বাতায়ন পথে নিরীক্ষণঃ হে মহাকবি তোমাকে প্রণতি জানাই by আতাউর রহমান
আধুনিক বাংলা ভাষার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। তিনি বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতি ভাষার বাতাবরণ থেকে অনেকখানি বের করে আনেন এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে বাংলা ভাষার সত্যিকার মুক্তি ঘটে।
রবীন্দ্রনাথই আধুনিক বাংলা ভাষার জনক। বাংলা গদ্য ও পদ্য ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে আজও তার সমকক্ষ কেউ নন। ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই মাসেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছি। আজকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পৃথিবীর সবদেশে পালিত হয়। আমি মনে করি, জাতি হিসেবে আমরা আমাদের সমৃদ্ধ ভাষা নিয়ে গৌরব বোধ করতে পারি। কিছুদিন আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৮৬তম জন্মজয়ন্তী পালিত হলো। বিটিভি’র একটি কথামালা অনুষ্ঠানে আমিও মাইকেলকে নিয়ে কিছু কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে তাকে আবার মনে করছি বিশেষ করে তার কাব্য ও নাট্য সাহিত্যের জন্য। মাইকেলের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’ মাদ্রাজে সমাদৃত হলেও কলকাতায় এই রচনা বিশেষ প্রশংসা পেল না। লর্ড বেথুন তখন বাংলাদেশের শিক্ষা সচিব। মাইকেলের বন্ধু গৌরদাস বসাক বেথুন সাহেবকে বেশ গর্বভরে বন্ধুর বইটি পড়তে পাঠালেন, ভাবটা এই ছিল যে, দেখ আমার বাঙালি বন্ধু তোমাদের ভাষায় কি সমৃদ্ধ লেখা লিখেছে। বেথুন সাহেব বইটি পড়ে বিরূপ মন্তব্য করলেন। সংক্ষেপে উনি জানালেন, মাঝে মধ্যে এই ধরনের রচনার প্রয়াস খারাপ নয়। তবে তোমাদের কবি নিজ ভাষায় লিখলে দেশ ও জাতির অনেক বেশি উপকার হতো। এর পরের ইতিহাস দীর্ঘ। বাংলা ভাষায় প্রায়-অজ্ঞ মাইকেল মধুসূদন বাংলা শিখলেন এবং যুগান্তকারী বাংলা ভাষার জন্ম দিলেন। তার অসাধারণ সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। মাইকেলের যদিও পাশ্চাত্যপ্রীতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল, তবুও তার আত্মার শিকড় স্থায়ীভাবে প্রোথিত ছিল বাংলার মাটিতে। সবারই অতিপরিচিত মাইকেলের দু’টো কবিতার কয়েকটি লাইন শোনা যাক। ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় উনি লিখেছেন-
“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; —
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!”
‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় উনি লিখেছেন—
“সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।”
এই কবিতা খণ্ড দু’টো আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাক্কা সাহেব এবং দু’জন শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রীর (রেবেকা ও হেনরিয়েটা) স্বামী মাইকেলের হৃদয়টি প্রোথিত ছিল বাংলার মাটিতে এবং যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষ নদকে ঘিরে তার মন কাঁদতো। ঢাকাবাসী এই স্যুট-প্যান্ট পরিহিত এবং বো-টাইধারী মাইকেলের জন্য একবার এক সংবধর্না অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। মাইকেল বক্তৃতার শুরুতেই বলেছিলেন— আপনারা আমাকে সাহেব ভাবিলেও ভাবিতে পারেন, কিন্তু আমি যথার্থই বাঙাল বটে। প্রণিধানযোগ্য যে, উনি বাঙালি বলেননি, নিজেকে বাঙাল বলে গর্ববোধ করেছেন। অর্থাত্ উনি ছিলেন মনে-প্রাণে পূর্ববঙ্গের মানুষ, যার পরিচয় পাই তার অনন্য সৃষ্টি—‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে (নাটকটির শিরোনামের বানান নাট্যকার ওইভাবে করেছেন)। আমি আজও এমন একটি ব্যাঙ্গাত্মক অথচ অর্থপূর্ণ, পাশাপাশি হাস্যরসে পূর্ণ প্রহসন পাঠ করিনি। নাট্য প্রহসনটি যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। নাগরিক নাট্য সমপ্রদায় ১৯৭২ সালে এই প্রহসনটি বর্তমান লেখকের নির্দেশনার সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছিল। কলকাতার অভিনেতা উত্পল দত্ত এই নাটকে ‘ভক্ত প্রসাদ’ চরিত্রে কালজয়ী অভিনয় করেছিলেন। মাইকেল রচিত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ তত্কালীন ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজকে নিয়ে লিখিত অপূর্ব ব্যাঙ্গাত্মক আরেকটি নাট্য রচনা। এই সাহেব কবিই বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক নাটক রচনা করেছিলেন, যার নাম ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’। মাইকেলের আগে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্যের নাটকের বঙ্গানুবাদ মঞ্চে অভিনীত হতো। মাইকেল যে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন, তার পরিচয় আমরা পাই তারই ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে। সংলাপের একটি ভগ্নাংশ উদ্ধৃত হলো, ‘লোকে যাকে নরপতি বলে বিশেষ বিবেচনা করে, দেখলে সে নরদাস বৈ নয়।’ আমরা এই সত্যটিই আমাদের আজকের গণতন্ত্র চর্চায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। নির্দ্বিধায় বলা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই নব মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ও ভাষার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, ততদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পাঠকের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। মাইকেল বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মানসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় পারঙ্গম ছিলেন। উনি দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নাটক ‘নীল দর্পণ’ নাটকের সফল ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তার ইংরেজি রচনার সংখ্যাও কম নয়। তার নাটকীয়, বর্ণচ্ছটাময় এবং যুগপত্ সুখময় ও দুঃখময় জীবন আমাদেরকে আজও বিহ্বল করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দান্তে, গ্যেটে, হোমার ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। মননের দিক থেকে শেক্সপিয়র ও মিলটনের দেশের উদ্দেশ্যে চির অভিযাত্রী এই সাহিত্য-স্রষ্টা দ্যুতিতে এদের দু’জনের চেয়ে কোনো অংশেই কম নন। সনাতন স্রোতের বিরুদ্ধে আজন্ম এই মহাকবি তার নৌকার বৈঠা চালিয়েছেন। কূপমণ্ডূকতা ও হীনমন্যতা তার অজানা ছিল। এমন বেপরোয়া কবি বাংলা ভাষায় বিরল। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যই তার স্বাধীন মনোভাবের প্রকাশবহ। সাহিত্যে বিদ্রোহ প্রকাশে তিনি ছিলেন কবি নজরুল ইসলামের পূর্বসূরি। হে মহাকবি, তোমাকে জন্ম-জয়ন্তীতে প্রণতি জানাই।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; —
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!”
‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় উনি লিখেছেন—
“সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।”
এই কবিতা খণ্ড দু’টো আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাক্কা সাহেব এবং দু’জন শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রীর (রেবেকা ও হেনরিয়েটা) স্বামী মাইকেলের হৃদয়টি প্রোথিত ছিল বাংলার মাটিতে এবং যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষ নদকে ঘিরে তার মন কাঁদতো। ঢাকাবাসী এই স্যুট-প্যান্ট পরিহিত এবং বো-টাইধারী মাইকেলের জন্য একবার এক সংবধর্না অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। মাইকেল বক্তৃতার শুরুতেই বলেছিলেন— আপনারা আমাকে সাহেব ভাবিলেও ভাবিতে পারেন, কিন্তু আমি যথার্থই বাঙাল বটে। প্রণিধানযোগ্য যে, উনি বাঙালি বলেননি, নিজেকে বাঙাল বলে গর্ববোধ করেছেন। অর্থাত্ উনি ছিলেন মনে-প্রাণে পূর্ববঙ্গের মানুষ, যার পরিচয় পাই তার অনন্য সৃষ্টি—‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে (নাটকটির শিরোনামের বানান নাট্যকার ওইভাবে করেছেন)। আমি আজও এমন একটি ব্যাঙ্গাত্মক অথচ অর্থপূর্ণ, পাশাপাশি হাস্যরসে পূর্ণ প্রহসন পাঠ করিনি। নাট্য প্রহসনটি যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। নাগরিক নাট্য সমপ্রদায় ১৯৭২ সালে এই প্রহসনটি বর্তমান লেখকের নির্দেশনার সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছিল। কলকাতার অভিনেতা উত্পল দত্ত এই নাটকে ‘ভক্ত প্রসাদ’ চরিত্রে কালজয়ী অভিনয় করেছিলেন। মাইকেল রচিত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ তত্কালীন ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজকে নিয়ে লিখিত অপূর্ব ব্যাঙ্গাত্মক আরেকটি নাট্য রচনা। এই সাহেব কবিই বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক নাটক রচনা করেছিলেন, যার নাম ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’। মাইকেলের আগে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্যের নাটকের বঙ্গানুবাদ মঞ্চে অভিনীত হতো। মাইকেল যে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন, তার পরিচয় আমরা পাই তারই ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে। সংলাপের একটি ভগ্নাংশ উদ্ধৃত হলো, ‘লোকে যাকে নরপতি বলে বিশেষ বিবেচনা করে, দেখলে সে নরদাস বৈ নয়।’ আমরা এই সত্যটিই আমাদের আজকের গণতন্ত্র চর্চায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। নির্দ্বিধায় বলা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই নব মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ও ভাষার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, ততদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পাঠকের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। মাইকেল বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মানসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় পারঙ্গম ছিলেন। উনি দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নাটক ‘নীল দর্পণ’ নাটকের সফল ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তার ইংরেজি রচনার সংখ্যাও কম নয়। তার নাটকীয়, বর্ণচ্ছটাময় এবং যুগপত্ সুখময় ও দুঃখময় জীবন আমাদেরকে আজও বিহ্বল করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দান্তে, গ্যেটে, হোমার ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। মননের দিক থেকে শেক্সপিয়র ও মিলটনের দেশের উদ্দেশ্যে চির অভিযাত্রী এই সাহিত্য-স্রষ্টা দ্যুতিতে এদের দু’জনের চেয়ে কোনো অংশেই কম নন। সনাতন স্রোতের বিরুদ্ধে আজন্ম এই মহাকবি তার নৌকার বৈঠা চালিয়েছেন। কূপমণ্ডূকতা ও হীনমন্যতা তার অজানা ছিল। এমন বেপরোয়া কবি বাংলা ভাষায় বিরল। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যই তার স্বাধীন মনোভাবের প্রকাশবহ। সাহিত্যে বিদ্রোহ প্রকাশে তিনি ছিলেন কবি নজরুল ইসলামের পূর্বসূরি। হে মহাকবি, তোমাকে জন্ম-জয়ন্তীতে প্রণতি জানাই।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments