীতির বহুমাত্রিকতা জানতে তাঁর বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি প্রকাশ করতে পারেন। এ ধরনের বিদগ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার।
অকৃতজ্ঞ কেউ যেমন অতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ, তেমনি উপকারীর কোনো উপকারকে অব্যাহত বলতে থাকলে ব্যক্তিত্বহীনতার প্রকাশ ঘটে। এবং তা করলে উপকারী ও উপকৃতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় না। আমাদের নেতারা অনবরত ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কথা বলে থাকেন। সবার জানা একটি ঐতিহাসিক সত্যকে অব্যাহত বলা হীনম্মন্যতার পরিচয়। ‘শ্রী’ কথাটি ভারতের জাতীয় সম্বোধন। এবং একটি ‘শ্রী’তেই কাজ চলে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমুখ বারবার ‘শ্রীশ্রী প্রণব মুখার্জি’ বলতে থাকলে কানে ভালো শোনাল না। বাংলাদেশের কারও নামের আগে জনাব বা শ্রী কোনোটাই না বলায় কেমন খালি খালি ঠেকল। অবশ্য রামেন্দু মজুমদার জনাব সম্বোধন করেছেন।
যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রীরা ‘শ্রীশ্রী’ বললেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানপ্রধান এলাকায় ‘জনাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ সম্বোধন করা হয়েছে। ‘জনাব জওহরলাল নেহরু’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে তাঁদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। তাঁরাও অন্যদের জনাব সম্বোধন করেছেন। ড. মনমোহন সিংকেও আমাদের মন্ত্রীদের জনাব সম্বোধন করতে আমি নিজে শুনেছি। সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণটি ছিল সুলিখিত ও সংযত। আমাদের বক্তাদের মধ্যে একটা বিগলিত তোষামোদীর ভাব প্রকাশ পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ—প্রদেশ নয়। স্বকীয় সংস্কৃতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে, সে সবের সুরাহা সংক্রান্ত কোনো সুখবর জানা না গেলেও, কলকাতার সংবাদপত্র থেকে জানা গেল:
‘বরাবরই তিনি স্বল্পভোজী। বিদেশে গেলে তো আরও। কিন্তু সেই নিয়ম ভাঙতে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “শাসনে”। এত ব্যস্ততার মধ্যেও রোববার ঢাকায় নিজ হাতে পায়েস রান্না করেছিলেন পুরোনো পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য। দুই বাটি খেয়েছেন প্রণব। কিন্তু মিষ্টি খেতে তো তিনি ভালোই বাসেন। তদুপরি চার রকমের মাছ খেতে হয়েছে তাঁকে। রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চিতল মাছের বিরাট পেটি, চুনোমাছের ঝাল আর গলদা চিংড়ি। একসঙ্গে এত কী করে সামলালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী? তাঁর ভাষায়, ‘কী করব! সামনে রীতিমতো ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো হাসিনা। না খেয়ে উঠতে দিলেন না।’...রোববার রবীন্দ্রসদনে [ভুল] বক্তৃতা দিতে উঠে অন্তত দুবার প্রণববাবুকে ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন শেখ হাসিনা। ...দিল্লি থেকে আমসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে গিয়েছেন প্রণব। তাঁর হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। ওই উপহারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বিখ্যাত বিপণির শাড়িও।’
মুখার্জি মহাশয় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। সফরসূচি তৈরিতে শুধু বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকলে নিশ্চয়ই এই সাক্ষাৎ হতো না। খালেদার সঙ্গে মুখার্জির পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব না থাকলেও তাঁদের সঙ্গে জানাশোনা বহুদিনের। বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতীয় অতিথিকে বগুড়ার দই বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন কি না জানা যায়নি। এমনও হতে পারে, শেখ হাসিনার বাড়িতে অত গুরুপাক খাদ্যে অতিভোজনের পর তাঁর আর কিছু মুখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। সেটা বিবেচনা করেই বেগম জিয়া টোস্ট বিস্কুট অথবা পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ সরষে তেল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে চা দিয়ে খাতির করে থাকবেন।
তবে কি খেলেন বা পেলেন, তারচেয়ে বড় কথা তাঁরা খোলামেলা আলোচনা করেছেন মাতৃভাষায়। ভারতের নেতা বলেছেন, কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় ভারত। খালেদা বলেছেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওবাড়িতে দুই বাটি পায়েস, চিতলের পেটি, গলদা, রুই প্রভৃতি থালায় নিয়ে যে বিরক্তিকর প্রসঙ্গ ওঠেনি, এবাড়িতে সেই তিস্তা ও টিপাই নিয়ে কথা হয়েছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক খুবই চমৎকার। তবে ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তা যদি দুটি দেশের মধ্যে হতো, তা হলে এ দেশের হতভাগ্য জনগণ হতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মা একই সময় ঢাকায় ছিলেন। তাঁকে কী কী বঙ্গীয় খাদ্যে ভূরিভোজ করানো হয়েছে সে খবর আমেরিকার কাগজে বের হয়নি। বিশ্ববিধাতা কোটি কোটি বছর ছিলেন একজন। ১৯৯০ থেকে দুইজন। একজন আকাশে—আর একজন মাটিতে। মাটির বিশ্ববিধাতার নিজস্ব পাটিগণিত আছে। যাদববাবুর পাটিগণিতের সঙ্গে তাঁর পাটিগণিতের মিল নেই। তাঁর পাটিগণিতের অঙ্কের হিসাব আলাদা। তাঁর পাটিগণিত তাঁর পলিসি। তাঁদের গ্রহটির প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গায় কোন মুহূর্তে কী হচ্ছে তা তাঁদের নখদর্পণে। এবং তাঁদের স্বার্থে কী হতে হবে, তার নীলনকশা তাঁদের নোটবইয়ে টোকা আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য। কোন ভূখণ্ডের জনগণ কী চায় তা গৌণ। গৌণ বললে ঠিক হবে না, তার কোনো মূল্যই নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মা বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে, সঙ্গী হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ সেই পথটা যদি চীন, ভেনেজুয়েলা বা কিউবা পর্যন্ত হয়, তা হলে এক কথা। যদি আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়ায় তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে হয়, তা হলে অন্য কথা। বড় মার মুখের ম্লান হাসির অর্থ বাংলার মানুষ কিছুটা বোঝে।
অভাগিনী বাংলা মায়ের সামান্য ধন, কিন্তু তার কাছে বড় মা ও বড়দাদের দাবি কত? তবু বলব, অতিথি নারায়ণ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ঘটনাক্রমে তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এক হপ্তার মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের আগমনের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই মিডিয়া বলতে থাকে তাঁদের সফল এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেমন আজকাল ১৫ দিন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন: অনাগত হরতালে ‘নাশকতা হবে’, ‘দূর থেকে মিছিলে গুলি হবে’, তেমনি মিডিয়ার মানুষ অতিথি আগমনের আগেই রায় দিয়ে দেন: এ সফর ‘সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য।’
শুধু সাংবাদিকদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই রিপোর্ট করেন। পেশাদার কূটনীতিক, প্রবীণ আমলা এবং টিভি চ্যানেলে প্রাত্যহিক জ্ঞানদানকারীদের মতামত ও বিশ্লেষণের মূল্য খুব বেশি। কিন্তু সাধারণ লোকজন যত নাদানই হোক, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকুক—যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের একটা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আছে। তাদের সেই মূল্যায়নের মূল্য স্বনামধন্য কলাম লেখকদের সারগর্ভ বিশ্লেষণের চেয়ে কম নয়।
তিন অতিথি কাছাকাছি সময়ে বা প্রায় একসঙ্গে এসেছেন—সেটাকেও বলা হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। আসলে তাঁদের একই হপ্তায় আসাটা পরিকল্পিত নয়—কাকতালীয়। যেকোনো কারণেই হোক একসঙ্গে ঘটে গেছে। এমন নয় যে বেগম ক্লিনটন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইসাব, চলেন আমরা এক লগে বাংলাদেশে যাই।’
জাপানি নেতা এসেছেন, তাঁরা আমাদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ প্রভৃতি বানানোর জন্য টাকা ধারকর্জ দেন। শুনেছেন সেই টাকা এধার-ওধার হয়। তাঁদের ট্যাক্সের কষ্টের টাকা। তা যে কাজের জন্য দেন, তা না করে ভাগাভাগি হলে তাঁদের কষ্ট হয়। সেই কথাটা বলতে তিনি এসেছিলেন: ও সব চলবে না। বকাঝকা খাওয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সাফল্য কম নয়!
কূটনৈতিক সাফল্য যেটুকু দেখানোর তা আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূত টোকিওতে দেখিয়ে এসেছেন। তাঁর সাফল্যের কথা জাপানি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তাদের চেয়ে ঢের বেশি জানেন সে দেশের এক বা একাধিক নারী। কী সুন্দর দেশ। কী অপরূপ চেরি ফুল। ওই অপরূপ পরিবেশে হাতের নাগালে যে যুবতীকে পাওয়া যায় তার গায়ে হাত দেওয়ার সাধ কার না হয়? ওই যে কবি বলেছেন: ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো।
লম্পট প্রকৃতির দুলাভাই নির্জন পুকুরের পাড়ে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে শালীকে হাতটা ধরে বলতে পারে, ‘তোমার বুবুর চেয়ে তুমি সুন্দর। কাছে আসো।’ ডাগর শ্যালিকা তার বাবার কাছে নালিশ নাও করতে পারে চক্ষুলজ্জায়। শুধু বোনকে সাবধান করে দেবে, ‘বুবু, তোমার জামাই কেমন জানি। চোখে চোখে রাখবা।’ কিন্তু বিদেশি যুবতীকে কোনো কূটনীতিক অশোভন প্রস্তাব দিলে তিনি নীরবে হজম করবেন না। এসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষ দেখতে চায়, দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যে দেশে খুনখারাবি, অপহরণের শাস্তি হয় না, সেখানে অর্থ আত্মসাৎ বা লুচ্চামি তো নস্যি। রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষ না, কিন্তু তারও একটি নৈতিক মান থাকতে হয়। জোট সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল জঙ্গি মৌলবাদের কারণে। এখন ভাবমূর্তি চূর্ণ হচ্ছে দুর্নীতি ও লাম্পট্যের ঘটনায়। কাঠমান্ডু থেকে টোকিও পর্যন্ত বাংলাদেশের বদনাম। টোকিওতে অনেক দিন থেকে কোনো রাষ্ট্রদূত নেই।
টোকিওর মেহমান যাওয়ার বেলায় যা বলে গেছেন, তাতে দেশের মানুষ মনে করে তাঁর না আসাই ভালো ছিল। কর্তাদের দুর্নীতির খাসলত না বদলালে তাঁরা কোনো অনুদান ও ঋণ দেবেন না। বলেছেন আগে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফয়সালা না হলে তাঁরা পদ্মা সেতুতে একটি পয়সাও দেবেন না।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বর্ষের দুই দেশের যৌথ অনুষ্ঠানমালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানিত অতিথি হয়ে। তাঁর আসার দিনক্ষণ ১৫১ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা ঠিক করে দেন, শুধু কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করেছেন আমাদের পররাষ্ট্র ও ভারতের বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তিনি যে উপলক্ষেই আসুন না কেন, তাকে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারেও কাজে লাগিয়েছেন। তিনি উপলক্ষকে কাজে লাগাবেন তাঁর দেশের স্বার্থে। বাংলাদেশের নেতারা যদি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারতেন, সেটাই হতো তাঁদের ‘কূটনৈতিক সাফল্য’।
পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলোর ভাষায়, প্রণব মুখার্জি ‘শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অন্তরঙ্গ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক যদি দুই দেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তা হলে তার মূল্য খুব বেশি। যদি বন্ধুত্বটা শুধু পারিবারিক ও ব্যক্তিপর্যায়েই গভীর থাকে, তাহলে তাতে দেশের মানুষের কিছু আসে-যায় না।
প্রণববাবু প্রাজ্ঞ মানুষ। রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানি অনেক দিন থেকে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞ। তিনি রাজনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমান দক্ষ। তাঁর খালি গায়ে মন্দিরে বসে চণ্ডীপাঠের দৃশ্য আমি মিডিয়ায় দেখেছি। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি গান্ধীজির অসহযোগের সময় থেকে কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। তাঁর পুত্রও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এসেছেন।
প্রণব মুখার্জি শুরুতে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। বহু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতের মতো একটি বৃহৎ উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তিনি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি একজন লেখকও। কংগ্রেস দলের বহু ইতিহাস আমার ঘরে রয়েছে, কিন্তু যখনই অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ইতিহাসের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় আমি তাঁর সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস দেখে থাকি। ভারতীয় অর্থনীতির বহুমাত্রিকতা জানতে তাঁর বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি প্রকাশ করতে পারেন। এ ধরনের বিদগ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার।
অকৃতজ্ঞ কেউ যেমন অতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ, তেমনি উপকারীর কোনো উপকারকে অব্যাহত বলতে থাকলে ব্যক্তিত্বহীনতার প্রকাশ ঘটে। এবং তা করলে উপকারী ও উপকৃতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় না। আমাদের নেতারা অনবরত ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কথা বলে থাকেন। সবার জানা একটি ঐতিহাসিক সত্যকে অব্যাহত বলা হীনম্মন্যতার পরিচয়। ‘শ্রী’ কথাটি ভারতের জাতীয় সম্বোধন। এবং একটি ‘শ্রী’তেই কাজ চলে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমুখ বারবার ‘শ্রীশ্রী প্রণব মুখার্জি’ বলতে থাকলে কানে ভালো শোনাল না। বাংলাদেশের কারও নামের আগে জনাব বা শ্রী কোনোটাই না বলায় কেমন খালি খালি ঠেকল। অবশ্য রামেন্দু মজুমদার জনাব সম্বোধন করেছেন।
যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রীরা ‘শ্রীশ্রী’ বললেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানপ্রধান এলাকায় ‘জনাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ সম্বোধন করা হয়েছে। ‘জনাব জওহরলাল নেহরু’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে তাঁদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। তাঁরাও অন্যদের জনাব সম্বোধন করেছেন। ড. মনমোহন সিংকেও আমাদের মন্ত্রীদের জনাব সম্বোধন করতে আমি নিজে শুনেছি। সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণটি ছিল সুলিখিত ও সংযত। আমাদের বক্তাদের মধ্যে একটা বিগলিত তোষামোদীর ভাব প্রকাশ পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ—প্রদেশ নয়। স্বকীয় সংস্কৃতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে, সে সবের সুরাহা সংক্রান্ত কোনো সুখবর জানা না গেলেও, কলকাতার সংবাদপত্র থেকে জানা গেল:
‘বরাবরই তিনি স্বল্পভোজী। বিদেশে গেলে তো আরও। কিন্তু সেই নিয়ম ভাঙতে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “শাসনে”। এত ব্যস্ততার মধ্যেও রোববার ঢাকায় নিজ হাতে পায়েস রান্না করেছিলেন পুরোনো পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য। দুই বাটি খেয়েছেন প্রণব। কিন্তু মিষ্টি খেতে তো তিনি ভালোই বাসেন। তদুপরি চার রকমের মাছ খেতে হয়েছে তাঁকে। রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চিতল মাছের বিরাট পেটি, চুনোমাছের ঝাল আর গলদা চিংড়ি। একসঙ্গে এত কী করে সামলালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী? তাঁর ভাষায়, ‘কী করব! সামনে রীতিমতো ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো হাসিনা। না খেয়ে উঠতে দিলেন না।’...রোববার রবীন্দ্রসদনে [ভুল] বক্তৃতা দিতে উঠে অন্তত দুবার প্রণববাবুকে ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন শেখ হাসিনা। ...দিল্লি থেকে আমসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে গিয়েছেন প্রণব। তাঁর হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। ওই উপহারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বিখ্যাত বিপণির শাড়িও।’
মুখার্জি মহাশয় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। সফরসূচি তৈরিতে শুধু বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকলে নিশ্চয়ই এই সাক্ষাৎ হতো না। খালেদার সঙ্গে মুখার্জির পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব না থাকলেও তাঁদের সঙ্গে জানাশোনা বহুদিনের। বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতীয় অতিথিকে বগুড়ার দই বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন কি না জানা যায়নি। এমনও হতে পারে, শেখ হাসিনার বাড়িতে অত গুরুপাক খাদ্যে অতিভোজনের পর তাঁর আর কিছু মুখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। সেটা বিবেচনা করেই বেগম জিয়া টোস্ট বিস্কুট অথবা পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ সরষে তেল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে চা দিয়ে খাতির করে থাকবেন।
তবে কি খেলেন বা পেলেন, তারচেয়ে বড় কথা তাঁরা খোলামেলা আলোচনা করেছেন মাতৃভাষায়। ভারতের নেতা বলেছেন, কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় ভারত। খালেদা বলেছেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওবাড়িতে দুই বাটি পায়েস, চিতলের পেটি, গলদা, রুই প্রভৃতি থালায় নিয়ে যে বিরক্তিকর প্রসঙ্গ ওঠেনি, এবাড়িতে সেই তিস্তা ও টিপাই নিয়ে কথা হয়েছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক খুবই চমৎকার। তবে ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তা যদি দুটি দেশের মধ্যে হতো, তা হলে এ দেশের হতভাগ্য জনগণ হতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মা একই সময় ঢাকায় ছিলেন। তাঁকে কী কী বঙ্গীয় খাদ্যে ভূরিভোজ করানো হয়েছে সে খবর আমেরিকার কাগজে বের হয়নি। বিশ্ববিধাতা কোটি কোটি বছর ছিলেন একজন। ১৯৯০ থেকে দুইজন। একজন আকাশে—আর একজন মাটিতে। মাটির বিশ্ববিধাতার নিজস্ব পাটিগণিত আছে। যাদববাবুর পাটিগণিতের সঙ্গে তাঁর পাটিগণিতের মিল নেই। তাঁর পাটিগণিতের অঙ্কের হিসাব আলাদা। তাঁর পাটিগণিত তাঁর পলিসি। তাঁদের গ্রহটির প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গায় কোন মুহূর্তে কী হচ্ছে তা তাঁদের নখদর্পণে। এবং তাঁদের স্বার্থে কী হতে হবে, তার নীলনকশা তাঁদের নোটবইয়ে টোকা আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য। কোন ভূখণ্ডের জনগণ কী চায় তা গৌণ। গৌণ বললে ঠিক হবে না, তার কোনো মূল্যই নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মা বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে, সঙ্গী হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ সেই পথটা যদি চীন, ভেনেজুয়েলা বা কিউবা পর্যন্ত হয়, তা হলে এক কথা। যদি আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়ায় তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে হয়, তা হলে অন্য কথা। বড় মার মুখের ম্লান হাসির অর্থ বাংলার মানুষ কিছুটা বোঝে।
অভাগিনী বাংলা মায়ের সামান্য ধন, কিন্তু তার কাছে বড় মা ও বড়দাদের দাবি কত? তবু বলব, অতিথি নারায়ণ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments