আলোয় ভূবন ভরাঃ বাউলে ও আকান শিশুদের নামকরণ by কাজী জহিরুল ইসলাম
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। রোদের তেজ মরে এসেছে। কিন্তু চারপাশ এত উজ্জ্বল, যেন আলোর বানে ভাসছে আবিদজান শহর। ঝকঝকে নীল আকাশ। সা সা করে বাতাস বইছে। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এরকম শন শন করে বাতাস বইতে দেখা যায়।
তখন ঝরাপাতারা উড়তে থাকে উতলা বাতাসে। আমি গাড়ির কাচ খুলে দিই। ফাল্গুনি হাওয়াটা পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই। আমাদের হলুদ দালানের আড়ালে ঢাকা পড়েছে নীল লেগুন। ফ্লাগস্ট্যান্ডের বৃত্তটা ঘুরে নিচে নামব, এক কৃষ্ণ সুন্দরী হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খুব কায়দা করে ওর বুকে ঝোলানো আইডিটা দেখে নিয়ে গাড়ি থামালাম। আমাদের ক্যাম্পাসে সিকিউরিটি কোম্পানিসহ অনেক ঠিকাদারের স্টাফ কাজ করে। ক্যাম্পাসে ঢোকার জন্য ওদেরও এক ধরনের আইডি আছে কিন্তু ওদের আমরা জাতিসংঘের গাড়িতে তুলতে পারি না। নিয়ম নেই। মেয়েটির গলায় ঝুলছে ইউএন আইডি, কাজেই ওকে তুলতে কোনো অসুবিধা নেই।
লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠেই আকিসি বলল, কুয়াসি তোমার সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। আমি বললাম, আমি কুয়াসি না, কাজী। বড়জোর তুমি আমাকে কুয়াজি বলতে পার। ও চুপসে গেল, ওর মুখ থেকে বিকেলের হাস্যোজ্জ্বল সূর্যের দ্যুতি মুছে গিয়ে একখণ্ড কালো মেঘ এসে ভর করে। ও কোনো কথা বলে না। গাড়ির ভেতরে এরকম গুমট পরিবেশ, আমারও অস্বস্তি লাগছে। আমি বলি ঠিক আছে, তুমি আমাকে কুয়াসি বলতে পার, এখন বল কোথায় যাবে? দ্যু-প্লাতু। রিণরিণে গলায় জানাল আকিসি। তার মানে ও আমার বাসার কাছেই কোথাও থাকে। তোমার সঙ্গে আমার মিলটা কি? এতক্ষণে যেন ও প্রাণ ফিরে পায়। কথা বলতে শুরু করে। তুমিও সোমবারে জন্মেছ, আমিও সোমবারে। তুমি কি অন্ধকারে ঢিল মারলে? তোমার ঢিল ঠিক জায়গায় লাগেনি। আমি শনিবারে জন্মেছি, সোমবারে না। আমার এ কথায় ও দ্বিতীয়বারের মতো মন খারাপ করে। তবে এবার আর চুপসে যায় না বরং তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাহলে তোমার নাম কুয়াসি হলো কেন, শনিবারে জন্মালে তো তোমার নাম হবে কফি। সোমবারে জন্মালেই তো ছেলেদের নাম হয় কুয়াসি আর মেয়েদের নাম হয় আকিসি।
আমি আসলে মেয়েটির কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত্ মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে আমার এক উগাণ্ডান সহকর্মী বলেছিলেন, পশ্চিম আফ্রিকার অনেক মানুষের নাম কফি, কারণ তারা সবাই শনিবারে জন্মেছে। শনিবারে জন্মালে নাম হয় কফি। বলাবাহুল্য যে, কথাটা কফি আনান প্রসঙ্গেই উঠেছিল। বিষয়টি আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। কি বারে জন্মালে কি নাম হয় এটা জানার জন্য আমি উঠেপড়ি লাগি। কিন্তু আকিসি এর বেশি কিছুই জানে না।
যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি, কিন্তু কেউই পুরোপুরি জানে না। পুরনো দিনের মানুষ দরকার। পুরনো দিনের মানুষের সন্ধ্যানে বেরিয়ে পড়ি। এরই মধ্যে জেনে যাই আফ্রিকার বাউলে এবং আকান সম্প্রদায়ের মধ্যেই কেবল জন্মবারের নামানুসারে নবজাতকের নাম রাখার প্রথা আছে। দু’শ’ কিলোমিটার গাড়ি হাঁকিয়ে উপস্থিত হই ডিম্বক্রু গ্রামে। এটা বাউলেদের গ্রাম। আইভরিকোস্টে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। পঞ্চাশ না পেরুতেই মরে যায়। এর মূল কারণ অসংযমী জীবন-যাপন, এবং অবধারিতভাবেই এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ। আইভরিকোস্টে এইচআইভি বহনকারীর সংখ্যা এখন ২৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
একজন কবিরাজ ধরনের মানুষ। পাখির পালক, ধনেস পাখির চক্ষু, পশুর চামড়া, ছাগলের শিং আরও কত বিচিত্র প্রাণীর শরীরের অংশবিশেষ এবং উদ্ভিদের শেকড়-বাকরে ঠাসা ছোট্ট পাথর-কাদায় গড়া ছনের ছাউনিটি। মানুষটির নাম ফোফানা ইয়াও। উদোম গায়ে একটি হাড়ের খাঁচা, চোখগুলো টকটকে লাল, মাথায় এবং চিবুকে কোঁকড়ানো সফেদ চুল-দাড়ি। কত হবে ফোফানার বয়স? যুবকের দলটি, যারা আমাকে নিয়ে গেছে ওর কাছে, হে হে হে হে করে হেসে ওঠে। ওদের কাছে ফোফানা এক আশ্চর্য মানব। তার বয়স কত, এই খবর রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, তিনি আছেন এবং তিনি ছিলেন, ভবিষ্যতেও তিনি থাকবেন—এরকম এক বিশ্বাস ওদের হাসিতে। ওরা বিশ্বাস করে ফোফানার সঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরের যোগাযোগ আছে। ঈশ্বরই তাকে বলে দেন, কোন রোগের চিকিত্সা কোন পশু-পাখির শিং-পালক-হাড় বা উদ্ভিদের শেকড়-বাকর দিয়ে করতে হবে।
ফোফানা আমার উদ্দেশ্য শুনে হাসেন। এত তুচ্ছ প্রয়োজনে কেউ এতদূর থেকে আসতে পারে, এটা ওর কাছে খুবই বিস্ময়কর লাগছে। আপনি কি বারে জন্মেছেন? ফোফানার ঝটপট জবাব, শুক্রবারে, এজন্য আমার নাম ইয়াও, যদি মেয়ে হতাম তাহলে আমার নাম হতো আয়া। সোমবারেরটা আমি জানি, অন্য পাঁচদিনের নামগুলো বলেন? ফোফানা বলতে শুরু করে। মঙ্গলবারের ছেলে কুয়াদি ও আর মেয়ে আদজুয়া। বুধবারের ছেলের নাম কোনাঁ আর মেয়ের নাম আমেনাঁ। বৃহস্পতিবারের ছেলে কুয়াকু আর মেয়ে আউ। ফোফানাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, এবার থামেন, আমি লিখে নিই। আমার লেখা শেষ হলে ও আবার বলতে শুরু করে, শনিবারের ছেলের নাম তো আপনি জানেনই বললেন, আপনাদের বস ছিল কফি। শনিবারের মেয়ের নাম আফুয়ে। রোববারে জন্মায় বিখ্যাত লোকেরা, তারা জগেক নেতৃত্ব দেয়। রোববারের পুরুষ হলো কুয়ামে আর নারী আমোয়াঁ।
ফোফানার কাছে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হলেও আমার কাছে বাউলে এবং আকান সম্প্রদায়ের সন্তানদের নামকরণের এই প্রথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার সম্প্রদায়গুলো শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তত উন্নত নয় বলে এসব সুপ্রাচীন প্রথা ও লোকজ বিশ্বাসগুলো হয়তো সেভাবে লেখা হয়নি। ফোফানার মতো বৃদ্ধরা মরে গেলে এই তথ্যগুলো জানার জন্য আমার মতো উত্সাহী ভবঘুরেরা কার কাছে যাবে?
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠেই আকিসি বলল, কুয়াসি তোমার সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। আমি বললাম, আমি কুয়াসি না, কাজী। বড়জোর তুমি আমাকে কুয়াজি বলতে পার। ও চুপসে গেল, ওর মুখ থেকে বিকেলের হাস্যোজ্জ্বল সূর্যের দ্যুতি মুছে গিয়ে একখণ্ড কালো মেঘ এসে ভর করে। ও কোনো কথা বলে না। গাড়ির ভেতরে এরকম গুমট পরিবেশ, আমারও অস্বস্তি লাগছে। আমি বলি ঠিক আছে, তুমি আমাকে কুয়াসি বলতে পার, এখন বল কোথায় যাবে? দ্যু-প্লাতু। রিণরিণে গলায় জানাল আকিসি। তার মানে ও আমার বাসার কাছেই কোথাও থাকে। তোমার সঙ্গে আমার মিলটা কি? এতক্ষণে যেন ও প্রাণ ফিরে পায়। কথা বলতে শুরু করে। তুমিও সোমবারে জন্মেছ, আমিও সোমবারে। তুমি কি অন্ধকারে ঢিল মারলে? তোমার ঢিল ঠিক জায়গায় লাগেনি। আমি শনিবারে জন্মেছি, সোমবারে না। আমার এ কথায় ও দ্বিতীয়বারের মতো মন খারাপ করে। তবে এবার আর চুপসে যায় না বরং তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাহলে তোমার নাম কুয়াসি হলো কেন, শনিবারে জন্মালে তো তোমার নাম হবে কফি। সোমবারে জন্মালেই তো ছেলেদের নাম হয় কুয়াসি আর মেয়েদের নাম হয় আকিসি।
আমি আসলে মেয়েটির কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত্ মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে আমার এক উগাণ্ডান সহকর্মী বলেছিলেন, পশ্চিম আফ্রিকার অনেক মানুষের নাম কফি, কারণ তারা সবাই শনিবারে জন্মেছে। শনিবারে জন্মালে নাম হয় কফি। বলাবাহুল্য যে, কথাটা কফি আনান প্রসঙ্গেই উঠেছিল। বিষয়টি আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। কি বারে জন্মালে কি নাম হয় এটা জানার জন্য আমি উঠেপড়ি লাগি। কিন্তু আকিসি এর বেশি কিছুই জানে না।
যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি, কিন্তু কেউই পুরোপুরি জানে না। পুরনো দিনের মানুষ দরকার। পুরনো দিনের মানুষের সন্ধ্যানে বেরিয়ে পড়ি। এরই মধ্যে জেনে যাই আফ্রিকার বাউলে এবং আকান সম্প্রদায়ের মধ্যেই কেবল জন্মবারের নামানুসারে নবজাতকের নাম রাখার প্রথা আছে। দু’শ’ কিলোমিটার গাড়ি হাঁকিয়ে উপস্থিত হই ডিম্বক্রু গ্রামে। এটা বাউলেদের গ্রাম। আইভরিকোস্টে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। পঞ্চাশ না পেরুতেই মরে যায়। এর মূল কারণ অসংযমী জীবন-যাপন, এবং অবধারিতভাবেই এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ। আইভরিকোস্টে এইচআইভি বহনকারীর সংখ্যা এখন ২৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
একজন কবিরাজ ধরনের মানুষ। পাখির পালক, ধনেস পাখির চক্ষু, পশুর চামড়া, ছাগলের শিং আরও কত বিচিত্র প্রাণীর শরীরের অংশবিশেষ এবং উদ্ভিদের শেকড়-বাকরে ঠাসা ছোট্ট পাথর-কাদায় গড়া ছনের ছাউনিটি। মানুষটির নাম ফোফানা ইয়াও। উদোম গায়ে একটি হাড়ের খাঁচা, চোখগুলো টকটকে লাল, মাথায় এবং চিবুকে কোঁকড়ানো সফেদ চুল-দাড়ি। কত হবে ফোফানার বয়স? যুবকের দলটি, যারা আমাকে নিয়ে গেছে ওর কাছে, হে হে হে হে করে হেসে ওঠে। ওদের কাছে ফোফানা এক আশ্চর্য মানব। তার বয়স কত, এই খবর রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, তিনি আছেন এবং তিনি ছিলেন, ভবিষ্যতেও তিনি থাকবেন—এরকম এক বিশ্বাস ওদের হাসিতে। ওরা বিশ্বাস করে ফোফানার সঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরের যোগাযোগ আছে। ঈশ্বরই তাকে বলে দেন, কোন রোগের চিকিত্সা কোন পশু-পাখির শিং-পালক-হাড় বা উদ্ভিদের শেকড়-বাকর দিয়ে করতে হবে।
ফোফানা আমার উদ্দেশ্য শুনে হাসেন। এত তুচ্ছ প্রয়োজনে কেউ এতদূর থেকে আসতে পারে, এটা ওর কাছে খুবই বিস্ময়কর লাগছে। আপনি কি বারে জন্মেছেন? ফোফানার ঝটপট জবাব, শুক্রবারে, এজন্য আমার নাম ইয়াও, যদি মেয়ে হতাম তাহলে আমার নাম হতো আয়া। সোমবারেরটা আমি জানি, অন্য পাঁচদিনের নামগুলো বলেন? ফোফানা বলতে শুরু করে। মঙ্গলবারের ছেলে কুয়াদি ও আর মেয়ে আদজুয়া। বুধবারের ছেলের নাম কোনাঁ আর মেয়ের নাম আমেনাঁ। বৃহস্পতিবারের ছেলে কুয়াকু আর মেয়ে আউ। ফোফানাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, এবার থামেন, আমি লিখে নিই। আমার লেখা শেষ হলে ও আবার বলতে শুরু করে, শনিবারের ছেলের নাম তো আপনি জানেনই বললেন, আপনাদের বস ছিল কফি। শনিবারের মেয়ের নাম আফুয়ে। রোববারে জন্মায় বিখ্যাত লোকেরা, তারা জগেক নেতৃত্ব দেয়। রোববারের পুরুষ হলো কুয়ামে আর নারী আমোয়াঁ।
ফোফানার কাছে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হলেও আমার কাছে বাউলে এবং আকান সম্প্রদায়ের সন্তানদের নামকরণের এই প্রথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার সম্প্রদায়গুলো শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তত উন্নত নয় বলে এসব সুপ্রাচীন প্রথা ও লোকজ বিশ্বাসগুলো হয়তো সেভাবে লেখা হয়নি। ফোফানার মতো বৃদ্ধরা মরে গেলে এই তথ্যগুলো জানার জন্য আমার মতো উত্সাহী ভবঘুরেরা কার কাছে যাবে?
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments