তিতাস একটি নদীর নাম-পাঁচালি নয় মহাকাব্য by হরিশংকর জলদাস

অদ্বৈত মল্লবর্মণের মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের (১ জানুয়ারি ১৯১৪-১৬ এপ্রিল ১৯৫১) জীবন। ক্ষীণ-আয়ু বলে খুব বেশিসংখ্যক সাহিত্যসৃষ্টি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি লিখেছেন তিতাস একটি নদীর নাম-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) পদ্মানদীর মাঝি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে।


অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) তিতাস একটি নদীর নাম প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। লক্ষণীয়, মানিকের মৃত্যু-বছরেই অদ্বৈতর উপন্যাসটি প্রকাশ পায়।
উপন্যাস দুটোর প্রকাশকালের মধ্যে ব্যবধান বিশ বছরের। এই বিশ বছরে বাংলা ভাষার কোনো ঔপন্যাসিক কৈবর্তসমাজকে কেন্দ্রে স্থাপন করে নদীভিত্তিক কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখেননি, অমরেন্দ্র ঘোষের (১৯০৭-১৯৬২) চরকাশেম (১৯৪৯) উপন্যাসটির কথা স্মরণে রেখেও এ কথা বলা যায়।
পদ্মানদীর মাঝি লিখিত হওয়ার পর জেলেজীবনকে নিয়ে আর উপন্যাস লেখার প্রয়োজন আছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে অদ্বৈত বলেছিলেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় আর্টিস্ট, মাস্টার আর্টিস্ট, কিন্তু বাওনের পোলা—রোমান্টিক। আর আমি তো জাউলার পোলা।’ অর্থাৎ মানিক ছিলেন প্রান্তিক সমাজের বাইরের লোক। তিনি বাইরে থেকে কৈবর্তসমাজে আলো ফেলেছিলেন, যদিও সে আলো ছিল সমাজভেদী। এক দরদি সমাজমনস্কতা নিয়ে তিনি এই প্রান্তজনের জীবনালেখ্য নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। তবুও এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে মানিকের পরেও কৈবর্ত-জনজীবন নিয়ে তিতাস একটি নদীর নাম-এর মতো আরও একটি উপন্যাস লেখার প্রয়োজন ছিল। কারণ, লেখক যে আর কেউ নন, কৈবর্তসমাজেরই একজন তিনি। তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণ। অন্তেবাসী কৈবর্তসমাজে জন্ম তাঁর। পরিচয়ের এই প্রত্যক্ষতাই ছিল তাঁর গৌরবের ভিত। নিম্নবর্গীয় কৈবর্তজীবনের সামূহিক ধারাবাহিকতাকে ভেতর থেকে অনুপুঙ্খভাবে দেখার ও জানার সুযোগ ও সুবিধে তাঁর ছিল। ফলে তাঁর লেখা কৈবর্তসমাজলগ্ন উপন্যাসটি হয়ে উঠল মালোজীবনের অকৃত্রিম চালচিত্র।
মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের (০১.০১.১৯১৪-১৬.০৪.১৯৫১) জীবন তাঁর। ক্ষীণ-আয়ু বলে খুব বেশিসংখ্যক সাহিত্য-সৃষ্টি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি। স্বনামে চারটা গল্প, ছয়টা কবিতা আর কিছুসংখ্যক প্রবন্ধ পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। অনুবাদসহ তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা চার। এসব রচনাকর্ম, বিশেষ করে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস দিয়েই দেরিতে হলেও স্থায়ী খ্যাতির আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্মর সংগ্রামে তাঁকে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তারই মধ্যে সাহিত্যসাধনার মতো কঠিন ব্রতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। অবজ্ঞাত প্রান্তিক পরিশ্রমজীবী পরিবারের অন্তর্গত হয়েও তিনি সাহিত্যের সত্য ও সৌন্দর্যানুষ্ঠানে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর মতো উদাহরণ খুব বেশি নেই।
