মনমোহনের ঢাকা সফর-আমলাতন্ত্রের জট খুলবে কি? by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

এই হচ্ছে আমলাতন্ত্র। এরাই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর পথের কাঁটা। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা এসে নিশ্চয়ই অনেক আটকে থাকা সরকারি প্রকল্পের জট খুলতে পারবেন। কিন্তু আমলাতন্ত্রের জট খুলতে পারবেন কি? জেনে রাখুন, সরকারিভাবে দু'দেশের সম্পর্ক যা-ই থাকুক না কেন, দু'দেশের মানুষকে কাছে আসতে দিন,


দেখবেন তারা নিজেরাই মৈত্রীর সেতুবন্ধ রচনা করেছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারতের ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার যতই রাজনৈতিক অসুবিধার মধ্যে পড়ূক না কেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারত এখন নতুন করে শান্তি ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে সে সম্পর্কে কোনো দ্বিধা ও সংশয় থাকার কথা নয়। মুম্বাই বিস্ফোরণের পর অন্য যে কোনো দেশ হলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে বসত। যুদ্ধ যে কোনো সরকারের পক্ষেই দেশবাসীর কাছে সহজে জনপ্রিয় হওয়ার একটা উপায়। জাতীয়তা বিপন্ন এই জিগির তুলে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত কম যুদ্ধবিগ্রহ হয়নি। কিন্তু মনমোহন সরকার সে পথে না হেঁটে বহু প্ররোচনা সহ্য করে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অরুণাচল নিয়ে চীন নতুন করে দাবি তুললেও ভারত কিন্তু কোনো প্ররোচনায় পা দেয়নি। বরং চীনের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। নেপালে মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড ভারতকে দু'বেলা মুণ্ডুপাত করলেও ভারত-নেপাল সম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটেনি।
প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর মধ্যে ভারতের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। ইন্দিরা গান্ধীর পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে এত সক্রিয়তা এর আগে দেখা যায়নি। ভারতের বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণা কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফর করে খুব সন্তুষ্ট হয়েই ফিরে গেছেন। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্কের উন্নতির জন্য যেসব বিষয় এতদিন ঝুলে ছিল, সেগুলোর মোটামুটি একটা নিষ্পত্তি ভারতের বিদেশ সচিব করে এসেছেন। এখন সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে গিয়ে তাতে সিলমোহর দিয়ে আসবেন। তার আগে এই মাসেই যাচ্ছেন সোনিয়া গান্ধী। যদিও এটি তার রাষ্ট্রীয় সফর নয়, তবুও এ সফরসূচিটি করা হয়েছে অনেক ভেবেচিন্তে।
আমি যতদূর বাংলাদেশের মানুষদের জানি, সোনিয়া ও মনমোহনের সফর সাধারণ মানুষের মধ্যেও যথেষ্ট ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করবে। সাধারণ মানুষ ইন্দিরা গান্ধীকে আপনজন বলে ভাবতেন। ১৯৭২ সালে ইন্দিরার ঢাকা সফরে আমি তার সঙ্গী ছিলাম। ঢাকায় তিনি যেখানেই গেছেন মানুষের ঢল নেমেছে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী যখন সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় যান, তখন শান্তিনিকেতন থেকে আমিও তার সফরসঙ্গী ছিলাম। এক প্লেনেই তার সঙ্গে দিলি্ল ফিরি। রাজীব সে সময় আলাদা করে বাংলাদেশের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় পাননি। সুতরাং সেই সফর সাধারণ মানুষের মনে কোনো দাগ কাটেনি। কিন্তু এবার সোনিয়া ও মনমোহনের সফরসূচি এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে জনসাধারণ তাদের ব্যক্তিত্বের একটা আঁচ পান।
সোনিয়া এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বর্ণময় চরিত্র। এক বিদেশিনী কন্যা। প্রেমে পড়লেন এক বিদেশি রাজকুমারের (পড়ূন নেহরু পরিবারের)।
অবশেষে ১৯৬৮ সালে বিবাহ। এরপর সুদূর ইতালি থেকে চলে এসে ভারতকেই নিজের দেশ বলে মেনে নিলেন। তিনি ও তার স্বামী রাজীব গান্ধী দু'জনই চেয়েছিলেন অরাজনৈতিক জীবন। রাজীব গান্ধী ১৯৮৩ সালে আমাকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পাইলটের চাকরিতেই তার সুখ। তিনি কখনও প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। কিন্তু ভাগ্য দু'জনকেই কীভাবে রাজনীতিতে নিয়ে এলো। ইন্দিরা ও সঞ্জয় গান্ধী নিহত না হলে রাজীব প্রধানমন্ত্রী হতেন না। রাজীব যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন এবং প্রধানমন্ত্রী অবস্থায় নিহত না হতেন তাহলে সোনিয়াকে কেউ রাজনীতিতে আনতে পারত না।
রাজনীতিতে এসে সোনিয়া কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হননি। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম এক ব্যক্তি যিনি সর্বসম্মতিক্রমে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অফার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা কোনো গুপ্ত খবর নয়। তাবড় তাবড় কংগ্রেস নেতা তিন-চার ঘণ্টা ধরে সোনিয়াকে সেদিন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা দেশের পক্ষে কতটা জরুরি। এই দীর্ঘ আলোচনা দূরদর্শন রিলে করে সারাবিশ্বকে দেখিয়েছিল।
সোনিয়া রাজনীতি ছাড়তে চাইলেও রাজনীতি তাকে ছাড়েনি। তিনি এখন ইউপিএ অর্থাৎ যে কোয়ালিশন এখন ভারতে সরকার চালাচ্ছে তার চেয়ারপারসন। ভাবতে অবাক লাগে, ১৯৯১ সালের ২১ মে রাজীব নিহত না হলে যে সোনিয়া রাজনীতিতে আসতেন না, আজ তিনি ভারতের ১২৩ বছরের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের প্রধান। ভারতেরও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকা সফরের সময় আমি সর্বপ্রথম সোনিয়া গান্ধীকে দেখি। তখন তিনি রাজনীতি সম্পর্কে নিরাসক্ত। সফরে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ হিসেবে। কথাবার্তা খুবই কম বলতেন।
আগামী ৬ ডিসেম্বর সোনিয়া ৬৫ বছরে পড়বেন। প্রৌঢ়ত্বে এসে তিনি এখন সুপরিণত ও পরিণামদর্শী রাজনীতিবিদ। একটি কোয়ালিশন সরকারকে তিনি গত আট বছর ধরে টালমাটাল অবস্থা থেকে রক্ষা করে আসছেন। এর আগেরবার ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে সিপিএম যখন ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল, তখনই তো মন্ত্রিসভা ভেঙে যাচ্ছিল। সোনিয়া তখন তার ভারসাম্যের রাজনীতি দিয়ে পতনোন্মুখ মন্ত্রিসভাকে শুধু রক্ষাই করলেন না, তাকে পরের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতিয়ে নিয়ে এলেন। তার ভারসাম্য রাজনীতির সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করা। সোনিয়া যদিও জানেন, যে কোনো দিন তিনি ইঙ্গিত করলেই মনমোহন সরে যাবেন এবং রাহুল প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। একদিনের জন্যও মনমোহন সিংকে তার যোগ্য মর্যাদা ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেননি। প্রশাসনের সার্বভৌম ক্ষমতা তিনি প্রধানমন্ত্রীকেই ন্যস্ত করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে যারা ব্যক্তিগতভাবে জানেন, তারা জানেন, ভারতের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এই মানুষটির অন্তরে লুকিয়ে আছে এক স্নেহশীল আপনভোলা মাস্টারমশাই। ১৯৬৩ সালে অক্সফোর্ড থেকে তিনি এমএ ডি ফিল করে দেশে ফিরে ওই বছরই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এরপর দিলি্ল স্কুল অব ইকোনমিক্সে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে (১৯৮০-৮৪) তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। রাজীব তার পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর করেছিলেন।
১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী তাকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করেন। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য উপদেষ্টা হন। ১৯৯১ সালের ২১ জুন নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। ভারতে অর্থনৈতিক সংস্কার তথা উদারীকরণ অর্থনীতির যুগ তার সময় থেকেই শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি মনমোহন সিংয়ের সরকার কতগুলো স্ক্যামে জড়িয়ে পড়ে একটু কমজোরি হয়ে পড়েছে। অন্ধ্র বিভাজন নিয়েও সরকার এখন ব্যতিব্যস্ত। সবসময় কী হয় হয় ভাব, কিন্তু ভারতে ২০১৪ পর্যন্ত মনমোহন সিং সরকারের পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখনও পর্যন্ত রাহুল গান্ধীর সমর্থকরা রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী করার যতই চেষ্টা করুন না কেন, দু'বছরের জন্য রাহুলকে এনে সোনিয়া কিছুতেই ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।
মনমোহন সিংও জানেন, এটা তার শেষ টার্ম। তাই আগামী দু'বছরের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি স্থায়ী শান্তি ও সহাবস্থানের সম্পর্কের ভিত পাকা করে যেতে চান মনমোহন। তার এজেন্ডার প্রথমেই রয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে একটা সমঝোতায় আসার জন্য মনমোহন আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারত সরকার জানে, পাকিস্তান এখন নিজেই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আছে। সেখানে আবার সামরিক শাসন আসন্ন কি-না তা বলা মুশকিল। কিন্তু পাকিস্তান যদি নিজের স্বার্থেই ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে সন্ত্রাসীদের দমন করতে এগিয়ে না আসে, তাহলে দু'দেশের নিরাপত্তার পক্ষেই তা মুশকিলের বিষয় হয়ে উঠবে। কারণ আমেরিকান সৈন্য আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেলে সন্ত্রাসবাদই পাকিস্তানের নিয়ন্তা হয়ে উঠবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যের পেছনেও মনমোহনের বাস্তববোধ বেশি করে কাজ করছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের এখন সন্ত্রাসবাদী হামলার কোনো আশঙ্কা নেই। এতদিন ধরে বাংলাদেশ উলফা জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এসব ঘাঁটির অধিকাংশই নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি নেতা পরেশ বড়ূয়ার নামে বাংলাদেশে চার্জশিট আছে। তিনি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেই গ্রেফতার হবেন। তাই তার পক্ষে ভারতের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ষড়যন্ত্রটি বাংলাদেশ পুলিশ ধরে ফেলে। যে অস্ত্র উদ্ধার হয়, সেই অস্ত্র এনেছিল উলফারা। হাসিনা এসে উলফাদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছেন।
আরেক জঙ্গি নেতা অনুপ চেটিয়া রাজশাহী জেলে আটক আছেন। পরেশ বড়ূয়া একসময় তো বাংলাদেশে অনেকটা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন বলে ভারতে প্রচার রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দু'দেশের জেলেই দু'দেশের অপরাধীরা বন্দি আছে। দু'দেশের বন্দি প্রত্যর্পণ ব্যাপারটির একটি ফয়সালা হওয়া দরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিই। এরপর আমি সদ্য মুক্ত বাংলাদেশে পাঁচ মাস কাটিয়েছি। ১৯৭৮, ১৯৮০ ও ১৯৮৫ সালে সাংবাদিকতার সূত্রে বাংলাদেশে গিয়েছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হওয়ার ও পাবনা-চট্টগ্রামে তার সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আবার ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকার নেওয়ারও আমার সুযোগ হয়। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল এমনকি সে সময়কার জামায়াতসহ দক্ষিণপন্থি নেতাদের কারও সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে আমার অসুবিধা হয়নি।
বাংলাদেশে 'ভারতবিরোধীদের' সংখ্যা কত আমি জানি না। কিন্তু নীতিগতভাবে ভারতবিরোধী আমি একজন বাংলাদেশিকেও দেখিনি। বাংলাদেশিদের অনেকের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ আছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আছে। আবার অনেকে মনে করেন, ভারতের উচিত ছিল দু'দেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা। বাংলাদেশের পণ্যের আরও বেশি করে ভারতে বাজার পাওয়া দরকার। বাণিজ্য মানে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের একচেটিয়া বাজার তৈরি করা নয়। অনেকের দাবি ভারত থেকে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও সরলীকরণ করার। ত্রিপুরা থেকে ভারত যাওয়ার রাস্তা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে হলে আরও কম সময়ে ঢাকা থেকে কলকাতা পেঁৗছা যায়। এসব নিয়ে কোনো বাংলাদেশির সমালোচনার সুরে কথা বলা মানে 'ভারত বিরোধিতা' নয়।
আবার কোনো ভারতীয় সাংবাদিক যদি লেখেন, শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন_ তার মানে তিনি যে বাংলাদেশবিরোধী তা মনে করা হবে কেন? কিন্তু এ কথা লেখার অপরাধেই এই প্রতিবেদক বিএনপি সরকারের সময় বাংলাদেশে আসার ভিসা পাননি। তিনি তৎকালীন বিদেশমন্ত্রীর কাছে বারবার পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিলেন, সাড়া মেলেনি।
আসলে দু'দেশের প্রকৃত সম্পর্ক নির্ভর করে মানুষে মানুষে সম্পর্কের ওপর। এই সম্পর্ককে প্রসারিত হতে দিন, দেখবেন দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়েও দু'দেশের মানুষের প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিসা উঠে গেছে। কিন্তু আমরা কেউ প্রশ্ন করছি না, কেন দু'দেশের ভিসা বর্ডারে দেওয়া হবে না? কেন আরও বেশি করে মানুষকে দু'দেশের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করতে দেওয়া হবে না? বাংলাদেশে শুধু পর্যটক হিসেবে যাওয়ার জন্য ভারতের মানুষের আগ্রহ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। গত সপ্তাহে কলকাতায় পর্যটন মেলায় বাংলাদেশ ভ্রমণের সব আসন দু'দিনেই ভর্তি হয়ে যায়।
সবশেষে বলি দু'দেশের আমলাতন্ত্র দু'দেশের সম্পর্কের উন্নতিতে বড় বাধা। রাষ্ট্রনেতারা এসে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে চলে যান। আমলারা তা কার্যকর করতে গড়িমসি করেন। এভাবে দু'দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
একটা গল্প হলেও সত্যি দিয়ে এবারের কথা শেষ করি। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের দীর্ঘ ২৬ বছর পর বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। ভারতীয় হাইকমিশনারকে প্রস্তাব দিলাম এই সুযোগটা আমি ব্যবহার করতে চাই। রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বক্তৃতা দিতে চাই। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাচক্রে মিলতে চাই। দ্বিতীয়টির তারা কোনো আমলই দিলেন না। প্রথমটির জন্য গুলশানের ইন্দিরা সেন্টারে একটা বক্তৃতার আয়োজন করলেন। কিন্তু বললেন, ইউনিভার্সিটি গেস্ট হাউস থেকে আমাকে গুলশানে নিয়ে যাওয়ার বা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব তারা নিতে পারবেন না। কারণ আমি ভারত সরকারের অতিথি বক্তা নই। তাই আমাকে গাড়ি দেওয়ার আইন নেই।
আমি বললাম, তাহলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভবই নয়।
তারা বললেন, ঠিক আছে। আসবেন না। আমরা অনুষ্ঠান বাতিল করে দিলাম। দিলেনও। এই হচ্ছে আমলাতন্ত্র।
এরাই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর পথের কাঁটা। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা এসে নিশ্চয়ই অনেক আটকে থাকা সরকারি প্রকল্পের জট খুলতে পারবেন। কিন্তু আমলাতন্ত্রের জট খুলতে পারবেন কি? জেনে রাখুন, সরকারিভাবে দু'দেশের সম্পর্ক যা-ই থাকুক না কেন, দু'দেশের মানুষকে কাছে আসতে দিন, দেখবেন তারা নিজেরাই মৈত্রীর সেতুবন্ধ রচনা করেছে।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.