ইলিয়াসকে আদালতে হাজির করতে রুল-তদন্তের অগ্রগতি ৪৮ ঘণ্টা পর পর জানানোর নির্দেশ

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীকে আদালতে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের আইজি, র‌্যাব মহাপরিচালকসহ ১০ জনকে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাবদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন। লুনার রিটের ওপর শুনানির আগেই হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এদিকে ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পর পর আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর সন্ধানে গতকাল দিনভর ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনা, আইনজীবী ও পুলিশের আদালতে দৌড়ঝাঁপের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক আদালতে এসব ঘটনা ঘটে।
লুনার রিট : ইলিয়াস আলীকে আদালতে হাজির করার বিষয়ে গতকাল সকালে হাইকোর্টে রিট (হেবিয়াস করপাস) করেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। লুনার পক্ষে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি দাখিল করেন। পরে রিট আবেদনটি বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চে উপস্থাপন করলে আদালত বিকেল ৩টায় শুনানির সময় নির্ধারণ করেন।
রিট আবেদনে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এসবি/বিশেষ শাখা), পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অপরাধ তদন্ত বিভাগ/সিআইডি), ঢাকা জেলা প্রশাসক, র‌্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার (ডিবি), বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।
ইলিয়াস আলীকে অবৈধভাবে আটক করা হয়নি- এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে তাঁকে আদালতে হাজির করার আদেশ কেন দেওয়া হবে না- সেজন্য রুল জারির আবেদন করা হয়। রিট আবেদনে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে বলা হয়, তিনি ও তাঁর পরিবার সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করেন যে, ১৮ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে (রাতের প্রথম প্রহরে) বাড়ি যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। আটকের ৩০ ঘণ্টা পরও তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি। তিনি কোথায় আছেন সরকার সেটাও প্রকাশ করছে না। রিট আবেদনকারী ও তাঁর পরিবার মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গোপন স্থানে রেখে তাঁকে নির্যাতন করছে।
বিকেল ৩টায় বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদের বেঞ্চে রিট আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হলে সরকারপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান আদালতে বলেন, ইতিমধ্যে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ এ বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ জারি করেছেন।
এ সময় আদালত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আমরা শুনানি মুলতবি রাখছি। আপনারা ওই আদালতে যান।' পরে রিটকারীর আইনজীবীরা বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে যান। সেখানে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সকালে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী একটি রিট আবেদন করেছেন। বিষয়টির ওপর শুনানির জন্য বিকেল ৩টায় সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষকে নোটিশ দিয়ে এই রিট আবেদনের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর রিট আবেদনের সংবাদ মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু আপনারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিয়েছেন। মওদুদ আহমদ বলেন, সংক্ষুব্ধ হয়ে কেউ রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো আদেশ দিতে পারেন না। তিনি আদেশটি প্রত্যাহারের আবেদন জানান।
এ সময় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেন, 'ঠিক আছে, আপনারা ওই কোর্টে যান। আমরা যে আদেশ দিয়েছি তা কার্যকর হবে না। অন্য কোর্টের আদেশ কী হয় তা আমাদের জানান।' এ অবস্থায় ব্যারিস্টার মওদুদসহ ইলিয়াস আলীর পক্ষের আইনজীবীরা আবারও বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদের বেঞ্চে আসেন। মওদুদ জানান, ওই কোর্ট ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর রিটের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তা ছাড়া আদেশ হলেও সেটি স্বাক্ষর হয়নি। তাঁরা আদেশটি স্থগিত করেছেন। এই কোর্টের সিদ্ধান্ত কী হয় তাঁরা তা জানাতে বলেছেন।
এরপর আদালত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে পাঠান। ওই কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেন এসে বলেন, আদালত আদেশ দিলেও তা স্থগিত করেছেন। এই আদালত কোনো আদেশ দিলে তা পরস্পরবিরোধী হবে না। এরপর বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদের নেতৃত্বাধীন আদালত আবেদনটি উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আবেদনটি উপস্থাপন করেন। আদালত শুনানি গ্রহণ করে রুল জারি করেন। পরে রুল জারির আদেশটি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চকে অবহিত করা হলে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ : ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে র‌্যাব ও পুলিশকে নির্দেশ দেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এছাড়া নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁকে উদ্ধারে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা আগামী ২৯ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক, র‌্যাব মহাপরিচালক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দিয়ে আদালত বলেন, সব ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে তাঁকে উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিম্ন আদালতের আদেশ : ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশে বলা হয়, 'ইলিয়াস আলী সাবেক সংসদ সদস্য এবং জাতীয় পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি ও তাঁর গাড়িচালক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা স্পর্শকাতর বিষয়। তাই তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করবেন এবং ৪৮ ঘণ্টা পর পর তদন্তের অগ্রগতি লিখিত আকারে অত্র আদালতে দাখিল করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।' বিচারক ওই আদেশের কপি পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রদানের নির্দেশ দেন।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বুধবার তাঁর স্ত্রী বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই জিডির তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী মাইনুল ইসলাম গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জিডির বিষয়ে তদন্তের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে আদালত উল্লিখিত আদেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.