ফরমালিন অর্থনীতি by আবু সাইয়ীদ

ক্রেতামাত্র মানুষের কাছে এখন যে শব্দটি সবচেয়ে পরিচিত, তা হলো ফরমালিন। ফরমালিন হলো এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা কোনো পচনশীল পদার্থকে দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব খাদ্যসামগ্রী দ্রুত পচনশীল, মাছ তার অন্যতম।


এ কারণে বিভিন্ন স্তরের মৎস্য ব্যবসায়ীরা উদ্বেগহীন বিপণনের স্বার্থে মাছে এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহার করে থাকেন। ফরমালিন ছাড়াও বিভিন্ন কীটনাশক, যা শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফলমূলকে কৃত্রিমভাবে পাকানো এবং রঙিন করার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিষাক্ত এসব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয সামগ্রীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। এসব ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কৃষিজাত পণ্যের ফলন বৃদ্ধি এবং ছত্রাক নাশক হিসেবে মাছ, শাকসবজি, ফলমূল বিপণন প্রক্রিয়ার দীর্ঘ আয়ুদানে সহায়তা করছে। একদিকে যেমন এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তথা ফরমালিন ক্রেতাদের কাছে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে আবার এই ফরমালিনই আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় (!) বিরাট চালিকাশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ফরমালিন অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা। ফরমালিন আছে বলেই তাদের মধ্যে কেউ কেউ তিন বেলা পেট পুরে খেতে পাচ্ছেন, কেউ কেউ মাঝে মধ্যে কোল্ড ড্রিংকস পান করতে পাচ্ছেন, কেউ কেউ দেশি-বিদেশি প্রসাধনী সামগ্রী মেখে রূপচর্চা করতে পারছেন, আবার কেউ কেউ অত্যাধুনিক ফিটিংসে সজ্জিত আবাসনে বসবাস করে দামি গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে মৎস্য শিকারি বা ব্যবসায়ীকে আগে মাছ শিকার করেই হন্যে হয়ে ক্রেতার পেছনে ছুটতে হতো, এখন আর তাকে তা করতে হয় না, রয়েসয়ে বাণিজ্য করার পথ এখন তার দখলে। একইভাবে ফল ও সবজি ব্যবসায়ীও আর দশটা সাধারণ পণ্যের মতো করে নিতে পেরেছে তার পণ্যকে; কোনো তাড়াহুড়া নেই, কারণ পচনকে জয় করতে পেরেছেন।
ছোট বা বড় ফল বাগানের মালিক, ছোট বা বড় কৃষক, সাধারণ জেলে বা মাছের পাইকারি বিক্রেতা থেকে শুরু করে বড় বড় আড়তদার, আমদানিকারক এবং খুচরা বিক্রেতাদের অর্থনৈতিক ভাগ্যের বিরাট পরিবর্তন এসেছে এসব কেমিক্যাল তথা ফরমালিন থেকে, নিশ্চিন্তে আয় করছেন যার যার অবস্থান থেকে। আর এক শ্রেণী তো সহজেই এক বা একাধিক ফ্ল্যাট বা গাড়িই কিনে ফেলতে পারছে এই ফরমালিন অর্থনীতির সুবাদে।
এখানেই শেষ নয়, এসব কেমিক্যাল তথা ফরমালিন আমাদের শরীরের বিভিন্ন রোগ-জীবাণু বৃদ্ধিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং অর্থনীতির চাকাকে আরেকবার ঘুরিয়ে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে হাজার হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর ক্রয়ক্ষম ক্রেতাগোষ্ঠী। একটি ছোট ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে যখন অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল অট্টালিকায় বনে যেতে দেখি অথবা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির টার্নওভার দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন এই ব্যবসার প্রসার নিয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। নগরের চাকচিক্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মঙ্গাপীড়িত বা দুর্যোগপূর্ণ এলাকার মানুষ আজ আর অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরে না। এমনটাই তো আমাদের প্রত্যাশা, অভাব-অনটন থাকবে না, ক্ষুধা মানুষকে কষ্ট দেবে না, শখ-আহ্লাদও কিছুটা মিটবে। তবে আশঙ্কার বিষয়, এই যে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া তা ঠিক পথে এগোচ্ছে কি-না। 'নিজে বাঁচলে বাপের নাম' শুধু এমন একটি জীবনদর্শনকে লালন করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে কি-না আর এসব কর্মকাণ্ড কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রেতা অন্বেষণের লক্ষ্যে, ক্রেতা সৃষ্টির প্রয়াসেই পরিচালিত হচ্ছে কি-না; বাংলাদেশে ফরমালিন রফতানি করে হাজারো পণ্য রফতানির পথ তৈরি করা হচ্ছে কি-না; এই যে ফরমালিননির্ভর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যা হয়তো দেশের সার্বিক অর্থনীতির একটা অংশজুড়ে রয়েছে, এর বাইরে যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফরমালিন অর্থনীতির মতো জাতির জন্য বিপজ্জনক কি-না; যারা অর্থনীতি বিশ্লেষণ করেন, যারা দেশের অর্থনীতি বিনির্মাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন তারাই বলতে পারবেন আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি আত্মঘাতী কি-না।
আবু সাইয়ীদ :চলচ্চিত্র নির্মাতা
aangic_c@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.