চারদিক-তবুও আশায় বাঁধি ঘর by মানসুরা হোসাইন
মায়ের শাড়ি ধরে তাহমিদুলের চিৎকার, ‘কষ্ট কবে শেষ হইব!’ তাহমিদুলের মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। নিজেই টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ব্যথায় পুরো শরীর কুঁচকে গেল। তার মা নিশ্চুপ।
সাত বছরের জুলেখার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
সাত বছরের জুলেখার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
লিকলিকে শরীর। মাথায় চুল নেই। মায়াবী চোখ দুটি দিয়ে শুধু একবার তাকাল, আবার উল্টো দিকে পাশ ফিরল। সবার ওপর তার অনেক অভিমান।
দুই বছর দুই মাস বয়সের সৌরভের একটি চোখ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়ায় জায়গাটি গর্ত হয়ে আছে। আরেকটি চোখ বীভৎস রকম ফুলে আছে। চোখে কিছু না দেখলেও সৌরভের মুখে কথার খই ফুটছে। সে বাড়ি যাবে, তাই ভীষণ খুশি। তবে মা জানেন, এ বাড়ি যাওয়াই হয়তো শেষ যাওয়া।
তাহমিদুল, জুলেখা, সৌরভের বয়স বেশি নয়। পৃথিবীর প্রায় কিছুই দেখেনি। কিন্তু তারা জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যানসার নামের ভয়ানক দানবটি বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসকেরাও এদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। জীবনপ্রদীপ যেকোনো সময় নিভে যাবে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর জন্য ‘প্রশমন সেবা’ বা ‘পেলিয়েটিভ কেয়ার’-এর সেবা নিতেই অভিভাবকেরা এসেছেন ধানমন্ডির আশিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে।
তাহমিদুল আগের দিনও এসেছিল। কিন্তু বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে সে। তাহমিদুলের খালা মাশরু বলেন, ‘ওর মনের শান্তির জন্যই বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়ে সে আরও অস্থির হয়ে উঠলে আবার নিয়ে এসেছি। শেষ মুহূর্তে একটু শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
বাবা-মা বা অন্য অভিভাবকেরাও জানেন, তাহমিদুলরা বেশি দিন বাঁচবে না। তবে মন মানে না। বসে বসে সন্তানের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা যায় না। তাই এর মধ্যেও কেউ কেউ আশার আলো দেখতে চান। জানতে চান, ‘ও আর কত দিন বাঁচবে?’ আশিক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সালমা চৌধুরী বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। বলতে পারি না, আপনার সন্তান আর বাঁচবে না। কিন্তু তার পরও একসময় এ সত্য কথাটাই বলতে হয়।’
সালমা চৌধুরী জানেন, এই সত্য কথাটি শুনতে কেমন লাগে। ক্যানসারে কেড়ে নিয়েছে তাঁর তিন বছরের ছেলে আশিককে। চোখের সামনেই ক্যানসার ছেলেকে অজানা দেশে নিয়ে চলে যায় ১৯৯৩ সালে—এ বিষয়ের সঙ্গে সালমা চৌধুরীর প্রথম পরিচয়। নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি, তবে অন্য মায়েদের সন্তানকে বাঁচানোর ইচ্ছা নিয়ে ১৯৯৪ সালে গড়ে তোলেন আশিক ফাউন্ডেশন। প্রশমনসেবার কেন্দ্রটি এই ফাউন্ডেশনের একটি কার্যক্রম। এটি শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে।
সালমা চৌধুরী বলেন, দেশে এখনো শিশুদের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। অভিভাবকেরা ক্যানসারের বিষয়টি একেবারে শেষ মুহূর্তে জানতে পারছেন। অনেক টাকা খরচ করেও তখন আর লাভ হচ্ছে না। যদি অভিভাবকেরা সচেতন হতেন, চিকিৎসকেরা দ্রুত সমস্যাটি শনাক্ত করতে পারতেন, তাহলে আর এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তোলার কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা কম থাকায় শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িতে। এই শিশুদের মৃত্যুর নীল যন্ত্রণা কিছুটা যদি কমানো যায়, সে জন্যই এ কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে বলে জানালেন সালমা চৌধুরী।
প্রশমনসেবা কেন্দ্রটির দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখা বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট হাতের ছাপ। নতুন শিশু এলেই হাতের ছাপ ও ছবি তুলে রাখা হয় স্মৃতি হিসেবে। তবে ভয়ানকভাবে এ স্মৃতিচিহ্নগুলো সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রে নতুন সেবা নিতে আসা ৩৩০ জনের মধ্যে ২০৮ জনই না ফেরার দেশে চলে গেছে। বেঁচে আছে ১২২ জন। অর্পিতা ঘোষ মারা গেছে গত বছর। যাওয়ার আগে ছবি এঁকেছিল। সে ছবি এখনো টাঙানো আছে কেন্দ্রের দরজায়।
গত ২৯ জানুয়ারি কেন্দ্রেই মারা গেছে মোহাইমিন। এ নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে। কেন্দ্রের সমাজকল্যাণকর্মী ইসপা সাদেক বলেন, ‘চোখের সামনেই ১০ থেকে ১২টি শিশুকে মরে যেতে দেখেছি। ক্যানসারের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে জুলেখার বাবা কৃষক আলম নিজের ভিটেটুকুও বিক্রি করে দিয়েছেন। এক বছর আগে জুলেখার হাতের টিউমারটিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা ফলোআপে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে দাউদকান্দি থেকে আর আসা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে শরীরের অসুখটি আবার চাঙা হয়েছে।
এত হতাশার পর সাফল্যও আছে। আজিমপুর ফরিদউদ্দিন সিদ্দিক স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মামুনুর রহমান ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। পাঁচ বছর বয়সে সে প্রথম জানতে পেরেছিল ভয়ানক অসুখটির কথা। আশিক ফাউন্ডেশন এবং সমাজের বিবেকবান কিছু মানুষের সহায়তায় মামুনুর রহমান এখন পুরোপুরি সুস্থ। ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
সালমা চৌধুরী বলেন, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকেই। সরকার যত দিন না আসছে, তত দিন সমাজের বিবেকবান মানুষগুলো এগিয়ে না এলে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না।
ইংরেজি মাধ্যম মাস্টারমাইন্ডের শিক্ষার্থীরা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কেন্দ্রের শিশুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। তবে এ ধরনের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
আজ শুক্রবার বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দিনটির কথা মনে রেখেই গিয়েছিলাম ওদের কাছে। ওদের দেখে কষ্টে ভরে যায় মন, তবুও আশায় বাঁধি ঘর। হয়তো কোনো একদিন সচেতনতাই এই শিশুদের ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করবে। রক্ষা করবে বড়দেরও।
দুই বছর দুই মাস বয়সের সৌরভের একটি চোখ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়ায় জায়গাটি গর্ত হয়ে আছে। আরেকটি চোখ বীভৎস রকম ফুলে আছে। চোখে কিছু না দেখলেও সৌরভের মুখে কথার খই ফুটছে। সে বাড়ি যাবে, তাই ভীষণ খুশি। তবে মা জানেন, এ বাড়ি যাওয়াই হয়তো শেষ যাওয়া।
তাহমিদুল, জুলেখা, সৌরভের বয়স বেশি নয়। পৃথিবীর প্রায় কিছুই দেখেনি। কিন্তু তারা জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যানসার নামের ভয়ানক দানবটি বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসকেরাও এদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। জীবনপ্রদীপ যেকোনো সময় নিভে যাবে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর জন্য ‘প্রশমন সেবা’ বা ‘পেলিয়েটিভ কেয়ার’-এর সেবা নিতেই অভিভাবকেরা এসেছেন ধানমন্ডির আশিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে।
তাহমিদুল আগের দিনও এসেছিল। কিন্তু বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে সে। তাহমিদুলের খালা মাশরু বলেন, ‘ওর মনের শান্তির জন্যই বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়ে সে আরও অস্থির হয়ে উঠলে আবার নিয়ে এসেছি। শেষ মুহূর্তে একটু শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
বাবা-মা বা অন্য অভিভাবকেরাও জানেন, তাহমিদুলরা বেশি দিন বাঁচবে না। তবে মন মানে না। বসে বসে সন্তানের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা যায় না। তাই এর মধ্যেও কেউ কেউ আশার আলো দেখতে চান। জানতে চান, ‘ও আর কত দিন বাঁচবে?’ আশিক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সালমা চৌধুরী বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। বলতে পারি না, আপনার সন্তান আর বাঁচবে না। কিন্তু তার পরও একসময় এ সত্য কথাটাই বলতে হয়।’
সালমা চৌধুরী জানেন, এই সত্য কথাটি শুনতে কেমন লাগে। ক্যানসারে কেড়ে নিয়েছে তাঁর তিন বছরের ছেলে আশিককে। চোখের সামনেই ক্যানসার ছেলেকে অজানা দেশে নিয়ে চলে যায় ১৯৯৩ সালে—এ বিষয়ের সঙ্গে সালমা চৌধুরীর প্রথম পরিচয়। নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি, তবে অন্য মায়েদের সন্তানকে বাঁচানোর ইচ্ছা নিয়ে ১৯৯৪ সালে গড়ে তোলেন আশিক ফাউন্ডেশন। প্রশমনসেবার কেন্দ্রটি এই ফাউন্ডেশনের একটি কার্যক্রম। এটি শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে।
সালমা চৌধুরী বলেন, দেশে এখনো শিশুদের ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। অভিভাবকেরা ক্যানসারের বিষয়টি একেবারে শেষ মুহূর্তে জানতে পারছেন। অনেক টাকা খরচ করেও তখন আর লাভ হচ্ছে না। যদি অভিভাবকেরা সচেতন হতেন, চিকিৎসকেরা দ্রুত সমস্যাটি শনাক্ত করতে পারতেন, তাহলে আর এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তোলার কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা কম থাকায় শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িতে। এই শিশুদের মৃত্যুর নীল যন্ত্রণা কিছুটা যদি কমানো যায়, সে জন্যই এ কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে বলে জানালেন সালমা চৌধুরী।
প্রশমনসেবা কেন্দ্রটির দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখা বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট হাতের ছাপ। নতুন শিশু এলেই হাতের ছাপ ও ছবি তুলে রাখা হয় স্মৃতি হিসেবে। তবে ভয়ানকভাবে এ স্মৃতিচিহ্নগুলো সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রে নতুন সেবা নিতে আসা ৩৩০ জনের মধ্যে ২০৮ জনই না ফেরার দেশে চলে গেছে। বেঁচে আছে ১২২ জন। অর্পিতা ঘোষ মারা গেছে গত বছর। যাওয়ার আগে ছবি এঁকেছিল। সে ছবি এখনো টাঙানো আছে কেন্দ্রের দরজায়।
গত ২৯ জানুয়ারি কেন্দ্রেই মারা গেছে মোহাইমিন। এ নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে। কেন্দ্রের সমাজকল্যাণকর্মী ইসপা সাদেক বলেন, ‘চোখের সামনেই ১০ থেকে ১২টি শিশুকে মরে যেতে দেখেছি। ক্যানসারের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে জুলেখার বাবা কৃষক আলম নিজের ভিটেটুকুও বিক্রি করে দিয়েছেন। এক বছর আগে জুলেখার হাতের টিউমারটিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা ফলোআপে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে দাউদকান্দি থেকে আর আসা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে শরীরের অসুখটি আবার চাঙা হয়েছে।
এত হতাশার পর সাফল্যও আছে। আজিমপুর ফরিদউদ্দিন সিদ্দিক স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মামুনুর রহমান ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। পাঁচ বছর বয়সে সে প্রথম জানতে পেরেছিল ভয়ানক অসুখটির কথা। আশিক ফাউন্ডেশন এবং সমাজের বিবেকবান কিছু মানুষের সহায়তায় মামুনুর রহমান এখন পুরোপুরি সুস্থ। ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
সালমা চৌধুরী বলেন, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকেই। সরকার যত দিন না আসছে, তত দিন সমাজের বিবেকবান মানুষগুলো এগিয়ে না এলে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না।
ইংরেজি মাধ্যম মাস্টারমাইন্ডের শিক্ষার্থীরা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কেন্দ্রের শিশুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। তবে এ ধরনের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
আজ শুক্রবার বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দিনটির কথা মনে রেখেই গিয়েছিলাম ওদের কাছে। ওদের দেখে কষ্টে ভরে যায় মন, তবুও আশায় বাঁধি ঘর। হয়তো কোনো একদিন সচেতনতাই এই শিশুদের ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করবে। রক্ষা করবে বড়দেরও।
No comments