বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-সংঘাতের বিষবৃক্ষে পানি ঢালা কেন? by ইমতিয়াজ আহমেদ

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ছাড়াও দল-নিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটির সদস্যরা কোনো কিছু না পেয়েই ভারতের কাছে বাংলাদেশের 'নতিস্বীকারের' অভিযোগ করছে। তারা বিশেষভাবে 'ট্রানজিট' সুবিধার কথা বলছে, যেখানে ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য যাচ্ছে


বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নত হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। জানুয়ারি, ২০১০-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ৫০ দফা ঐতিহাসিক যৌথ ইশতেহার প্রকাশ থেকে ইতিবাচক লক্ষণও মেলে। কিন্তু এতে প্রথম হোঁচট আসে সেপ্টেম্বর, ২০১১-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। তখন তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে চুক্তি হবে, এটা একরূপ নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি। কিন্তু তারপরও কেউ মনে করে না যে দুই দেশের সম্পর্ক ২০০৯ সালের অনিশ্চয়তার সময়ে ফিরে যাবে।
কিন্তু আমরা কি বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের গুণগত উত্তরণের বিষয়ে কথা বলতে পারি? আমি আমার আলোচনা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান পানির ইস্যু বিশেষ করে তিস্তা, টিপাইমুখ ও ভারতের আন্তঃনদী সংযোগের বিষয়ে সীমিত রাখব।
কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যুক্তিসঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে আপত্তি করেছেন। তিনি দিলি্লর কাছে সিকিম (তিস্তার উৎপত্তি) থেকে তার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ কতটা পানি পাবে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা চেয়েছেন। এটা তার ক্ষেত্রে ন্যায্য দাবি হতে পারে। কিন্তু তার সমালোচকরা মনে করেন, কেন্দ্র থেকে রাজ্যের জন্য অধিকতর আর্থিক বরাদ্দের দাবি পূরণে তিনি তিস্তাকে ইস্যু করেছেন। কিন্তু এ পথে চললে ভারতের ফেডারেল সরকারের কর্তৃত্ব খর্ব হয়, যা দিলি্ল ঘটতে দিতে রাজি নয়।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ছাড়াও দল-নিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটির সদস্যরা কোনো কিছু না পেয়েই ভারতের কাছে বাংলাদেশের 'নতিস্বীকারের' অভিযোগ করছে। তারা বিশেষভাবে 'ট্রানজিট' সুবিধার কথা বলছে, যেখানে ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য যাচ্ছে। ঢাকার সরকারি মহল দিলি্লকে প্রকাশ্যে না হলেও ঘরোয়াভাবে অভিযুক্ত করে বলছে যে, এসব ইস্যু শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে, দলেরও ক্ষতি হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এখনকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করতে পারে বলেই ধারণা করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে দিলি্লতে আয়োজিত সার্ক কাউন্টার টেরোরিজম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের এক সভায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশও অনুপস্থিত থাকে।
মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্য নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি সম্পাদন এবং ছিটমহল হস্তান্তরে তার অনীহা প্রদর্শন কি পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ থেকে উদ্ভূত? এ ব্যবসায়ী মহল বাংলাদেশ-ভারত নতুন সম্পর্কের বিষয়ে কম উৎসাহী। 'প্যান বাঙালি' ধারণার তারা বিরোধী। কারণ, এতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে ব্যবসায়িক সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে পারে। এভাবে তাদের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন প্রতিযোগী, যেখানে তারা বহু বছর যাবৎ একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করছে।
তিস্তাই একমাত্র ইস্যু নয়। ফেনী, মনু, মুহুরি, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার প্রভৃতি নদ-নদীর পানি বণ্টনের আলোচনাও স্থবির হয়ে পড়েছে। ভারতের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে এসব বিষয়ে নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। দিলি্ল যদি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে অগ্রগতি হয়েছে সেটা ধরে রাখতে চায়, তাহলে এসব ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
শুধু পানি বণ্টন নয়, বাঁধের ইস্যুও দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলছে। বিশেষভাবে আলোচনায় রয়েছে টিপাইমুখ বাঁধ। আসামের কাছাড় উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের ধারণা থেকে এ বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে জোর পড়ে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প স্থাপনে। তবে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার ৩০ শতাংশেরও কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত রয়েছে। এ এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে, বাঁধ নির্মাণ হলে তাদের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং এ কারণে তাদের বিরোধিতা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক স্মারকলিপিতে জানানো হয়েছে, টিপাইমুখ বাঁধ চালু হলে ৭৮ লাখ গাছ এবং প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর বনাঞ্চল তলিয়ে যাবে।
বাংলাদেশেও বিরোধিতা প্রবল। পরিবেশ বিপর্যয়, পানিপ্রবাহ হ্রাস, ভূগাঠনিক পরিবর্তনের কারণে অজানা বিপদের শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কার বিষয়েও সতকর্তা রয়েছে। শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ে প্রকাশিত ইশতেহারেও রয়েছে এর প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ সরকার জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। তিন দশকের বেশি সময় ধরে যেসব বিরোধীয় ইস্যু সম্পর্ক উন্নয়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, এখন তা নিয়ে এসেছে নতুন ঝুঁকি।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা :এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের গত ২৭ ফেব্রুয়ারির রায়কে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলতে হবে। নদ-নদীর আন্তঃসংযোগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে প্রদত্ত এ রায়ের ইস্যুটি তিস্তা ও টিপাইমুখ ইস্যুর মতোই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশের ৫৭টি নদ-নদী রয়েছে, যা একাধিক দেশে বিস্তৃত। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৫৪টি এবং বাকি তিনটি মিয়ানমারের সঙ্গে। ৫৪টি নদীর যে কোনো একটির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘি্নত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ এমনকি রাজনীতির ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। নদীবহুল ও ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পানি নিয়ে স্পর্শকাতরতা স্বাভাবিক। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আদেশে আমরা উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারি না। কারণ আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনায় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের 'বাড়তি' পানি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি রয়েছে। এ বাড়তি পানি ভুটান ও নেপাল 'মজুদ' করে কেন ভারতে প্রত্যাহার করবে, সে প্রশ্ন স্বাভাবিক। এভাবে পানি মজুদ করলে বাংলাদেশেও তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা হিমালয়ান নদী ব্যবস্থার অংশ। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদের বিবেচনায় এসব 'নদী দেশেরই'। পেনিনসুলার নদীগুলোর জন্য এটা প্রযোজ্য হলেও নিশ্চিতভাবেই হিমালয়ান নদীর ক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। আদালত স্বীকার করেছে যে, এ প্রকল্পের বিষয়ে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের উদ্বেগ রয়েছে। তারপরও বলা হচ্ছে, এ প্রকল্প 'জাতীয় স্বার্থের'। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত ও উদ্বেগ আদৌ গুরুত্ব পায়নি, দেশের বাইরের অভিমত তো বিবেচনার প্রশ্নই আসে না।
বাঁধ নির্মিত হলে ভারতে অনেক লোক বাস্তুচ্যুত হবে। তবে বাংলাদেশের উদ্বেগ তার নিজের লোকদের নিয়ে। হিমালয়ান নদ-নদীর পানি মজুদ এবং প্রত্যাহারের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা প্রবল। এর প্রভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন করে বিরোধের ইস্যু তৈরি হবে। এমনকি এভাবে যারা ভূমিহারা হবে তাদের একটি অংশ সীমান্তের অপর অংশেও উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় চাইতে পারে! বাংলাদেশ ছাড়াও নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রভাব পড়বে পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের। ভারত কি এটা বিবেচনায় নেবে?
সবশেষে বলব অধিকারের কথা। ভারতের আদালত নদ-নদীর ওপর অধিকারের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। প্রায় ১৫ বছর আগে আশীষ নন্দী, অজয় দীক্ষিত ও আমি যৌথভাবে বলেছি এবং এখনও বলছি :নদীর অধিকার রাষ্ট্র ও জনগণ কর্তৃক নিশ্চিত হতে হবে। সাগর ও মহাসাগরের ক্ষেত্রে এটা স্বীকৃত হয়েছে। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন কনভেনশন অনুযায়ী উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর 'সাধারণ দায়িত্ব' হচ্ছে সাগর ও মহাসাগরের সম্পদ সংরক্ষণ। এটা শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভোগের জন্যই নয়, মানবজাতির নিজের অস্তিত্বের জন্যও। একই ধরনের লক্ষ্য নিয়ে নদী সংক্রান্ত আইন প্রণীত হতে পারে।
নদীর নিজেরও অধিকার রয়েছে। তাকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য নিরাপদ হতে হবে। সেচ সুবিধা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীর ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে আধুনিক সভ্যতার ভিত রচিত হচ্ছে, অনেকের জীবনে পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পরিবর্তন করায় বিপর্যয়ও নেমে আসছে। নদীতে হস্তক্ষেপ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে এবং লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে। উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে ভাটির অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য জীবনদায়ী ব্যবস্থা আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশগত উদ্বাস্তু সৃষ্টির জন্য একে দায়ী করা যায়।
পেনিনসুলার নদ-নদীর বাইরে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বিস্তৃত হলে তা ভারত এ পর্যন্ত যেটুকু 'গুডউইল' অর্জন করেছে, তাকে নিশ্চিতভাবেই নস্যাৎ করে দেবে। ভারত কিংবা তার প্রতিবেশী কেউই সংঘাতের বিষবৃক্ষে পানি ঢেলে যেতে পারে না। আর এখানেই নিহিত রয়েছে আশা!

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.