সুরতহাল প্রতিবেদনে ভুল তথ্য-ময়নাতদন্তের ভাষা বোঝে না পুলিশ by কামরুল হাসান
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভাষা ঠিকমতো বোঝেন না। আবার মৃত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদনে তাঁরা তুলে ধরেন অপ্রয়োজনীয় ও ভুল তথ্য। এ কারণে তদন্তে অতিরিক্ত সময় লাগে। আবার প্রকৃত অপরাধীও শনাক্ত হয় না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির এক সমীক্ষায় হত্যা মামলার তদন্তের এ চিত্র ফুটে উঠেছে। ঢাকা অঞ্চলের ১১টি জেলার ১২০টি খুনের মামলা নিয়ে সম্প্রতি এই সমীক্ষা করা হয়। সিআইডির বিশেষ সুপার মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সমীক্ষার কাজে নেতৃত্ব দেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ সম্মেলনে সারা দেশের পুলিশ সুপারদের সামনে এটি তুলে ধরেন সিআইডির প্রধান (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) মোখলেসুর রহমান।
ঢাকা ও আশপাশের ১১টি জেলার যেসব মামলা তদন্তের জন্য সিআইডিতে এসেছে, সেগুলোর ওপরই সমীক্ষাটি করা হয়। এতে দেখা যায়, এই ১২০টি মামলা থানা থেকে সিআইডিতে আসতে সময় লেগেছে এক বছর চার মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত। নিহত ১২০ জনের মধ্যে ৩৯ জনকেই খুন করা হয়েছে শ্বাসরোধে। অন্যদের মধ্যে দেশি অস্ত্রের আঘাতে ৬৩ জন, গুলিতে আটজন, বিষ প্রয়োগে তিনজন এবং দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাতজন।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসবের মধ্যে ৩৬টি খুনের কোনো কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি সিআইডি। এগুলোর বেশির ভাগই শ্বাসরোধের মাধ্যমে খুন করা হয়েছে। শ্বাসরোধে খুন হওয়ার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন না। এতে করে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। এসব মামলা তদন্তে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলা হয়, নিহত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদন ঠিকমতো না করা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বুঝতে না পারা, লাশ শনাক্ত না হওয়া এবং বিজ্ঞানসম্মত বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহে অনাগ্রহ। এর কারণ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন লেখা হয় ইংরেজিতে। তা-ও আবার চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা অনুযায়ী।
জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ তদন্তকারীরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এটা কোনো ব্যক্তির সমস্যা নয়, দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যবস্থা চলে আসছে।
সুরতহাল প্রতিবেদন: ১২০টি মামলার সুরতহাল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, থানা-পুলিশের এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাঁরা উপস্থিত সাক্ষীদের সই নিয়েছেন, কিন্তু টিপসই নেননি। অনেক সাক্ষী পরে আদালতে এসে বলেছেন, এই সই তাঁদের নয়। আবার মৃত ব্যক্তির শরীরের জখমের চিহ্নও সঠিকভাবে সুরতহাল প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির শরীরের কোনো অংশ মাটি বা শক্ত বস্তুর ওপর লেগে থাকলে রক্ত জমাট বেঁধে লাল ও নীলের মিশ্রণে একধরনের রং ধারণ করে। একে মরণোত্তর কালশিরা বলে। তবে বিষ প্রয়োগে মৃতের ক্ষেত্রে এই রং চেরি ফুলের মতো হতে পারে। কিন্তু অনেক তদন্তকারী এটা বুঝতে না পেরে এই চিহ্নকে মৃতের শরীরের জখম হিসেবে সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শ্বাসরোধে হত্যার ক্ষেত্রে সুরতহাল প্রতিবেদন করার সময় পুলিশের কর্মকর্তারা মৃতের শরীরের চিহ্ন ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। এতে করে অনুমানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। এরপর রয়েছে মৃত্যুর সময় নির্ধারণ। মৃত্যুর আনুমানিক সময় জানা গেলে মৃত ব্যক্তি ওই সময় কোথায় ছিলেন, কে কে তাঁকে দেখেছেন, কীভাবে মারা গেছেন, তা জানা সহজ হবে। এ ছাড়া জখমের ধরন, জখমের স্থান ও ব্যবহূত অস্ত্রের ধরন দেখেও অপরাধী ও অপরাধের কারণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তদন্তের এসব দিকে কেউ দৃষ্টি দিতে চান না।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকতার। এত দিন এসব বিষয়ের দিকে কারও নজর পড়েনি। এখন বিষয়টি আলোচনায় আসার পর এ থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
উদাহরণ: প্রতিবেদনে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার একটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, এক ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট দারোগা বলেন, আসামি মজিবর মৃতের গলা টিপে ধরে। আসামি দোলোয়ারা বেগম, নাছির মাতবর, আনোয়ার হোসেন ও আলমাস গং বিভিন্ন স্থানে চেপে ধরে স্থানীয় মেম্বার ও চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে গলা টিপে হত্যা করেছে। কিন্তু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কিশোরী হেনা আক্তারকে ধর্ষণ করে তার চাচাতো ভাই মাহবুব। পরে সালিসে হেনাকে ১০০ দোররা মারা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি হেনা মারা যায়।
মৃত্যুর পর হেনার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন নড়িয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসলাম উদ্দিন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, হেনা আক্তারের সঙ্গে তার চাচাতো ভাই মাহবুবের প্রেমের সম্পর্ক ছিল।’ হেনার মৃত্যু নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত মিথ্যা, ত্রুটিপূর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন করার জন্য আসলাম উদ্দিনকে ভর্ৎসনা করেন।
সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন দিকের বর্ণনা থাকতে হয়। শরীরের কোন অঙ্গটি কীভাবে পাওয়া গেছে, কোনো আঘাত বা দাগের চিহ্ন আছে কি না প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এতে মৃতদেহের বিবরণ ছাড়া আর কিছুই লেখার নিয়ম নেই।
সিআইডির বিশেষ সুপার ও সমীক্ষার নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, এসব প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে যেমন মূল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তেমনি এ ধরনের প্রতিবেদন অনেক সময় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: সিআইডির প্রতিবেদনে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলা হয়, সমীক্ষা প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন, কোনো কর্মকর্তারই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। তাঁরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শুধু চিকিৎসকের মতামতের শেষ অংশটুকু পড়েন। শেষ অংশে ওই ব্যক্তি হত্যা না আত্মহত্যার শিকার হয়েছেন, তার উল্লেখ থাকে। কিন্তু তাঁরা শুধু মতামতের শেষ অংশটুকু নিয়েই তদন্ত শেষ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যার ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘কন্টিনিউয়াস লেগেচার মার্ক’ বলে ইংরেজি শব্দ থাকে। এর অর্থ হলো সম্পূর্ণ গলায় দড়ির দাগ। আত্মহত্যা হলে একটানা নয়, শুধু সামনে দাগ থাকার কথা। এসব দাগকে বলা হয় ‘নন-কন্টিনিউয়াস লেগেচার মার্ক’। আরেকটি শব্দ হলো, ‘এসফিক্সিয়া’ অর্থাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়ে নীলাভ বর্ণ ধারণ করা। আবার মৃতের চামড়ার নিচে রক্ত জমাট হওয়াকে বলে ‘ইকাইমোসিস’। ফুসফুসে রক্ত জমা হয়ে থাকাকে বলা হয় ‘কনজেস্টেড লাং’। আবার রড দিয়ে কাউকে আঘাত করা হলে ত্বকে যে কালচে দাগ হয়, তাকে বলা হয় ‘ব্রুইস’। আঁচড় দিলে যে দাগ হয় তা হলো ‘অ্যাব্রেশন’। ‘পার্চমেন্টাইজেশন’ লেখা থাকা গামছা অথবা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যার ইঙ্গিত বহন করে। এতে গলায় সুতার আঁশ লেগে থাকে। এটা খালি চোখে না-ও দেখা যেতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ তদন্তকারী এসব শব্দ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।
সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দই তদন্তকারী কর্মকর্তার জন্য কিছু না কিছু তথ্য দিয়ে থাকে। কিন্তু তদন্তকারীরা সেটা না বোঝার কারণে এসব তথ্য কোনো কাজে আসে না। ময়নাতদন্ত করেন এমন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কানে তুলছেন না।
প্রতিবেদনে পুলিশ প্রবিধানের ৩০৬(খ) ও ৩০৭(খ) ধারায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না বুঝলে জেলা সিভিল সার্জনের মতামত নেওয়ার নিয়ম আছে। আবার ময়নাতদন্তের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিত থাকারও নিয়ম আছে। কিন্তু এসবের চর্চা নেই।
ঢাকা ও আশপাশের ১১টি জেলার যেসব মামলা তদন্তের জন্য সিআইডিতে এসেছে, সেগুলোর ওপরই সমীক্ষাটি করা হয়। এতে দেখা যায়, এই ১২০টি মামলা থানা থেকে সিআইডিতে আসতে সময় লেগেছে এক বছর চার মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত। নিহত ১২০ জনের মধ্যে ৩৯ জনকেই খুন করা হয়েছে শ্বাসরোধে। অন্যদের মধ্যে দেশি অস্ত্রের আঘাতে ৬৩ জন, গুলিতে আটজন, বিষ প্রয়োগে তিনজন এবং দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাতজন।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসবের মধ্যে ৩৬টি খুনের কোনো কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি সিআইডি। এগুলোর বেশির ভাগই শ্বাসরোধের মাধ্যমে খুন করা হয়েছে। শ্বাসরোধে খুন হওয়ার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন না। এতে করে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। এসব মামলা তদন্তে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলা হয়, নিহত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদন ঠিকমতো না করা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বুঝতে না পারা, লাশ শনাক্ত না হওয়া এবং বিজ্ঞানসম্মত বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহে অনাগ্রহ। এর কারণ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন লেখা হয় ইংরেজিতে। তা-ও আবার চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা অনুযায়ী।
জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ তদন্তকারীরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এটা কোনো ব্যক্তির সমস্যা নয়, দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যবস্থা চলে আসছে।
সুরতহাল প্রতিবেদন: ১২০টি মামলার সুরতহাল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, থানা-পুলিশের এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাঁরা উপস্থিত সাক্ষীদের সই নিয়েছেন, কিন্তু টিপসই নেননি। অনেক সাক্ষী পরে আদালতে এসে বলেছেন, এই সই তাঁদের নয়। আবার মৃত ব্যক্তির শরীরের জখমের চিহ্নও সঠিকভাবে সুরতহাল প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির শরীরের কোনো অংশ মাটি বা শক্ত বস্তুর ওপর লেগে থাকলে রক্ত জমাট বেঁধে লাল ও নীলের মিশ্রণে একধরনের রং ধারণ করে। একে মরণোত্তর কালশিরা বলে। তবে বিষ প্রয়োগে মৃতের ক্ষেত্রে এই রং চেরি ফুলের মতো হতে পারে। কিন্তু অনেক তদন্তকারী এটা বুঝতে না পেরে এই চিহ্নকে মৃতের শরীরের জখম হিসেবে সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শ্বাসরোধে হত্যার ক্ষেত্রে সুরতহাল প্রতিবেদন করার সময় পুলিশের কর্মকর্তারা মৃতের শরীরের চিহ্ন ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। এতে করে অনুমানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। এরপর রয়েছে মৃত্যুর সময় নির্ধারণ। মৃত্যুর আনুমানিক সময় জানা গেলে মৃত ব্যক্তি ওই সময় কোথায় ছিলেন, কে কে তাঁকে দেখেছেন, কীভাবে মারা গেছেন, তা জানা সহজ হবে। এ ছাড়া জখমের ধরন, জখমের স্থান ও ব্যবহূত অস্ত্রের ধরন দেখেও অপরাধী ও অপরাধের কারণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তদন্তের এসব দিকে কেউ দৃষ্টি দিতে চান না।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকতার। এত দিন এসব বিষয়ের দিকে কারও নজর পড়েনি। এখন বিষয়টি আলোচনায় আসার পর এ থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
উদাহরণ: প্রতিবেদনে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার একটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, এক ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট দারোগা বলেন, আসামি মজিবর মৃতের গলা টিপে ধরে। আসামি দোলোয়ারা বেগম, নাছির মাতবর, আনোয়ার হোসেন ও আলমাস গং বিভিন্ন স্থানে চেপে ধরে স্থানীয় মেম্বার ও চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে গলা টিপে হত্যা করেছে। কিন্তু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কিশোরী হেনা আক্তারকে ধর্ষণ করে তার চাচাতো ভাই মাহবুব। পরে সালিসে হেনাকে ১০০ দোররা মারা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি হেনা মারা যায়।
মৃত্যুর পর হেনার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন নড়িয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসলাম উদ্দিন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, হেনা আক্তারের সঙ্গে তার চাচাতো ভাই মাহবুবের প্রেমের সম্পর্ক ছিল।’ হেনার মৃত্যু নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত মিথ্যা, ত্রুটিপূর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন করার জন্য আসলাম উদ্দিনকে ভর্ৎসনা করেন।
সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন দিকের বর্ণনা থাকতে হয়। শরীরের কোন অঙ্গটি কীভাবে পাওয়া গেছে, কোনো আঘাত বা দাগের চিহ্ন আছে কি না প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এতে মৃতদেহের বিবরণ ছাড়া আর কিছুই লেখার নিয়ম নেই।
সিআইডির বিশেষ সুপার ও সমীক্ষার নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, এসব প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে যেমন মূল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তেমনি এ ধরনের প্রতিবেদন অনেক সময় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: সিআইডির প্রতিবেদনে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলা হয়, সমীক্ষা প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন, কোনো কর্মকর্তারই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। তাঁরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শুধু চিকিৎসকের মতামতের শেষ অংশটুকু পড়েন। শেষ অংশে ওই ব্যক্তি হত্যা না আত্মহত্যার শিকার হয়েছেন, তার উল্লেখ থাকে। কিন্তু তাঁরা শুধু মতামতের শেষ অংশটুকু নিয়েই তদন্ত শেষ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যার ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘কন্টিনিউয়াস লেগেচার মার্ক’ বলে ইংরেজি শব্দ থাকে। এর অর্থ হলো সম্পূর্ণ গলায় দড়ির দাগ। আত্মহত্যা হলে একটানা নয়, শুধু সামনে দাগ থাকার কথা। এসব দাগকে বলা হয় ‘নন-কন্টিনিউয়াস লেগেচার মার্ক’। আরেকটি শব্দ হলো, ‘এসফিক্সিয়া’ অর্থাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়ে নীলাভ বর্ণ ধারণ করা। আবার মৃতের চামড়ার নিচে রক্ত জমাট হওয়াকে বলে ‘ইকাইমোসিস’। ফুসফুসে রক্ত জমা হয়ে থাকাকে বলা হয় ‘কনজেস্টেড লাং’। আবার রড দিয়ে কাউকে আঘাত করা হলে ত্বকে যে কালচে দাগ হয়, তাকে বলা হয় ‘ব্রুইস’। আঁচড় দিলে যে দাগ হয় তা হলো ‘অ্যাব্রেশন’। ‘পার্চমেন্টাইজেশন’ লেখা থাকা গামছা অথবা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যার ইঙ্গিত বহন করে। এতে গলায় সুতার আঁশ লেগে থাকে। এটা খালি চোখে না-ও দেখা যেতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ তদন্তকারী এসব শব্দ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।
সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দই তদন্তকারী কর্মকর্তার জন্য কিছু না কিছু তথ্য দিয়ে থাকে। কিন্তু তদন্তকারীরা সেটা না বোঝার কারণে এসব তথ্য কোনো কাজে আসে না। ময়নাতদন্ত করেন এমন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কানে তুলছেন না।
প্রতিবেদনে পুলিশ প্রবিধানের ৩০৬(খ) ও ৩০৭(খ) ধারায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না বুঝলে জেলা সিভিল সার্জনের মতামত নেওয়ার নিয়ম আছে। আবার ময়নাতদন্তের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিত থাকারও নিয়ম আছে। কিন্তু এসবের চর্চা নেই।
No comments