১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারিতে অদ্বৈত জন্মেছিলেন সেকালের ত্রিপুরা রাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপকণ্ঠে গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ায়। ভদ্রলোকদের কাছে এ পাড়াটি ‘গাবরপাড়া’ নামে পরিচিত ছিল। তৎকালীন ভদ্রসমাজ এ পাড়াটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। অদ্বৈতর পিতা ছিলেন অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। বাবার নাম জানা গেলেও মায়ের নাম এখনো অনাবিষ্কৃত। অদ্বৈতরা ছিলেন তিন ভাই, এক বোন। অল্পবয়সেই তাঁর দুই সহোদর মারা যান। অদ্বৈতর অপরিণত বয়সে মা-বাবাও পরলোকগমন করেন। বোন তরঙ্গময়ী অল্পবয়সে বিধবা হন। বালক বয়সে জারিগানে অংশগ্রহণ করেছেন অদ্বৈত। গানের দলে ‘গানদার’ হিসেবে বেশ নাম করেন তিনি। শীর্ণ দেহ ছিল তাঁর।
দারিদ্র্যের নদীতে, অসহায়তার তরঙ্গে ডুবসাঁতার দিতে দিতে অদ্বৈত কালক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম ই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। শিক্ষানুরাগী সনাতন মাস্টারের প্রণোদনায় ও অর্থানুকূল্যে অদ্বৈত ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এডওয়ার্ড হাইস্কুলে এবং সেখান থেকেই ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর আত্মশক্তিতে বলীয়ান অদ্বৈত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। কুমিল্লায় কল্পনা দে রায়ের বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে থাকতেন তিনি। বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে কল্পনা দেবী গ্রেপ্তার হলে অদ্বৈত আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। ১৯৩৪ সালের মে-জুন মাসে অদ্বৈতর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অদ্বৈত কলকাতায় পৌঁছালেন। তার পরের ইতিহাস অন্য রকমের—জীবনের ও মরণের।
বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈতর মান্যতা ঔপন্যাসিক হিসেবে। তবে অদ্বৈতর সাহিত্যজীবন কিন্তু শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। অনুবাদসহ তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা চার—জীবন তৃষ্ণা, তিতাস একটি নদীর নাম, রাঙামাটি ও শাদা হাওয়া। জীবন তৃষ্ণা আরভিং স্টোনের বিখ্যাত উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ (১৯৩৪)-এর অনুবাদ।
১৯৫৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তিতাস একটি নদীর নাম প্রকাশিত হয়। শ্রাবণ ১৩৫২ থেকে মাঘ ১৩৫২, সময়সীমার মধ্যে সাত সংখ্যায় উপন্যাসটি মোহাম্মদীতে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের জুলাই-আগস্ট থেকে ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উপন্যাসটির আদি রূপ প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদীতে সপ্তম কিস্তি প্রকাশের পরও লেখা ছিল, ‘ক্রমশ’। কিন্তু পত্রিকায় কয়েকটি দেশাত্মবোধক কবিতা ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য পত্রিকার কর্তৃপক্ষ অদ্বৈতর ওপর রুষ্ট হন এবং তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। অদ্বৈতর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৫৬ সালে পুঁথিঘর নামক প্রকাশন সংস্থা তিতাস একটি নদীর নাম-এর আমূল সংশোধিত বর্তমান রূপটি প্রকাশ করে।
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি চারটি খণ্ডে বিন্যস্ত। প্রতি খণ্ডে আবার দুটি করে পর্ব আছে। বিন্যাসটি এ রকম—
প্রথম খণ্ড: ক) তিতাস একটি নদীর নাম,
খ) প্রবাস খণ্ড।
দ্বিতীয় খণ্ড: ক) নয়া বসত,
খ) জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ
তৃতীয় খণ্ড: ক) রামধনু,
খ) রাঙা নাও
চতুর্থ খণ্ড: ক) দুরাঙা প্রজাপতি,
খ) ভাসমান
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের কাহিনি শোনাতে গিয়ে জানিয়েছেন, তিতাস বিখ্যাত কোনো ইতিহাসের সাক্ষী নয়, ভূগোলের পাতায় তার নাম নেই, সে শুধু একটা নদী, একান্ত অখ্যাত—অকুলীন। লেখক লিখেছেন:
‘তিতাস সাধারণ একটি নদী মাত্র। কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না। কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই। কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই?’
এই নদীর ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস তিতাস-তীরস্থ রক্ত-মাংসের মানুষের, সেই ইতিহাস মানবিকতার আর অমানুষিকতার। ‘মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বউ-ঝিয়েদের দরদ’-এর কাহিনিই নির্মাণ করেছেন লেখক এই উপন্যাসে। এই নদীকে কেন্দ্রে স্থাপন করে অদ্বৈত আসলে তিতাস—তীরবর্তী মালোদের অবজ্ঞাত, অপরিচিত, অবহেলিত জীবন-তাৎপর্যকেই তুলে ধরেছেন।
তিতাসপাড়ের মাছ-শিকারি জেলেদের জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহার, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শোষণ-বিড়ম্বনা, মিলন-বিরহ, দুঃখ-উল্লাস-দ্রোহ—এককথায় মালোসমাজের অতীত ও বর্তমান প্রাণস্পন্দনের হদিস মেলে তিতাস একটি নদীর নাম-এ। মালোজীবনের অতল থেকে লেখক যে অরূপ রতন তুলে এনেছেন, তা বহু মূল্যবান। মূলত, নদী-আশ্রিত জেলেদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনন্য রূপায়ণ ঘটেছে এই উপন্যাসে। এখানে অদ্বৈত মালোসমাজের জীবনচর্যার লবণাক্ত রূপের গাথা রচনা করেছেন। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দৈবনির্ভরতা মালোদের জীবনকে পঙ্গু করে রেখেছে। এই সমাজের সেবাবতী বিবাহিত নারীদের স্বামীরা জলের ফসল তুলতে গিয়ে প্রকৃতির দুর্বিপাকে পড়ে মরে গিয়েও মরে না, তারা শুধু নিখোঁজ হয়। আর অনাথা নারীর চারপাশে ছড়ানো থাকে ভ্রষ্টা হওয়ার হাজারো প্রলোভন।
জেলেরা সম্পূর্ণভাবে শোষিত এক সম্প্রদায়। দাদনদার, মহাজন ও আড়তদারদের শিকার এরা। মাছ ধরার মতো আদিম উপজীবিকার ওপর নির্ভরশীল জেলেগোষ্ঠীকে প্রাকৃতিক শক্তির পাশাপাশি বাইরের সমাজের নানা অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গেও নিরন্তর লড়াই করতে হয়। মহাজন-আড়তদার থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রেতা পর্যন্ত সবার সমবেত শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, সমরেশ বসুর গঙ্গা, আবদুল জব্বারের ইলিশমারির চরসহ অধিকাংশ নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে এই জীবনসংগ্রামের পরিচয় আছে। তিতাসের কথাকার অদ্বৈত, মানিকের মতো এতখানি খুঁটিনাটি বা আনুপুঙ্খিক আলোচনায় না গেলেও জাল-নৌকাবিহীন জেলেমাঝিদের নিষ্ঠুর ভবিতব্যের ছবি তাঁর উপন্যাসটির পাতায় যথাযথভাবে উপস্থিত করেছেন।
মালোদের ‘জলের উপরে জলটুঙ্গি’ বাঁধা জীবন, তাই তাদের জীবন সংশয়াতীতভাবে অনিশ্চিত। আর এই অনিশ্চয়তা স্বাচ্ছন্দ্যের—দুবেলা দুমুঠো অন্নের। একটা কদাকার, ভীষণ, জীবনধ্বংসকারী দারিদ্র্যদীর্ণ জীবনের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে উপন্যাসজুড়ে।
উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবহমানকালের; এ দ্বন্দ্ব সামাজিক, এ দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক। মালিক-শ্রমিক, জমিদার-প্রজা, প্রভু-ভৃত্য, মহাজন-খাতক, মনিব-মুনিষ—এই দুই বিপরীত বর্গের মধ্যে অর্থনৈতিক বিরোধ প্রকট হয়ে আছে। এই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের মালোদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন। শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মালোদের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেনি, বাজার-অর্থনীতির টানাপোড়েনেও তাদের বিলুপ্তি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসে তিতাসকে ঘিরেই মালোদের অর্থনৈতিক সংঘাত মূর্ত হয়েছে। কারণ, নদীটির সঙ্গে মালোজীবন ও বাজার-অর্থনীতির সম্পর্ক জড়িত। শুধু সুবল, গগন, তিলক মালোর নয়, অন্যান্য কৈবর্তেরও অর্থনৈতিক জীবনের ওঠা-নামা নদীর সঙ্গেই সূত্রবদ্ধ। এরা ব্যক্তি হিসেবে যতটুকু, তার চেয়ে বেশি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়েই অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
নিজে কৈবর্ত বলেই অদ্বৈত জানতেন যে মাছ ধরার মতো আদিম উপজীবিকার ওপর নির্ভরশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যান্য সমাজের সংঘাত প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। বাইরের এই শক্তিসমূহ মালোদের অস্তিত্বকে পুরোপুরিভাবে কবজা অথবা নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। উপন্যাসের প্রথম থেকেই মালোদের অর্থনৈতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন লেখক। এসেছে বিজয়নদীর পাড়ের মালোদের সঙ্গে তিতাসপারের মালোদের অর্থনৈতিক তুলনা। গোকর্ণঘাটের মালোদের অবস্থা সচ্ছল। কারণ, এখানকার তিতাসে অনেক জল, অফুরান মাছ। তবু এখানে গগন মালোর মতো দরিদ্ররা আছে। পদ্মানদীর মাঝির কুবের-গণেশের জাল-নৌকা ছিল না। ফলে ধনঞ্জয়ের মতো শোষকের জাল-নৌকা নিয়ে তাদের জীবসংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে। এরা প্রতারিত হয়েছে, দারিদ্র্যের পীড়ন পেয়েছে। তিতাস একটি নদীর নাম-এর গগন-সুবলের কোনোকালেই নিজস্ব নৌকা-জাল ছিল না। ফলে দারিদ্র্যের কামড় তাদেরও সহ্য করতে হয়েছে। কৈবর্তসমাজের ভেতরই বোধাই-কালোবরণদের সঙ্গে সুবল-গগন-তিলক-গৌরাঙ্গদের শ্রেণীপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজ বিকাশের ধারায় কৈবর্তরা একটা বিশেষ স্তরে স্থিত, কিন্তু সেখানেও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের চিত্র স্পষ্ট। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ধ্বংস হওয়ার পেছনে বিরুদ্ধ অর্থনৈতিক শক্তি কাজ করে এবং মালোসমাজেই তার উদ্ভব হয়—এ কথাটিই লেখক সচেতনভাবে উপন্যাসে পরিষ্কার করে তুলেছেন।
তিতাসের জলের দখলিস্বত্ব ছিল মালোদের। চর জাগার ফলে তিতাস হয়েছে শীর্ণকায়া, তার বিপুল জলরাশি শুকিয়েছে। জলসংশ্লিষ্ট মালোদের জীবন ধীরে ধীরে মনুষ্যত্বের পর্যায় থেকে মানবেতর স্তরে নেমে আসে। তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে যায়। ঋণদান কোম্পানির বাবুরা বন্দুকধারী পেয়াদার সাহায্যে মালোদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যথাসর্বস্ব নিয়ে যায়। তারা ঋণদান কোম্পানির কাছ থেকে হুজুগে পড়ে যে ঋণ নিয়েছিল, তা শোধ করতে পারে না। চক্রবৃদ্ধি হারে সে ঋণের পরিমাণ যখন পাহাড়সমান: এই কোম্পানির প্রতিনিধি বিধুভূষণ পাল মালোদের ধ্বংসকামী পালদের প্ররোচনায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করল:
‘সব ছাঁকিয়া তুলিয়াও তেমন কিছুই আদায় হইল না দেখিয়া শেষে তারা ঘরের থালা-ঘটি-বাটি, সুতার হাঁড়ি, জালের পুঁটলি বাহির করিয়া নিয়া ঘোড়ার গাড়িতে তুলিয়া চলিয়া’ গেল।
এখানে বিধুভূষণ একক ব্যক্তি নয়, সমবায় সমিতির প্রতিনিধি। যে সমিতি প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণে নিয়োজিত ছিল, সে সমিতিই চক্রান্তকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।
তিতাস-বুকে চর জাগার ফলে তার দখল নিয়ে বিরোধ ঘটেছে ভূমিলগ্ন কৃষকের সঙ্গে রামপ্রসাদ মালোদের। জল যাদের দখলে ছিল, সেখানে চর জাগলে স্বাভাবিক নিয়মে তার মালিক তারাই হওয়ার কথা। কিন্তু মালোরা নিঃস্ব দরিদ্র বলে, শক্তিহীন বলে ওই নিয়ম এখানে প্রযোজ্য হলো না। চরম বিরোধের সময় মালোরা ভয় পেল, রামপ্রসাদ ভূমিহীন কৃষকের সঙ্গে জোট বেঁধে চর দখলে উদ্যোগী হয়ে বেঘোরে প্রাণ দিল। ভূমিহীন কৃষক ও মালোরা দখল পায় না, চরের মালিক হয় পেশিতন্ত্রের লালনকারী শোষক মহাজনেরা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ এখানে অসহায় ব্রাত্যশ্রেণীর শ্রমজাত মুনাফা লুণ্ঠনকারী শোষকদের রুগ্ণ স্বরূপটি উদ্ঘাটন করেছেন। সমাজ পাল্টায়, ব্যবস্থাও পাল্টায়, কিন্তু শোষণের চাবুক চলতে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে শোষকের কৌশলটি বদলে যায় শুধু। অদ্বৈত উপন্যাসটিতে এই মৌলিক সমাজ-সত্যটির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে মালোসমাজের লোকায়ত সংস্কৃতির এক বর্ণময় জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। মালোদের নিজস্ব স্বতন্ত্র একটা সংস্কৃতি ছিল। সেই সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটত গানে, প্রবাদে, পূজা-পার্বণে এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাপনের হাসি-ঠাট্টায় ও তাদের নিজস্ব ধারার ধর্মবিশ্বাসে। মালোসমাজের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে তাদের ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে ছিল। এই ধর্মবোধ দুইভাবে এই উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে—সম্প্রদায়গত ধর্মভাবনায় ও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে। উপন্যাসে উল্লিখিত গোকর্ণঘাট, শুকদেবপুর, নয়াকান্দা, বাসুদেবপুর, বৈকুণ্ঠপুর, নবীনগর ইত্যাদি গ্রামের সব মালোই কৃষ্ণমন্ত্রী অর্থাৎ বৈষ্ণব। মালোদের ব্যক্তিনামের মধ্যেও বৈষ্ণব ভাবাপন্নতা লক্ষ করা যায়। উদাহরণত—কিশোর, সুবল, নিত্যানন্দ, গৌরাঙ্গ, অনন্ত, ছিনিবাস (শ্রীনিবাস), দয়ালচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র, হরিমোহন, নিতাইকিশোর, শ্যামসুন্দর, বনমালী ইত্যাদি নাম উল্লেখ করা যায়। এই নামগুলো কৃষ্ণ ও চৈতন্যমহিমায় আকীর্ণ।
মালোদের চিন্তায়-আচরণে বৈষ্ণবীয় বোধের উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষণীয়। বারোমাসি গান, ভাটিয়ালি গান, সারিগান, মাঘমণ্ডলের গান কিংবা জাতকর্মাদির অনুষ্ঠানগুলোতেও কৃষ্ণলীলার বহু বিচিত্র বিস্তার ঘটেছে। দোললীলা কৃষ্ণসংশ্লিষ্ট একটি পার্বণ। দোলযাত্রার ফাগের রঙে মালোরা রঞ্জিত হয়েছে। রাঙিয়েছে তিতাসের জলকে। প্রবাসজীবনে এই হোলির অনুষ্ঠানেই কিশোর প্রেমে পড়েছিল একজন কিশোরীর। আবার বহুদিন পরে, সেই নারী পাগল-কিশোরের সঙ্গে মিলনাকাঙ্ক্ষায় উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল, সে-ও এক হোলির দিনে।
নদী একাধারে মালোদের পূজ্য দেবতা এবং জীবিকা সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র। ফলে নদীকে ঘিরে তাদের মধ্যে নানা রকম সংস্কার ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। এই সংস্কার ও বিশ্বাস জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। পবিত্র উপকরণ হিসেবে তিতাস নদীর জলকে মালোরা নানা ব্রত ও অনুষ্ঠানে ব্যবহার করেছে। প্রতিদিনের জালিক-কাজকর্মে তারা নদীকে নমস্কার করে এবং তার জলে হাত-পা ধুয়ে নৌকায় ওঠে। নদীযাত্রায় তারা গঙ্গামায়ের নাম স্মরণ করে, কখনো কখনো নদীর বুকে নৌকা ভাসানোর সময় পাঁচপীরের ধ্বনি দেয়, ‘পাঁচপীর বদরের ধ্বনি দিয়া প্রথম লগি ঠেলা দিল তিলক।’ তিতাসপারের মালোদের দৃৃঢ় বিশ্বাস, ‘গাঙের ডর মাঝ গাঙে না, গাঙের বিপদ পারের কাছে। বা’র গাঙে মা—গঙ্গা থাকে, বিপদে নাইয়ারে রক্ষা করে।’
নদী-নৌকা-জাল—এই তিন নিয়েই মালোজীবন। নদীর মতো নৌকাও জেলেজীবনের অপরিহার্য উপাদান। সে জন্য নৌকা ধুয়েমুছে তারা পরিষ্কার রাখে, তাকে দেবতাজ্ঞানে প্রণাম করে। দূরদেশে নৌকাযাত্রার সময় মালোনারীরা জোকার দেয়। শুকদেবপুর যাত্রার সময় কিশোরকে নদীর জল দিয়ে নৌকাকে প্রণাম করতে দেখা যায়, ‘তিলককে ভাত চাপাইতে বলিয়া কিশোর গলুইয়ে একটু জল দিয়া প্রণাম করিল।’ উপন্যাসটির ‘নয়াবসত’ অংশেও গৌরাঙ্গসুন্দরকে নৌকার গলুই ধুতে দেখা যায়।
এই উপন্যাসে নানা ধরনের জালের উল্লেখ আছে। যেমন—ঠেলা জাল, ভেলাস জাল, ভৈরব জাল, জগৎবেড়া জাল, ছান্দি জাল ইত্যাদি। নদীতে এই জাল ফেলা ও মাছ ধরা নিয়েও মালোসমাজে নানা সংস্কার প্রচলিত আছে। শুকদেবপুরে সুবল—কিশোরের মাছ ধরার চিত্রে দেখা যায়—
‘নৌকা মাঝ নদীতে গেলে কিশোর জাল ফেলিল এবং এক আঁজলা জল মুখে পুরিয়া কুলি করিয়া জালে “বুলানি” দিল।’
বাংলার নদীকেন্দ্রিক গানবহুল জীবনের প্রতিচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। নদী-নৌকা-জালনির্ভর মালোজীবনের কাহিনি লিখতে গিয়ে অদ্বৈত গানের ডালি দিয়ে সাজিয়েছেন এ উপন্যাসকে। মূলত লেখক মালোদের নির্মম নিয়তিনিয়ন্ত্রিত জীববৃত্তান্ত শোনাতে গিয়ে লোকগানের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা অনুষঙ্গ, নানা ব্রতকথা, পূজা-পার্বণাদি এই উপন্যাসে সংগীতনির্ভর হয়ে পরিবেশিত হয়েছে। এই উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পূর্ণ এবং আংশিক কলি নিয়ে মোট ৫৯টি গান ব্যবহার করেছেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস একটি নদীর নাম-এ জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের স্রোতে বহমান কৈবর্তসমাজের বিচিত্র নারীদের মূর্ত করে তুলেছেন। পুরুষের পাশাপাশি এই নারী চরিত্রগুলো দীপ্যমান। এখানে আছে বাসন্তী, অনন্তর মা, উদয়তারার মতো মুখ্য চরিত্র, আছে গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ, সুবলের মা, বাঁশিরামের স্ত্রী, কালোর মা প্রভৃতির মতো গৌণ চরিত্র। কালোয়-ফরসায় মেশানো এই মালোনারীরা কৈবর্তসমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে।
মালোসমাজ গোষ্ঠীবদ্ধ। যূথবদ্ধ সামাজিক নিয়মের বাঁধন এখানে যেমন কঠোর ও মান্য, তার শিথিলতাটুকুও নজর এড়িয়ে যায় না। পুরুষেরা মাছ ধরে, নারীরা জালের সুতা কাটে, সংসার সামলায় এবং সন্তান ধারণ করে। শ্বাস-প্রশ্বাসটা যেমন স্বাভাবিক, নারীর সন্তান ধারণও এ সমাজে তেমনি স্বাভাবিক। পরিশ্রমের ফাঁকে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের অবকাশে জেলেপুরুষ জেলেরমণীর সঙ্গে মিলিত হয়; তার ফলে স্বাভাবিক নিয়মে সন্তান জন্মায়। তারা সামাজিক জীবনে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে। তারা পুরুষের সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে না গেলেও মাছ ধরার সব প্রারম্ভিক কাজ সম্পন্ন করে। এ রকম সামূহিক বাস্তবতার চিত্র দেখতে পাওয়া যায় কালোবরণের পরিবারের প্রাত্যহিকতায় চোখ রাখলে—
‘তিন বউ সারারাত সুতা কাটিয়া শেষরাতে শুইয়াছিল। অল্প একটু ঘুমাইতেই কালোবরণের জালে যাওয়ার সময় হইল। ভোররাতে রোজ এরা জাল লইয়া নদীতে যায়। বেচারী বউরা কি আর করে। স্বামীর পাশ হইতে উঠিয়া কেউ তামাক টিকার ডিবা, কেউ মানসা, খলুই জালের পুঁটলি হাতে নিয়া বাহির হইয়া পড়ে। ততক্ষণে ফরসা হইতে থাকে। পাখ-পাখালির ডাক শুরু হয়। কালোর মা যত দিন বাঁচিয়া আছে এই সময় বউদের উঠিতেই হইবে। সকল বাড়ির বউদের আগে কালোর বাড়ির বউদের স্নান করিয়া আসা চাই।’
জেলেনির কর্মব্যস্ত দিনের এভাবে শুরু হয়। তারপর নানা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তার পরও যদি কিছু সময় মেলে, তাকেও হেলায় কাটানো যায় না। নানা রকম সুতা কেটে, জাল বুনে সেই সময়টুকুকে পার করতে হয় মালোবধূকে।
তিতাসতীরের জেলেসমাজে কালোর মা, মঙ্গলার বউ, সুবলের মায়ের মতো অনেক চরিত্র আছে, কিন্তু বাসন্তীর মতো দ্বিতীয়টি নেই। এ চরিত্রটির প্রাণলক্ষণ নিহিত আছে অপরিচিতকে চেনার মধ্যে, বাস্তবকে স্বীকারের মধ্যে, প্রতিকূলতাকে জয়ের মধ্যে, ব্যক্তি ও সমাজ—নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে। অসংস্কৃত প্রান্তিক জেলেসমাজে এ এক অসাধারণ নারী। তার ভেতরে একজন শাশ্বত বাঙালি নারীর উপস্থিতি আমাদের সচেতন করে তোলে।
কৈবর্তসমাজের মতো নিম্নবর্গীয় সমাজে সন্তানহীনা নারীর মানসিকতা প্রায়ই রুক্ষ ও কর্কশ হয়। সন্তান জন্মের অক্ষমতা তাকে ভারসাম্যহীন ও ভয়ংকর করে তোলে। বাসন্তী শুধু সন্তানহীনা নয়, পতিহারাও বটে। প্রত্যেক বিবাহিত নারীর জীবনে পতি ও সন্তানের ভূমিকা সর্বাত্মক, যা থেকে বাসন্তী বঞ্চিত। তাই পিতৃহারা বালক অনন্তর প্রতি বাসন্তী আগ্রাসী—সন্তানবাৎসল্য প্রদর্শন করে। বাসন্তীর এই অনন্ত-প্রীতি শেষ পর্যন্ত তার পিতামাতাকে তার প্রতি নিষ্ঠুর ও সন্দেহপ্রবণ করে তোলে। বাসন্তী কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পবিত্রতম সম্পর্কটিকে মধুরতমভাবে আস্বাদন করতে পারে না। ফলে বাসন্তীর মধ্যে জেলেরমণীর আদিমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে—
‘ভাবছিলাম আমারই দুঃখের দুঃখী অনন্তর মার মত সাথী পাইয়া, অনন্তর মত ছাইলা কোলে পাইয়া সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়ামু। তোমরা আমারে তার কাছে যাইতে দিবা না। দিবা না যখন, আমি মানুষ ধরুম। দেখি তোমরা কদিন আমারে ধরে বাইন্ধ্যা রাখতে পার।’
এই উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিজেই কথক এবং তিনি সর্বদর্শী। আখ্যানবৃত্তে কৈবর্তজীবনের নানা অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন তিনি। এই উপস্থাপনে কোনো কৃত্রিমতা নেই। জেলেসমাজকে আদ্যন্ত চিনতেন তিনি। মালোদের সমাজ-সংস্কৃতি অদ্বৈতর চেতনার গভীরে প্রোথিত ছিল। লেখক তাঁর আবাল্য পরিচিত জগৎকে এই উপন্যাসের বিষয়-আশয় করে তুলেছেন। নারী-আচরণ, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের অনুষ্ঠানাদির বিবরণের পাশাপাশি নানা পূজা-পার্বণের ছবিও ফুটিয়ে তুলেছেন অদ্বৈত এই উপন্যাসে।
অদ্বৈত যথোচিত বাস্তবতায় কৈবর্তজনজীবনের জাত-কর্মাদি অনুষ্ঠানের ছবি এই উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে কেতুপুরের জেলেপাড়ায় জন্মের অভ্যর্থনা বিষণ্ন ও নিরুৎসব। অন্যদিকে তিতাসপারের মালোপাড়ায় জন্মের অভ্যর্থনা জাঁকজমকপূর্ণ ও উৎসবমুখর। এর পেছনে কৃষ্ণমন্ত্রী মালোদের ধর্মভাবনা কাজ করেছে। কৃষ্ণের প্রতি মা যশোদার যে নিবিড় স্নেহ, তারই অভিব্যক্তি লক্ষ করা যায় মালোজনজীবনে। সন্তানের আগমনকে এখানে সানন্দে স্বাগত জানানো হয়। তবে, মেয়ের তুলনায় ছেলের আগমন এ সমাজে অধিকতর আকাঙ্ক্ষিত। তাই ‘ছাইলা হইলে পাঁচ বার জোকার, মাইয়া হইলে তিন বার।’
মালোসমাজ একেবারে আবিলতামুক্ত নয়। এ সমাজে সৎ লোক যেমন আছে, অসৎ লোকেরও তেমনি অভাব নেই। উপন্যাসটি রচনা করতে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ এ কথা ভোলেননি। তাই দোষত্রুটিহীন মালোসমাজ তাঁর উপন্যাসে স্থান পায়নি। এই সমাজেও যে লোভী আছে, ঈর্ষাতুর আছে, বেইমান আছে, শোষক আছে, বঞ্চনাকারী আছে—উপন্যাসটি লিখতে বসে অদ্বৈত তা এড়িয়ে যাননি। তিনি বাস্তবতাসচেতন অকৃত্রিম জীবনশিল্পী বলে তামসীর বাপের মতো বিভীষণ ও কালোবরণের মতো স্বসংস্কৃতিবিদ্বেষী চরিত্র অঙ্কনে দক্ষতা দেখিয়েছেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ—(১ জানুয়ারি ১৯১৪-১৬ এপ্রিল ১৯৫১)
বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈতর মান্যতা ঔপন্যাসিক হিসেবে। তবে তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরু কবিতা দিয়ে। অনুবাদসহ তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা চার—জীবন তৃষ্ণা, তিতাস একটি নদীর নাম, রাঙামাটি ও শাদা হাওয়া। জীবন তৃষ্ণা আরভিং স্টোনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’ (১৯৩৪)-এর অনুবাদ।
লেখক: নিজে জেলে সম্প্রদায় থেকে আসা, জেলেজীবন নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস: দহনকাল, জলপুত্র ও রামগোলাম।

No comments

Powered by Blogger.